হৃদয়ম পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
134

#হৃদয়ম পর্ব:-০৪/শেষ

শিশিরের মধ্যে যে বিশেষ কিছু আছে, এটা বাবার থেকে ঠিকানা নিলেই আবার জানতে পারবে সে।

সে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞাসা করলো,
—ওই ভাইস-প্রিন্সিপালের নাম কী? উনি কী মা*রা গেছেন? কোন স্কুলে চাকরি করতেন তিনি?

সারোয়ার হাবীব ছেলের প্রশ্নটা না শোনার ভান করে স্ত্রীকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যেতে বললেন। হৃদ স্পষ্ট টের পেল, তার বাবা তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন৷ হৃদ আবার জিজ্ঞাসা করলো,
—কাল শিশিরের ঠিকানা জানা হয়নি। ওর বাসাটা…

—তুমি না বিয়েটা ক্যান্সেল করেছো? এখন এত প্রশ্ন করে লাভ কী?

হৃদ বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। শিশির সম্পর্কে তার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে। তবে বাবার কাছে কী এই মুহুর্তে সেই আগ্রহটা প্রকাশ করা আর ঠিক হবে? বিড়ম্বনার যন্ত্রণাও এত বিরক্তিকর হয়! সে চুপচাপ বাবার সামনে থেকে উঠে চলে আসে। শিশিরের সাথে কথা বলা দরকার। একটা মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য তার বুকের ভেতর ছটফটানি শুরু হয়েছে। একটা মেয়ে সে, তাও আবার জেলখানার আসামী- তার জন্য বুকের ভেতর এতখানি উতলা হচ্ছে ওর! হৃদের নিজের কাছেই বেশ লজ্জা লাগছে। আটাশ বছর বয়সী একটা ছেলের এমন বিচ্ছিরি পরিস্থিতি মানায় না।
“আমি কী শিশিরের প্রেমে পড়ে গেলাম? কিন্তু কীভাবে? ওর প্রেমে পড়ার কোনো কারণই নেই। তবু কীসের যেন অনুভূতি বারবার বুকের ভেতরটায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে। শিশিরের কথা, ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শী চিন্তাভাবনা এগুলো কী তার মত একটা মানুষকে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট নয়? না, না, আমি একটু বেশিই ভাবছি। আমাকে টানছে ওর রহস্য। বাবা কেন এই কারণে ওর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছেন, সেটা আমার জানা দরকার। বাবার কাছে সরাসরি এ উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে শিশির নিশ্চয় সম্পূর্ণ সত্যটা জানে। আর তার কাছে জানতে চাইলে নিশ্চয় লুকোবে না। ”

একা একাই এসব ভেবে বিড়বিড় করছে হৃদ। ভালোবাসা নাকি রহস্য উন্মোচনের নেশা ধরেছে তার, তা সে জানে না। তবে যেটুকু উপলব্ধি করতে পারছে সেইটুকুর জন্য শিশিরের সাথে দেখা করাটাও ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ভীষণ রকম জরুরি। সে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই শিশিরের বাবার নাম্বারে কল দিলো। অদ্ভুতভাবে সেই কল রিসিভ করলো শিশির নিজেই।
হাসি হাসি কন্ঠে ওপাশ থেকে বললো,
—হৃদ সারোয়ার, আপনি ভালো আছেন?

হৃদ প্রচন্ড অবাক হলো। শিশিরকে সে আশা করেনি। সে ধারণা করেছিল শিশিরের বাবা কল রিসিভ করবেন এবং মুখ গোমড়া করে বলবেন, “আমার মেয়ে তোমার সাথে কথা বলবে না। আমি শুনেছি, তুমি ওকে বিয়ে করতে চাও না। তাহলে নাকোচ করার পর কেন কল দিচ্ছো?”

তার ভাবনার দ্বারে কুঠারাঘাত ঘটলো ওপাশে শিশিরের পুনঃকন্ঠস্বরে। শিশির হাসতে হাসতে বলছে,
—আপনি কী আমাকে কিছু বলতে চান? বলুন, আমি শুনছি।

—আপনার বাবার ফোন আপনি ব্যবহার করেন?

