মায়া মহল পর্ব-০৫

0
111

#মায়া_মহল ( ৫) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
বাতেন ও হানিফের মৃত্যু নিয়ে সেই একই ব্যক্তির সন্দেহ গাঢ় হলো। সে পুকুর ঘাটে একাকী বসে চিন্তা করতে থাকে,
ডাক্তার ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মিথ্যা হইতে পারে না কিছুতেই। সেইটা ঠিক। তবে দুজনের মৃত্যুর লক্ষনগুলো যেহেতু একই ছিলো। সুতরাং এই মৃত্যুর পিছনে ভিন্ন রহস্য আছে। কিন্তু কি সেই রহস্য?

সেই ব্যক্তি ভাবনার একূল অকূল খুঁজেও ঠিকঠাক হিসেবে মেলাতে পারছে না। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে কারো ডাকে। সে উঠে যায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে।

এই ভিতরে মায়া মহলের সবাইর সাথে চেনাজানা হয়ে গিয়েছে মায়ার। সখ্যতাও জমেছে বেশ। আঞ্জুমান আরাকে এখন সে বেগম সাহেবার বদলে আন্টি বলে সম্বোধন করে। মায়া স্বভাবে জেদী,স্পষ্টবাদী, ও সাহসী। দেখতে লাস্যময়ী। ছিমছাম গড়ন। লম্বাটে। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণের হলেও মায়াবী চেহারায় রূপে অপরূপা সে। নজর কাড়া শারীরিক সৌন্দর্য।

রাতদিন দূর্বার কৌতুহল খেলা করে তরুণী মায়ার হৃদয়ভূমিতে। তার মনে কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয় যখন তখন।

আঞ্জুমান আরা তার সাথে এত গল্প করে, কিন্তু শহরে থাকা স্বামীর গল্প করে না কখনো। কিন্তু কেন? তারা সবাই একত্রে খায় না কেন? তার স্বামীরা কয় ভাইবোন? এই মহলে অপরিচিত কেউ ভুল করে ঢুকে পড়লে তার মাথা কাটা পড়ে কেন? থানা পুলিশকে কেউ জানায় না কেন? তাকে গুপ্তচর বলল তারা। তাহলে নিশ্চয়ই এই মহলে কোন গুপ্তধন রয়েছে। কিন্তু কি সেই গুপ্তধন? কোথা থেকে আসলো? কিভাবে পেলো এরা এতকিছু? গুপ্তধন কি হিরে,মনি,মুক্তা,জহরত,সোনাদানা? নাকি অন্যকিছু? কি বিপুল পরিমাণ হলে সেসব পাহারাদার দিয়ে রক্ষা করতে হচ্ছে তাদের?
বাতেন ও হানিফ মারা গেলো একই সিম্পটমে। তাদের মৃত্যু কি সত্যিই স্বাভাবিক ছিলো?

ঠিক কার থেকে তার এতসব জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে, এটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। প্রথম দিনে আঞ্জুমান আরাকে সাধারণ একটি কথা জিজ্ঞেস করাতেই,মনক্ষুন্ন হলো। তাই তাকেতো জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না।

মায়াকে আলাদা রুম দেওয়া হলো কিছুদিন আগেই। একটা পড়ার টেবিল ও ছোট একটা ওয়ারড্রব দেওয়া হলো তার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য। বেশিরভাগ রাত্রিতে মায়া আঞ্জুমান আরার সঙ্গেই ঘুমায়। মায়া তৃতীয়বারের ন্যায় আরেকটি চিরকুট পেলো বালিশের নিচে। ভাগ্যিস এসাইমেন্টের জন্য আজ নিজের রুমেই ঘুমাবে সে। আর তাই বিছানা ঝাড়তে গিয়ে পেলো। নিতান্তই কয়েকটি সহজ সরল শব্দের একটি লাইন মাত্র। কিন্তু বাক্যটির গভীরতা ও তাৎপর্য ব্যাপক। মায়া কিছু অনুধাবন করতে পারলো।

” ডুবেছি তোর চোখের অনন্ত মায়ায়।”

এটাতো একটি গানের কথা। কে যে লিখে? শাহের ভাই? জুবায়ের ভাই? নাকি অন্যকেউ? উফফস! করেই, মায়া বহুরাত অবধি জেগে থাকে। কল্পনায় হারায় আবেশে। অচেনা,অজানা এক অস্তিত্বের সঙ্গে অনুভূতির নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে যায় সুখ স্বপ্নের সারথি হয়ে।

একদিন মায়া কলেজ থেকে আসার পর আঞ্জুমানকে বলল,

আন্টি আমি কুমকুম আপাকে নিয়ে আপনাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাই। গাছগাছালী, লতাপাতা,প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে আমার খুউব ভালোলাগে আন্টি।

আঞ্জুমান আরা থমকে গেলো। ক্ষণপরেই অনুমতি দিলো যাওয়ার।

আচ্ছা যাও মায়া।

পিছন হতে কুমকুমকে বোবা ইশারায় কিছু একটা বলল আঞ্জুমান। কুমকুমও ঘাড় হেলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো।

বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে সহ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো মায়া। বেশ সময় গড়ালো। বেলাও ফুরিয়ে এলো। পূবের আকাশটা কমলা রঙে রঙিন হয়ে উঠলো। জংলী ছাপার শাড়ির মতো তার মাঝে মাঝে উদ্ভাসিত হলো টুকরো টুকরো হলুদ,ধূসর,সাদা,নীল মেঘের ছড়াছড়ি।

