মায়া মহল পর্ব-০৮

0
99

#মায়া_মহল (৮)#রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
কায়রুস কি জানে হানিফ ও বাতেনের মৃত্যু সংবাদ? জানে কি মায়া মহলে মায়া নামের একটি কন্যার আগমনী বার্তা?
পরেরদিন সকালে নাস্তা সেরেই মার্কেটে মায়াকে নিয়ে গেলো শাহের। ড্রাইভার বাদ দিয়ে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করলো। মায়াকে পাশের সিটে বসিয়ে নিলো। মায়ার পছন্দে মোবাইল,বেশকিছু ড্রেস,হ্যান্ড ব্যাগ,স্যান্ডেল, কসমেটিকস,ঘড়ি,অর্নামেন্টস কিনে দিলো।

মায়া খুশীতে আত্মহারা। জীবনে এই প্রথম একসঙ্গে এত বিপুল উপহার পেলো সে। বাসায় ঢুকেই আঞ্জুমান আরার রুমে গেলো। প্যাকেট থেকে সবকিছু বের করে আঞ্জুমান আরাকে দেখালো। আঞ্জুমান আরা খুশি খুশি ভাব নিয়ে সব দেখলো নেড়েচেড়ে। তবে মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হলো ছেলের উপর। ধনীর পুত্র হয়ে মহলের সামান্য এক আশ্রিতা মেয়ের জন্য তার এত দায়িত্ববোধ,কর্তব্যবোধ,মানবিকতা,আন্তরিকতা যেন ভালো ঠেকছে না। একেবারেই বেমানান হয়ে যাচ্ছে। হাস্যকর ভীষণ!

বিকেলের অবসরে শাহের মায়ার মোবাইলে সিমকার্ড ভরে সব ওকে করে নিলো। নিজের কাছে অতিরিক্ত সিম ছিলো বলে কিনতে হয়নি। মায়াকে পাশে বসিয়ে মোবাইলের সব বুঝিয়ে দিলো। নিজের বিকাশ থেকে রিচার্জ করে দিলো। ওয়াইফাই কানেক্ট করিয়ে দিলো। ইমু,হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দিলো। তার নাম্বার সেভ করে দিলো।

তারপর বলল,
যাও এবার তোমার মাকে ফোন দাও। আর প্রয়োজন মনে করলে আমাকে এনিটাইম ফোন দিবে। অবশ্যই ভালো করে বলবে তোমার মাকে যেনো একবারেই চলে আসে।

মায়া চলে গেলে শাহের নিজের মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরলো। তার ঘাড়ের সমস্ত র*গ দাপাদাপি শুরু করলো। দেয়ালের পিঠে হাত মুঠি করে সজোরে ঘুষি মেরে বসল। ব্যথা পেয়ে উহু করে উঠলো। নিজে নিজে বলতে লাগলো,

উফফস! কি এক অসীম যন্ত্রণা হচ্ছে। ভাবছি আজ বলব। কিন্তু পারলাম কই। আমার আবেগ পরাভূত হচ্ছে মহলের জমিদারি আর উঁচু নিচুর দাম্ভিকতায়। আর কত তীব্র দহনে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবো।

কখনোই কি মায়াকে বলা হবে না,

“ভালোবাসি অনুভবের সমস্ত ঐশ্বর্য দিয়ে, তোমাকে চাই সব ছেড়েছুড়ে।
আমার হয়ে যাও ভেদাভেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে।
হৃদয়ের অশান্ত ঝড় থামিয়ে দাও তোমার পবিত্র আলিঙ্গনে।
মুখর করে তোলো আমার মন পাড়ের শান্ত পাখিটাকে।”

শাহের ধপাস করে উপুড় হয়ে বিছানার একপাশে পড়ে গেলো। বিবেকের কাছে ধরাশায়ী, ঘায়েল সে।

“পৃথিবীতে কাউকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে না পারার যন্ত্রনার চেয়ে বড় কষ্ট আর কিছুতেই নেই।”

