#মিশেছো_আলো_ছায়াতে
#Writer_Sintiha_Eva
#part : 08
🍁🍁🍁
ডাক্তার আমান কাল থেকে ছুটিতে থাকায় তিন্নির দায়িত্ব টা এসে সিমথির উপর পড়ে। সিমথি নিজের কেবিন থেকে আদির সাথে রাগারাগি করে সোজা তিন্নীর কেবিনে চলে যায়। দরজা খোলার শব্দে মেহের, ইশান আর তিন্নি দরজার দিকে তাকায়। সিমথিকে দেখেই তিন্নি লাফিয়ে উঠে। তিন্নির লাফানো দেখে সিমথি না চাইতে ও মুচকি হাসি দেয়।
তিন্নি : ডাক্তার আন্টি ইউ আর সো লেট।
তিন্নির কথায় সিমথি হালকা হাসে। তিন্নির ছোট গালগুলোতে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
সিমথি : আমি ঠিক টাইমেই এসেছি। বাই দ্য ওয়ে মেহের ম্যাম তিন্নিকে আজই ছেড়ে দেওয়া হবে। আপনারা আজই ওকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।
সিমথির কথায় মেহের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সিমথি তিন্নির পালস রেট চেক করে সব ঠিক ঠাক দেখে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। তখনই কেবিনে হন্তদন্ত হয়ে আদি প্রবেশ করে। আদিকে দেখা মাত্র সিমথির মাথায় রাগ পুনরায় ঝেকে বসে। কেবিনে থাকা নার্স কে তিন্নির খেয়াল রাখতে বলে চলে যেতে নিল তিন্নির কথায় আটকে যায়।
তিন্নি : একি ডাক্তার আন্টি তোমার হাতে তো র/ক্ত। ( বিচলিত হয়ে)
তিন্নির কথায় মেহের আর ইশান বিচলিত হয়ে সিমথির দিকে তাকায়। হাতের শুভ্র রঙের ব্যান্ডেজ টা র/ক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আদি অপরাধীর দৃষ্টিতে সিমথির দিকে তাকায়। সিমথি একটা বারের জন্য ও আদির দিকে তাকালো না। তিন্নির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে,,,
সিমথি : তেমন কিছু না।
মেহের : কি বলছো তেমন কিছু না হাতটা সম্পূর্ণ র/ক্তে ভিজে গেছে।
সিমথি : না ম্যাম ইট’স ওকে। আমি ঠিক ঠিক আছি।
ইশান : কিন্তু সিমথি
সিমথি : ভাইয়া ইট’স ওকে। তিন্নির খেয়াল রাখুন আমি আসছি।
সিমথির কথায় মেহের আর ইশান একে অপরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। সিমথি চলে যেতে নিলে তিন্নির জেদ ধরে বসে।
তিন্নি : নার্স আন্টি ডাক্তার আন্টিকে ব্যান্ডেজ করে দাও।
সিমথি : তিন্নি সোনা দেখো,,
সিমথির কথা শেষ হবার আগেই তিন্নি কাঁদতে শুরু করে।
তিন্নি: তুমি ব্যান্ডেজ না করলে আমিও আর মেডিসিন খাবো না । ( কাঁদতে কাঁদতে)
মেহের : তিন্নি কিন্তু অনেক জেদী মেয়ে।
তিন্নির মায়ের কথায় সিমথি হালকা কেশে নার্সের দিকে তাকায়। নার্স ভয়ে ভয়ে সিমথির দিকে আসে। নার্সকে এমন ভয় পেয়ে নতুন বউয়ের মতো আসতে দেখে সিমথি বিরক্তি নিয়ে হালকা ধমকের সুরে বলে ওঠে,,,,
সিমথি : বিয়ে করে নতুন বরের কাছে আসছো নাকি। এভাবে ভয় পাওয়ার কি আছে। তাড়াতাড়ি আসো নয়তো আমাকে দাও আমি করে নিচ্ছি। স্টুপিড একটা।
সিমথির ধমকে মোটামুটি সবাই অনেকটাই কেঁপে ওঠে। নার্স দ্রুতপায়ে সিমথির কাছে আসে। অতঃপর সন্তপর্ণে হাতে র/ক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ টা খুলে দেয়। হাতের দিকে তাকাতেই মেহেররা কেঁপে ওঠে। হাতটা লাল হয়ে অনেক ফুলে গেছে। তিন্নি সিমথির হাত দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সিমথি পড়ে যায় বেকায়দায়। নার্সের হাত থেকে তুলো আর ব্যান্ডেজ নিয়ে দ্রুত নিজের হাতেই ব্যান্ডেজ করে নেয়। অতঃপর তিন্নিকপ এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খায়। হালকা হেসে বলে উঠে,,,
সিমথি : কাঁদছো কেনো?
