মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০২

0
171

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-২

“তিতুন কত বড় হয়েছে দুপুর?”
আমি চমকে উঠি। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। তুতলে উঠে বলি-“মমমমমানে? কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না আমি।”
উনি নিষ্ঠুরের মতো চটুল হাসি দিলো-“তুমি সব বুঝতে পারছ দুপুর। কি ভেবেছিলে কেউ কোনদিন জানতে পারবেনা তিতুনের কথা?”
আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। এসব কি বলছে মানুষটা? আমি কম্পিত কন্ঠে বলি-“কি জানাজানির কথা বলছেন বুঝতে পারছি না আসলে। আপনি কেন এসেছেন আমার কাছে বলুন তো?”
তিনি গম্ভীর হয়ে গমগমে কন্ঠে উত্তর দিলো-“কেন এসেছি সে কথা ধীরে ধীরে জেনে যাবে দুপুর। এতটুকু মনে রেখো এতদূর এমনি এমনি ছুটে আসিনি আমি। তোমার সব খবরাখবর নিয়েই এসেছি। আপাতত আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাও দুপুর। ধীরে ধীরে সব জেনে যাবে তুমি।”
ওনার বলা প্রতিটা কথা বুকে গেঁথে গেলো। ভয়ে আমার শরীর শীতল হয়ে আসছে। আমার সবকিছু জানেন উনি। কি করে? মাথা ওলটপালট হয়ে গেলো। ব্রেন কাজ করছে না। আমি চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারকে বলি বাসায় যেতে। গাড়ি ঘুরে গেলো। আমি চুপচাপ বসে আছি। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওনাকে দেখছি। চোখ বুঁজে সিটে হেলান দিয়ে আছে চুপচাপ। মানুষটা কেন এলো আমার কাছে? আমি তো একা একা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি তবুও কেন আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে না একা? মনটা অশান্ত হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগছে না। যত বাড়ির কাছাকাছি হচ্ছি ভয় তত বাড়ছে। উনি কি আমার কাছ থেকে তিতুনকে কেড়ে নেওয়ার জন্য এসেছে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই চোয়াল শক্ত হলো আমার। কেড়ে নিতে আসলেই কি কেড়ে নিতে দেব আমি? এতো সহজ সবকিছু? নিজেকে শক্ত করে স্থির হয়ে বসলাম।

“নামুন, চলে এসেছি আমরা।”
উনি চোখ খুলে তাকালো। ধীরে সুস্থে গাড়ি থেকে নেমে বারো তলা এপার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর আমার দিকে ফিরে চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো-“ফ্লাট কিনেছ নাকি দুপুর?”
আমি নিরব রইলাম। উনি হাসলো-“ভালো উন্নতি করেছ দেখা যাচ্ছে। ভালো ভালো বেশ ভালো।”
চুপচাপ ওনাকে নিয়ে সাততলায় নিজের ফ্লাটে উঠে এলাম। বুক দুরুদুরু করছে আমার। এইসময় আমি বাড়ি ফিরি না কখনোই খুব ইমারজেন্সি না হলে। জানি না মোমেনা খালা কি করছে তিতুনকে নিয়ে। চাবি ছিলো আমার কাছে আওয়াজ না করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ওনাকে ভেতরে ঢুকে বসতে বলে আমি ডাইনিং পেরিয়ে বেডরুমে পা বাড়াই। তিতুনকে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আমি নিশ্চিত হলাম। আস্তে করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে আরেক রুমে যাই। মোমেনা খালা বারান্দায় কাপড় মেলছিলো আমাকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“তুমি এতো সকালে বাসায় যে? কি হইছে খালামনি?”
আমি হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে মোমেনা খালার কাছে এগিয়ে যাই-“আমার শাশুড়ী মা আসছে।”
মোমেনা খালা ফিসফিস করলো-“কি বলো? তোমাকে খুঁজে পাইলো কেমনে?”
“জানি না। আজকে চেম্বারে এসে হাজির। জোর করে বাসায় আসছেে। তিতুনের কথাও জানে। কি করবো বুঝতে পারছি না।”
মোমেনা খালা হাতের কাপড় ফেলে এগিয়ে এলো-“এখন কি হবে খালামনি? তিতুনকে যদি নিয়ে যায় সাথে করে?”
এ কথা শুনতেই মনটা শক্ত করলাম-“বললেই হলো? নিয়ে যাওয়ার কথা বলেই দেখুক। গতবার কিছু বলতে পারিনি বলে কি সববার তাই হবে? আচ্ছা শোন, তুমি খাবারের ব্যবস্থা করো। আর গেস্ট রুমটা ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দাও। তিতুনকে আমি দেখবো।”
মোমেনা খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে উনি নড়েচড়ে বসলো-“কোন ঘরে থাকবো আমি? ঘর দেখিয়ে দাও।”
আমি বললাম-“আপনি শাওয়ার নিতে নিতে ঘর তৈরি হয়ে যাবে। ওপাশে ওয়াশরুমে আছে।”
“আচ্ছা।”
উনি ধীরে সুস্থে ব্যাগ খুলে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে গেলো। আমি এই সুযোগে রান্নাঘরে গিয়ে মোমেনা আপাকে তাড়া দিলাম। আপা খাবার গরম করছে। আজ চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউয়ের ঝোল আর গরুর মেজবানি রেধেছে মোমেনা খালা। তিতুন আজকাল গরুর মাংস খেতে ভালোবাসছে বলে গরু বেশি খাওয়া হচ্ছে। আজ দুপুরে আমিও খেতে আসিনি ওটি ছিলো বলে। এখন গরম গরম খাবারের গন্ধে আমার পেট খিদেয় মোচড় দিলো। সব সাজিয়ে আমি আরেকবার তিতুনকে দেখে এলাম। মোমেনা খালা গেছে গেস্টরুম গোছাতে।

খুব ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করলেন উনি। মনে হলো বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেলেন। খাবার শেষে এককাপ চা খাওয়ার বানয়া করলো। মোমেনা খালা চা নিয়ে আসতেই উনি ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করলো-“দুপুরের সাথে কতদিন ধরে আছো?”
“সাড়ে চার বছর হবে।”
“তাহলে আমার নাতনিকে তুমিই পেলে পুষে বড় করলা?”
“আমি আর কি করি? খালামনি চাকরি বাদে বাকী সময় মামনীকেই দেখে।”
“হুমমম।”
খালা জবাব দিতে দিতে বারবার আমার দিকে তাকায়। আমি নির্লিপ্ত ভাব ধরে রাখলেও কান খাঁড়া করে রাখছি। চা শেষ করে উনি উঠে দাঁড়ালো-“আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। শরীর ক্লান্ত লাগছে।”
আমি মাথা দুলাই। উনি ঘরে ঢুকতেই আমিও নিজের ঘরে চলে এলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে বলে তিতুনের পাশে শুয়ে পড়লাম। নানামুখী ভাবনায় মনটা অশান্ত হয়ে আছে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানি না।

ঘুম ভাঙলো মোমেনা খালার ডাকে। পাশে তাকিয়ে দেখি তিতুন নেই। বুকটা ছ্যাত করে উঠতেই মোমেনা খালা বললো-“তিতুন ওর দাদীর সাথে খেলতেছে খালামনি।”
আমার মনে তীব্র ভয় বাসা বাঁধলো। কিছু না ভেবেই এক ছুটে ড্রয়িংরুমে পৌঁছে গেলাম। ওনাকে দেখলাম কানে হাত দিয়ে তিতুনকে ভেংচি কাটছে আর তিতুন তাতে মজা পেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য কিন্তু আমার কাছে মনে হলো কুৎসিত। আমি প্রায় চেচিয়ে উঠলাম-“তিতুন! কি করছো?”
তিতুন দৌড়ে এলো আমার কাছে-“মা দেখো দিদা কি মজা করে খেলছে। দিদা আমাকে অনেকগুলো নতুন টয় কিনে দিয়েছে মা। আমি কি নেব খেলনাগুলো?”
উনি হাসি মুখে আমাদের মা মেয়েকে দেখছেন। আমি ক্লান্ত মুখে বলি-“ঠিক আছে। খেলনা নিয়ে তুমি একটু ভেতরে যাও। আমি দিদার সাথে কথা বলবো।”
“দিদাকে বকবে নাতো?”
আমি অজান্তেই নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরি। এই এতটুকু সময়ে উনি আমার মেয়েটাকে এভাবে দখল করে নিলো? বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে মেজাজের পারদ ওঠানামা করছে। আমি মাথা নেড়ে তিতুনকে আশ্বস্ত করি। মোমেনা খালাকে ইশারা দিলাম তিতুনকে নিয়ে যেতে। তিতুন চলে যেতেই আমি ওনার সামনে বসে চেচিয়ে উঠলাম-“আসলে আপনি কি চান আমার কাছে? কেন এসেছেন এখানে?”
উনি একটুও ঘাবড়ে গেলেন না। চেহারায় স্বাভাবিক হাসিটুকু ধরে রেখে বললো-“তুমি কি সারোয়ারের কোন খবর জানো? কোথায় আছে ও?”
আমি অবাক হলাম। উল্টো পাল্টা কথা শুনে আমি আর মেজাজ ধরে রাখতে পারি না। জোরে চেচিয়ে উঠে বলি-“সারোয়ার কোথায় তা আমি কি করে বলবো? আমার সাথে গেম খেলছেন আপনি?”
উনি বরাবরেট মতোই হাসলো-“তোমার কি মনেহয়? এতোদিন পরে তোমাকে খুঁজে বের করেছি। ঢাকা থেকে চলে এসেছি তোমার সাথে ফাজলামো করবো বলে? তাড়াতাড়ি বলো সারোয়ার কোথায়?”
এবার ওনার কন্ঠ কিছুটা কঠিন শোনালো। চেহারায় গাম্ভীর্যের আড়াল। আমার মাথা এবার ওলট পালট লাগে। সারোয়ার কোথায় সেটা আমি কি করে জানবো তাই বোধগম্য হলো না। সারোয়ার আমার স্বামী আমার প্রাক্তন প্রেমিক। যে বিশ্বাস নিয়ে দু’জন দু’জনার হাত ধরেছিলাম সেই বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত অটুট ছিলো না বলেই তো আমি পালিয়েছিলাম। এখন সারোয়ারের মা আমার কাছে এসে বলছে সারোয়ার কোথায়? এটা কি ধরনের ফান হতে পারে আমি বুঝে পাচ্ছি না।
“দেখুন, আপনি কি বলতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সারোয়ারের খবর আমার জানার কথা না। সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমি চলে এসেছি পাঁচ বছর আগে।”
উনি কঠিন গলায় বললো-“সব বুঝতে পারবে দুপুর। পুলিশে খবর দিলে সব পরিস্কার বুঝতে পারবে। আমি সব বোঝার ব্যবস্থা করছি।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin