মেঘবৃত্ত পর্ব-০২

0
645

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” মেঘ, চল বিয়ে করে ফেলি! ”
মেঘার কর্ণগহ্বরে কথাটা বিষের জ্বালার ন্যায় প্রবেশ করলো। মেঘা চেঁতে উঠলো। ঝাঁজ দেখিয়ে বললো,
— ” পাগল হয়ে গেছিস? বিয়ে মানে কি সেটা আদৌ তুই বুঝিস? সারাজীবন যে ছেলে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, সেই ছেলের মুখে বিয়ে শব্দ আদৌ মানায়? ”
বৃত্ত অস্থির হয়ে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। এখানে সবাই ব্যস্ত। কারো কাছে এক বিন্দু ফুরসত নেই, অন্যের কাজে মাথা ঘামানোর। বৃত্ত হঠাৎ ধাম করে বসে পড়লো এক বেঞ্চে। মাথা নিচু করে হাতে কপাল ঠেকালো। তবে, মেঘা দাঁড়িয়েই আছে। সে চোখ সরু করে বৃত্তের একেকটা গতিবিধি লক্ষ্য করছে।আজ এক অস্থির বৃত্তকে লক্ষ্য করলো মেঘা। একমাত্র পরীক্ষার আগের রাতে বৃত্তের এমন অস্থিরতা দেখা যায়। আর বাকিটা সময়? বৃত্ত এক প্রাণোচ্ছল ছেলে।
বৃত্ত প্রায়ই বলে, ” আমাদের জীবন একটাই। এই একজীবনে আফসোস নিয়ে মরতে নেই। জীবনটাকে যতোটা পারো, উপভোগ করো। যেনো মরার আগে এই ভেবে মরতে পারো, বাহ! কি জিন্দেগি ছিল ইয়ার! মাজা আ গায়া। ‘
বৃত্তের এই কথার সাথে তার কাজের মিল বেশ। সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, এখানে-সেখানে ট্যুরে যাওয়া, রাত করে বাড়ি ফেরা, এসবই বৃত্তের দৈনন্দিন কাজ।দায়িত্ব বলতে একটা শব্দ আছে,সেটা বৃত্তের জানার বাইরে। হঠাৎ করে, পুরনো কথা মনে পড়ায় মেঘা খানিক আবেগপ্রবন হয়ে উঠলো। কিন্তু, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ে রইলো বৃত্তের পানে।
একটাসময় বৃত্ত মাথা তুললো। নিজের দুহাতে সম্পূর্ণ মুখ ঘষলো। মুখ ঘষার কারণে বৃত্তের ফর্সা মুখ ঈষৎ লাল বর্ণ ধারণ করলো। বৃত্ত নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মেঘার দিকে চেয়ে বললো
— ” দেখ মেঘ! আমি চাইনা, আমার জন্যে তোর গায়ে কলঙ্ক লেপ্টাক। তুই খুব ভালো একটা মেয়ে। এসব কলঙ্ক-ফলন্ক তোর জন্যে নয়।তাই আমার মনে হয়, বিয়ে ইজ দ্যা বেস্ট অপশন। তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস?

মেঘা কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথা চক্কর দিচ্ছে তার। বৃত্ত মানুষ হিসেবে খুব ভালো। আর বন্ধু হিসেবে অবলীলায় তাকে সর্বোচ্চ ভালো মানুষের কাতারে ফেলা যায়। কিন্তু স্বামী হিসেবে? এক্ষেত্রে, বৃত্ত বেশ কাঁচা। একজন স্বামীর দায়িত্ব পালন করা বৃত্তের দ্বারা যে সম্ভব না, সেটা মেঘার চেয়ে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না। বৃত্তের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে চলন মেঘার। বৃত্তকে ভালো করে সে চিনবে না তো কে চিনবে? মেঘা অস্থির পায়ে বসে পড়লো বৃত্তের পাশে। দুহাত দিয়ে বেঞ্চে ঠেস দিয়ে বসলো ও। স্যান্ডেল পরিহিত পায়ের দিকে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না তার। মাথাটা মনে হচ্ছে, ব্যাথায় ফেঁটে যাচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা মনে হয় আবারও মাথা চাড়া দিতে চাচ্ছে। বাসায় গিয়ে টাফনিল খেতে হবে একটা। মেঘা দুহাত দিয়ে মাথা শক্ত করে চেপে ধরলো।
তবে, এটা সত্য যে, বৃত্তের প্রতি মেঘার ফিলিংস আছে। তবে, সেটা ভালোবাসার কিনা সেটা সে জানে না। আসলে,
‘ কোনো কিছু জানার জন্যে তার প্রয়োজনীয়তা থাকতে
হয়। ‘
মেঘার ক্ষেত্রে সেই প্রয়োজনটা কখনোই হয়নি। তাই, নিজের এই দুর্লভ ফিলিংসের কারণ, কিন্তু, কেনো কিছুই জানে না সে। মেঘা কিছুক্ষন পর ধরা গলায় ডাক দিলো,
— ” বৃত্ত? ”
বৃত্ত মাথা নিচু করে অস্ফুটসুরে জবাব দিলো,
— ” হু? ”
— ” আমরা বেস্ট ফ্রেন্ডই ঠিক ছিলাম রে। এসব বিয়ে, দায়িত্ব আমাদের দুজনের মধ্যে একদমেই মানায় না। তোর রাস্তা আমার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এককথায়, আমরা বিপরীতধর্মী। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না আমি। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ”
বৃত্ত মাথা তুলে পাশে তাকালো। মেঘার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। সেই জল চিবুক পেরিয়ে গলায় এসে ঠেকছে। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে মেঘার কোলে। মেঘার এমন করে কান্না দেখে বৃত্তের ভারী কষ্ট হলো। সে ভুলে গেলো তার অস্তিত্ব। ভুলে গেলো, সব বাউন্ডুলে আচরণ। খুবই আচমকা সে মেঘার হাত ধরলো। নিজের পুরুষালি হাতে মুষ্টিবদ্ধ করলো মেঘার নরম তুলতুলে হাত। তবে, মেঘা এখনো তাকায় নি বৃত্তের দিকে। বৃত্ত তুলোর চেয়েও নরম কণ্ঠে সুধালো,
— ” এই,মেঘ? একবার তাকা আমার দিকে। ”
মেঘা তাকালো। বৃত্ত বুঝালো মেঘাকে,
— “দেখ, আমি আজ পর্যন্ত একটাও প্রেম করিনি। শালার লাইফে কোনো মেয়েই আমার পছন্দ হয়নি। প্রেম তো দূরের কথা। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতেও আমি কোনো মেয়েকে ভালোবাসবো না। বাকি রইলো, বাউন্ডুলে আচরন। দেখ মেঘা, তুই আমার বউ হয়ে থাকলে খুব একটা সমস্যা হবে না।আগের মতই, আমরা ফ্রেন্ড হিসেবে থাকবো। ভার্সিটি যাবো, ঘুরবো, ফিরবো। সব আগের মতোই। শুধু পার্থক্যটা হলো, আগে তুই তোর বাসায় থাকতি। এখন তুই আমার বাসায় থাকবি। ব্যাস। এটুকুই। তাহলে, বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? বল? ”
মেঘা চোখ সরালো। তাকালো, অন্যপাশে। বৃত্তের থেকে
নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— ” তুই যত সহজ ভাবছিস বিষয়টা ততটা সহজ না, বৃত্ত। ”
— ” তুই ইচ্ছে করেই বিষয়টা জটিল বানাচ্ছিস, মেঘ। ”
বৃত্তর কণ্ঠে এবার রাগ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। মেঘা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেই নিঃশ্বাসে ভারী হলো আশপাশ। মেঘা গম্ভীর গলায় বললো,
— ” তুই যেটা ভালো মনে করিস। ”
— ” তার মানে তুই রাজি? ”
বৃত্তর চোখ চকচক করলো। মেঘা দাঁড়িয়ে গেলো। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— ” আমি এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আমার মতামতের চেয়ে বেশি ভাগ্যের মতামতের জোর বেশি। আমি তো শুধু ভাগ্যের হাতের এক পুতুল মাত্র। ”

মেঘা চলে গেলো। ওই তো, দূরে দেখা যাচ্ছে, মেঘার
রিকশা। রিকশার বাইরে দোদুল্যমান, মেঘার শুভ রঙের ওড়না। বৃত্ত সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। কপালের লেপ্টে থাকা ঘন চুলগুলো হাত দিয়ে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন আবার বিয়ের জন্যে মা’কে রাজি করাও। মেঘাকে রাজি করানো ছিলো এক যুদ্ধ। এখন মাকে রাজি করানো হলো এক ভয়ঙ্কর মহাযুদ্ধ।
_______________________________
— ” মা? ”
রান্নাঘরে বৃত্তের মা, ফাহিমা কাজ করছেন। আজ বাসায় মেহমান আসছে। নিজের ভাইয়ের পুরো পরিবার আসার সুবাদে মজাদার খাবার রান্নার ঘ্রাণে ঘর একদম মৌ-মৌ করছে। বৃত্ত সে কখন থেকে মায়ের পিছু পিছু ঘুরঘুর করছে। বিয়ের কথাটা বলবে,বলবে করেও শেষ পর্যন্ত বলা হচ্ছে না। কথাটা বলবেও বা কি করে? সে মাত্র অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। চাকরি-বাকরি করতে এখনো ঢের দেরি। এই বয়সে বিয়ের কথা তোলা মানেই নিজের মান-সম্মান নিজেই খোয়ানো। কিন্তু, বৃত্ত নিরুপায়। বলতেই হবে তাকে। বৃত্ত এবার রান্নাঘরের দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাকে দুবার ডাক দিয়েছে। মায়ের পক্ষ থেকে জবাব পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে পুনরায় চুপ হয়ে থেকেছে। গলাটায় বড্ড জ্বালা করছে। আর করবেই না কেনো? এত কথা গলার মাঝখানে দলা পাকাচ্ছে যে! বৃত্ত দু ঢোক গিলে আবারও ডাক দিলো,
— ” ও, মা? ”
বৃত্তের মা এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। খুন্তি হাতে বৃত্তের দিকে ফিরে তেতে উঠা কণ্ঠ নিয়ে বললেন,
— ” তুই যাবি এখান থেকে? কিছু বলতে হলে বল, নাহলে এখান থেকে বিদায় হ। আমার অনেক কাজ আছে। ”
মা জননী রেগে গেছেন। মাকে আর ঘাটানো ঠিক হবে না। তাই, বৃত্ত এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ” মা, মেঘা…! ”
বৃত্তের কথা ফুরাবার আগেই বৃত্তের মা বলে উঠলেন,
— ” মেঘাকে আসতে বলিস তো আজকে। মেহমানের জন্যে ভালো খাবার রান্না হচ্ছে। খেয়ে যাবে নে। ”
বৃত্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। নাহ, এখন বিয়ের কথা বলার মোক্ষম সময় না। একটা নিরিবিলি পরিবেশে কথাটা তুলতে হবে ওর। বৃত্ত রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

#চলবে।