মায়ার বাঁধন পর্ব-০৮

0
382

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৮.
ফোন হাতে বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে নীরা। মনটা বিষন্ন। একটু আগেই মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার মা জানিয়েছে জামাইকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। তারপর সেখানে তিনদিন থাকতে হবে। এটাই নাকি নিয়ম। কিন্তু তুরান, সে কী শুনবে এসব? কখনোই শুনবে না। মুখের ওপর না বলে দেবে। যেখানে বিয়েটাকেই সমানে অগ্রাহ্য করে চলেছে সেখানে এসব আবদার তো ছেলেখেলা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল নীরা। মাকে কী জবাব দেবে সে? চিন্তায় তার মস্তিষ্ক অচল।

দুপুরের খাবার খেয়ে নীরা ঘরে চলে এলো বিশ্রাম নিতে। তুরান এখন অব্ধি ফেরেনি। জাহানারা চৌধুরী বলেছে তুরান নাকি ফোন করে বলে দিয়েছে সে বাহিরে খেয়ে নেবে। এমনিতেই ফিরতে লেট হবে। সে এমনটা আগেও করেছে। ভার্সিটি চলাকালীন সময়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যেত তাই ক্যান্টিনে খেয়ে নিত। এখনো মাঝেমধ্যে তেমনটা করে থাকে। নীরা এ বিষয়ে নতুন তাই জাহানারা চৌধুরী ইচ্ছে করেই আগ বাড়িয়ে বলে দিল সব। যাকে করে ওর দুশ্চিন্তা বা কোনো প্রকার সন্দেহ না হয়। নীরার মনটা এমনিতেও খারাপ ছিল। তার ওপরে খাবার টেবিলে রিনা তাকে বেশ কিছু কটুক্তি শুনিয়েছে শ্বাশুড়ির অগোচরে। কথা গুলো ছিল এমন, “এত দামি খাবার আগপ কখনো চোখে দেখনি তাই না? তাই জন্যই তো স্বামীকে রেখেই গিলে নিচ্ছ। এত ভালো ভালো খাবার সামনে ফেলে কী আর অপেক্ষায় থাকা যায়। ছোট লোক কোথাকার।”

নীরার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠে। তবুও সে রয় নিশ্চুপ, নিস্তেজ। শুধু মনে মনে বলে,

-“ব্যবহারে বংশের পরিচয়। ছোট লোক কে তা তো আপনার ব্যবহারেই প্রকাশ্য, বড় ভাবি। কিন্তু আফসোস কোনো এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে আমি আবার সৎ অস্তিত্বকে দমিয়ে রেখেছি নয়তো আমাকে অপমানের চরম মূল্য আপনাকে চুকাতে হতো।”

——🍂
এপাশ ওপাশ করেও বিন্দু মাত্র ঘুমের রেশ ধরা না দেওয়ায় ছাদের দিকে অগ্রসর হলো নীরা। এ বাড়িতে এসে এখনো ছাদ পরিদর্শন করা হয়নি। যেখানে বাবার বাড়ি থাকলে প্রতিটি বিকেলে ছাদটা নীরার হয় সেখানে এই তিনদিন যাবৎ সে এখনো ছাদের মুখ দেখল না। নিজের ক্ষুদ্র ছেলেমানুষীটাকে বাস্তবতায় রুপ দিতে সে গুটিগুটি পায়ে উঠে গেল ছাদে। লোহার গেইটের ছিটকিনি সুনিপুণ ভাবে খুলে ঢুকে গেল গন্তব্যে। আহা মুহূর্তেই তার অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে গেল। সকল দুশ্চিন্তা সরিয়ে ফেলে ডুব দিল প্রকৃতির নৈসর্গিক মায়ায়।