একটু একটু করে শাহেরের গোটা পৃথিবী দখল করে নিলো সাধারণ একটি মেয়ে। যাকে নিজের অজান্তেই
সে উম্মাদের মতো ভালোবেসে ফেললো। যার অবাধ আধিপত্য তার সারা হৃদয়জুড়ে। কিন্তু সে তাকে তা বলতে পারছে না। নিজের ব্যক্তিত্বের কাছে নত হতে পারছে না কিছুতেই। কি করবে,কি করা উচিত তার। এমন মনস্তাত্ত্বিক সংকটে শাহের ভুগছে অহর্নিশ। দিবানিশি পুড়ছে মায়ার মায়াবী অনলে।

মায়ার সারামুখে হাসির উজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে পড়লো এই ভেবে,
মাকে ফোন দিতে আর আন্টির ফোনের ভরসা করা লাগবে না। সে মহলের বাইরে গিয়ে একটি প্রকাণ্ড গাছের আড়ালে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মা তফুরাকে ফোন দিলো। আলুথালু হয়ে নাকি নাকি সুরে সব জানালো। তাকে আসার বিষয়টিও বলল শাহেরের কথা বলে।
এবং প্রসংগক্রমে বলল,

জানো আম্মা,আমি যেই বাড়িতে থাকি,তোমাকেতো আগেই বলছি তারা একলাই থাকে এই বাড়িতে।বাড়িটির নাম মায়া মহল। বিশাল ধনী তারা। তুমি আসলেই নিজ চোখে দেখবে,তোমার মেয়ের কি আরামদায়ক জীবনযাপন।

তুই না বললেও আমি আইতামরে মা। তোর মুখে এত প্রসংশা শুনি তাদের। এখন নিজ থেকেই তাদেরকে দেখার ইচ্ছা জাগছে মনে।

মায়ার মুখে নিজের আসার কথা শুনে একবাক্যেই রাজী হয়ে গেলো তফুরা। তার আনন্দ যেন আর ধরে না।

মায়া আরো বলল তার মাকে,

আরেহ আম্মা জানো। তোমাকে বলছি না এদের বাড়িতে দুজন কর্মচারী মারা গেলো একই রকম অসুস্থতায়। সেইম কারণে এদের দুই বাড়ি পর আরেকটা ছেলেও মারা গেলো। কি অদ্ভুত নাহ? সে আবার আমার পিছনে ঘুরতো। এখন এই তিনজনের মৃত্যু নিয়ে আমার মাথায় একটা বিষয় চরকির মত ঘুরছে।

তোর মাথায়তো কতকিছুই ঘুরে। আগে বল তোর কোমরের তাবিজটা ঠিকঠাক আছেতো?

আছেতো আম্মা।

খবরদার! একদম খুলবিনা কইলাম।

মায়ের সাবধান বানী শুনে মায়া আরো সাবধানী হয়ে উঠে। জামার উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে তাবিজটি আছে কিনা চেক করে নেয়।

________

একদিন মায়া কলেজে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো বাড়ির গেইট দিয়ে দুজন ভিক্ষুক ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হারিস পালোয়ান কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছে না তাদের। মায়া এমন বিষয় আরো দুবার দেখেছিলো। কিছু মনে করেনি। কিন্তু আজ তার খারাপ লাগছে। সে থমকে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞেস করলো হারিসকে,

এদেরকে ভিতরে যেতে দিন। নইলে আপনি গিয়ে চাল এনে দিন।

হারিস অধিকারসুলভ কন্ঠে বলল,
বেগম সাহেবার মানা।

মায়া মনে মনে উপহাস করে বলল,

কাড়ি কাড়ি ধন সম্পদ এদের। অথচ গরিবদের, অনাহারিদের দেয় না কেন? এত কৃপণ বলেই মনে হয় কিছু জোটাতে পেরেছে।
মায়া ভিক্ষুকদের দাঁড় করিয়ে নিলো। নিজে ভিতরে গিয়ে কুমকুমকে বলে লুকিয়ে বেশকিছু চাল নিলো একটা পরিত্যক্ত কৌটায়। এনে দিয়ে ভিক্ষুক দুজনকে বিদায় করে দিলো।

তারা মায়াকে দোয়া করতে করতে দূর্বল পায়ে চলে যেতে লাগলো।

হঠাৎ মায়ার এহেন কাণ্ডে হারিস রেগে গেলো মায়ার উপরে। উদ্ধত আচরণ করলো মায়ার সাথে। দুদিনের আশ্রিতা বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও কার্পণ্য করল না।বেগম সাহেবাকে জানিয়ে তাকে বের করার ব্যবস্থা করবে বলেও হুমকি দিলো।

মায়া নিরব থেকে কলেজে চলে গেলো। ফিরে এসে দেখলো আঞ্জুমান আরা অন্যদিনের মতই স্বাভাবিক আচরণ করছে তারসাথে। মায়া স্বস্তির দম ছাড়লো হারিস তার বিরুদ্ধে নালিশ করেনি বলে৷

তার একদিন পরে হারিস অসুস্থ হলো। অল্প জ্বর, গা জ্বালাপোড়া, ব্যথা শুরু হলো তার। ডাক্তার ডাকা হলো দ্রুত। ঔষধ দিলো ডাক্তার সেরে যাবে বলে। শাহের, জুবায়ের সবাই হারিসের তদারকি করছে সারাক্ষণ। এমনকি বেগম সাহেবা আঞ্জুমানও। তবুও তিনদিন পরের রাতে নিজের বিছানায় ছটপট করতে করতে হারিস মারা গেলো।

মহলের সবাই নির্বাক হয়ে গেলো। মহলে হচ্ছেটা কি এসব। লোক পাঠিয়ে সেই ডাক্তারকে ডাকা হলো।

শাহের, জুবায়ের তাকে বলল,

আপনাকে এখনি পুলিশে দিবো। ভেজাল মেডিসিন দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলছেন। বাতেন ও হানিফকেও আপনিই মেডিসিন দিয়েছেন। মাহবুবকেও মনে হয় একই মেডিসিন দিয়েছেন?

ডাক্তার ভড়কে গেলো। তবুও আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল,

আমার মেডিসিনে ভেজাল আছে, প্রমাণ হলে আমি নিজে ফাঁসিতে ঝুলব। ওই খোদার নামে শপথ করে বলছি।
ওদের সবার মৃত্যু অন্য কারণে হচ্ছে। সেই রহস্য উদঘাটন করুন পারলে।

শাহের,জুবায়ের মেডিসিনগুলো পরিক্ষা করে আনলো ল্যাবে লোক পাঠিয়ে। জানা গেলো মেডিসিন নির্ভেজাল। মেয়াদউত্তীর্ণ নয়।

ডাক্তারকে সসম্মানে ছেড়ে দিলো শাহের। হারিসের পরিবারকে খবর দেওয়া হলো। তারা এসে হারিসের লাশ নিয়ে গেলো। হারিসের অধ্যায় শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে গেলো।

রুস্তম ও পরশ অসহায়ের মত বসে রইলো গেইটের পাশে বড় চৌকিটার মাঝে। তারা দুজন হারিসের সঙ্গে কাটানো ভালো সময়গুলো মনে করতে লাগলো দুঃখী দুঃখী কন্ঠে।

পরশ ভেজাচোখ দুটো ঢলে মুছে নিলো কাঁধের গামছাটি দিয়ে। তার আবেগাপ্লুত মন দেখে রুস্তম বলে উঠলো অনুযোগের সুরে,

মায়া নামের এই ছেমরিটাই একটা অলক্ষী! কূফা! ছলনাময়ী! এরা সবাইকেই মাইরা দেয়। কিন্তু ক্যামনেজানি এই ছেমরি বাইঁচা
গেলো। এই মহলে সে আসার পর হতেই বাতেন,হানিফ,হারিস মরে গেলো। মরলো ওই বাড়ির মাহবুব ও।

পরশ অবাক চোখে চেয়ে বলল,

এতে তার কি হাত?

আছে ভাই আছে। প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও পরোক্ষভাবে এই ছেমরির হাত আছে।

আরেকটা বিষয় খেয়াল করছেন পরশ ভাই?

কিহ?

এই ছেমরি আওনের পর মহলে আর কোন,চোর,গুপ্তচর, ডাকাত প্রবেশ করতেছে না।

হুম খেয়াল করলাম। তবে তুমি এত নিশ্চিত হইয়া ক্যামনে এসব বলতাছ রুস্তম?

নিস্তেজ কন্ঠে জানতে চাইলো মায়া মহলের সবচেয়ে পুরাতন ভৃত্য পরশ চাকলাদার।

চলবে…