তিন্নি : তোমার হাত এতোটা কিভাবে কাটলো। কতটা কেটে গেছে। ( কাঁদতে কাঁদতে)
সিমথি : আসে ছুড়ি লেগে কেটে গেছে। সমস্যা নেই সেড়ে যাবে। এখন কান্না বন্ধ করো।
তিন্নি: তুমি কিন্তু ঔষুধ খাবে।
সিমথি : আচ্ছা খাবো।
তিন্নি : আমি কিন্তু তোমার সাথে এসে মাঝে মাঝে দেখা করবো।
সিমথি : আচ্ছা।
তিন্নি : আমার যখন ইচ্ছে তখনই আসবো।
সিমথি : আচ্ছা।
তিন্নি : হুমমমম ( গাল ফুলিয়ে)
তিন্নির গাল ফুলানো দেখে সিমথি তিন্নির ফুলানো গালে টপ একটা চুমু খায়। অতঃপর তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,,
সিমথি : মেডিসিন গুলো টাইমলি খাবে ওকে।
তিন্নি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সিমথি মেহেরের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসে। আদি এতোক্ষণ সিমথির দিকে তাকিয়ে ছিলে। সিমথি চলে যেতেই আদি ও হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিছুই ভালো লাগছে না। এবার একটু রিফ্রেশ হতে হবে। আদি গাড়ি নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যায়। ফুল স্পিডে ড্রাইভিং করছে।কানে শুধু সিমথির বলা কথাগুলোই সানাইয়ের মতো বাজছে। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে পড়ে। শার্টের হাতায় শুকিয়ে যাওয়া র/ক্তের দিকে তাকায়।
__________________
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবদলের পালাক্রমে গ্রীষ্মের পরই শুরু হয় বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানেই হচ্ছে বৃষ্টি। রাস্তাঘাট, গাছগাছালি বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। তবে ব্যস্ততায় ঘেরা শহুরে মানুষের মাঝে তেমন কোনো আলাদা উচ্ছ্বাস নেই। তবে এটা যদি হতো গ্রামাঞ্চল তাহলে তার চিত্র ফুটে উঠতো রকমারি সাজে। শহুরে মানুষ ইট-পাথরের দালান-কোঠার মাঝে থাকতে থাকতে নিজেরাও হয়ে উঠেছে পাথর মনের মানব।
অম্বর জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা। মাঝে মাঝে শীতল বাতাসে বইছে। সন্ধ্যা ছয়টা হওয়া স্বত্বেও বাইরের অবস্থা দেখে যে কেউ বলবে রাত হয়ে গেছে। আদিরা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আজ অফ ডে। পুরো ফ্যামিলি মেম্বার্স রা একত্রে আড্ডায় মজে আছে। একেকজন একেক কথা বলছে আর বাকিরা হেসে উঠছে। আচমকায় আড্ডার মাঝে তিন্নি লাফিয়ে উঠে।
তিন্নি : উফফসস পাঁচ দিন হলো ডাক্তার আন্টিকে দেখি না।
তিন্নির কথায় ইশান খোঁচা দিয়ে বলে,,,
ইশান : এক কাজ কর তোর ডাক্তার আন্টি কে ফোন দিয়ে আসতে বল।
তিন্নি আফসোসের সুরে বলে ওঠে,,,
তিন্নি : ডাক্তার আন্টি অনেক বিজি।
আচমকা ওদের মাঝে আদি বলে উঠে,,,,