সমস্ত দিনের লেনদেন চুকিয়ে এক ঝাঁক মুক্ত পাখি নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কুমকুমও মহলে ফিরে যাওয়ার তাড়া দিলো মায়াকে।

আপামনি চলেন। আমার কাজ আছে আঙিনায়।

মায়া বলল,
আপনি যান। সমস্যা নেই। আমি ওদিকটা একটু দেখেই চলে আসছি।

কুমকুম চলে গেলো। মায়াও একটু ঘুরে দেখেই চলে এলো মহলে। বিশাল মহলের পিছনে এসেই মায়া পা থামিয়ে নিলো। দেখলো ভারি সুন্দর একটি পায়রা। পায়রাটিকে সে ধরতে গিয়েই আবিষ্কার করলো মহলের একটি বন্ধ দরজা। যা সে এই প্রথম দেখলো। মায়া দরজাটির গায়ে হাত বুলিয়ে চলে গেলো মহলের অন্তপুরে। তার কৌতুহলের মাত্রা এবার আরেক ধাপ উঁচুতে উঠলো। তবুও মায়া তার গোপন কৌতুহলকে চাপা দিয়ে রাখলো গোপনেই।

সেই রাতে আহার শেষে আঞ্জুমান তাকে জিজ্ঞেস করলো,

কেমন দেখলে সব?

মায়া আহ্লাদী সুরে মুচকি হেসে বলল,

আন্টি মন ভরেনি একটুও। এত বড় বাড়ি। চারপাশজুড়ে এত সবুজের সমারোহ। একদিনে, একবার দেখলে হয়? বলেন? আরো কয়েকবার দেখলে মন ভরবে।

হাঃহাঃহাঃ শোনো মেয়ের কথা। বলে কি। আচ্ছা দেখো যত ইচ্ছে। কোন আপত্তি নেই।

প্রাণোচ্ছল হেসে বলল আঞ্জুমান।

ওহ শোন, তোমার ছোট বাবু তার সাথে তোমাকে দেখা করতে বলেছে।

এখন যাবো আন্টি?

নাহ। তাড়ার কিছু নেই। যেও তোমার সুযোগ সুবিধামতে। তবে যেও। ভুলে যেও না। তার জেদতো দেখলেই সেদিন।

অবশ্যই আন্টি, বলে মায়া তার রুমে চলে যায়।

তার একদিন পর এক ব্যস্ত দুপুরে আঞ্জুমানের সেবাদাসী কুমকুম সন্তপর্ণে জুবায়েরের রুমে এলো। ভীতচিত্তে বলল,

ভাইজান একটা কথা কইতে চাই।
কি কথা কুমকুম? বলে ফেলো ঝটপট?
পিসির কিবোর্ডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল জুবায়ের।

আমার সাথেতো হানিফ ভাইয়ের ভালোই খাতির ছিলো, উনি মারা যাওয়ার আগের দিন আমারে একটা কিছু কইছিলো।

জুবায়েরের হাত থেমে যায়। মুখ ঘুরিয়ে কুমকুমের পানে চায়। একটু সময় চুপ করে থাকে। পরে জিজ্ঞেস করে,

থামলে কেন? বলো হানিফ কি বলতে চেয়েছে বা কি বলেছে?

হানিফ ভাই আমার হাত ধরে কইলো,

কুমকুম আমার মনে হয় আমি মইরা যামু। আর এরজন্য আমিই দায়ী। কিন্তু বিষয়টা এমন,খুইলাও কইতে পারতেছি না তোরে। কইলে সবার আগে তুইই আমারে ভুল বুঝবি। আমারে মাফ কইরা দিস তুই।

তুমি এতদিন বললে না কেন কারো কাছে এই কথাগুলো? তারা দুজন মরে গিয়েছে একমাস হলো? যদিও তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতেছি না।

ভাইজানগো আমি ডরে কইনাই। আর কারে কমু? ছোটবাবুরে সবাই ডরায়। আমিও। খালাম্মাতো কিছু শুনার আগেই চিল্লায়া মাথায় উঠায় ফালায়। আর খালাম্মার ওই কেচ্ছার সঙ্গী মায়াপু? সেতো করে এখানে চাকরি। আইজ আছে কাইল নাই। খালুতো একটা আজরাইল। আপনের খালাতো বোন বেনু? উনাকে বললেও কি লাভ হইতো,উনি এই বাড়ির অতিথি।

তো এখন আমাকে বললি কেন?

এখন মনেরে বুঝাইতে পারতেছি না। আপনে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। যদি কোন রহস্য বাইর কইরতে পারেন। তাই। নইলে আমরা সবাই যদি আস্তে আস্তে মারা পড়ি ভাইজান? নাকি বাড়িতে জ্বিন,ভূতের কুনজর পড়লো? একজন একজন কইরা মাইরা পুরা বাড়িটারে দখল নিবো মনে হয় হেরা।

তুই যা। আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখি। আর শোন এই বিষয়টা ভুলেও যেন দ্বিতীয় কান না হয়। নয়তো তুই ফেঁসে যাবি।

জুবায়েরের কথা শুনে কুমকুম ঘাবড়ে উঠে। মাথা নেড়ে বলে,

কারো কাছেই কমু না ভাইজান।

কুমকুম চলে গেলে জুবায়ের তার আপন কাজে ফের মনোযোগী হয়ে উঠে।

সেদিন রাতে একটি বই হাতে নিয়ে জুবায়েরের রুমে যায় মায়া। চাপানো দরজা ফাঁক করেই সে দেখতে পেলো,

চলবে…