মেঘভেলায় প্রেমচিঠি পর্ব-১৪+১৫

0
483

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

১৪.

শহরের নির্লিপ্ততা ভীষণ ভাবে অবাক করে তুললো রোদসীকে। সাধারণ দিনের তুলনায় সিমসাম গোছানো পরিপাটি করা। অন্য দিনের তুলনায় মুখটা ভদ্রতায় ঘেরা। দৃষ্টি আগাগোড়া নির্মল শান্ত। রোদসীর পাশেই গা লাগিয়ে বসে আছেন দিলারা। কিন্তু মোটেও মুখ মন্দ করে যাচাই বাছাই করছেন না। হাসিমুখে কথা বলছেন। সহজ সরল মানুষ কিনা ওইরকমই।

রোদসী প্রথম দফায় ঝটকা খেয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। হতভম্বতা কাটিয়ে রাগী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে যেতে নিলেই কেয়া চোখ গরম করে তাকালেন। ওই দৃষ্টির ভাষা বুঝলো রোদসী, ‘চুপ করে বসে থাকে, নাহলে তোর খবর আছে।’ বাধ্য হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় অবশিষ্ট রইলো না।
শহরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বারংবার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু শহর ভুলে তাকাচ্ছে না। যেনো রোদসীকে একবার দৃষ্টিতে আবদ্ধ করাও মহাপাপ বলে আখ্যায়িত হবে।
রোদসী বুঝতে পারলো না, শহর কীভাবে রাজি হলো বিয়ের প্রায় নিয়ে বাসায় আসতে। এতোটুকু অন্তত রোদসী জানে, দিলারার কথাতেই হয়তো শহর বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু যে কিনা রোদসীকে কথায় কথায় কটাখ্য করে সে মানুষ কী করে এতোটা ভদ্রলোকের ব্যবহার করতে পারে! এহেন চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে রোদসীর। এ-ও ভাবছিলো রোদসী, যে তাঁর মা কী করে শহরের সঙ্গে বিয়ে দিতে হ্যা বললো। যেখানে মায়ের মুখে ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছে, ছেলের যদি উপার্জনের কোনো চেষ্টা না থাকে তবে তেমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। মোট কথা কর্মঠ হতে হবে। তবে দিলারা যখন বললেন, শহর পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংএর কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। কিন্তু বিস্মিত হলো, এই ভেবে যে শহর কোন সময় কাজ করে! কারণ দুটো মাসে আজ অব্দি শহরকে ভবঘুরে উড়ে বেড়ানো ছাড়া কিছু করতে দেখেনি। হয় তাঁকে চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখেছে আর দ্বিতীয়ত মাঠেঘাটে কড়া রোদে ক্রিকেট খেলতেই চোখে পড়েছে। সে যাকগে, রোদসীর ওসবে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মোটকথা সে ভাবতে চায়না। এখন তাঁর মাথায় চলছে,কীভাবে ওই বাঁদর ছেলেটা হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। আর ইচ্ছেমতো টাইট দিতে পারবে। সুযোগও হলো। দিলারা বললেন, দু’জনকে একান্তে কথা বলে নিতে।

রোদসী শহরকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলো মায়ের বলায়। নিজের ঘরে ঢুকেই রোদসী ক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করলো। শহর তেমন একটা গুরুত্ব দিলোনা৷ সে চুপচাপ কাউচে বসে পা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। রোদসী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘আপনি সিরিয়াস? ‘

শহর চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

‘কোন বিষয়ে? ‘

‘বুঝতে পারছেন না? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার মানে কী? ‘

‘বিয়ের প্রস্তাব কেনো আনে মানুষ? ‘

‘বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আপনার সঙ্গে কী কখনো আমার এমন কথা হয়েছে, যেখানে আমি ইঙ্গিত দিয়েছি আপনাকে পছন্দ করি? এক্ষুনি না বলবেন সবাইকে। ‘

‘এহ! তুমি এমন একটা ভাব নিচ্ছো। যেনো তোমাকে বিয়ে করতে মরেই যাচ্ছি আমি। নেহাৎ মায়ের দিব্বি খেয়ে বাধ্য হলাম। ‘

