মিথির গপ্পোসপ্পো পর্ব-০১

0
132

মিথির গপ্পোসপ্পো
গল্প: #আসমানী_পালক

|১|
“সমাজসিদ্ধ সম্বোধনে বাঁধা পড়লেও স্বীকৃতি দেবার মতো কোনো সম্পর্ক আদতে নেই আমার অপুর সাথে। আমার কাছে সে বন্ধুত্বের উর্ধ্বে, অন্যকিছু। তার কাছে বোধহয় আমি কেউ না; কখনো আবার বোধহয় বন্ধু। খুব কনফিউজিং আমাদের সম্পর্কটা। এজন্য লোকে নানাকিছু ডাকলেও একে কোনো নাম দিই না আমরা। মাঝেমধ্যে আমার অপুকে ভালোবাসার কথা বলতে ভাল লাগে। নিগূঢ় নিস্তব্ধ কোনো রাতে প্রেমহীন আলিঙ্গন আর বাঁধভাঙা আদরের উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে আমি ফিসফিস করে অপুর কানের কাছে বলি,
“তোকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি অপু৷ তুই বুঝতে পারিস?”
অপু ক্ষণিক থমকায়। ব্যথার ছাপ ফুটে ওঠে ওর চোখেমুখে। ক্ষণকাল নিষ্প্রভ থেকে সহসাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ভীষণ স্নেহে মাথার চুলে হাত বুলতে বুলতে বলে,
— বলেছি না ত্রয়ী ভালোবাসা সবার জন্য না। আমার জন্য তো একদমই না। ভালোবাসতে হয় ভালো ছেলেকে। আমি তো ভালো ছেলে নই। আমি ভীষণ মন্দ একটা ছেলে। মন্দ ছেলেদের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নাই।
— তাহলে আমি তোকে মন্দবাসি অপু। মন্দ ছেলের জন্য আমার হৃদয়ে উপচে পড়া মন্দবাসা৷ তুই স্বীকার করে নে তো।
অপু হাসে। চুল খামচে ধরে বলে,
— তুই একটা পাগল।
ওর মেকি হাসিটা আমি চিনতে পারি। কান্না পায় আমার। অনুযোগে বলতে ইচ্ছে হয়,
— আমাকে পাগল বানিয়েছিস তো তুই। তোর প্রেমে, তোর বিরহ-যাতনায় আমি ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। তবে কি আমার শুশ্রূষার দায়ভার তোর নয়! অন্তত বন্ধু, প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী।কোনো একটা সম্পর্কের অধিকারবলে তুই আমায় মেনে নে। আমি যে আর পারছি না অপু। আর পারছি না।

গোপনের কথা গোপনেই লুকিয়ে থাকে। মুখ ফুটে আর বলা হয় না। অভিমানী দৃষ্টি তবু হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করতে চায় কখনোসখনো। সে বোধহয় জানে না, যে মানুষ চোখের ভাব বোঝে না তার চোখে দৃষ্টি রাখা কতটা নিরর্থক। অপুকে আমি দোষ দিই না। যতখানি দোষত্রুটির ভাগিদার তা আমি একাই, বলতে দ্বিধা নেই। আমি তো জানতাম পথভ্রষ্ট ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়েও সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তবু যে কেন গিয়েছিলাম ওর পিছুপিছু, আঁকড়ে ধরেছিলাম ওর হাত শক্ত করে সমস্ত আঁধারকে ঠেলে সরিয়ে দিতে কে জানে!
অপু যে খুব চার্মিং বয় তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটায় ও আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে কুখ্যাত একটা ছেলে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। শিক্ষক মহলে অবাধ্য, ইররেগুল্যার আর খারাপছাত্র বলে বেশ দুর্নাম ছড়িয়েছিল ওর। ওর যে খুব যায়-আসত এসবে তা কিন্তু নয়। লোক্যাল ছেলে, মেয়র বাবা-র টাকাপয়সার গরম আর পলিটিক্যাল ভাই-ব্রাদারের ছত্রছায়ায় ও বেশ ছিল ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসটা ছিল ওর কাছে অকারণ এর-ওর সাথে ঝামেলা বাঁধানো আর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে টই টই করে ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। প্রায়ই ক্যাম্পাসের ঝোপঝাড়ে বাইকের ওপর গার্লফ্রেন্ডের সাথে অপ্রীতিকর অবস্থায় ওকে দেখতে পাওয়া যেত। লাজ-লজ্জা ওর মধ্যে তো কোনোদিনও লেশমাত্র ছিল না,বরং প্রতক্ষদর্শীরা ওদের দেখে লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে চলে যেতে বাধ্য হতো। একে অপরের জীবনে আমাদের এক্সিজটেন্স তখন ঐ অতটুকুনই ক্লাসমেট অথবা অপুর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওকে ঘৃণা করতে শুরু করা ব্যাচের প্রথম সারির স্টুডেন্ট ত্রয়ী হিসেবে। এর বাইরে কিচ্ছু নয়।
সত্যি বলতে আমি কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না অপুর প্রতি আমার বিরূপ ধারণা জন্মের কালে কখনো পাল্টাবে। ভাবতে পারতাম না ঘৃণার খোলস ভেঙে-গুঁড়িয়ে কখনো মরিয়া হয়ে ওকে ভালোবাসতে চাইব, ওকে আপন করতে চাইব আমি।
অদ্ভুত হলেও অপরিকল্পিত এই পরিবর্তনটা ঘটে গেল হুট করে সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে। ফাইনাল পরীক্ষায় বসার দিন পাঁচেক আগের ঘটনা,হেক্টিক ক্লাস-ল্যাব করে সবাই নাজেহাল; বইয়ের বাইরে অন্যকোথাও মন দেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। ঠিক এমনই ব্যস্ততম এক দিনে ল্যাব থেকে বের হয়ে কানাঘুষো শুনলাম অপুকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তার অপরাধ, আগেরদিন রাত্রিবেলা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে পালানোর সময় মেয়ের বাড়ির লোক হাতেনাতে ওকে ধরে ফেলেছে এবং পরিবারের ভয়ে মেয়েটা তৎক্ষনাৎ অস্বীকার করে সাহায্য করেছে বাবাকে অপুকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে। এবং ঘটনা এখানেই শেষ নয়। অপুর বাবা যেহেতু প্রভাবশালী গোছের লোক, তিনিও পাল্টা কেস করেছেন মেয়ের পরিবারের নামে। ভাসা ভাসা খবর ছুটে বেড়াতো দুই পরিবারে আগে থেকেই অনেক ঝামেলা, এই ঘটনার পর সে ঝামেলা বাড়ল বৈ কমল না।
প্রথমে শুনে আমার খুব বিরক্ত লাগল। অপুর মতো সৃষ্টিছাড়া বাজে ছেলের উচিৎ শিক্ষা হয়েছে ভেবে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দেও ফেটে পড়লাম। কিন্তু প্রথমদিন পরীক্ষার হলে আমার ঠিক পাশের সিটটা যখন ফাঁকা পড়ে রইল, প্রফেসরদের যখন নীচু কণ্ঠে আলোচনা করতে শুনলাম চেয়ারম্যান স্যার ওকে টিসি দিতে চাইছেন ক্যাম্পাস থেকে, ঠিক তখনই কেন যেন অজানা আংশকা আর অদ্ভুত বোবা কষ্টে আমার সমস্ত হৃদয় থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি চমকালাম, বিস্ফারিত হয়ে আবিষ্কার করলাম নিজের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটার জন্য অদ্ভুত অনুভূতির সাতকাহন। করুণা নাকি মায়া?
