মেঘবিলাসী পর্ব-১৩+১৪

0
534

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_13

পড়ন্ত বিকেলে এই শহরের কোলাহল কমেনা,বরং বাড়তে থাকে।নিজের ডেস্ককে বসে কফি খাচ্ছে জিসান। এসির নিচে বসা সত্বেও কপালে বার বার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে। জিসান কে দেখে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। সেই ড্রাগ ডিলারের অনেক ইনফরমেশনই সে জমা করে ফেলেছে। এখন শুধু তাকে হাতেনাতে ধরার পালা। এমন সময় জিসানের ফোনে একটা কল আসলো। কল রিসিভ করার পর থেকে খুব চিন্তিত দেখালো তাকে। সে দ্রুত তার পুরো টিম নিয়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে।
গাড়িতে বসেই রিয়াজ বললো

-“জিসান ইনফরমেশন টা কি 100% সঠিক?”

-“জি,রিয়াজ ভাই। ওই ড্রাগ ডিলার শপিং কমপ্লেক্সের পার্কিং এরিয়াতে থাকবে। আমি ওর জন্য যেই ফাঁদ পেতেছি তাতে তাকে ধরা দিতেই হবে।”

-“তোর ঠিক করা লোকের কাছে ড্রাগ সাপ্লাই করতে ফাহিম আসবে তো? নাকি আবার অন্য কাউকে পাঠায়?”

-টেনশন নিবেন না ভাই, ওই ব্যাটা ফাহিমই আসবে।

শপিংমলে পৌছেই তারা সকলে তাদের পজিশন নিয়ে নিলো। জিসানের ঠিক করার লোক পার্কিংয়ের একটা পাশেই অপেক্ষা করছে ফাহিম নামক লোকটির জন্য। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো জিসান। একটা মধ্য বয়সি ছেলে কাধে ব্যাগ নিয়ে এ দিকে এগিয়ে আসছে। আড়ালে থেকে একটু উঁকি দিয়ে দেখল ছেলেটা ফাহিম।জিসান তার পুরো টিমকে এলার্ট করলো।

ফাহিম ছেলেটা এসে জিসানের ঠিক করা ছেলেটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। একসময় সে ব্যাগ থেকে ড্রাগস এর প্যাকেট বের করলো। ঠিক সেই সময় রিয়াজ সকলকে অ্যাটক করার নির্দেশ দিলো। এই আকস্মিক ঘটনায় ফাহিম কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে নিজেকে স্যারেন্ডার করলো। সবকিছু সুন্দরভাবে সমাধান হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তাদের উপর অ্যাটাক করে। জিসানের আর বুঝতে বাকি রইল না যে ফাহিম একা আসেনি।

আকর্ষিক হামলায় জিসানের টিমের ফয়সাল গুরুতর আহত হলো। সেই সময় ফাহিম তার থেকে এটা রিভলবার বের করে অ্যাটাক শুরু করলো। দুই পক্ষ থেকে গোলাগুলি শুরু হলো। জিসানের না চাইতেও ফাহিম এবং অপর লোকটির ইনকাউনটার করতে হলো। ফ্লোরে তিনটা দেহ পরে আছে। এর মধ্যে একজন হচ্ছে ফয়সাল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস এখনো চলছে। ফ্লোরের চারিদিকে রক্তের বন্যা বইয়ে গেছে। কিছু রক্তের ফোঁটা জিসানের মুখে লেগে আছে।

জিসানের হঠাৎ মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে। পেছনে তাকিয়ে সে হতভম্ব হয়ে গেলো। এই সময় তিন্নিকে সে মোটেও আশা করেনি। তিন্নির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। জিসানের এই রূপটা সে তিন্নির সামনে আনতে চাইনি। জিসান দ্রুতই তিন্নির দিকে এগিয়ে গেলো। তিন্নির সামনে পৌঁছানোর আগেই সে সেন্সলেস হয়ে নিচে পড়ে গেলো।

জিসান দ্রুতই তিন্নির মাথাটা কোলে তুলে নিলো। এভাবে পড়ে যাওয়ায় তার মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছেন সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