‘দেখুন, রাগ উঠাবেন না আমার। চুপচাপ আন্টিকে বলবেন, আপনি রাজি না। ‘

‘কেনো কেনো? আমি কেনো ফাঁসবো মায়ের কাছে বলে! তোমার এতো সমস্যা হলে তুমি আন্টিকে বলো।’

রোদসী চেচিয়ে বলল,

‘বিয়ে কী শুধু আমার একার? ‘

‘না, আমারও। কিন্তু আমি মায়ের সামনে না বলতে পারবো না। আমার মায়ের কসম খেয়েছি আমি। ‘

রোদসী নিরাশ হয়ে সোফায় মাথা চেপে বসে পড়লো।
নরম হয়ে বলল,

‘আপনি না খুব ভালো! প্লিজ,আমার দ্বারা বিয়ে সম্ভব না। বোঝার চেষ্টা করুন। মা অসুস্থ না হলে আমি জোর গলায় না করে দিতাম। ‘

শহর ভ্রু কুচকে বলল,

‘বাহ! বারো মাস আমি বেয়াড়া ছেলে, বাদর, অসভ্য। আর এখন ভালো হয়ে গেলাম?’

‘হ্যা, হয়ে গেলেন। প্লিজ! ‘

‘আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা? নাকি তুমি সারাজীবনই কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো? ‘

‘সেটা আপনার জানতে হবেনা। ‘

‘তাহলে আমারও কোনো ঠ্যাকা পড়েনি। নিজের খেয়ে অন্যের জন্য কাজ করবো। তোমার ঝামেলা তুমি বোঝো। আমি গেলাম। মায়ের মুখের উপর কথা বলিনা আমি, জানোই তো আমি খুব ভালো ছেলে। ‘

শেষের কথাটা বলে ঠিক আগের মতো গা জ্বালিয়ে দেয়ার মতো দাঁত কেলিয়ে হেঁসে ঘর থেকে চলে গেলো। শুধু যাওয়া সময় হাত নাড়িয়ে বলল,

‘টাটা, ডিয়ার হবু বউ। তেজপাতা জীবনে আগমনের প্রস্তুতি নাও। ‘

ফুঁসতে ফুঁসতে সোফার কুশনটা ছুড়ে দিলো রোদসী। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা শহরের গায়ে লাগলো না। রোদসী ঠিক ঠিক বুঝেছে, শহর আগে বিয়েতে অমত রাখলেও এখন রাজি হয়ে যাবে। কারণ রোদসীকে পার্মানেন্ট জ্বালানোর সার্টিফিকেটটা হাতছাড়া করতে চাইবে না কোনোমতেই। রোদসী বিরবির করে বলল,
‘আপনি মায়ের কত বাধ্য ছেলে, তা ভালোই জানা আছে আমার। যতসব আমাকে জ্বালানোর ধান্দা। কয়েক দিন আগে ইগনোর করার জন্য প্রতিশোধ নিতে চাইছেন তো! আমিও দেখে নিবো আপনাকে। আপনার লাইফটা ত্যানাত্যানা না করেছি, আমার নামও রোদসী না! ‘

সময়টা যেনো দৌড়ে পালাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ের ডেট ফিক্স হয়ে গেলো। রোদসী বাবা মায়ের কাছে হাজারও তালবাহানা দিয়েও পাড় পেলো না। অতঃপর বুঝে গেলো, বিয়েটা কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব না। তখন রাগে খিটমিট করতে করতে সম্মতি দিয়ে গেলো। তারমধ্যে শহরের রোজকার কল তাঁকে আরও অতিষ্ট করে তুললো।

না না, সে মোটেও আট দশটা ছেলের মতো হবু বউয়ের সঙ্গে রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলেনা। বরং রোদসীকে এটা ওটা বলে পৈঁচাশিক আনন্দ নেয়। যেমন, রোদসী যখন ভোরের দিকে শান্তি মতো একটু ঘুমায় সেই শান্তি হারাম করতেই শহর কল দিয়ে বকবক করে। যেহেতু রোদসী কম কথা বলে এবং বাঁচাল মানুষ পছন্দ করে না। তাই অতিরিক্ত কথাই বিষের মতো ঠেকে রোদসীর কাছে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচালেই শহর কেয়ার কাছে বিচার দেয়ার হুমকি দেয়। অতএব এই অত্যাচারে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই রোদসীর। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আগামী কাল বিয়ে। দুই পক্ষের পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত। রোদসী মলিন মুখ করে শুয়ে আছে। রাত বাজে এগারোটা।