আদি : চল তোর ডাক্তার আন্টির সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।
আদির কথায় কয়েক জোড়া চোখ আদির দিকে তাকায়। ওদের তাকানো দেখে
আদি : কি? এভাবে তাকানোর কি আছে? জাস্ট তোর মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করাতে চেয়েছি অর নাথিং।
আদির কথায় আদিবা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,,,,
আদিবা : তো আমরা কখন বললাম তুই অন্য কিছু বলেছিস।
আদিবার কথায় আদি থতমত খায়।
আদি : আ আসলে
তুহা : তোর হাব ভাব মোটেই সুবিধার লাগছে না ভাইয়া।
মেহের : ভাইয়া বিয়ে সাদি করবা নাকি।
মেহেরের কথায় আদির কাশ উঠে যায়। ইশান আর শাওন হাসতে হাসতে আদির পিঠ চাপড়ে দেয়।
শাওন : আহ মেহের ছেলেটার পেছনে শুধু শুধু কেনো লাগছো।
ইশান : চুপ কর ভাইয়া। আদি ব্রো’র হাব ভাব মোটেই সুবিধার না।
তুহা : রাইট। সারাদিন কি এতো ভাবো একা একা। আবার মাঝে মাঝে হাসিস। বল বল।
আচমকায় আদিবা গেয়ে উঠে।
আদিবা : প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
আদিবার গানে আদি রাগী রাগী চোখে ওদের দিকে তাকায়। বাকিরা সবাই হেসে দেয়। আদি কোলের উপরের কুশন টা আদিবার দিকে ছুঁড়ে মারে।
আদি : বে’য়া’দ’ব বড় ভাই হয় তোর।
আদির কথায় এবার বাকি সবাই হেঁসে দেয়। এদিকে বেচারি তিন্নি বোকা বোকা চোখে সবার দিকে তাকাচ্ছে। কি হচ্ছে কি করছে সবাই সবই তার ছোট্ট মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
তিন্নি : কি হচ্ছে এসব। ( চেঁচিয়ে)
তিন্নির চেঁচানো তে ইশানরা কানে হাত দেয়।
শাওন : এই এক মেয়ে। পুরাই মায়ের মতো হয়েছে।
শাওনের কথায় মেহের রাগী চোখে তাকায়।
মেহের : কি বললে। আবার বলো।
শাওন : হিহিহি। কিছুই না। তিন্নি চল ঘুরে আসি।
তিন্নি : কোথায় যাবে? ডাক্তার আন্টির কাছে।
আদি : চল যায়।
আদিবা : ডাক্তার আন্টি র কথা শুনলে তুই সবার আগে লাফাস কেনো?
তুহা : ব্যাপার কি ভাই।
আদি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তিন্নিকে কোলে তুলে হাঁটা লাগায়। পেছনে সবাই বোকার মতো আদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
_________________
তন্ময় : আজ চল কফিশপে যায়। আমার ও কাজের প্রেশার কম তোদের ও কম।
রোদেলা : গুড আইডিয়া।
তুহিন : চল চল তাহলে।
মেঘা : সিমথি কে রাজি করানোর দায়িত্ব তন্ময়ের।
তন্ময় : বাঘের খাঁচায় যাওয়ার জন্য তো আমি তন্ময় আছিই।
তন্ময়ের কথায় সবাই হেসে দেয়।
তন্ময়রা সিমথির কেবিনে যায়। তন্ময় গিয়ে সোজা সিমথির সামনে চেয়ারে বসে পড়ে। সিমথি ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকায়।
সিমথি : হোয়াট হ্যাপেন্ড?