নিজের প্রিয়সিণীর এই করুণ অবস্থা তার প্রেমিক মনকে ক্ষতবিক্ষত করছে।পুরো পৃথিবীতে এই মানুষটাই তার সবচাইতে আপন। কেমন দম বন্ধ করা একটা অনুভূতি। জিসান পাগলের মত তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
তিন্নিকে এই পরিস্থিতিতে দেখে রিয়াজ অনেকটা অবাক হলো। আরও অবাক হলো জিসানের অবস্থা দেখে। ছেলেটা কেমন পাগলের মত আচরণ করছে। তাদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে কঠোর ছেলেটার এমন বাচ্চা সুলভ আচরণএ সে অবাক না হয়ে পারলো না। ফয়সালকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে রিয়াজ জিসানের দিকে এগিয়ে আসলো। আর বললো

-“জিসান পাগলামি করিস না। তিন্নি জাস্ট ভয়ে সেন্সলেস হয়েছে। ওকে বাসায় নিয়ে যা। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি।”

-“রিয়াজ ভাই,ও ঠিক আছে তো?”

-“হ্যাঁ ঠিক আছে, তুই চিন্তা করিস না।”

জিসান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো।
মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে তিন্নির। মনে হয় হালকা ব্যথা করছে। তিন্নি পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করলো। চারদিক কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে। জোরপূর্বক সে চোখ মেলে তাকালো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সে অনেকটা অবাক হলো আর ভাবলো “হায় আল্লাহ!! কোথায় আমি?”
পরমুহুর্তেই তার মনে পড়লো জিসানের সেই বীভৎস চেহারার কথা। সেই রক্তমাখা দেহ গুলোর কথা মনে পড়লো। একটা মানুষ কতটা পাষণ্ড হলে এভাবে অন্যকে খুন করতে পারে। এসব ভাবতে যেয়ে তিন্নির মাথা প্রচন্ড ব্যথা হতে শুরু করলো। মাথায় হাত রাখতেই বুঝতে পারলো তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা।

এমন সময় রুমের দরজা ঠেলে কেউ একজন প্রবেশ করলো। জিসান প্রবেশ করেছে রুমে আর তার হাতে একটা ট্রে। জিসান কে দেখে সে বুঝতে পারলো সে এখন জিসানের বাসায় আছে।

তিন্নিকে জিসান নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলো। তিন্নিদের বাসায় গেলে এই মুহূর্তে তাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। তাছাড়া তিন্নির বাবা-মা অনেক টেনশনে পড়ে যেত। তিন্নিকে বাসায় এনে সে সবার আগে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল তার মাথায়।
জিসানের স্বপ্ন ছিল তিন্নিকে তাঁর বাসায় নিয়ে আসার। তবে এভাবে সে কখনোই কল্পনা করেনি।
জিসান দ্রুত তিন্নির পাশে বসলো। জিসানকে তার পাশে বসতে দেখেই তিন্নি কিছুটা পিছিয়ে গেলো। তিন্নির এই মুহূর্তে প্রচন্ড ভয় লাগছে স্বামী নামক মানুষটিকে। জিসানের রক্তমাখা চেহারাটা মনে পড়তেই তিন্নির গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। একরাশ ঘৃণা নিয়ে সে জিসানের দিকে তাকালো।
জিসান তিন্নির হাত ধরে বললো

“তুমি ঠিক আছো? মাথায় কি খুব বেশি ব্যথা করছে?”

তিন্নি কিছুই বলল না। সে দ্রুত জিসানের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো।
জিসান তিন্নির দিকে তাকালো। আচ্ছা তিন্নি কি তাকে ভয় পাচ্ছে?সেতো কিছুতেই চায় না তার হৃদয়হরিণী তাকে ভয় পায়। সেতো চায় তিন্নি তাকে ভালোবাসুক।

জিসান আবার তিন্নির হাত ধরে বললো

“তুমি কি ভয় পাচ্ছ?তিন্নি ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সব ঠিক আছে।”

তিন্নি যেন এবার ভয়ের মাঝেই ক্রোধে ফেটে পড়লো। সে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো

“সব ঠিক আছে মানে? কিচ্ছু ঠিক নেই। আপনি কি মানুষ? কিভাবে পারলেন একজন মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে? আপনাদের হাতে বন্দুক আছে বলে যা খুশি তাই করবেন। মানুষ কে আপনারা মানুষ বলে মনে করেন না। আপনাদের মত কিছু মানুষের জন্যই চারিদিকে এত আহাজারী। আসলে এই দেশে আইন বলতে কিছুই নেই। টাকার পেছনে আপনার সবাই বিক্রি হয়ে যান। আপনার কাছে তো মানুষের জীবনের কোনো মূল্যই নেই। আপনি আসলে একটা জানোয়ার।”

তিন্নির কথা শুনে জিসান স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে ভাবতেও পারেনি তিন্নি তাকে এসব কথা বলবে। তাকে এতোটা খারাপ ভাববে।

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_14

এতগুলো কথা বলে তিন্নি আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিলো। তার গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খেতে পারলে মনে হয় ভালো লাগতো। স্তব্ধতা কাটিয়ে জিসান তিন্নির দিকে একটা পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলো। আর বললো

“তিন্নি প্লিজ তুমি আগে শান্ত হও। নাও পানি টুকু খেয়ে নাও।”

তিন্নি যেন এবার আরো রেগে ফেটে পড়ছে। এমন কাজ করে কিভাবে একটা মানুষ এতো শান্ত থাকতে পারে? অথচ এই লোকটাই তার স্বামী! ছি!
তিন্নি গ্লাসটা এক ধাক্কায় ফেলে দিলো। আর বলতে শুরু করলো “আপনি ভাবলেন কিভাবে আপনার মত মানুষের হাতে আমি পানি খাবো? এই হাত দিয়ে না জানি আপনি কত মানুষের রক্ত ঝরিয়েছেন।”

জিসানের মনে হচ্ছে কেউ তার ভেতরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে। তার হৃদয় হরণকারী নারীসত্তা টি তার দিকে কেমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা তিন্নি তাকে এতোটা ভুল বুঝে কেন? সে তিন্নির এই কঠিন দৃষ্টি সহ্য করতে পারছে না। এই মানুষটার চোখে তো সে শুধু ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিলো।

জিসান নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। হঠাৎ সে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরলো।ইসস!! ভালোবাসার মানুষকে এভাবে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে কেমন যেন শান্তি অনুভব হয়।
জিসান তিন্নিকে বলতে শুরু করলো
“তিন্নি তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। একটাবার পরিস্থিতিটাকে বোঝার চেষ্টা করো।”

হঠাৎ জিসানের এভাবে জড়িয়ে ধরায় তিন্নি হতভম্ব হয়ে গেলো। তিন্নি জিসানকে এক ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। আর বললো
“আপনি প্লিজ আমার কাছে আসবেন না। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আমি বাসায় যাব।”

কথাটা বলেই সে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।
পরিস্থিতিটাকে কিভাবে সামাল দেবে জিসান ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তিনি এই মুহূর্তে প্রচন্ড রেগে আছে। সে এই মুহূর্তে কিছুই বুঝবে না। তাই সে তিন্নিকে বললো “তুমি এমনিতেই মাথায় ব্যথা পেয়েছ। প্লিজ এত উত্তেজিত হাওয়া তোমার জন্য ঠিক হবে না। আমি তোমাকে বাসায় পৌছে দেবো।”
তিন্নি চিৎকার করে বললো
“আপনাকে আমি এই মুহূর্তে একদম সহ্য করতে পারছিনা। আমি একাই যেতে পারবো।”
কথাটা বলে তিন্নি আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। সে জিসানের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আসলো।

তিন্নির যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিসান। মানুষটা তাকে এভাবে ভুল বুঝে চলে গেলো। জিসান ধপ করে খাটে বসে পড়লো। সবকিছু কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছে তার কাছে। তিন্নিকে কিভাবে সেই পরিস্থিতি এক্সপ্লেইন করবে সে বুঝতে পারছে না।

দুই হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো কে টেনে ধরলো সে। তার সাথে দু ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পরলো।

অবণী রহমান ড্রইংরুমে পায়চারি করছে। রাত দশটা বেজে গেল অথচ এখনও তিন্নি বাসায় পৌঁছলো না। পাশের একটা সোফায় বসে আছেন আনিসুর রহমান। এই মুহূর্তে তারও কিছুটা চিন্তা হচ্ছে। বারবার কল করে যাচ্ছে তিন্নিকে কিন্তু সে কল রিসিভ করছে না।

হঠাৎ বাসার ডোর বেলটা বেজে উঠলো। অবনী রহমান দ্রুত দরজা খুলে দিলেন। তিন্নির দিকে তাকিয়ে অনেকটা আঁতকে উঠলেন। তিনি অস্থির হয়ে বলে উঠলেন “তোর মাথায় কি হয়েছে, ব্যান্ডেজ কেন?

