মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৮

0
139

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৮

কোন এক রোদ্রজ্জোল দিনে রঙ্গনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। নভেম্বর মাঝামাঝি সময়ে ক্লাস শুরু হলো। প্রকৃতি কেবলই ঠান্ডা হতে শুরু করেছিল। চমৎকার আবহাওয়া। আমাদের মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে আমি কেবল ডাক্তারি পড়ার সু্যোগ পেয়েছিলাম বলে বাবা মা ভাই বোন সকলেই ভীষণ খুশি। খুশি ছিলাম আমিও। প্রথমদিন বাবা নিজেই আমাকে মেডিকেলে গেটে ছাড়তে এলো। নির্দিষ্ট রুমে যেয়ে বসলাম। সহপাঠীদের সাথে হাই হ্যালো বলতে বলতে ক্লাসের সময় হলো। ক্লাস শুরুর আগে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে রঙ্গন বসেছিল আমার পাশে।
“একটা কলম হবে?”
এই বাক্য দিয়েই আলাপ শুরু হয়েছিল আমাদের মধ্যে। সেই আলাপ দুই বছরে তুই তোকারিতে গড়ালো। দু’জন মোটামুটি একইরকম পরিবার থেকে এসেছি বলেই হয়তো ওর সাথে দ্রুত বন্ধুত্ব হলো আমার। আর রঙ্গন বেশ ঠান্ডা ধাঁচের ছেলে। পারফেক্ট হাইট, মায়াকাড়া চেহারা আর স্বভাবে নরম রঙ্গন যে কোন মেয়ের কাছেই আরাধ্য লাগবে। কিন্তু রঙ্গন খুব রিজার্ভ পারসোনালিটি। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে মিশে। একমাত্র আমি ছিলাম ওর সার্বক্ষনিক সাথী। দুটো বছর আমরা এমনভাবে একসাথে থেকেছি যে স্যার ম্যাডামরা আমাদের নাম দিয়েছিল মানিকজোড়। রঙ্গন দূর্দান্ত রেজাল্ট করতো আমি টেনেটুনে পাশ। তবুও আমাদের বন্ডিং এ চির ধরেনি।

তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর পরই হুট করে একদিন রঙ্গন ওর খালাতো ভাই সারোয়ারকে নিয়ে এলো আমার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে। সারোয়ার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ার। সারোয়ার স্বভাবে রঙ্গনের একদম বিপরীত। রঙ্গন গম্ভীর সারোয়ার রসালো ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অল্প সময়ের মধ্যে আসর জমিয়ে ফেলতে পারে। ওর ধারালো সৌন্দর্য আর আমেজি ব্যক্তিত্বে আমি আকর্ষিত হলাম দ্রুত। সারোয়ার প্রায়ই মেডিকেলে আসতে লাগলো। ক্লাস শেষ করে বেরুলেই দেখতাম সে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বলতো-“দুপুর, একটু হাঁটতে যাবে আমার সাথে? দুপুরের সময় দুপুরের সাথে পথচলা, কি দারুণ না ব্যাপারটা?”
আমি হেসে দিতাম। হাঁটতে হাঁটতে সারোয়ার এরকম আরও অসংখ্য মজার কথা বলতো যা শুনে না হেসে পারা যেত না। রঙ্গন এমনিতেই গম্ভীর থাকতো। সারোয়ারকে দেখে আরও গম্ভীর হয়ে যেত। আমি অবশ্য ওসব খেয়াল করতাম না। অতো সময় কোথায় আমার? আমি তখন সারোয়ারে বুদ হয়ে আছি। ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। জানি ক্লাস শেষ হলেই সারোয়ারকে দেখতে পাব। পরিচয়ের মাস তিনেক পর সারোয়ার আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। ততদিনে সারোয়ারে মুগ্ধ আমার মন, প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই রাজি হয়ে গেছিলাম।

পরের একটা বছর স্বপ্নের মতো গেছে। তখন রঙ্গনকে দেখার সময় ছিলোনা আমার। খেয়াল করিনি রঙ্গনের চেহারা থেকে হাসি পুরোপুরি মুছে গেছে। ওর চেহারা শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি জমছে। ও দিনরাত এক করে কেবল পড়ে। আমি ক্লাস ফাঁকি দেই, লেকচার নোট করি না। রঙ্গনের কাছে চাইতেই গম্ভীর মুখ করে সেগুলো দিয়ে দেন। কোন বাড়তি কথা বলে না। অনার্স শেষ হতেই সারোয়ার বিয়ের প্রস্তাব দিলো।আমার তখন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল। আমি বাসায় জানাতেই বাবা বেঁকে বসলেন। তার এক কথা, ছেলে কিছু করে না, নিজের কোন পরিচয় নেই। আমরা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার, আর ওরা উচ্চবিত্ত বলা যায়। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি গাড়ি। আমাদের সাথে ম্যাচ হবে না ওদের। আমি সারোয়ারকে জানালাম।
সারোয়ার একদিন নিজে বাসায় গেলো বাবার সাথে কথা বলতে। ওদের নিজেদের ব্যবসা, সারোয়ার সেখানেই বসবে এসব বুঝিয়েও বাবাকে রাজি করানো গেলোনা। বাবা আমাকে বোঝালেন-“ছেলো নিজে কিছু করুক। বাপের ব্যবসাতো নিজের না। ও কষ্ট করতে জানে না। তোর ডাক্তারি পেশাও মেনে নেবে না। তখন অশান্তি হবে। এতো পড়ালেখা করে কি তুই বেকার বসে থাকবি?”
আমি বাবার কথা বুঝলাম না। রাগারাগি করে চলে এলাম। সবচেয়ে কষ্ট পেলাম রঙ্গনও যখন আমাকে বুঝলো না। পুরো ঘটনা শুনে ও গম্ভীর হয়ে গেছিল-“আঙ্কেল ভুল কিছু বলেনি দুপুর। সারোয়ার আমার ভাই হলেও আমি আঙ্কেলের কথার সাথে একমত। সারোয়ারের নিজের মধ্যে কিছু করার তাড়না কম। তোকে বুঝবে না ও।”
আমি দুঃখী মুখ করে বলি-“তুইও এমন করে বলছিস? আমার সুখটা তোদের কাছে ম্যাটার করে না, তাই না? সারোয়ার ঠিকই বলে, কারো ভালো কেউ দেখতে পারে না। তুই সারোয়ারকে হিংসা করিস এটা এতোদিন সারোয়ার বললেও আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ করতে হলো।”
রঙ্গন স্তিমিত হয়ে গেলো। কষ্ট পেয়ে ওর চেহারা নীল। সে অবাক হয়ে বললো-“আমি সারোয়ারকে হিংসে করি আর তোকে? তোকেও কি হিংসে করি?”
আমি ঠোঁট উল্টে বলেছিলাম-“কি করিস তা জানি না তবে আমার সুখে থাকাটা সহ্য হচ্ছে না তোর এটুকু বুঝতে পারছি।”
রঙ্গন অবাক নেত্রে অনেকটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর দুঃখ ভরাক্রান্ত গলায় বললো-“খুব ভুল করছিস দুপুর। এই ভুলের জন্য একদিন পস্তাতে হবে। ভালো থাকিস।”
কথাগুলো বলেই রঙ্গন চলে গেছিল আমার সামনে থেকে। পরের শুক্রবার সারোয়ার ওর মাকে নিয়ে এলো। বাবা রাগ করে সেদিনই বিয়ে করানোর কথা বললেন। আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। তার আগেই সারোয়ার রাজি হয়ে গেলো। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য যে, সেদিন গুটিকয়েক মানুষের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হয় এবং আমি সারোয়ারের সাথে চলে আসি ওদের বাসায়। শুরু হলো আমার অদ্ভুত বিবাহিত জীবন। অদ্ভুত কেন বলছি তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। আমার সহজ সরল জীবনটা কোথা থেকে কোথায় চলে গেলো যে পরিবর্তনের সেই বাঁকটাই আর খুঁজে পেলাম না। কোথায় ভেবেছিলাম…

মোবাইল বিরক্তকর আওয়াজে আমার অতীত মুহুর্তে চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেলো। ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। রঙ্গন ফোন করেছে। আমি তাড়াহুড়ো করে ফোনটা তুললাম-“হ্যালো রঙ্গন। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে?”
“নাহ। দুপুর তুই একটু খালার লাগেজগুলো খুঁজে দেখতো কোন ডাক্তারি ফাইল পাস কিনা।”
রঙ্গনের কন্ঠে তাড়া। আমি উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চাইলাম-“এমন কেন মনেহচ্ছে তোর? টেস্ট রিপোর্ট কি খারাপ এসেছে? কি হয়েছে ওনার?”
রঙ্গন সে কথার ধার দিয়ে গেলো না। সে পুনরায় আমাকে তাড়া দিয়ে বললো-“এখনও কিছু বলতে পারছি না দুপুর। তুই প্লিজ দেখ খালার ব্যাগে কোন ফাইল আছে কিনা। খুঁজে পেলে আমাকে জানাস। কাউকে নিতে পাঠাব।”
আমার জবাবের প্রত্যাশা না করেই রঙ্গন ফোন কাটলো। আমি অবাক হয়ে ফোন রেখে গেস্ট রুমে এলাম। রঙ্গন এরকম কেন বললো? ওনার কি হয়েছে? খুব কঠিন কোন অসুখ নয়তো?

গেস্ট রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে ওনার ব্যাগটা ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখলাম ঘরের এককোণে। তাহলে কাপড় রেখেছেন কোথায়? আমি আলমারি খুলতেই দেখলাম সেটা চমৎকার করে গোছানো। এই আলমারিতে সাধারণত পুরনো কাপড়গুলো জমা রাখতাম আমি। সেগুলোর দেখা পেলাম না। তার বদলে ওনার কাপড় গুছিয়ে রাখা। একেক তাকে একেক জিনিস রেখেছেন। দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। এসব কবে আর কখন করলেন? ওনার কি এখানেই থেকে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো? সেটা কিভাবে সম্ভব? সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। আমি মোমেনা খালাকে ডাকলাম।
“কি হইছে খালা?”
“এসব উনি কবে করলেন? আর এখানকার কাপড়গুলো কোথায় রেখেছে?”
“আসার দুইদিন পরেই। তিতুনকে নিয়ে বাইরে যাইতো তখন একটা দুইটা করে নিয়ে নিয়ে গরীব মানুষকে দিয়ে দিত। আর কিছু কাপড় ট্রাঙ্কে রেখে দিছে। আলমারি আমাকে দিয়েই মোছাইছে।”
আশ্চর্য মানুষ তো? আমার জিনিস নিজের মতো করে দান করেছে? নিজেকে সামলে নিয়ে মোমেনা খালাকে বলি-“আচ্ছা। তুমি যাও আমি দেখছি।”
মোমেনা খালা চলে যেতেই আমি ওনার কাপড় চোপড় সব নামিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কোন প্রেসক্রিপশন তো দূর কাগজের দেখা পেলাম না। ওনার কিছু গয়না পেলাম। অনেক পুরনো গহনা বোঝা যায়। গহনা সাথে নিয়ে ঘুরছে কেন উনি? প্রশ্নটা মনে রেখেই জায়গায় জিনিস জায়গায় রেখে দিলাম। ভাবছি, রঙ্গন যখন বলেছে এমনি এমনি বলেনি। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে বলার। ভাবতে ভাবতে রুমের চারপাশে নজর বুলিয়ে চলেছি। হুট করে কি মনে হতেই ওনার ব্যাগ দু’টো নিয়ে বসলাম। প্রথম ব্যাগটায় কিছু না পেলেও ট্রলি ব্যাগটার তালা ঝোলানো দেখে সন্দেহ হলো। তালা ভেঙে ব্যাগটা খুলতেই ফাইলটা নজরে এলো। বিশাল মোটা একটা ফাইল। আমি দ্রুত হাতে ফাইলটা তুলে নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি। ও মাই গড! হোয়াট ইজ দিস? সি ইজ হ্যাভিং লিউকেমিয়া, স্টেজ থ্রি!

চলবে—
©Farhana_Yesmin