নীরার পুরোটা গোধূলি কাটল ছাদের আনাচে কানাচে। গ্রামের ছাদ আর শহুরে ছাদের মধ্যে সে খুজে পেয়েছে বিস্তর ফারাক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিষ্কার করেছে সবকিছু। যেখানে তাদের গ্রামের ছাদে উঠলে শুরুতেই চোখে পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সারি। তার মধ্যে বেশিরভাগ আছে নারিকেল, সুপারি ও তাল গাছ। আকারে বৃহৎ হওয়ায় এই গাছগুলো একেবারে দোতলা বাড়ির ছাদ পেড়িয়ে তিনতলা সমান বেড়ে উঠেছে। কিন্তু শহুরে ছাদের আশেপাশে যতদূর নজর পড়ে শুধু দালানকোঠা। বড় বড় সিমেন্ট, পাথরের বাড়িঘর। যার ভিড়ে আকাশটাও সুস্পষ্টভাবে উপভোগ করার উপায় নেই। আরও আছে, পাখপাখালিদের দিক বিবেচনা করলে গ্রামের তুলনায় শহরে এসব নেই বললেই চলে। এখানে বেশিরভাগ কাকের উপদ্রব। রঙ-বেরঙের বাহারি পাখিরা কই? তারপরে ওঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সেদিক দিয়েও গ্রামই এগিয়ে। ছাদের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে গ্রামের প্রাণখোলা স্নিগ্ধ পবন গায়ে মাখার আনন্দই আলাদা। যেখানে শহরে স্নিগ্ধ পবন বলতে যানবাহন, মিল কারখানা,ইত্যাদি থেকে নিসৃত কালো ধোঁয়া দ্বারা দূষিত গরম হাওয়া। এমন আরও অনেক অনেক তুলনামূলক দিক রয়েছে। যা নীরার চোখে সুস্পষ্ট। তবু কেন শহুরে লোকেরা গ্রামকে গ্রামের মানুষদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে? নীরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সময় যতই এগিয়ে চলুক না কেন আধুনিকতার নামে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের বাহ্যিক চাকচিক্য কিন্তু ভেতরটা? ভেতরটা এখনো সেই আদিম যুগেই পড়ে আছে।

—–🍂
গোধূলি পেড়িয়ে অপরাহ্নের শুরুতে নীরা ঘরের পথে পা বাড়ায়। পুনরায় ছাদের দরজা ঠিক আগের মতো লাগিয়ে দিয়ে চলে যায় ঘরে। সন্ধ্যা হয়েছে প্রায়। একটু পড়েই মাগরিবের আজান পড়বে। এই সময়টা থেকে বাহিরের প্রকৃতি ধীরে ধীরে আধারে হারাতে শুরু করে। পরপরই নেমে আসে আলো-আঁধারিময় নিশুতি। সন্ধ্যার আধার ছুয়েছে ঘরের কোণ। নীরা এসেই শুরুতে সুইচ হাতড়ে লাইট অন করে দেয়। সে ভেবেছে এখনো তুরান ফেরেনি। ফিরলে নিশ্চয়ই লাইট জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করে নিত? পরপরই ভুল প্রমাণিত হয় তার অনুমান। বিছানার ওপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে তুরান। কপালের ওপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করা। আরেকহাত বিছানায় ফেলানো। শার্টের ওপরের গুণে গুণে তিনটে বোতাম খোলা। বক্ষের কিছু অংশ উন্মুক্ত। শার্টটা ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সকালের পরিপাটি তুরান ফিরেছে কেমন বিধস্ত রুপে। নীরার শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। অজান্তেই খারাপ লাগে অন্তঃকোণে। কতেক প্রশ্ন এসে জড়ো হয়। উশখুশ করতে থাকে বারংবার। আচ্ছা, লোকটার কী শরীর খারাপ?খুব ক্লান্ত লাগছে? কিছু কী প্রয়োজন? ঠান্ডা কিছু? হুম হতেই পারে।

নিজের মনে ভেবে নিয়ে ছুট লাগায় নীরা নিচে। চটপট এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত করে নিয়ে হাজির হয়।

নীরার উপস্থিতি টের পেয়েছিল তুরান। তবুও ঘাপটি মে’রে পড়ে ছিল। কেন জানি সে চাইছিল নীরা নিজে থেকে কিছু বলুক। অবশেষে নীরার ঝটপট প্রস্থান দেখে হতাশ হলো সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শোয়া থেকে উঠে বসল। মুহুর্তেই নিজের চিন্তাধারায় ভীষণ অবাক সে। এমন চিন্তাধারা তার মস্তিষ্কে কীভাবে আসছে? সে তো চায় না নীরা তার কাছে আসুক। নাহ, মুখে না চাইলেও মন শুধু নীরাকেই চাইছে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে যখন আবদ্ধ হয়েছে তখন মায়ার বাঁধনে আটকা না পড়ে উপায় আছে? কিন্তু ওই যে শঙ্কা। সেটাকেই বা কীভাবে ভোলা যায়? এক সত্তা যখন নীরাকে কাছে টানতে চাইছি আরেক সত্তা তখন তীব্র বিরোধিতা জানাচ্ছে। দোটানায় ভাসছে তার জীবন। অনেকটা খেই হারা স্রোতের মতোন।

তুরানের ভাবনাকে উপেক্ষা করে নীরা শরবতের গ্লাস তার সম্মুখে তুলে ধরে। আচমকা চমকে ওঠে তুরান। শরবতের গ্লাস অনুসরণ করে ধীরে ধীরে তাকায় প্রেরণকারীনির দিকে। মনটা উৎফুল্ল হয় মুহুর্তেই। নীরা তার চিন্তাধারার উর্ধ্বে কিছু করে ফেলেছে। চাওয়ার থেকে বেশি কিছু পেয়ে গেলে মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে সম্ভিৎ হারিয়ে বসে। তুরানেরও হলো তাই। জ্ঞানশূন্য মস্তিষ্ক সে ক্লান্ত,উৎফুল্ল চোখে অপলক চেয়ে রইল তার সম্মুখে হালকা গোলাপি রঙা সালোয়ার কামিজ পরিহিত পিচ্চি মেয়েটার দিকে। যে কীনা তার বউ নামে পরিচিত। সালোয়ার কামিজে মেয়েটাকে একেবারে গুলুমুলু পিচ্চি লাগছে। পিচ্চি মায়াবিনী বউ তার। তুরান মনে মনে হাসল। ধ্যান ভাঙে নীরার গলা খাঁকারিতে।

-“এই যে মিস্টার, এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতো চেয়ে না থেকে শরবতটা নিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।”

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তুরান চমকে ওঠে। নিজের কাজে লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকায়। নীরার কথার প্রতিত্তোর না করে শরবতের গ্লাসটা হাতে নেয়। নীরার দিকে এক পল চেয়ে ঢকঢক করে শেষ করে ওটা। অতঃপর গ্লাসটা পুনরায় নীরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে উঠে কাবার্ডের কাছে যায়৷ প্রয়োজনীয় পোশাক নিয়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। আপাততঃ তার শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন।

তুরানের কান্ডে নীরা হতবাক। কোমরে হাত রেখে বিড়বিড় করল সে। বলল,

-” আজব! নূন্যতম জ্ঞানটুকু নেই লোকটার। একটি ধন্যবাদ অব্দি দিল না। কেসটা কী হলো আমার উস্কানিমূলক কথার পিঠে একটা রা শব্দটুকুও করল না? মতলব টা কী? কী ফন্দি আটছে কে জানে?”

নীরা গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল সেভাবেই দাড়িয়ে। পনের মিনিট বাদেই তুরান বেড়িয়ে এলো। নীরাকে এখনো ওভাবে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষণেই চটজলদি বলল,

-“ওভাবে সঙ-এর মতো না দাড়িয়ে থেকে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

নীরার হুঁশ ফিরে। কিন্তু তাতে দ্বিগুণ তব্দা খেয়ে যায় সে। তুরান নিজে থেকে তাকে খাবার আনতে বলছে? এটা কী সত্যি নাকি তার ভ্রম? নিজেই নিজের হাতে চিমটি কাটে সে। পরপরই ‘আহ’ শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে। তুরান বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পুনরায় বলে,

-“যাবে তুমি নাকি আমিই নিয়ে আসব?”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি।”

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি