মুগ্ধতায় তুমি পর্ব-১৫

0
569

#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

কাল সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানোর ফলে আজ খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। জ্বর এখন নেই বললেই চলে। তাই ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ছাদের বাগানে হাঁটাহাঁটি করছি। আমার মনটা আজ খুব ভালো কিন্তু কারন আমার জানা নেই। দোলনায় বসে আছি হঠাৎ করেই শুভ্র ভাই কোথা থেকে ঝড়েরবেগে এসে আমার পাশে বসে পরলেন।

বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়ার পর শুভ্র ভাই হুট করেই আমার হাত নিয়ে ওনার পকেট থেকে একটা ব্রেসলেট বের করে আমার পরিয়ে দিলেন। আমার হাতটা ওনার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্ত গলায় বললেন-

— ” অনেক দিন ধরে আমার কাছে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম তোকে দিবো বলে। আজ সেই সময় এসে পরেছে তাই এটা এখন থেকে তুই যত্ন করে রেখবি। কখনো খুলবি না এটা, সব সময় পড়ে থাকবি।”

একথা বলে আমার হাতটা উঁচু করে ওনার ঠোঁট ছোয়ালেন। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। শুভ্র ভাই কি শুরু করছেন কাল থেকে!! আমাকে ইচ্ছে করেই বার বার লজ্জায় ফেলেন।

আচমকাই শুভ্র ভাই উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বললেন-

—” অনন্য তুই এখনও পিচ্চিই রয়ে গেলি এইটুকুতেই তুই লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছিস!!

ওনার কথায় আমার লজ্জার পরিমান যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমি কোনো রকম ওনার কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিচে চলে আসলাম। শুভ্র ভাইয়ের ঝংকার তোলা হাসি তখনও আমার কানে ভেসে আসছে।

———————

বাসা থেকে বের হতেই দেখলাম শুভ্র ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমাকে আসতে দেখেই মুচকি হাসলেন। আজ ওনার হাসিটা মারাত্মক রকমের সুন্দর লাগছে। উনি তো আগেও আমার সামনে হাসতেন তখন তো এমন লাগেনি। তাহলে আজ কেন ওনার হাসি আমার কাছে এমন অমায়িক লাগছে!!

আমি ওনার কাছে যেতেই উনি আমার দিকে ঝুকে কানে ফিসফিস করে বললেন-

—” অবশেষে এই মুগ্ধতার নজর পরলো তার মুগ্ধ প্রেমিকের উপর। যাক মুগ্ধ প্রেমিক এবার ধন্য হলো। তার মুগ্ধতায় নিজেকে পুড়ে ঝলসানোর ফল হিসেবে তার এইটুকু নজর কেড়েই যেন ধন্য এই মুগ্ধ প্রেমিক। ”

শুভ্র ভাইয়ের কথা আমি কিছুই বুঝলাম না তাই কনফিউজড হয়ে বললাম-

—” এসব কি কাব্যিক কথা বলছেন সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সহজ করে কথা বলতে পারেন না আপনি!! আর এইসব কি মুগ্ধ মুগ্ধ করেন!!”

শুভ্র ভাই আমার গালে হাল্কা এক টান দিয়ে বললেন-

—” থাক আপনাকে আর কষ্ট করে এসব বুঝতে হবে না। এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

——————

ভার্সিটিতে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামবো তখনই শুভ্র ভাই বললেন-

—” আজ নিতে আসবো প্রমিজ। আর কালের জন্য আবারও সরি অনন্য।”

—” সরি বলতে হবে না কাজ তো থাকতেই পারে। আর এমনিতেই আপনি এতো ব্যস্ততার মাঝেও আমার খেয়াল রাখেন তার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমি যাই মিমশি হয়তো অপেক্ষা কিরছে।”

শুভ্র ভাই খপ করে আমার হাত ধরে একটা শুভ্র রঙের গোলাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি গোলাপের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বললাম-

—” শুভ্র ভাই আপনি কি ম্যাজিক জানেন না-কি!! হুটহাট করে গোলাপ, ব্রেসলেট এইসব কখন আর কিভাবে আনেন??”

শুভ্র ভাই আমার নাক টান দিয়ে বললেন-

—” তোর এসব জানতে হবে না অনন্য।”

আমি আর কিছু না বলে চলে গেলাম মিমশির কাছে। মিমশি আমার হাতের গোলাপ আর ব্রেসলেটের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বেশ অবাক কন্ঠে বললো-

—”শুভ্র ভাই তোকে প্রপোজ করে ফেলেছে??”

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম-

—” নাহ তো… শুভ্র ভাই কেন আমাকে প্রপোজ করবে?”

—” কেন আবার শুভ্র ভাই তোকে ভালোবাসা তাই।”

আমার হাতের ব্রেসলেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবারও ভাবলেশহীন ভাবেই বললাম-

—” শুভ্র ভাই কি কখনো বলেছেন যে উনি আমাকে ভালোবাসে!! নাহ বলেনি তাহলে তুই কেন বলছিস এই কথা??”

মিমশি আমার কাধে হাত রেখে বললো-

—” আমার বলতে হবে না। আমি খুব ভালো করেই জানি শুভ্র ভাই কখনো ভালোবাসার কথা না বললেও তুই বেশ ভালো করেই ওনার ভালোবাসা অনুভব করতে পারছিস।”

আমি কিছু বললাম না একটা মুচকি হাসি দিয়ে মিমশির দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই হয়তো কখন আমাকে ভালোবাসি কথাটা বলেনি তবে ওনার প্রতিটা কাজের মধ্যেই আমি ভালোবাসা দেখতে পাই। শুভ্র ভাই যেমন সাংঘাতিক লোক তার ভালোবাসাও খুব সাংঘাতিক মুখে না বলেও যেন তার অসীম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে দেয়।

———————

এই তিনদিন শুভ্র ভাই আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। হুটহাট করেই লজ্জায় ফেলে দিতেন আমাকে। আর প্রতিদিন যেন সাদা গোলাপ দেওয়া তার নিয়মের মধ্যেই পরে গেছে। আর আমার কানে ফিসফিস করা কথা বলা যেন আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার প্ল্যান তার। তবে আজ একদিন হলো এইসব কিছুই যেন বড্ড মিস করছি। আজ দু’দিন হতে চলছে শুভ্র ভাই অফিসের কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গেছে। কবে আসবে কিছুই বলেনি এক বার ফোনে কথা হয়েছিল খুব অল্প সময়ের জন্য।

বাসায় এসে দরজা খোলা পেয়ে একটু অবাক হলাম দরজা তো কখন এভাবে খোলা থাকে না। ভিতরে যেতেই কিছু মানুষের গলার কন্ঠ শুনতে পেলাম। ড্রয়িংরুমের দিকে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। আহনাফ আর তার মা বসে আছে ড্রয়িংরুমে সোফায়। ওনারা এখানে কি করছে!!

দূর থেকেই তাদের কথা শুনছি। আম্মু বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলছে-

—” অনু তো এখনো ছোট তাই বিয়েটা কিছু দিন পরে দিবো আর অনু এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে আমাদের সবারই মতামত আছে।”

আম্মুর কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পারল। আমার বিয়ে!! কিন্তু কার সাথে??? আহনাফ!!! না না কি ভাবছি আমি এসব। আহনাফকে আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু আম্মু কি বললো আমার বিয়ে ঠিক….. আমি তো কিছুই জানি না এব্যাপারে।

আহনাফের আম্মু নিরাশ হয়ে বললেন-

—” আসলে আপা আমি অনেকটা আশা নিয়ে এসেছিলাম। আমি তো আর বেশি দিন বাঁচবো না তাই ভেবেছিলাম ছেলের পছন্দের মানুষের সাথে ওর বিয়ে টা নিজ দায়িত্বে দিয়ে যেন মরতে পারি। আহনাফ তো অনেক আগে থেকেই অনন্যা কে পছন্দ করে।”

আম্মু আহনাফের আম্মুর হাত ধরে বললেন-

—” এসব কি বলছেন আপা আপনি ঠিক মতো চিকিৎসা চালিয়ে যান। ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর অনুর বিয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম অনু বড় হলে তখন বিয়েটা দিব। তাই দুঃখিত আপনাদের কথা রাখতে পারছি না।”

আহনাফ আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকালেন। ওনাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আহনাফের আম্মু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন কিন্তু আম্মু রাজি না। আহনাফের সাথে বিয়ে না এটা ভেবে একটু স্বাভাবিক হতেই পরক্ষণেই মনে পরলো ওনার সবাই আমার বিয়ে অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছে। আমার বিয়ে ঠিক এটা ভেবেই আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো। একথা ভাবতেই কান্না আসছে বুকের ভেতর হাল্কা ব্যথা অনুভব করছি। চোখের সামনে শুধু শুভ্র ভাইয়ের চেহারা ভাসছে কিন্তু কেন জানি না। আমি হয়তো ওনাকে আমার মনে জায়গায় দিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই কিন্তু অন্য কারও সাথে বিয়ে এটা আমি কীভাবে মেনে নিব!!

রুমে এসে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরলাম। সন্ধ্যার পর ঘুম ভাঙলো ফ্রেশ হয়ে ছাদে চলে গেলাম। আজ কারও সাথে কথা বলিনি। সবাই কিভাবে পারলো আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলতে!!

আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎই আমার মাথায় কারও হালকা থাপ্পড় দেওয়াতে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে দেখেই আমার বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়ে গেল।

শুভ্র ভাই আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

—” অনন্য কি হয়েছে তোর? চোখে মুখের এই অবস্থা কেন?? কান্না করেছিস!!”

আমি নিজেকে কোনো রকম সামলিয়ে বললাম-

—” আহনাফ ওনার আম্মু নিয়ে বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন।”

শুভ্র ভাই শক্ত গলায় বললেন-

—” তারপর কি হয়েছে বল।”

—” আম্মু ওনাদেরকে বললেন আমার বিয়ে না-কি আগে থেকেই অন্য কারও সাথে ঠিক করে রেখেছেন।”

শুভ্র ভাই কিছুটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন-

—” তো এভাবে কান্না করার কি আছে। বিয়ে ঠিক করে রেখেছে এটা তো ভালো কথা।”

শুভ্র ভাই একটু চুপ থেকে আবার বললেন-

—” তুই কি আহনাফকে এখনো ভালোবাসিস!! ওর সাথে বিয়ে হবে না বলেই কি কান্না করছিস অনন্য?”

এবার আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না দোলনায় বসেই কান্না শুরু করে দিলাম। কান্না করতে করতে শুভ্র ভাইকে বললাম-

—” আমি অন্য কাওকে বিয়ে করবো না শুভ্র ভাই। আপনি কিছু একটা করুন।”

শুভ্র ভাই কিছু না বলে গম্ভীরমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

চলবে……