তন্ময় : জানু শোন না।
সিমথি : এতো রস মেখে কথা না বলে কি বলবি বল।
সিমথি র কথায় তন্ময় হালকা কাশে।
তন্ময় : চল না সবাই মিলে একটু কফি খেয়ে আসি।
সিমথি : কিসের ট্রিট। তোর বিয়ের ( ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে)
তন্ময় : কি যে বলিস আমার বিয়ে হলে তো সবার আগে তুই জানবি। ( মুচকি হেসে)
মেঘা : তন্ময় বিলিভ মি তোর ভাগ্য ভালো সিমথির মতো একজন গার্লফ্রেন্ড পেয়েছিস।
তন্ময় : এ কথা আমি অস্বীকার করবো আম রিয়েলি লাকি। আমি সত্যিই ভাগ্যবান আমি সিমথির মতো একজন ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি। ভীষণ ভালোবাসি সিমথিকে। চাইলে ও ওর থেকে দূরে সরে থাকতে পারি না।
তন্ময়ের কথায় সিমথি হাসে। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,,,
সিমথি : মিস্টার এহমাদ এতো প্রেমিক পুরুষ কবে থেকে হলেন। আম রিয়েলি সারপ্রাইজড।
সিমথির কথায় তন্ময়সহ বাকিরা ও হেসে দেয়।
মেঘা : কিরে তন্ময় তুই নাকি এখনো সিমথিকে আই লাভ ইউ বলিস নি।
মেঘার কথায় তন্ময় হাসে । উঠে গিয়ে সিমথির পেছনের চেয়ারের কাধে হাত রেখে সিমথির দিকে হালকা ঝুঁকে বলে উঠে,,,,
তন্ময় : আই লাভ ইউ বললেই কি ভালোবাসা হয় নাকি। ভালোবাসা মানে ভালো রাখা। বিপরীত পাশের মানুষ টার সব কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া। বিপরীত পাশের মানুষ টা কে সম্মান করা। সর্বোপরি আচার-আচরণে ভালোবাসার বর্হিপ্রকাশ করা। আমি আই লাভ ইউ বলে ভালোবাসা প্রকাশে বিশ্বাসী না। আমি ব্যবহারে প্রকাশিত ভালোবাসায় বিশ্বাসী।
তন্ময়ের কথায় সিমথি বাদে বাকিরা চেঁচিয়ে উঠে।
মেঘা : সিমথি বইন ইউ আর রিয়েলি লাকি।
মেঘার কথায় সিমথি হেসে দেয়। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে একটা টেডি স্মাইল দিয়ে বলে উঠে,,,
সিমথি : ইউ আর রাইট মেঘা। সিমথি রিয়েলি লাকি পার্সন।
আচমকা তন্ময়ের চোখ দরজায় যেতেই সিমথির কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তন্ময়ের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজায় দিকে তাকায়।
মেঘা : আদি ভাইয়া।
চলবে,,,,,
#মিশেছো_আলো_ছায়াতে
#Writer_Sintiha_Eva
#part : 09
🍁🍁🍁
কেবিন জুড়ে পিনপন নীরবতা। আদি এক দৃষ্টিতে সিমথির দিকে তাকিয়ে আছে। আদির দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই সিমথির দিকে তাকায়। সিমথি ভাবলেশহীন ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে। যেনো কিছুই হয়নি। বেশকিছু ক্ষণ সবাই কে চুপচাপ দেখে তিন্নি গাল ফুলিয়ে ছোট ছোট পায়ে সিমথির দিকে এগিয়ে যায়।
রোদেলা : এহেম এহেম। আদি ভাইয়া আসুন না বসুন এসে। নৌরিন
নৌরিন এসে রোদেলার দিকে তাকায়।
রোদেলা : এক কাপ কফি নিয়ে আসো উইথ সুগার।
নৌরিন যেতে নিলে আদি বাঁধা দেয়।
আদি : না রোদেলা তিন্নি ওর ডাক্তার আন্টির সাথে দেখা করতে এসেছিলো। তাই নিয়ে এসেছি। তিন্নি তুমি থাকো। কাকাই একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল করে আসছি।
আদির কথায় তিন্নি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। আদি দ্রুতপদে কেবিনে থেকে বেরিয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা দেয়। আকাশে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে। কেবিনে হওয়া সবগুলো কথায় আদি শুনতে পেয়েছে। বৃষ্টির পানিতে গায়ে সাদা শার্ট টা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে বাতাসের দাপটে। রাস্তায় তেমন একটা মানুষ নেই। আদি যেন ভ্রমে চলে গেছে। কিছুতেই মানতে পারছে না সিমথি আর আদির নেই। মন বলছে সিমথি এখনো আদিকে ভালোবাসে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে সিমথি এখন তন্ময়ের। আদি একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। জায়গা টা অত্যন্ত নীরব। আশেপাশে কোনো লোকালয় নেই। যতদূর চোখ যায় কেবল সুনসান নীরবতা।
আদি তিন্নিকে দিয়ে বেরিয়েছে প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চললো। কিন্তু এখনো আদির ফেরার নাম নেই। এদিকে আদির নাম্বার ও নেই কারোর কাছে। তারমধ্যে তিন্নি ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
সিমথি : এই লোকটার সামান্য কমনসেন্স টুকুও নেই। একটা বাচ্চা মেয়েকে রেখে কোথায় গেলো।
মেঘা : আমাদের আর কফি খাওয়া হলো না।
তন্ময় : এক কাজ করি।
তুহিন : কিহ
তন্ময় : আমরা যাওয়ার পথে না হয় তিন্নিকে আদি ভাইয়া দের বাসায় ছেড়ে যাবো। আর নৌরিন কে বলে দে আমরা গেলে আদি ভাইয়া আসলে যেনো বলে দেয় আমরা তিন্নিকে নিয়ে গেছি। মনে হয় আদি ভাইয়া কোনো কাজে আটকে গেছে।
সিমথি : হবে হয়তো। কিন্তু আদি ভাইয়ার বাসা চিনিস তুই।
তন্ময় : আরে হুমম চিনি চল এখন তাড়াতাড়ি বৃষ্টি একটু কমেছে।
অগত্যা তিন্নিকে কোলে নিয়েই সবাই বেরিয়ে পড়ে।
আদিবা : রাত আট টা বাজে তিন্নি কে এখনো নিয়ে আসার নাম আছে এই ছেলেটার।
শাওন : সত্যিই তো কোথায় গেলো বলো তো।
মেহের : তোমার মেয়ে কেমন নাছোড়বান্দা জানো না নাকি। নির্ঘাত সিমথিকে ছেড়ে আসতে চাইছে না।
মেহেরের কথায় শাওন রাগী দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকায়।
শাওন : আমার মেয়ে কে নিয়ে বাজে কথা বললে বাপের বাড়ি ছেড়ে আসবো মনে রেখো।
শাওনের মা : শাওন থাপ্পড় খাবি। এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছিস এখনো বউয়ের সাথে ঝগড়া করিস।
শাওনের বাবা : সবই তোমার আস্কারায়।
আদিবা : নেও এদের ও ব্যান্ড বেজে গেছে। ( বিড়বিড় করে)
এদের কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠে।
আদির মা : ওই তো এসে গেছে। দাড়াও আমি খুলে দিচ্ছি।
আদির মা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। আদি ভেবে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নেবে তখনই সামনে একটা মেয়েকে দেখে আটকে যায়। মেয়েটা পেছন দিক করে আছে । মেয়েটার কোলে তিন্নিকে দেখে বিচলিত কন্ঠে হালকা চেঁচিয়ে বলে,,,
আদির মা : এই মেয়ে আমাদের তিন্নির কি হয়েছে।
আচমকা কোনো মহিলার চেচানোতে সিমথি চমকে যায়। কান থেকে ফোন নামিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। বয়স্ক একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিমথি ভ্রু কুঁচকায়। পড়নে নীলরঙের একটা শাড়ি। চুলগুলো খোপা করা। নাকে ফুল কানে কানের দুল আর গলায় একটা চিকন সোনার হার। সিমথি হালকা কেশে নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বলে উঠে,,,,
সিমথি : মেহের ম্যাম আছেন এখানে।
সিমথির ভয়েজ কানে আসতেই আদিবা, তুহা, ইশান, শাওন আর মেহেরসহ উপস্থিত সবাই চমকে দরজার দিকে তাকায়। কালো শার্ট কালো জিন্স পড়ুয়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমড় অবধি চুলগুলো উপরে তুলে বাঁধা। গোলাপি ঠোঁটে হালকা পিংক লিপস্টিক। গায়ে একটা জ্যাকেট জড়ানো। বাম হাতে ঘড়ি। বৃষ্টি পানিতে মুখটা অনেক টা ভিজে ফর্সা মুখ টা অত্যন্ত মায়াবী রূপ ধারণ করেছে।
