মায়া মহল পর্ব-০৬

0
107

#মায়া_মহল ( ৬) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
সেদিন রাতে একটি বই হাতে নিয়ে জুবায়েরের রুমে যায় মায়া। চাপানো দরজা ফাঁক করেই সে দেখতে পেলো,

বেনুর ও জুবায়েরের নিবিড় আলিঙ্গন। দুজনের দুই জোড়া ঠোঁট কবুতরের মতো একজোড়া হয়ে আছে। মায়া খুক করে গলা ঝেড়ে তার আগমনী জানিয়ে দিলো তাদের। তড়িতেই তারা দূরত্ব তৈরি করে নিলো। বেনু লজ্জা না পেয়ে মায়ার উপর বিরক্ত হলো অনেক। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় নিজের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অধিকারসুলভ কন্ঠে মায়াকে বলল,

মানুষ প্রশ্রয় পেলে মাথায় উঠে। ভুলে যেওনা তুমি এই পরিবারের একজন আশ্রিতা মাত্র। সো রাত বিরাতে কোন যুবক ছেলের কক্ষে প্রবেশ, তোমার জন্য অশোভনীয় ও দৃষ্টিকটু।

বেনুর এমন দম্ভনীয় আচরণে মায়া ভীষণ ব্যথিত হলো। রুমে না ঢুকে পা ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
পিছন হতে ডাক পড়লো তখনই।

মায়া ভিতরে আসো বলছি।

মায়া রুমের ভিতরে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো বিরস মুখে।

আমি বেনুর হয়ে সরি বলছি মায়া। ভুল বুঝনা। আসলে পারিবারিকভাবে ওর সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। তাই ওর ইচ্ছেই একটু আধটু ওসব আর কি। তবে ওকে আমার তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু বড়রা চাচ্ছে। মানা করারও সুযোগ নেই।

স্মিত হেসে বলল জুবায়ের।

মায়া বলল,নাহ ভাইয়া আমিও খুউব সরি। একচুয়েলি আমার এভাবে আসা উচিত হয়নি বোধ হয়। আর আপনাদের বিষয়টা আমি মাত্রই জানলাম। আমি একটা চ্যাপ্টার বুঝতে এসেছি।

জুবায়ের মায়াকে পড়া বুঝিয়ে দিলো। মায়া উঠে চলে গেলো। এবং ধরে নিলো জুবায়েরের চরিত্রে ত্রুটি আছে হয়তো। নয়তো পছন্দ না হলে চুমু খাওয়ার ফিলিংস হয় কিভাবে। অপরদিকে নিশ্চিত হলো তাকে জুবায়ের নয় শাহের চিরকুট দেয়।

মায়া তার পরেরদিন সন্ধ্যায় শাহেরের রুমে যায়। শাহের মায়ার মুখপানে তৃষ্ণার্ত নয়নে চাইলো। মনে মনে ছন্দ আওড়ালো,

“তুমি যেন বিলের জলে, সদ্য ফোটা এক পদ্ম।
হোক না তোমার মতিগতি অল্পস্বল্প ছদ্ম।
তুমি আমার অবসরের লুকানো দীর্ঘস্বাস।
ভালো রবো যদি পাই, তোমাকে পাওয়ার আশ।
তোমাকে চাই বলি কেমনে, আমি যে ছোটবাবু।
দিতে পারিনা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন,হচ্ছি রোজ কাবু।
জানি না কেন হারাই আমি, তোমার রূপের মায়ায়।
পেলে তোমায় যত্ন করবো, রাখবো বুকের ছায়ায়।”

আমায় ডেকেছেন ছোট বাবু?

শাহেরের সম্বিত ফিরে এলো। সে হুঁ করেই চঞ্চল উদ্বেলিত স্বরে বলল,

স্যুপ খেতে চাই। ভুলে গেলে মায়া?

আপনিতো বলেন নি আজকের আগে?

বাহ! আমি চাইলে খাওয়াবে। নয়তো নিজ থেকে খাওয়াবে না? তাই না?

মায়া বলল,
কাল সকালেই পাবেন।

ওকে। তুমি নিয়ে এসো। ও হ্যাঁ পড়াশোনার কি খবর? তোমার মায়ের সাথে কথা হচ্ছে তো?

জ্বি ছোটবাবু,পড়াশুনা আলহামদুলিল্লাহ ভালই চলছে। আম্মার সাথেও কথা হচ্ছে মাঝে মাঝে আন্টির মোবাইল দিয়ে।

তোমার মাকে একবার এসে বেড়িয়ে যেতে বলো আমাদের বাড়ি থেকে। উনার মেয়েটা কোন পরিবেশে আছে,কাদের সান্নিধ্যে আছে উনার দেখার সেই অধিকার রয়েছে।

বলব তাহলে এবার।

ওহ হো! তোমার তো হাতে মোবাইল নেই। তোমাকে একটা মোবাইল গিফট করবো আমি। তুমি এখন এই পরিবারের একজন সম্মানিত সদস্য। হাতে ফোন না থাকাও বেমানান।

লাগবে না ছোটবাবু বলে মায়া লাজুক মুখে বের হয়ে গেলো।

শাহের নিজের অজান্তেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। এলোমেলো ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলো বিছানায় উপুড় হয়েই।

পরেরদিন সকালে সবার নাস্তা শেষে মায়া চিকেন স্যুপ নিয়ে যায় শাহেরের রুমের সামনে। শাহেরের অনুমতি নিয়ে রুমে গেলো মায়া। টেবিলের উপরে স্যুপের বাটিটি সযতনে রাখলো।মিষ্টি কন্ঠে বলল,

ছোটবাবু নিন।

ধন্যবাদ মায়া। দাঁড়াও কমপ্লিমেন্ট নিয়ে যাও।
শাহের গরম গরম স্যুপ মুখে দিয়েই চোখের পাতা বুঁজে ফেলল।

জাস্ট ওয়াও মায়া! হেব্বি স্বাদ! আজ ক্লাস আছে তোমার?

জ্বি ভাইয়া। যাই আমি?

যাও এখন।

মায়া চলে গেলে শাহের বিড়বিড় করে ক্যাব্যের সুরে বলল,

” অজুহাতে আনতে চাই তোমায় কাছে
বাহানায় চলে যাও, বলো কাজ আছে।
সম্মুক্ষে রাখি তোমায় নানান কথার ছলে।
গোপনে পুড়ি আমি, বলতে কিছু পারিনা বলে।”

এদিকে মায়া শিকারির ন্যায় সুযোগ খুঁজছে মহলের পিছনের যাওয়ার। বাহানা রেডি করে একদুপুরে চলেও গেলো। বাঁশের বেড়া, কাঠ সরিয়ে ধুলাবালির আস্তরণে ও মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ দরজাটা ধরে দেখলো। এই দরজাটা কি কাজে আসে ঘরের সে বুঝে উঠছে না। তবে বহুমাস এই দরজা উম্মুক্ত হয়নি তা বোঝা গেলো। নাকি এদের গুপ্তধন এটার ভিতরেই। মহলের ভিতর থেকেতো এই দরজার হদীস পাওয়া গেল না। মায়া ঠিক করলো, এভাবে নিজে নিজে রহস্য উদঘাটন করতে গেলে এক জনমেও পারবে না। বরং তারা টের পেলে জানটাও যাবে। এরচেয়ে ঢের ভালো মহলের এমন কারো সাথে হাত করা। যার থেকে সে সঠিক কিছু জানতে পারবে।

আঞ্জুমান জুবায়েরকে ডেকে বলল,
খেয়াল করলাম মায়া মেয়েটার সামান্য কয়টা পোষাক। ওকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করে দে।

আম্মা আমি ব্যস্ত অন্যদিকে। শাহেরকে আদেশ করেন।

ওর মেজাজ যে চড়ায় থাকে, মায়ার বিষয়ে কিছু বলা যাবে? তুই বল?

তাহলে বেনুকে বলেন আপনি।

আচ্ছা বুঝলাম। তুই যা।

জুবায়ের চলে যায়। সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে কুমকুমের বলা বিষয়টা।মহলের সামান্য কর্মচারীর মৃত্যু নিয়ে ঘাটাঘাটি করার মানসিকতা তার নেই।এটা তার কাছে অনাবশ্যক মনে হয়।

পরেরদিন শাহের আঞ্জুমান আরার রুমে এসে বলল,

আম্মা, মায়াকে একটা মোবাইল কিনে দিলে কেমন হয়? কলেজে নিবে না। বাসায় থাকবে মোবাইল। এতে সে তার মা ও নিকটজনদের সাথে মন চাইলেই কথা বলতে পারবে।

আঞ্জুমান আরা পুত্রের কথায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। বললেন,

বাবা উত্তম চিন্তা তোমার। ওকে কিছু পোশাকও কিনে দাও। ঘুরেফিরে তিন চারটি পোশাক পরিধান করে মেয়েটি। নিজেই লজ্জিত হই। যেখানে আমাদের দাসীরাই বেহিসেবী পোশাক পরিধান করে।

ওহ নো! তাইনাকি আম্মা? তো আরো আগে বলেন নি কেন?

সেই অবকাশ আছে? জুবায়ের পারবে না। বাতেন হানিফ মরে গেলো। তোর যেই তিরিক্ষি মেজাজ। কিভাবে শুধাই?

তাও ভুল বলেন নি আম্মা। আচ্ছা কালই আমি ওকে নিয়ে মার্কেটে যাবো।

আঞ্জুমান অবাকের সপ্তাকাশে পৌঁছে গেলো শাহেরের কথা শুনে। মায়ার মতো মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শাহের মার্কেটে যাবে। এ যেনো তার কাছে অলৌকিক বিষয়।

সেদিন বিকেলে মহলের মূল ফটকে হৈ-হুল্লোড় শোনা গেল। সবাই ছুটে গেলো গেইটের কাছে মূল ব্যক্তিরা ছাড়া।

দেখা গেলো পাশাপাশি একটি বাড়ির মানুষজনের জটলা। তাদের মাঝথেকে কয়েকজন ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,

আমাদের মাহবুব ভাই আকস্মিক মারা গিয়েছে। দুদিন ধরেই জ্বর,গা ব্যথা,আর শরীর জ্বালাপোড়া ছিলো। শুনলাম আপনাদের বাড়িতে থাকা মায়া নামের মেয়েটির সঙ্গে মাহবুব ভাইর খুব খাতির ছিলো। মায়া যদি উনার মৃত্যুর বিষয়ে কোন কিছু বলতে পারতো?

সব শত্রুতামি ও কূটনৈতিক চাল মহলের বিরুদ্ধে। ভাগো সব। ভাগো বলছি। কি আবোল তাবোল বকছ। যার মরণ যখন সে এমনিতেই মরবে। একটা উছিলা নিয়েই সে মরবে।

এই বলে সিকিউরিটি গার্ড হারিস ও রুস্তম তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো।

তারা বলল,

দয়া করে মায়াকে একটু ডেকে দিন। সত্য মিথ্যা উনার মুখেই শুনি। তবেই আমাদের স্বস্তি মিলবে।

মায়াকে সবসময় মহলের যেই ব্যক্তিটি অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে আসছে। সেই ব্যক্তি এদের কথাগুলো পাশে দাঁড়িয়ে শুনে নিলো। সে মহলের অন্দরে গিয়ে আড়াল হতে মায়ার দিকে জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রইলো। অপেক্ষা করবে সে আরো কিছুদিন।

চলবে…