মুগ্ধতার ভিরে পর্ব-১২

0
6850

#মুগ্ধতার_ভিরে🥀
#পর্ব__১২
#লেখিকাঃফাতেমা জোহরা নাভিলা

.

ছেলে পক্ষ আসার পর থেকেই ছোট হোলরুমে মুহূর্তে কেমন জেনো হট্টগোল বেধে গেছে।ফুঁপিয়ে কান্নার নিঃশব্দে ভারি আওয়াজ থেমে থেমে কানে বার বার ভেসে আসছে । নাভিলা এভার আর কিছু তেই চুপ চাপ বসে থাকতে পারছে না। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো তার মাও তার কাছে আসছে না।তার কাছে ব্যাপারটা মোটেও এখন ভালো ঠেকাচ্ছে না।অস্থির হয়ে দাঁত দিয়ে নক খেতে খেতে দরজার দিকে তাকিয়ে সারা রুমময় ঝুড়ে পায়চারী করতে লাগলো। সময় প্রহর গুলো জেনো আজ শেষ হতে চাচ্ছে না। তার কাছে ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত লাগছে। মেয়ে দেখতে এসে কেই বা কান্না করে দেয়!এটাও আবার কেমন কথা! আগে তো এমন কোথাও হতে দেখেনি আর না শুনেছি! কিন্তু আপাতত কথা হচ্ছে বাহিরে কান্না করছে তো করছে কে! নিজের মধ্যে কৌতূহোল আর এক ঝাক এমন নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে জোট গুলোকে আর আটকে রাখতে না পেরে শেষে রুম থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

ডরিং রুমের সামনে এসে ইতদস্ত করতে করতে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে স্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে ডরিংরুমের নীল পর্দা আড়ালে চট করে দাঁড়িয়ে পরলো। বাম হাত দিয়ে পর্দা টেনে নিজেকে আড়াল করে।আড়াল থেকেই উক্কিঝুক্কি দিলো ব্যাপারটা দেখার জন্য। কিন্ত ডরিং রুমে যা দেখলো তা দেখার জন্য মোটেও সে কোনো কালেই প্রস্তুত ছিলো না। বিষ্মত ভাবে তাকিয়ে আছে। তারা বাবা কান্না করছে কিন্তু একা না তার সাথে আরো একজন ভদ্র মধ্য বয়স্ক লোক ও কান্না করছে সমান তালে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু কেনোই বা করছে! বাবাকে এভাবে কান্না করতে দেখে নাভিলার বুকের ভিতরে ধুক করে মুচড় দিয়ে উঠল।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে তার বাবাকে একবারের জন্য ও এভাবে নিজের চোখের পানি ফেলতে দেখে নি।ছোটবেলায় শুধু একবার বাবার চোখে পানি দেখছিলো। এটাও খুব ভয়াংকর ভাবে অস্থির হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে ছিলো এর পর আর কখনো দেখেনি। তার এখনো মনে আছে। তার বয়স যখন সাত কিংবা আট হবে তখন রোজকার মত বিকালে ছাদ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি থেকে নিচে পরে গিয়ে মাথা সামান্য একটু ফেটে গিয়েছিলো।কপালে ভ্রুরুর নিচের দিকে কিছুটা কেটে গিয়েছিলো। সিঁড়ি থেকে কোনো মতে উঠে মায়ের বকার থেকে বাঁচার জন্য রক্তমাখা অব্যস্থাই মাথা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে বাবার কাছে দৌড়ে দিলো। বাবা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে তখন খবরের কাগজ পড়ছিলো। হঠাৎ তার সামনে রক্তমাখা অব্যস্থা নাভিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত আর্তকে উঠে। উৎজিত হয়ে সেই দিন প্রথম বারের মত কান্না করতে দেখেছিলো।এখনো তার চোখে সামনে বাবার সেই কান্নামিশিতো চেহারা ভেসে উঠে। কি ভয়াংকর দিনই না ছিলো তার জীবনে।
.

নাভিলা এভার নিজেকে আর আটকে না রাখতে পেরে পর্দা আড়াল থেকে দ্রুত বের হয়ে ডরিং রুমে নাফিজের পাশে এসে দাঁড়ায়। কি হচ্ছে বুঝার জন্য। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ডরিং রুমে টেবিলের পাশে তার ফুঁপি, মা, ভাবি , আবির এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে তাদের চোখে ও বিষ্মত ফুটে উঠেছে।নাভিলা এভার নাফিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আপাতত নক খেতে ব্যস্ত।
.

__এইইইই ভাইয়া এই শুনছো, আব্বু কান্না করছে কেনো ! উনি কি বাসায় এসে আব্বুকে উল্টা পালটা কিছু বলেছেন! নাহ্ উনিও তো দেখছি নিজেও আব্বুর সাথে কান্না করছে। তাহলে বাহহ উনি কি বা এমন বলবেন। তারা কান্নাই বা এভাবে করছে কেনো! এই ভাইয়া বল না চুপ কেন!
ফিসফিস করে বলল নাভিলা,,,,

__চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখ এই মুহূর্তে কিছুই জিগ্যেস করিস না।আমি নিজে ও কিছু বুঝতে পারছিনা না। হঠাৎ আব্বু ভাবির বাবাকে দেখে এইভাবে কান্নাই বা কেনো করছেন।
নাভিলার বিপরীতে নাফিজ বলে উঠল,,

.
দুইভাই বোন একে উপরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত চাহনিতে এক সাথে এভার নক খেতে খেতে টেনশনে সামনের দিকে তাকালো ব্যাপারটা বুঝার জন্য।
.

এভার ভদ্র লোক কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন,,,

__কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি সাদাফ! আমি তোকে দেশে এসে কত খুঁজেছি কিন্তু কোথাও কাউর কাছে তোর সঠিক খোজ আদৌ পাইনি। দেশের এসে পরের দিনই আমি তোকে চমক দেওয়ার জন্য মাকে নিয়ে কুমিল্লা ছুটে যাই। কিন্তু গিয়ে আমি নিজেই সব থেকে বড় একটা চমক পেয়ে যাই।তোর বাসায় গিয়ে জানতে পারি চাচাজানের কথা। তার সাথে জানতে পারি এলাকার আশেপাশে লোকের কাছ থেকে আরো দুইবছর আগে চাচাজানের মৃতুর পর তোর চাচারা তাদের নামে সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নেন। তার পর তোদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন।এত কিছু ঝড়ঝাপটা তোর সাথে হয়ে গিয়েছে আমাকে একবারো জানানো প্রয়োজন মনে করলি না! আমি কি তোর কিছু লাগি না! না আমাকে কখনো আপনই ভাবিসনি! বল চুপ কেন?

_জানালে কি হত আসিফ! সব কি আর আদৌ আগের মত ঠিক হয়ে যেতো। উলটো কি হতো!তুই নিজের এতদিনের স্বপ্নের কথা ভুলে আমার জন্য দেশে সব কিছু ছেড়ে ছুটে এক মুহূর্তে চলে আসতি।যা আমি কোনো কালেই চাইনি।

_তো নিজের প্রান প্রিয় বন্ধুর থেকে কি নিজের স্বপ্ন বড় হয়ে গেলো রে শালা।
রেগে বললেন,

_তাইতো আমি তোকে কিছু জানাই নি।আমি জানতাম এসব কিছু তুই জানলে বাস্তবতা কিছু না চিন্তা করেই আমার কাছে চলে আসতে চাইতি।

_আমার কথা কি একবারো মনে পরেনি তোর?

_মনে কি আর না পরেছি প্রতিটি মুহূর্তেই মনে পরেছে।

-তাহলে আমার সাথে পরে যোগাযোগ করিসনি কেনো!

_সময় পাইনি রে কর্তব্য যে আমার উপর বড্ডো দিন দিন বেড়ে গিয়েছিলো। পরিবারের বড় ছেলে বলে কথা তার উপর নতুন অচেনা শহর, মা বোনের দায়িত্ব, অভাবের আহালের সংসারে দায়িত্ব,সেই সময় হাতে কোনো ভাল চাকরি ও ছিলো না। এত কিছুর মাঝে ভাবার জন্য তেমন সময় পাইনি।

_তাই বলে কি ত্রিশ বছরে মধ্যে একটি বারো আমার জন্য তোর কাছে সময় হয়ে উঠেনি!

_ঢাকা শহরে কোথাই বা খুঁজতাম তোকে বল!ঢাকা শহর তো সেই আর কম বড় কথা না। মেচের ঠিকানা ছাড়া তো আমার কাছে তোর বাসার কোনো ঠিকানাও ছিলো না।

_আচ্ছা যাহ্ মাফ করে দিলাম। এত গুলো বছর পর তোকে আজ নিজের কাছে পেয়েছি এটাই আমার কাছে অনেক।এভার আর কোথাও হারিয়ে যেতে দিবো না।

_আমিও না

এই বলে দুই বন্ধু একে উপরকে আবার ও জড়িয়ে ধরলেন।তাদের কথায় এতক্ষনে সবায় বুঝতে পারলো তাদের কান্নার আসল কারন।

.
অহনা,নাফিজ, নাভিলা এভার তাদের বাবাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সাথে নাভিলার ফুঁপি, মা, আবির ও পাশে এসে দাঁড়ালেন।
.

_এভার তোমাদের কান্নাকাটি থামাও তো আমাদের তো ভয় পায়িয়ে দিয়েছো। (অহনা)

.
অহনার কথায় আসিফ আর সাদাফ দুইজনেই হেসে দিলো।মেয়ে উদ্দেশ্য বলে উঠল,,

_মনে আছে অহনা আমি তোকে এক ফেরেস্তার কথা বলেছিলাম। মানুষরূপী আস্তা ফেরেস্তা।যে ফেরেস্তা তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে শুধু আমার স্বপ্ন পূরন করার কথা ভেবেছে।নিজের কষ্টের জমানো টাকা দিয়ে আমাকে বাহিরে পড়াশুনা করতে পাঠিয়েছে।যাতে আমি আমার স্বপ্ন গুলো পূরন করতে পারি। আজ আমি এত সফলতা অর্জন করতে পেরেছি শুধু মাত্ররো তার জন্য। সে ফেরেস্তার আর কেউ নয় এইযে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু সাদাফ।

.

__ ভুল আমি মোটেও ফেরেস্তা নয়।

__আমার কাছে ফেরেস্তা থেকে কম ও নয়।যখন আমার কেউই ছিলো না তখন তুই ছিলিস আমার পাশে আমার পুক্ত ঢাল হয়ে।

বলেই আসিফ রহমান আবার ও সাদাফ হোসেইনকে জড়িয়ে ধরলেন।

.
অহনা চোখ দুইটো অসম্ভব পানিতে চিকচিক করছে।অটা কষ্টের পানি না অতি সম্মানের।ছোট থেকে তার বাবা থেকে সে শুনে এসেছে বাবার সেই হারিয়ে যাওয়া ভালো বন্ধর কথা।সেই যে তার বাবার জন্য কি কি ত্যাগ করেছে তা তার সবটাই জানা।অবশ্যই বাবাই তাকে তাদের বন্ধুত্ব গল্প শুনিয়েছে। একজন নির্সাথ্য বন্ধুত্ব আসলে কেমন হওয়া উচিৎ তা ও বাবা বন্ধুর কথা শুনে বুঝতে পেরেছে।আজকের দিনে রক্তের ভাই ভাইয়ের জন্য বিনার্সাথ্যে সামান্য কিছু করতে চায় না। আর সেই জায়গায় বন্ধ হয়ে তার বাবার জন্য কতোই না করেছেন। নিজের স্বপ্ন ও বির্সজন দিয়েছে তার বাবার স্বপ্নের জন্য। তার জমানোর ব্যবসার টাকা দিয়ে বাবাকে বিদেশ পাঠিয়েছে যাতে বাবা কিছু করতে পারে। এমন নির্সাথ্য মানুষ আদৌ হয়! হয়তো হয় না হলে আজ তাকে দেখতে পেতো না।অহনা এগিয়ে গিয়ে সাদাফের দুই পা দুইটো ধরে সালাম করলেন।এটা ও সব সময়ই করে যখন সাদাফের সাথে তার দেখা হয়। কিন্তু আজকে সালামটা ছিলো অতি সম্মানের। সাদাফের অহনার মাথায় হাত ভুলিয়ে হাসলেন।