মেহের : সিমথি তুমি ( হালকা চেঁচিয়ে )
মেহেরের চেঁচানো তে সিমথির আদির মায়ের পাশ দিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে তাকায়। অনেক জোড়া চোখ সিমথির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিমথি কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে পড়ে।
আদির বাবা : কাণ্ডজ্ঞান কি সব চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছো। মেয়েটাকে ভেতরে আসতে দাও। দরজায় দাঁড়িয়ে এভাবে পুলিশের মতো জেরা শুরু করেছো কেনো।
আদির বাবার কথায় আদির মায়ের হুশ ফিরে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত অনুভব করে। কিছু লজ্জিত গলায় বলে,,,
আদির মা : সত্যি ই তো ভেতরে এসো মা।
আদির মায়ের কথায় সিমথি হালকা কেশে বলে,,,
সিমথি : নাহ আন্টি আজ আর ভেতরে যাবো না। তিন্নিকে পৌঁছে দিতে এসেছিলাম তাই,,
বাকিটা বলার আগেই আদিবা এসে সিমথিকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। এবার সিমথি বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। এই প্রথম সিমথি আদিদের বাড়িতে পা রেখেছে। আগে কখনোই আসা হয়নি। তাই এতোটা অস্বস্তি হচ্ছে।
আদিবা : তা বললে তো হয়না। এই প্রথম তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছো আর দরজার বাইরে থেকেই চলে যাবে।
ইশান : কারেক্ট
শাওন : মেহের তিন্নিকে কোলে নাও। মেয়েটা আর কতক্ষণ তিন্নিকে কোলে রাখবে।
শাওনের কথায় মেহের জিভ কেটে তিন্নিকে কোলে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দেয়।
আদিবা : মা-বাবা তোমাদের বলেছিলাম না কয়েকজন ছেলে আমাকে আর তুহাপু কে ডিস্টার্ব করছিলো তখন সায়ন ভাইয়ার বোন আমাদের বাঁচিয়েছিলো। সিমথিপুর কথায় বলেছিলাম।
মেহের : আর তিন্নিকে র/ক্ত ও দিয়েছিলো সিমথিই।
শাওন : সিমথি বোন বসো। দাঁড়িয়ে আছো কেনো।
সিমথি : না না আসলে
শাওনের বাবা : কি না। বসো রাতের খাবার না খাইয়ে কিন্তু ছাড়ছি না।
শাওনের বাবার কথায় সিমথির কাশ উঠে যায়।
ইশানের বাবা : আরে মেয়েটাকে পানি দে।
ইশানের বাবার কথায় শাওনের মা পানি এনে সিমথি কে দেয়। পানি খেয়ে নিজেকে কিছু টা সামলে বলে,,,
সিমথি : আম সরি।
শাওনের বাবা : এখানে সরির কি আছে।
আদির মা : আরে সিমথি তুমি বসো তো আগে।
আদির মায়ের কথায় সিমথি বসে পড়ে। সবাই সিমথির দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিমথি নার্ভাস হয়ে যায়।
সিমথি : আশ্চর্য এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে।
আচমকা ফোন বাজতেই সিমথি উঠে দাঁড়ায়। জ্যাকেট থেকে ফোন টা বের করে তন্ময়ের নাম দেখে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।
সিমথি : এক্সকিউজ মি প্লিজ
সিমথি দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে।
ইশানের মা : ইশশ মেয়েটা কত কিউট। একটা মেয়ের এতো কিউট কিভাবে হয়।
মেহের : ছোটো মা চুপ করো সিমথি শুনলে লজ্জায় পড়ে যাবে।
শাওনের বাবা : মেয়েটার জন্য কিছু নিয়ে আসো। এটা ও বলে দিতে হয়।
শাওনের বাবার কথায় আদির মা, শাওনের মা আর ইশানের মা রান্নাঘরের দিকে যায়।
সিমথি : আব্বেহ কেউ একজন আয়। আমাকে তো ছাড়তেই চাইছে না।
তন্ময় : তুই ওখানেই থেকে যা। যেতে হবে না আমার সাথে।
সিমথি : কি আজব আমার সাথে রাগ করিস কেনো।
তন্ময় : রাগ করবো কেনো। আমি কে?
সিমথি : কল রাখ ফা/জি/ল একটা।
সিমথি কল কেটে পেছনে তাকায়। মেহের হেসে সিমথির কাছে এসে দাঁড়ায়।
মেহের : ভাইয়া কোথায় ?
সিমথি : কোন ভাইয়া ?
শাওন : আদি কোথায় এটাই জিজ্ঞেস করছে।
সিমথি : ওহ। আসলে আদি ভাইয়া
ইশান : ভাইয়া
ইশানের কথায় মেহের, তুহা, আদিবা আর শাওন কেশে উঠে। সিমথি বোকার মতো ওদের পাঁচজনের দিকে তাকায়।
ইশান : সরি সরি। বলো আদি ভাইয়া এটার পরে কি বলো।
সিমথি : আদি ভাইয়া তিন্নিকে আমার কাছে রেখে কিসের কল আসায় চলে গিয়েছিলো তারপর অনেক্ক্ষণ হয়ে যাওয়ায় ও আসেনি। আর আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মাথায় হঠাৎ করে কফি খাওয়ার ভূত চেপেছে। তাই তিন্নিকে এখানে ছেড়েই আমরা যেতাম।
শাওন : ওহ আচ্ছা। শুধু শুধু আদির জন্য তোমার কষ্ট হলো সরি বোন।
সিমথি : বোন ও বলছেন আবার সরি ও বলছেন নট গুড।
সিমথির কথায় শাওন হেসে দেয়।
সিমথি : আচ্ছা আমি আসছি। বাইরে আমার ফ্রেন্ডরা ওয়েট করছে।
মেহের : সেকি কিছু খেয়ে যাও।
সিমথি : না মেহের ম্যাম আমাকে,,
মেহের : আমার বরকে ভাইয়া বলো আর তার বউকে ম্যাম নট গুড।
কথার মাঝে বাঁধা পেয়ে মেহেরের কথা শুনে সিমথি হালকা হেসে দেয়।
সিমথি : নেক্সট টাইম না হয় ভাইয়ের সম্পর্কে যা হোন তাই ডাকলাম। বাট নাও আম অলসো লেট বাই।
আদির মা : তা বললে তো হচ্ছে না। এই নাও মিষ্টি মুখ করে তারপর যাও।
আদির মায়ের কথায় সিমথি ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট টেবিলটার দিকে তাকায়। রকমারি মিষ্টি দেখতেই সিমথির গা গুলিয়ে উঠে। সিমথি হালকা কেশে উঠে।
সিমথি : আ আমি মিষ্টি খাই না আন্টি।
সিমথির কথায় সবাই আকাশ থেকে পড়ে। সবার মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কেউ এদের মুখে জোর করে করলার রস ঢুকিয়ে গিলতে বলা হচ্ছে।
আদিবা : সিরিয়াসলি সিমথিপু।
আদিবার কথায় সিমথি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সবাই মুখ টা লটকিয়ে সিমথির দিকে তাকায়। সবার মুখের অবস্থা দেখে সিমথি মিষ্টির পাশে থাকা জুসটা নিয়ে দু চুমুক খায়।
সিমথি : এনাফ। আজ আসি। আল্লাহ হাফেজ।
আদির বাবা : বললে ও তো থাকবে না জানি। আবার একদিন সময় করে এসো।
আদির বাবার কথায় সিমথি হালকা হেসে সম্মতি জানায়।
মেহের : আবার এসো কিন্তু।
সিমথি : ইয়াহ বাই।
সিমথি সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। আচমকা পেছন থেকে হাতে টান পড়ায় থেমে যায়। পেছন ফিরে দেখে তিন্নি ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ঠোঁট উল্টে সিমথির দিকে তাকিয়ে আছে।
তিন্নি : তুমি আমাকে না বলে চলে যাচ্ছো কেনো? ( বাচ্চা বাচ্চা গলায়)
তিন্নির কথায় সিমথি একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকায়। অতঃপর হাঁটু গেড়ে তিন্নির সামনে বসে তিন্নির গালে একহাত রাখে।
সিমথি : তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে তারজন্য ডাক দেয়নি।
তিন্নি : হুহ আমি লাগ ( রাগ) কলেছি ( করেছি)