ঘুম আসছেনা। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো শহরের কল। মুখ ভেঙচিয়ে রিসিভ করে কানে দিলো। রোদসীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একাই নিজের মতো কথা বলতে থাকলো। রোদসী ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে চোখ বুজে নিলো। অর্ধঘুম অর্ধজাগ্রত অবস্থায় আছে। শহরের সব কথা বুঝতে না পারলেও একটা কথা শুনে ঘুমের মধ্যেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। শহর তখনও ডেকে ডেকে বলছে,

‘এই শুনছো, বিয়ের পর কিন্তু আমার মোজা জোড়া ধোঁয়ার দায়িত্ব তোমার। এই শুনছো? ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

১৫.

‘কন্যা বিদায় ‘ শব্দটা শুনতে নেহাৎই যন্ত্রণাময়, বিষাদে টইটুম্বুর কোনো দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি চোখের পাতায় ভেসে ঘুরঘুর করে। নববধূ কাঁদতে কাঁদতে চোখের সাদা অংশ লাল বানিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে আপনজনকে জড়িয়ে শেষবার আলিঙ্গন করে, অতঃপর স্বামীর হাত ধরে নতুন পথে পা বাড়াবে। সুখ দুঃখের সঙ্গী স্বামী তাঁর পরিণীতা স্ত্রীর জন্য নিজের
বক্ষস্থল উন্মুক্ত করে দিবে। এটাই হয়তো আমাদের সকলের চিন্তা ভাবনায় টগবগ করে। কিন্তু আশেপাশের সকলের চিন্তাকে টপকিয়ে উর্ধ্বে গিয়ে বিয়ে হলো রোদসী ও শহর নামক নব্য দম্পতির। মেহমান যখন এসে হাজির হলো কন্যাকে স্বান্তনার বাণী শোনাতে তখন কন্যা মুখ ভরে বিরক্ত হয়ে বলল,

‘আমি কী বিদেশ যাচ্ছি, যে আমাকে এসেছো স্বান্তনা দিতে! আমার বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি। নিচ থেকে উপরে যাব মাত্র। ‘

এহেন কথায় সবাই অবাকের রেশ তরতর করে ঝাপিয়ে যাচ্ছিলো। রোদসী তখন মুখভরে সাজসজ্জার রঙিন সরঞ্জামে পূর্ণ হচ্ছে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সে। মূলত, রোদসী উপলব্ধি করে বিয়ে যতই সে না মানুক। আর অনীহা করুক। তবু, বিয়ে তো জীবনে একবারই হয়। কী দরকার আমোদ টুকু ভেস্তে দেয়ার! শহরকে তো পাচ্ছেই আজীবন জব্দ করার জন্য। রোদসীর মনে হয়, দুঃখের মধ্যেও সুখটাকে অনুভব করার ক্ষমতাটা সৃষ্টিকর্তা তাঁকে বেশ ভালো করে দান করেছে বলেই হয়তো আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপটুকু করা থেকে সে বেঁচে গেছে। নয়তো বর্তমানের সময়টায় নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ হতোনা।
ভেবে অজান্তেই চোখের কার্নিশের আবছা অশ্রুকে দমিয়ে নেয়। নতুন জীবনটা কেমন হবে, ভেবেই নিজেকে অস্থির করে তোলে ভেতরে। কিন্তু বাহিরে শূন্য অনুভূতিহীন থেকে যায়।

শেরওয়ানি পড়ে ফিটফাট হয়ে মুখে রুমাল চেপে লাজুক বরের বেশে পাত্রপক্ষের সহিত হাজির হলো শহর শ্বশুর বাড়ি। মাত্র উপর থেকে নিচে একতলা নামতেই আর পরিশ্রম করার প্রয়োজন নেই সেখানে তাঁর এতো কীসের লজ্জা ছেলে মানুষ হয়ে তা ভেবে বড়ই চিন্তিত দিলারা৷ ছেলের মুখের উপর থেকে রুমাল টেনে সরিয়ে নিয়ে বললেন,

‘তোর এতো লজ্জা তৈরি হলো কোথা থেকে! এই জামানায় কেউ এমন করে! ‘

শহর রুমাল মুখ থেকে সরিয়ে একটু কৃত্রিম লজ্জা মাখা হাসি দেয়। আশেপাশে ভাই বোনেরা স্বশব্দে হাসাহাসি করছিলো শহরকে দেখে। ইতিমধ্যেই সবাই তাঁকে বিয়ে পাগলা বলে নাম দিয়েছে। এতোটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বিয়ে করতে সম্ভবত কাউকে দেখা যায়নি। ছেলেরা সাধারণত একটু লাজলজ্জাহীনই থাকে। কিন্তু তাঁর প্রকাশ এতো খোলামেলা ভাবে কেউ করে না। মুরব্বিদের বলার আগেই শহর হাসি হাসি করে নিয়ম কানুন পালন করছে। যেমন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিজেই আগ্রহী হয়ে মা’কে বলল,

‘মা, তুমি কাঁদছো না কেনো? ‘

দিলারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন,

‘বিয়ে হচ্ছে তোর আর রোদসীর। এতে আমি কাঁদতে যাবো কেনো? আর রোদসীকে তো আমিই পছন্দ করে বউ বানাচ্ছি, আমার খুশিতে নজর দিস কেনো তুই হতচ্ছাড়া! ‘

‘উহ, মা! তোমার কী একটুও চিন্তা হচ্ছে না? এবার থেকে আমি বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরঘুর করবো তোমাকে ভুলে যাবো। তোমার কিন্তু আরেকবার ভেবে দেখা উচিত তাইনা? ‘

দিলারা বাঁকা হেসে বললেন,

‘ওরে আমার সোনার টুকরো ছেলেরে! তুমি কী ভেবেছো! এসব কথা আমাকে বলে উসকিয়ে দেবে, আর আমি গর্দভের মতো বিয়ে ক্যান্সেল করবো। তা আর হচ্ছেনা। লক্ষ্মী ছেলের মতো বিয়ে করে বউ নিয়ে আসো। ‘

শহর মুখটা কালো করে ফেললো। কী লাভ হলো এতো তোষামোদি করে! যেই লাউ সেই কদু! ভেবেছিলো কিছু একটা উপায়ে মায়ের মাথা থেকে রোদসীকে বিয়ের ভূতটা নামাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হলোনা। রোদসীকে এতো দিন যে পরিমাণ জ্বালিয়েছে, এতে যে রোদসী কী ভয়াবহ ফিডব্যাক দিবে তা ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেলো। সবার সামনে নিজের ভেজা বেড়ালের রূপটা আর দেখালো না। বীরপুরুষের ভান করে হাসিমুখে শ্বশুর বাড়ি প্রবেশ করলো। সবার সাথে কথা বলে দেখলো বধূসাজে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রোদসী। বোনরা রোদসীকে শহরের পাশে এনে বসালো। বসেতেই শহর ওর দিকে তাকালো রোদসী কটমট ইশারা করলো,
‘একবার বাগে পেয়ে নেই, বোঝাচ্ছি। ‘ শহর ঢোক গিলে ফিসফিস করে বলল,

‘তোমাকে সুন্দর লাগছে রোদচশমা! ‘

রোদসী বাঁকা হেঁসে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘বিয়ের পরের দিনগুলোতে আরও সুন্দর লাগবে! ‘

শহর চোরা চোখে এপাশ ওপাশ করে করে দেখছে। এ কয়েক দিনে যে রোদসীকে অতিষ্ট করেছে তাঁর প্রতিশোধ রোদসী নিবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কীভাবে! এটাই চিন্তার ব্যাপার।

দেখতে দেখতে শুভক্ষণ এগিয়ে আসলো। হঠাৎ করেই রোদসীর মনটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি এলো মন খারাপের। মা বাবা আর ভাইটার থেকে একটু পরই বিচ্ছেদ হবে মানতে বড়ই কষ্ট হলো তাঁর। কাজী সাহেব যখন খাতা কলম নিয়ে বসে বললেন, কবুল বলো। তখন এক পাহাড় সমান কালচে অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছিল। মনিরুল হোসেন মেয়ের পাশে এসে নিজের চোখটা মুছে কবুল বলতে ইশারা করলেন। চোখ বন্ধ করে কবুল বলে রোদসী তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের তালিকার বাঁচাল বেয়াড়া মানুষটাকেই জীবন সঙ্গী করে নিলো।

শহরের ক্ষেত্র অবশ্য এতোকিছু না হলেও। অদ্ভুত একটা অনুভূতি মনের আনাচে-কানাচে তীব্র বেগে ছুটে চলছিলো। কিছুটা দ্বিধা ও অদ্ভুত অনুভূতির মিশ্রণে সিক্ত হয়ে কবুল বললো সে। তিন কবুল ও একটা স্বাক্ষরই দু’টো দুই প্রান্তের মানুষকে এক বন্ধনে আবদ্ধ করলো। দুটো মানুষ নিজেদের মনে অপর মানুষটির জন্য কতটুকু জায়গা তৈরি করতে পারে, তা অবশ্য একটা বিরাট প্রশ্ন দাঁড় করাতে সক্ষম।

_

মা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আর্শকে আদর করে
দিলো। আর্শ বহুদিন পর সেই পুরনো স্নেহময় স্পর্শে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। রোদসী নিজের কান্না লুকিয়ে রাখলো। আর্শ ছাড়তে চাইলো না বোনকে। অতঃপর রোদসী ভাইকে সঙ্গে করেই ও বাসায় গেলো। যেহেতু অধিকাংশ মানুষই রোদসীকে চেনে তাই তেমন কোনো
কষ্ট পোহাতে হলোনা। রোদসীকে পরম আদরে আগলে নিলেন দিলারা। নিজের একটা মেয়ের বড়ই শখ ছিলো তাঁর। আজ মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন তিনি। তবে, রোদসীকে এতো তাড়াতাড়ি আনার আরেকটা কারণ আছে। বড় ছেলেটাকে সত্যি বলতে দিলারা খুবই ভালোবাসেন। সামনে যতই বকাবকি করুক শহর তাঁর কলিজার একটা অংশ বটে। শহরও যে তাঁকে কতটা ভালোবাসে তাও তিনি জানেন। কথায় আছে, ভালোবাসা যত গাঢ় হবে ততই বাড়বে চিন্তা। দিলারাও বড় ছেলের ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তাঁর এই উড়োনচন্ডি ছেলেটা মাঝে মাঝেই দূর দূরান্তে বেরিয়ে যায়। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড় সমুদ্র ঘুরে বেরায় তো আবার কখনো কারো বিপদে গিয়ে হাজির হয়। এতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। ছেলে যত সাহায্য করতে চায় করুক। বাপ দাদার সম্পত্তির অভাব নেই।
কিন্তু, চিন্তা একটা জায়গায়। নিজের প্রতি তাঁর তেমন কোনো যত্ন নেই। ছোট বেলায় বাচ্চারা যেখানে একের পর এক আবদার জুড়ে বসে, সেসময় শহর নিজের দামী জুতা তাঁর বন্ধুকে চুপিচুপি দিয়ে এসেছিলো। নিজে সাদামাটা জীবন যাপন করে। যেখানে এই বয়সে ছেলেরা বাপের টাকা ফুর্তি করে উড়িয়ে দেয়।
বিয়ের পর যদি ছেলেটা কারো টানে বাড়ি ছেড়ে দূরে না সরে এর জন্যই এতো আয়োজন।