—না, তবে আমার মনে হচ্ছিলো আপনি হয়তো আমাকে কল করবেন। তাই নিজের কাছে রেখে দিলাম। আর সত্যি সত্যি আপনি আমার খোঁজ নিচ্ছেন।

—আমি দেখা করতে চাই। আপনার সময় হবে?

শিশির যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। সে মুহুর্ত সময়ও বিলম্ব না করে হৃদকে তাদের বাসাতেই আমন্ত্রণ জানায়।

৪.
ঠিক সন্ধ্যার পরপর হৃদ শিশিরদের বাসায় পৌঁছায়। পুরনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি, বাইরের দেওয়ালে রঙ চটে পড়ছে। পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এর বেশি বুঝতে পারা যায় না। হৃদ ভ্রু কুঁচকে গেইট পার হলো। ছোট এক টুকরো গেইট। জং ধরে গেছে। শুরুতে ভিতরে ঢুকতে অস্বস্তি লাগলেও বাসার ভিতরে ঢুকে হৃদ প্রচন্ড অবাক হলো। পুরনো হাল আমলের বাড়ি, দোতলা। ভারতীয় আর্ট সিনেমাগুলোতে যেমন পোড়োবাড়ির ডিজাইন দেখা যায়, ঠিক সেরকম। বাড়িটা বোধহয় বহু বছর আগে বানানো হয়েছে। দীর্ঘদিন রঙ করা হয় না। তাতে বাড়ির মাহাত্ম্য কিংবা ঐতিহ্য একবিন্দুও কমেনি। বোধহয় নতুন করে কাজ না করাতেই বেশি ভালো দেখাচ্ছে।

হৃদ ভিতরে ঢুকলে আট বছরের ছোট একটা বাচ্চা তাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—শিশির আপুর সাথে দেখা করতে আসছেন?

—হুম। তুমি কে বাবু?

—ইতু। শিশির আপু আমার চাচাতো বোন। বড় চাচার মেয়ে। চলুন,আপনাকে আপার রুমে নিয়ে যেতে বলছে। আপু দোতলার ঘরে থাকে। একলা একলা।

হৃদ ইতুর কথার জবাবে সামান্য মুচকি হাসার চেষ্টা করলো। তবে হাসতে পারলো না। শিশির একা একা থাকে। ব্যাপারটা তার কাছে খুব একটা সুন্দর লাগছে না। শিশিরের সমস্যাটা কী?

ভ্র কুঁচকে নানান কথা ভাবতে ভাবতে সে দোতলায় শিশিরের ঘরের সামনে পৌঁছালো। ঘরের দরজা খোলাই আছে, খুব সম্ভবত হৃদের অপেক্ষাতেই ছিল সে। ইতু তাকে দরজা দেখিয়ে দিয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।
—আপা ভেতরে আছেন। যান।

—তুমিও চলো।

—না, যাবো না। আপনার জন্যে নাস্তা বানাচ্ছে আমার মা আর মেজো কাকী। আমাকে যেতে বলে দিয়েছে।

হৃদ কিছুটা অবাকই হলো। তার আগমন উপলক্ষে এবাড়িতে আয়োজন চলছে। তার মানে শিশির সবাইকেই আগেভাগে আয়োজন করতে বলে দিয়েছে! ছি: ছি: কীসব কাজ করে বসে আছে এরা! হৃদের প্রচন্ড সঙ্কোচ হচ্ছে এবং সেই সঙ্কোচ নিয়েই সে ঘরের মধ্যে ঢুকলো।

শিশির চুল খুলে চেয়ারে বসে আছে। বারান্দার দিক থেকে কোনো এক চাপা সুগন্ধ ভেসে আসছে। হৃদ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই গন্ধের প্রতি মনোনিবেশ করলো। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে শিশির বললো,
—বসুন। আপনি আসবেন শুনে আমার বাড়ির লোক নানান আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।

হৃদ তার কথার জবাবে কিছুই বলে না। তবে যথাসম্ভব ভদ্রলোকের মত বিছানার কোণে চুপচাপ বসলো। শিশির চেয়ারেই বসে আছে। হৃদ কিছুটা স্থির হয়ে এলে সে জিজ্ঞাসা করে,
—বলুন, কী জানতে চান?

—আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি যা জানতে চাই, তা তুমি জানো। সরি, তুমি করেই বলছি।

—ইটস ওকে। ঠিকই ধরেছেন, আমি জানি। হয়তো সব জানি না। তবে কিছুটা হলেও জানি। আপনার বাবা আমার সাথেই কেন বিয়ে দিতে চাইছেন-এটা জানতে চান আপনি। দেখুন, এ ব্যাপারে আপনার বাবার জবাব দেওয়া উচিত ছিল। তবে উনি তা দিবেন না। তারও কারণ আছে। আপনি কি আমার অতীতের সবকিছু জেনে এসেছেন?

—হ্যাঁ, জানি। শুধু তোমাকে জানি না।

শিশির একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললো,
—আচ্ছা, আমি আপনাকে সমস্তই খুলে বলছি। তবে এরপর আসলে আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। এরপর বলছি কেন, আপনি রিজেক্ট না করলেও আমি বিয়েটা করতাম না। যাই হোক, এসব ছেড়ে মূল কথা বলা ভালো। আমাকে যে ভাইস-প্রিন্সিপালের খু*নের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিল, ওই খু*নটা করেছিল আমার বান্ধবী। আমার সিক্সথ সেন্স কেন জানি অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। কিছু কিছু ব্যাপার আমার মনের ভিতর অগ্রীম খবর দেয়। এটাকে অতিপ্রাকৃত শক্তি না ভেবে বরং মিসির আলির ভাষায় স্ট্রং টেলিপ্যাথি বলা ভালো। আমার সেই টেলিপ্যাথি শক্তির কারণেই সেদিন মনে হচ্ছিলো আমাদের ম্যামের সাথে খুব বাজে কিছু হতে যাচ্ছে। শুরুতে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি হতে শুরু করে। আমি তখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ম্যামের বাসায় যাই। এরপর গিয়ে দেখি আমার বান্ধবী তার শাশুড়ীকে খু*ন করেছে। কারণ ছিল, আগেরদিন রাতে ওর শাশুড়ী ওকে ওর ওই প্রতিবন্ধী স্বামীর সাথে আত্মপ্রণোদিত হয়ে শারিরীক সম্পর্ক করতে বলে। প্রতিবন্ধী ছেলে তো কিছুই বোঝে না, তাই ও যেন নিজে থেকে এসব করে। আপনি কী বুঝতে পারছেন, একটা মেয়ের জন্য এসব কেমন বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার?

হৃদ জবাব দিলো না। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে। শিশিরের দিকেও তাকাতে পারছে না। শিশির বলে যাচ্ছে,
—পরদিন ওর শাশুড়ী ওকে এসব না করার কারণে অকথ্য আর নোংরা ভাষায় নানান কথা শোনায়। তখন মেয়েটা আর সহ্য করতে না পেরে তাকে রাগের বশে খু*ন করে ফেলে। এই ঘটনা আমি, আমার বান্ধবী আর পরবর্তীতে আপনার বাবা ছাড়া আর কেউ জানতো না। কোর্টে সেদিন কাকতালীয়ভাবে আপনার বাবা ওখানে উপস্থিত হন। আমার মামলার রায় হলো। জেল হলো। যখন নেমে আসছিলাম, আপনার বাবাকে দেখে নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে বসি,“আমার ভাইস-প্রিন্সিপাল কী আপনার প্রাক্তণ প্রেমিকা?”
প্রিন্সিপাল ম্যাম এবং তার নাম বলার পর আপনার বাবা সাংঘাতিকভাবে চমকে যান। এটাই তো স্বাভাবিক। হুট করে কেউ কারো অতীত বলে দিলে মানুষ চমকাবে তো বটেই, কেউ কেউ স্ট্রোক করে মা*রাও যেতে পারে।

—এরপর? উনি কী সত্যিই বাবার প্রেমিকা ছিলেন?