তিন্নির কথায় সিমথি হালকা হাসে।
সিমথি : আচ্ছা যাও সরি।
তিন্নি : নাহ এভাবে না। আমাকে পাপ্পি দাও এখানে ( গাল বাড়িয়ে)
সিমথি তিন্নির গালে টপ করে একটা চুমু খায়। অতঃপর কপালে একটা চুমু খায়।
তিন্নি : ডাবল আদল ( আদর) ।
সিমথি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। তিন্নি সিমথিকে ঝাপটে ধরে সিমথির গালে পরপর দুইটা চুমু খায়। অতঃপর দুজনই হেসে দেয়। এই তিন্নিকে সিমথির ভীষণ ভালো লাগে। এমনিতেই বাচ্চাদের প্রতি সিমথির ঝোঁক টায় আলাদা। সিমথি আর তিন্নির কেমিস্ট্রি দেখে সবাই হেসে দেয়।
তিন্নি : তুমি কিন্তু আবাল আসবে হুহ
সিমথি : ওক্কে। তুমি ও যাবে।
তিন্নি : আচ্ছা।
সিমথি : এবার আমি যাই।
তিন্নি : ইচ্ছে কলছে সালাজীবন লেখে দেয় ( ইচ্ছে করছে সারাজীবন রেখে দেয়) ।
তিন্নির কথায় সিমথি হালকা হেসে পুনরায় কপালে একটা স্নেহের পরশ মেখে তিন্নিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে ১০+ মিসড কল দেখে ঘাড় চুলকায়। অতঃপর সবার দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে।
সিমথির পেছন পেছন সবাই আসে। সিমথি ফোনের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে বের হতে নিবে তখনই কারো সাথে ধাক্কা লাগে। তাল সামলাতে সামনের ব্যক্তির কলার খামছে ধরে। যার ফলস্বরূপ হাত থেকে ফোন নিচে পড়ে যায়। সামনে ব্যক্তিও অজান্তেই সিমথির কোমড় আঁকড়ে ধরে। বিনা পয়সায় বিনোদন দেখে সবার মুখ টা হা হয়ে যায়। বড়রা দ্রুত সেখান থেকে সরে যায়। আদিবা,তুহা,মেহের,শাওন,ইশান একে অপরের দিকে তাকায় আবার সামনের দুইজনের দিকে তাকায়। তিন্নি গালে দু হাত দিয়ে হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আদি : চোখ খুলো।
আচমকা আদির ভয়েজ কানে আসতেই সিমথি চোখ খুলে তাকায়। আদির অবস্থা দেখে সিমথি থতমত খেয়ে যায়। কি অবস্থা আদির। হসপিটাল থেকে বের হবার সময় তো সুস্থ সবলই ছিলো। কিন্তু এখন মাথার বামপাশে ব্যান্ডেজ, চোখগুলো রক্তজবার মতো লাল হয়ে ফোলা ফোলা। গায়ের শার্ট ভিজে গায়ের সাথেই লেপ্টে আছে। অন্যদিকে সিমথির চোখের দিকে তাকাতেই আদি অন্য জগতে চলে যায়। সিমথির মুখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। পেছনে পাচ জোড়া হুহ ছয় জোড়া চোখ ওদের কীর্তিকলাপ দেখছে। আদিবারা মিটিমিটি হাসতে শুরু করে। আচমকা সিমথির চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। আদিকে হালকা ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দেয়। নিচ থেকে ফোন তুলে একবার পেছনে তাকায়। অতঃপর সরি বলে চলে যায়। মুহুর্তে পাঁচ জনের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ কি হলো? সিমথি রেগে গেলো কেনো? আদি সিমথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আদি : আবেগের জগৎ থেকে বেরিয়ে তুমি বাস্তবতার পথে হাটছো। আর আমি বাস্তবতার জগৎ ছেড়ে তোমার অতীত পথে হাঁটছি। ( মনে মনে)
চলবে,,,