.
নাভিলা নাফিজকে হাতের ইশারায় সাদাফ তার পাশে আসতে বললেন। বাবার ডাকা নাভিলা আর নাফিজ বাবার সামনে হাসিমুখে গিয়ে দাঁড়ালেন।

_এই আমার বড় ছেলে নাফিজুর রহমান।

_বাবাহ বাব কা বেটা দেখি পুরো তোর কার্বন কপি।

“আসিফের কথায় সাদাফ নিঃশব্দ হাসলেন নাভিলার উদ্দেশ্য বলে উঠলেন”

_ওহ ফাতেমা জোহরা নাভিলা আমার ছোট মেয়ে যার জন্য আজ তোর সাথে দেখা হলো।

_আসসালামু আলাইকুম।

“আসিফ নাভিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বিষ্মত হয়ে বলে উঠলেন”

_এই তো দেখছি পুরোই আলেহা চাচিজান । চাচি জান গিয়ে তার মত আর এক চাচিজান রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য। সেই বাদামি চোখ, সরু নাক, ফোলা ফোলা গাল, লালছে কোঁকড়া চুল, টানা টানা চোখের তাকানো সব মিলিয়ে চাচির ছায়া।

_হ্যাঁ আমার আম্মা যে তাই। তা বিয়াইন সাহেবা আপনার ছেলে কই দেখছিনা যে? (সাদাফ)

_আর বলিস না নয়নটা হয়েছে এক্কেবারে নিরামিষ। বলে তোমরা গিয়ে দেখে আসো তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। এত করে বললাম সাথে আসার জন্য কিন্তু সে কিছুতেই আসতে চাইলো না।

_আচ্ছা তোমারা কি এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা আজ কথা বলবা ঠিক করেছ! বসতে বলবা না।(উম্মে)

_দেখছিস আমি তোকে বসতে বলতেই বুলে গিয়েছি। বস বস বসে কথা বল।

_অস্থির হওয়ার কোনো কারন নেই। শান্ত হও আমরা আমরাই তো।

_তোমরা কথা বলো আমি চা নিয়ে আসছি।(উম্মে)

____________________
অন্ধকার বারান্দা দাঁড়িয়ে আছে নাভিলা।চোখ দুইটো আকাশে তারা গুলোর মাঝে। আজ আকাশে মোস্ত বড় চাঁদ উঠেছে তার সাথে অনেক তারা ও উঠেছে।চারপাশে কি সুন্দর ঝিলমিল করছে তারাদের আনাগণায়। নাভিলার পাশে নাফিজ এসে নিঃশব্দে দাঁড়ালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,,,

_মন খারাপ!

_উঁহু।

_তাহলে চুপ কেন!

_আব্বু এই বিয়েতে অনেক খুশি তাইনা ভাইয়া!

_হ্যাঁ তা আর বলতে।

_তারা চলে গেছে!

_হ্যাঁ গিয়েছে। আম্মু অনেক করে বলল ডিনার করে যেতে কিন্তু তারা রাজি হয়নি। কালতো আবার আসবে তাই চলে গেলো।প্রিপারেশনের তো একটা ব্যাপার আছে।তাই চলে গেলেন।

_সব কিছু একটু বেশী তাড়াতাড়িতে হয়ে যাচ্ছে না রে ভাইয়া,,,,,

চলবে,,,,,