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। যাকে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে নিজের সমস্ত অন্তর দিয়ে কেবল ঘৃণাই করে এসেছি তার কষ্টে ব্যথিত হওয়া আমাকে মানায়! এ তো নিজের সাথেই নিজের নিষ্ঠুরতম অন্যায়। বাড়ি ফিরে সেদিন, এরপরের কয়েকটা দিন আমি ভীষণ ভীষণ যন্ত্রণায় কাটাতে লাগলাম শুধু এটা ভেবেই ঘৃণিত মুখটা, নিন্দিত ঐ ছেলেটার জন্য আমার সংগোপনে ব্যথার লহর কেন বইবে! সদুত্তর যদিও পেলাম না এক মুহুর্তের জন্যেও। তবে আমার অগোচরে ঐ আমার যাতনার দিন শুরু। এরপর সময়ের মতো সময় কাটল দ্রুত। নিজের প্রতি অসন্তোষ থেকে এরপর বিন্দুমাত্র খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম না বাজে ছেলেটার। আমাদের ফাইনাল শেষ হলো, ভাইভা হলো, রেজাল্টে উত্তীর্ণ হয়ে নতুন সেমিস্টারও চলে এলো। নিজেদের মতো করে সবাই এগিয়ে গেলাম আমরা শুধু পিছিয়ে পড়ার দলে পড়ে গেল অপু। এবং অজান্তে সারথি করে নিলো আমাকে। নিজের ওপর খুব শক্ত একটা কন্ট্রোল থাকায় অপুর শূন্যতায় আমার ভেঙে পড়াটা কাউকে বুঝতে দিলাম না। কেউ জানতে পারল না সেমিস্টারে পাশের সিট ফাঁকা দেখে, ক্লাসে ঢুকে একদম শেষের ডেস্কটা ফাঁকা দেখে পাড়ভাঙা নদীর মতো কি করে আমার সমস্ত হৃদয় লুটিয়ে বিলীন হয় সর্বনাশা স্রোতধারায়। একটা নিন্দিত মুখকে মনে করে রাতের পর রাত নোনাজলে আমার বালিশ ভেজে, প্রিয় ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে কলম আঁচড় কেটে একটাই নাম লেখে “অপু, অপু,অপু”

নিজের মনের সাথে যুদ্ধ, সে বড় জটিল জিনিস। মারণ ব্যধির মতো নিভৃতে মানুষকে শেষ করে দেয়, কেউ বুঝতেও পারে না। আমারও বোধহয় সে মারণব্যধিতে পেয়ে বসল ক’দিন পর। আমি হুট করে নিজের পাল্টে ফেলা প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম আয়নায়। যে প্রতিচ্ছবি চিৎকার করে জপ করছে একটাই বাক্য “অপুকে চাই, অপুকে চাই, অপুকে চাই”
কি অদ্ভুত ঘৃণার আড়ালে কখনো এতখানি ভালোবাসা লুকিয়ে থাকতে পারে কভু!
হ্যাঁ শার্সিতে নিজের প্রতিচ্ছবির চোখে চোখ মিলিয়ে অকস্মাতে আমি অনুভব করতে পারলাম আমি অপুকে ভালোবাসি। সেই প্রথম দিন থেকে। যখন ওরিয়েন্টেশনে কাছাকাছি রোল দেখে ও আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিল, চেনা জানা নেই আচমকা পাওয়ার গ্লাস টান মেরে চোখে চোখ মিলিয়ে বলেছিল,
“সেকি রে আকাশী কামিজ পরা আসমানী পালক, তোর চোখ তো পদ্মপুকুরের টলটলে জল। দেখলেই জীবনানন্দের মতো কবিতা লিখতে মন চাইবে। এত কাঠখোট্টা কেন রে তুই। সুন্দর চোখগুলোকে ঢেকে রাখিস বদমাশ গ্লাসে!”
আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সেদিন, ভয়ে আতংকে জমে আড়ষ্টভাবে ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েছিলাম। সরু সরু দেবে যাওয়া লাল চোখেই কি আমার মরণ হয়েছিল তবে! কে জানে।
অপুকে ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখে কষ্ট অনুভব করিনি কখনো সেভাবে। শুধু অন্য মেয়ের চোখে চোখ মিলিয়ে বাঁধভাঙা হাসিতে
ভেঙে পড়তে দেখলে কি একটা খোঁচার মতো বিঁধে যেত আমার বুকের ভেতর। অস্বস্তি দানা বেঁধে আমার সারাটাদিন নষ্ট করে দিত। আমি আরও বেশি ঘৃণা করতে চাইতাম অপুকে। পারতাম কই! বোধহয় ঘৃণার পরতে পরতেই মিশে থাকত অপরিমেয় ভালোবাসা।

অপুকে নিজের ভালোবাসার মানুষ কল্পনা করার পর আমি ভীষণ সাহসী হয়ে উঠলাম। চিরজীবন লোকে কি বলবে সেই ভয়ে ভীত আমার সমস্ত ভয় ঝুপ করে ঢাকা পড়ে মন বিদ্রোহ করে উঠল, অপুকে পাশে চাই;কাছে চাই। প্রিয়তমের মতো, একজন সঙ্গীর মতো। কিন্তু আমি চাইলেই কি অপু আমায় চাইবে! কে জানে কোথায় আছে ও। অবচেতন সারাটা সময় সতর্ক করে গেল “কপাল পুড়ল বলে তোর। জেনে-বুঝে পোড়াসনা নিজেকে” কিন্তু মন সে বারণ শুনবে কেন?
হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম আমি অপুকে। দৃষ্টিসীমায় আর নিজের জীবনে। পরিশ্রম তেমন করতে হলো না। পরিচিতি আর ক্ষমতার বদৌলতে ছাড়া পেয়েছিল ও দ্রুতই। কিন্তু লেখাপড়ার সাথে সম্পর্ক ভেঙেছে বলে ক্যাম্পাসে আসত না। বাউণ্ডুলের মতো নেশা পানি খেয়ে এধারওধার ঘুরে বেড়াত। ওর খোঁজে একদিন ওর এলাকায় যেতেই একটা চায়ের দোকানে দেখা মিলল একদিন। কোঁচকানো শার্ট, উসকোখুসকো চুল আর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। মন্দ ছেলের মন্দ বেশভূষা দেখে আমার হৃদয়ের ব্যথা বাড়ল বৈ কমল না। ঘোরগ্রস্তের মতো ছুটে গেলাম ওর কাছে। মুখোমুখি বসে ঠোঁটে কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বিড়বিড়িয়ে বললাম,
” আমাকে তুই গ্রহণ কর অপু। নইলে তোর বিরহে আমি মারা পড়ব দেখিস”
খুব স্বাভাবিক আমাকে এমন অদ্ভুতভাবে অপু কল্পনা করেনি। গোলগোল বিস্ফারিত চোখে নির্বাক তাকিয়ে রইল। বিব্রতভাবে আশেপাশে তাকিয়ে হাত টেনে ধরে আড়ালে নিয়ে গেল। ধমকের সুরে বলল,
— তুই কি পাগল হয়ে গেছিস ত্রয়ী। কি বলছিস ভেবে বলছিস!
ইতোমধ্যে চিন্তাশূন্য হয়ে পড়েছিলাম আমি। ওর ধমকে ঈষৎ কেঁপে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। জড়িয়ে ধরে বললাম,
— ভালোবাসি আমি তোকে। কেন বুঝিস না?
এখনও ওর প্রতিক্রিয়াটা বলতে গেলে কষ্ট হয়, আবার হাসিও পায় খানিক। ভুল সময়ের প্রেম নিবেদনের বিনিময়ে ও যেভাবে চপেটাঘাত করেছিল আমার গালে। সেই ব্যথা শরীর ছাপিয়ে হৃদয়তটে আছরে পড়েছিল প্রবলভাবে। আত্মসম্মানেও লেগেছিল প্রচুর। আমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কিসব বলছিল অপু শুনতে পাচ্ছিলাম না। শুধু মনে আছে হাত ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম ঐ জায়গাটা থেকে।
এরপর অনেকদিন যাইনি আর ওর সামনে, করিনি ওর খোঁজ। নাহ্ নিজেকেও যে সামলাতে পেরেছি তা নয়। আগুনপ্রেমী পতঙ্গ স্বেচ্ছায় যখন অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়েছে তখন তাকে সামলায় কে!
তবে আমি ওর পথ না মাড়ালেও কি ভেবে অপুই এগলো আমার দিকে। একদিন ব্রেক টাইমে ক্যাফেতে বসে একটা আর্টিকেল লিখছি, হঠাৎ ভূতের মতো প্রকট হলো আমার সামনে। স্বভাবসুলভ নিজের দু আঙুলে সিগারেট চেপে লম্বা টান দিয়ে বলল,
— আমি এখন একটা দাগী আসামি হয়ে গেছি জানিস?
উত্তরে কি বলতে হবে বুঝে উঠতে পারলাম না আমি৷ শুধু বিস্মিতভাবে দু’দিকে মাথা নাড়লাম। ও হাসল।
— নিজের আম্মার খুনের দায় আমার মাথায় এসে বর্তেছে। অবাক হচ্ছিস? তুই ছাড়া আর কেউ অবাক হয়নি জানিস। সবাই জেনেই বসে আছে আমার দ্বারা খুনও সম্ভব। সেদিন বলে এলি না ভালোবাসিস আমায়। ভালোবাসা কি ত্রয়ী? একটা বিধ্বংসী ঝড় ছাড়া।
বলে কিছুটা চুপ করে রইল অপু। আমি চোরা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই কৌতূহলি চোখে চেয়ে দেখছে আমাদের। ভাবছে খারাপ ছেলেটার সংস্পর্শের আরেকজন কলঙ্কিনীকে পাওয়া গেল বোধহয়। অস্থির লাগল আমার। চোখ বুঁজে সামলালাম নিজেকে। অপু তারস্বরে বলছে,
— মিরার হাত ধরে যেদিন পলায়ে যাইতে চাইলাম ঐদিন মিরার বাপে আমারে জেলে ভরল শুনেছিস তো? এরপর আমাদের বাসায় আইসা বাপ-মারে যা নয় তাই বইলা অপমান করল, তাদের শাঁসাল। আমার আব্বা তো জানিস কাউরে ভয় পায় না। তিনিও ভালই জবাব দিলেন। ইটের বদলে পাটকেল। কিন্তু আমার শয্যাশায়ী মা হজম করতে পারলেন না ছেলের জীবনে আসা প্রচন্ড টর্নেডোকে। মা চাইতেন কি না, আমি যেন বাবার মতো না হই। কিন্তু মায়ের আশা পূরণ হলো না ত্রয়ী। আম্মাকে কষ্ট দিলাম আমি। আর সেই কষ্ট সইতে না পেরে আম্মা..