তিন্নির মায়ের কথা শুনে আনিসুর রহমান এগিয়ে আসলেন। তিন্নি তার বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। তিন্নি বাবা আর কোন কথা না বলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আনিসুর রহমান তার স্ত্রীকে শান্ত হতে বলেন। আর তিন্নিকে আগে ফ্রেশ হতে বললেন।

শাওয়ারের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি। কপালের ব্যান্ডেজ টা ভিজে হালকা রক্ত পড়ছে। তিন্নি কিছুতেই সে দৃশ্যটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।জিসানকে খুব শান্ত বলেই জানত সে। কিন্তু এই মানুষটা এত হিংস্র হতে পারে সেটা সে জানতো না।
তিন্নি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো তার ফোনটা অনবরত বেজে চলছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো জিসান কল করছে। তিন্নি কলটা কেটে ফোনটা বন্ধ করে ফেললো। এই মুহূর্তে সে জিসানের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। তার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তার এখন ঘুমের প্রয়োজন।

জীবনে সুখের মুহূর্তগুলো এতো ক্ষণস্থায়ী হয় কেন?
অনেকগুলো বছর পর একটু সুখের অনুভূতিগুলো পেয়েছিলো জিসান। হঠাৎই মনে হচ্ছে ঝড়ো হাওয়ায় সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। নিজে অর্ধাঙ্গিনীর চোখে যে ঘৃণা দেখেছে সে তা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। তিন্নি তো যথেষ্ট ম্যাচিওর একটা মেয়ে। তাহলে কেন সে বিষয়টা বুঝতে পারছে না।

বুক ফেটে কান্না আসছে তার। মায়ের মৃত্যুর পর সে নিজেকে অনেক স্ট্রং করে নিয়েছিলো। কারন সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে কঠোর হতে হবে। তার প্রফেশনে ও সে একজন স্ট্রিক অফিসার। তবে তিন্নির সামনে সে কখনোই তার কঠোরতা ধরে রাখতে পারেনি। এই জায়গাটায় এসে সে কোমল হৃদয়ের মানুষ হয়ে যায়। তিন্নির ব্যক্তিত্বের সামনে সে কখনো কঠোরতা দেখাতে পারেনি।

অনেকেই বলে সংসারে একজন গরম হলে অন্যজনকে হতে হয় নরম। তিন্নির ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়ে সে বুঝে গিয়েছিল তাকে নরম হওয়ার জায়গাটা নিতে হবে।
তার মেঘলা আকাশে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছিল তিন্নি। কেমন সুখ সুখ অনুভুতি হতো তার। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো লাগছে।

দুটো দিন কেটে গেলো। এরমধ্যে তিন্নিকে আর কেউ কোনো প্রশ্ন করে নি। আনিসুর রহমান ও আর কিছু ঘাটায় নি। কারণ তিনি জানেন কিছু বলার হলে তিন্নি নিজেই তার কাছে বলতো। যেহেতু তিন্নি নিজে থেকে কিছু বলেনি তার মানে সে কাউকে সেটা বলতে চায় না। আর আনিসুর রহমান ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি বরাবরই তার সন্তানদের স্বাধীনতা দিয়ে এসেছেন।

বিকেলের দিকে তিনি সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। এমন সময় বাসার ডোর বেল বেজে উঠলো। বিরক্ত নিয়ে সে দরজা খুলতে গেলো। কিন্তু সামনের মানুষটাকে দেখে সে বেশ অবাক হলো।

তিন্নির রুমটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো সূচনা। তিন্নি যে বেশ গোছানো মেয়ে তা রুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সূচনা মুচকি হেসে তিন্নিকে তার পাশে বসলো। সূচনা বলতে লাগলো
“আমাকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছো তাই না?

তিনি মুচকি হেসে বললো

“না তেমন কিছু না। বরং আপনাকে দেখে আমার খুব ভাল লাগছে।”

-“জানো তিন্নি একজন এসিপির ওয়াইফ হওয়া অনেক টাফ। কারণ তারা টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকে। সাধারন মানুষগুলো যেনো আরাম করে রাতে ঘুমাতে পারে, রাস্তায় যাতে মানুষজন স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরা ব্যস্ত থাকে। জানো এমন অনেক রাত যায় বাসায় আসছি আসছি বলেও আসতে পারে না। কারন সবার আগেই তাদের ডিউটি বড়। তুমি ঠিকই বলো ওদের হাতে অনেকেরই রক্ত লেগে আছে। কিন্তু কাদের রক্ত লেগে আছে জানো? যারা এই সমাজকে কলুষিত করে। যারা অন্যায় ভাবে মানুষের রক্ত ঝরায়। মানুষরূপী অমানুষ গুলো কে দমন না করলে সমাজটা বিষাক্ত হয়ে যাবে। এই অমানুষগুলোর রক্তই যদি জিসানের মত ছেলেদের হাতে লেগে যায় তাহলে অন্যায় কোথায়?