_

যেমনটা শহর ভেবেছিলো তাঁর কিছুই ঘটলো না। রোদসী ঘরে বসে আনমনে বসে ছিলো কতক্ষণ। শহর বারবার কাছে যেতে নিয়েও দ্বিধায় আমতাআমতা করতে থাকলো। এতোবার দুজন ঝগড়াঝাটি করেছে তবে আজ কেমন যেন দূরত্বের পরিধি ক্রমশ দুজনের মধ্যে ছেয়ে গেছে। রোদসীর যতোটা কঠোরতা শহর আশা করেছিলো তেমন কিছুই দেখা গেলো না। রোবটের মতো খাট থেকে উঠে সুতির একটা শাড়ি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পাল্টে এসে দাঁড়ালো। শহর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ভাবে কাপড় বদলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে হাতঘড়ি খুলে রাখছিলো। চিন্তা না করলেও কিছু ব্যাপার অজান্তেই মস্তিষ্কে খুপরি দিয়ে বসে ৷ রোদসী সামনে এসে দাঁড়াতেই শহর তাকায়। কেমন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু। এতোদিন যে ঘরটায় শুধু মাত্র শহরের একার বিচরণ ছিলো। সে ঘরটার মালিকানায় অর্ধেক অংশ আজ থেকে রোদসীর। রোদসীরও মনের একই অবস্থা। কীসের ঝগড়া কীসের কী! শহর নামের অর্ধ চেনা অর্ধ অচেনা ছেলেটা তার স্বামী ভাবতেই বুকের ভিতর কিছু একটা নড়াচড়া দিয়ে উঠলো। হৃদপিণ্ডের বেগ বেড়ে গেলো। ভেজা মুখ মুছে শহরের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘শুনুন। ‘

শহর ফিরে তাকালো। সে আনমনেই ভাবলো, রোদসী হয়তো কোনো মিষ্টি কথা বলে তাদের সম্পর্কটা উন্নত করবে। কিন্তু সেগুড়ে বালি দিয়ে রোদসী যা বলল, তাতে বিস্ময়ের সপ্তআকাশ ভেদ করে উপরে গেলো শহর। রোদসী হাতে একটা মোটা বই নিয়ে চোখে চশমা পড়ে বলল,
‘আপনি কী রাতে লাইট বন্ধ করে ঘুমান?’

শহর থতমত খেয়ে একবার রোদসীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘না, কেনো? ‘

‘এখন থেকে ঘুমাবেন। যান বিছানায় শুয়ে পড়ুন। ‘

শহর হা করে তাকিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল,

‘আর তুমি কোথায় ঘুমাবে? ‘

রোদসী ভ্রু কুচকে বিছানার অপর পাশে বসে হেলান দিয়ে বলল,

‘আমাকে কী ছবির নায়িকা পেয়েছেন! আপনি খাটে শোবেন আর আমি অবলা নারীর মতো নিচে চাদর বিছিয়ে শোবো! সে আশা বাদ দিন। ‘

শহর আরেক বার ভড়কে গেলো। চুপটি করে বিছানার ওপাশে শুয়ে পড়লো। চোখ বুজে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করলো। লাইটের আলোয় ঘুমানোর অভ্যাস কী আর আছে নাকি! মাথা উঁচু করে রোদসীর দিকে তাকালো। গুণধর বউ তখন চশমা চোখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে ক্যালকুলেটর হাতে লক্ষ টাকার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। শহরের মনে বাসর রাত নিয়ে কখনো তেমন চিন্তা ভাবনা উদয় হয়নি। তাই বলে, সে এটাও আশা করেনি যে রাতটা কোনো কথা না বলে তাঁর বউ বইয়ের সঙ্গে মিলে ভেস্তে দিবে। এই দুঃখে শোকাবহ বেদনায় ডুবে রইলো শহর। কী দিনকাল এলো! কোথায় বউ লজ্জায় ঘোমটা মাথায় বসে থাকবে। তা না, বউ কিনা বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে। হায়! একি দুর্দশা হলো। শহর মাথা তুলে বলল,

‘ইয়ে মানে, তুমি কী সারারাত পড়বে? ‘

রোদসী বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল,

‘হুম। ‘

‘ঘুমাবে না?’

‘না। ‘

‘কেনো? ‘

রোদসী সঙ্গে সঙ্গে কড়া চোখে তাকালো। শহর চুপসে গিয়ে কম্বলে মুখ ঢেকে হড়বড় করে বলল,

‘আমি তো ঘুমিয়ে গেছি। ‘

শহরের কান্ডে নিঃশব্দে হেঁসে ফেললো রোদসী। পুনরায় বইয়ে মগ্ন হলো। ইতিহাসের প্রথম বধূ যে কিনা বাসর রাতটা বই পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। তবে, সকাল হতেই যা ঘটলো এতে কেউই প্রস্তুত ছিল না।।

চলবে-
লেখিকা- নাঈমা হোসেন রোদসী।