কেউ আঙুল তুলে দোষারোপ করল না আমায় কিন্তু আমি জেনে গেলাম মায়ের এই পরিণতি শুধু আমার জন্য। শুধুই আমার জন্য।”
— তারপর?
কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইলাম আমি। সিলিংয়ের থেকে চোখ সরিয়ে অপু সরাসরি চাইল আমার দিকে। কঠোর গলায় বলল,
— জামিনে ছাড়া পেয়ে আমি খুন করতে গেলাম মিরার বাপরে।
— অপু!
— হ্যাঁ ঠিক শুনছিস তুই। যদিও টপকাতে পারিনি লোকটাকে। কৈ মাছের প্রাণ তো! তবে প্যারালাইজড হয়ে গেল পুরোপুরি। কখনো সুস্থ হবে কি না তার গ্যারান্টি নেই।
— তারপর ওর ফ্যামিলি এটেম্পট টু মার্ডার কেস করে দিল?
— সাব্বাশ এই না হলে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। হ্যাঁ শুধু সেই কেসেই নয়। এরপর আমার আব্বার অপোজিশনের সাথে হাত মিলায় ড্রাগস ট্রাগসসহ হাজারখানেক কেসে আমায় ফাঁসায় দিলো। কে জানে বিচার কোনদিন হবে। আমি আপাতত জামিনে জামিনে খোলা আকাশের নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
— এরপর, এরপর কি হবে অপু?
বোকার মতো জানতে চাইলাম আমি। বিনিময়ে পুনর্বার হাসল অপু। সংক্ষেপে বলল,
— জানি না।
সহসা আমিও কথা খুঁজে পেলাম না। টেবিলের এপাশ-ওপাশ দুজনের গাঢ় শ্বাস, ক্যাফের কলরব, বাসনের টুংটাং শব্দ অনেকক্ষণ আমার মস্তিষ্কজুড়ে হায়ারোগ্লিফিক্সের মতো দুর্বোধ্য লাগতে লাগল। ক্ষণিক পর অকস্মাৎ আমি শুধলাম,
— আমায় বিয়ে করবি অপু?
এতক্ষণে অপু থমকাল। সেদিনের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি ফিরে এলো ওর। অস্ফুটে বলল,
— সবকিছু জানার পরেও?
— হ্যাঁ সবকিছু জানার পরেও। আমি তোকে ভুলতে পারছি না কি করে বোঝাই। অবিচ্ছেদ্য একটা অংশের মতো হয়ে গেছিস তুই আমার জীবনে। আমি, আমি ঠিকমতো বাঁচতে পারছি না অপু তোকে ছাড়া। তুই আমাকে গ্রহণ কর নইলে মেরে ফেল। ইটস এ্য রিকোয়েস্ট।
দু-হাত জড়ো করে পরাজিতের মতো বললাম আমি। অপু উঠে দাঁড়াল। মাথা নেড়ে বলল,
— তা হয় না। তোর জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নাই ত্রয়ী। তুই..তুই একটা ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে। সামনে তোর ব্রাইট ফিউচার। আর আমাকে দেখ আমি তো সাক্ষাৎ আঁধার। জেনেবুঝে আমি তোকে নিজের সাথে জড়াতে পারি না। কিছুতেই না, কিছুতেই না।
উন্মাদের মতো আওড়াতে আওড়াতে পালিয়েই যেন গেল অপু। ফেলে গেল পুনরায় প্রত্যাখ্যাত পরাজিত প্রেমকে।”

চলবে,