আমি অনেকবারই রিয়াজকে দেখেছি বিভিন্ন আঘাত নিয়ে রক্তাক্ত হয়ে বাসায় ফিরতো। দু-দুবার তার গায়ে গুলি লেগেছিলো। মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এসেছে সে। প্রথম প্রথম আমিও অনেক ভয় পেতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। একজন এসিপির ওয়াইফ হয়ে যদি নিজেকে সামলাতে না পারি তাহলে তো তার ওয়াইফ হওয়ার যোগ্যতাই রাখি না।

ঐদিন জিসান যাঁকে গুলি করেছিলো, সে একজন মার্ডারার। আবার ড্রাগ সাপ্লাইয়ার। ওই লোকটার জন্য কত ছেলে মেয়ে ড্রাগ এর নেশায় তলিয়ে গেছে জানো?
ঐদিন অবশ্য তারা তাকে মারতে চাই নি। বরং এই লোকটাই আগে জিসান দের উপর গুলি করেছে। সেই জায়গায় যে রক্তাক্ত দেহ গুলো দেখেছ, তার মধ্যে একটা ছেলে ছিল জিসানদের টিমের। ওদের প্রফেশনে এমন সিচুয়েশন অনেকবারই আসে।
তোমার তো তোমার স্বামী ওপর প্রাউড হওয়া উচিত। সেতো সমাজের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। কয়জন পারে এমন করতে।

ছেলেটাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছ তুমি। জানো কতগুলি বছর পর ছেলেটাকে আমি এতটা হ্যাপি থাকতে দেখেছি। সে তোমার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল।আর এটা তুমিও খুব ভালো করে জানো। তুমি যদি তাকে সাপোর্ট না করতে পারো এটা তোমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে।

একজন এসিপির ওয়াইফ তুমি। তুমি কি অনেক কঠিন হতে হবে। এত বিপদের মধ্যে কাজ করে ওরা। দিন শেষে আপন মানুষগুলো কাছ থেকে একটু সাপোর্ট আশা করে ওরা।
যে ছেলেটা এই কয়েক বছরে একদিন অফিস বন্ধ দেয়নি, সেই ছেলেটা আজ দুই দিন ধরে অফিসে আসছে না। নিজেকে বাসার ভিতরে বন্দী করে ফেলেছে। এই পর্যন্ত পৌঁছাতে এই ছেলেটাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ওর কোন পরিবার ছিল না না ছিল কারো সাপোর্ট।

অনেক কথা বলে ফেলেছি তোমাকে। আমার কোন কথায় খারাপ লাগলে প্লীজ বড় বোন হিসেবে মাফ করে দিও।

শরীরটা কেমন অসার মনে হচ্ছে তিন্নির। তার হার্টবিট টা কেমন অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। কোথাও মনে হয় চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। সে তখন স্তব্ধ হয়ে সূচনার কথাগুলো শুনছিলো। তার মত একটা বুদ্ধিমতি মেয়ে কেন এই বিষয়গুলো বুঝতে পারল না। মানুষটাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। সে তো কখনই এমন ছিলনা। কত কিছুই না বলে এসেছে সেই লোকটাকে। ওর দুচোখে অশ্রু জমা হলো।
তিন্নির অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে সূচনা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অতি সুন্দরী মেয়েদের চোখে কি আর জল মানায়?
সূচনা তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“আরে বোকা মেয়ে কাঁদছে কেন? তোমাকে এভাবে দেখে কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগছে না। জিসান যদি জানতে পারে আমি তার অতি সুন্দরী বউকে এত কথা বলেছি আর কান্না করিয়েছি তাহলে কিন্তু আমার খবর করে ছাড়বে। এমনিই বউ পাগল মানুষ সে।”

তিন্নি এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। আর বললো
-“আপু আসলে আমি বিষয়টা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”
-“আমি জানি। তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।