—হ্যাঁ, ছিলেন। একথা পরবর্তীতে জেলখানায় গিয়ে উনি আমার সাথে সাক্ষাতে বলেছিলেন। আমি কীভাবে জানি, সেটাও উনাকে বলেছিলাম। এমনকি, আমি যে তার প্রেমিকাকে খু*ন করিনি, এই কথাটাও তাকে বলি যেন সে মনে কষ্ট না পায়। কিন্তু আপনার বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলছিলেন ওই মহিলার সাথে উনার বিচ্ছেদ হয়ে ভালোই হয়েছিল। মানুষটার আচরণ উনার পছন্দ ছিল না। এই হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপার। তবে আমার ধারণা, আপনার বাবা আমার টেলিপ্যাথি শক্তিটার প্রতি দুর্বল। সেজন্য উনি চাইছিলেন আমি যেন আপনার জীবনে আসি। মাঝেমধ্যে এমন হুটহাট বিপদ থেকে বাঁচাই।

হৃদ কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে মেঝের দিকে চেয়ে রইলো। প্রায় তিন চার মিনিট তাদের মধ্যে আর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না। শিশির নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইছে। না, সেটা গান নাকি কবিতা-স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। সে যতক্ষণ এই ঘরে থাকবে, এই বাড়ির কেউ ঘরের ভেতর ঢুকবে না। এই বিষয়টি হৃদ স্পষ্ট বুঝতে পারছে।

প্রায় অনেকক্ষণ পর হৃদ শিশিরের মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। কতক্ষণ সময়-তা সে নিজেও জানে না। কিছুটা উশখুশ করে সে বললো,
—শিশির, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

শিশির ওর দিকে দৃষ্টি রাখলো, জবাব দিলো না। হৃদ আবার বললো,
—তোমার এই টেলিপ্যাথি শক্তির জন্য নয়। এসব আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না৷ তবে বাবার বিষয়টি বিবেচনায় আনলে অবিশ্বাস করার মতও কিছু নয়। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই এর একটাই কারণ- তুমি অসাধারণ একটি মেয়ে। অসাধারণ তোমার ব্যক্তিত্ব। আমি তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি। বলতে পারো প্রেমে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার এই বয়সে এটা বোধহয় মানায় না। তবুও প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।

শিশির চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালো। হৃদকে সে হয়তো কিছু বলতে চায়। অথচ বলতে পারছে না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে বললো,
— বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। চলুন, নিচে যাওয়া যাক। আপনার প্রশ্নের জবাব আমি আগেই দিয়ে রেখেছি। কেন দিয়েছি জানেন? কারণ আমার এই গোপন কথা যে জানে, তার সাথে আমি থাকতে চাই না। আমি এমন কাউকে বিয়ে করতে চাই, যে আমার এই ব্যাপারটি জানে না। কারণ, এই জানাজানির অধ্যায়টা আমার জীবনটাকে বিষিয়ে দেয়, আমার কাছে মানুষের এএক্সপেকটেশন বাড়িয়ে দেয়, আমার জীবনটা অস্বাভাবিক হয়ে আসে। আশা করি আমাকে বুঝতে পেরেছেন।

—আমি তবুও তোমাকে ভালোবাসবো। ভালোবাসতে চাইবো। আমার হৃদয়ের গভীরে তোমার জন্য উষ্ণতা জমিয়ে তোমার জন্য হৃদয়ম নামক পবিত্র উপাসনালয় বানিয়ে যাবো। প্রয়োজনে তুমি এই জানাজানির স্মৃতিটুকু ইরেজারে মুছে নিও।

হৃদ এবারও ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সে নিচে নামার পর শিশির আস্তে করে ঘরের দরজা ঠেলে দেয়। তার চোখে স্বচ্ছ জল চিকচিক করছে। একদিকে তার গোপন সত্য,অন্যদিকে হৃদয়ের হৃদয়ম। সে তো কোনোদিকেই পা বাড়াতে পারছে না।

(সমাপ্ত)