“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১৬.
ঘুমের ঘোরে উঠে বসে চোখ মুখ কচলে বসলো রোদসী। ঘুম ভেঙে তেমন কিছু মনে করতে পারছিলো না। কিন্তু অন্য দিনের তুলনায় নিজের রুমের পরিবর্তে অন্য রুম দেখে দুই মিনিট থম মেরে বসে থাকলো। তারপর বুঝতে পারলো, সে এখন বিবাহিত। আর রুমটা শহরের। তড়িৎ গতিতে মনে পড়লো, শহর কোথায়? এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলো। রোদসী চমকে উঠলো এই দেখে, যে শহর খাট থেকে গড়িয়ে নিচে গিয়ে পড়ে আছে। সম্পূর্ণ পড়েনি। পা দুটো খাটেই। এই অদ্ভুত মানুষটার অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি দেখে যারপরনাই হতাশ ও অবাক হলো। হতাশ হওয়ার কারণ, এই যে রোদসী যেখানে ঘুমে বিন্দু মাত্র নড়াচড়া করেনা সেখানে শহরবাবু নড়েচড়ে খাট থেকেই পড়ে গেছে। হায় কপাল! বলতে বলতেই কপাল চাপড়ে নিলো সে। হামাগুড়ি দিয়ে শহরে পা টেনে ধরলো। শহর তখন আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ কারো টান খেয়ে হকচকিয়ে গেল। পা দুটো এর ফলে ফ্লোরে পড়ে গেলো। রোদসী পুরো দৃশ্যটা দেখে মুখ হাত ঢেকে হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে পেট চেপে বলল,
‘ছি ছি! এতো বড় হয়েও কীভাবে খাট থেকে পড়ে যায়! ‘
শহর তখন কোমর চেপে ব্যাথায় উহঃ করছিলো। ঘুম ভেঙে সদ্য ওঠায় সাধারণত তাঁর মেজাজ খুব একটা ভালো থাকেনা। তার উপর রোদসীর তাচ্ছিল্যে তাঁর মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এলোমেলো চুল আর জামা কাপড় ঠিক করে নিলো। যতযাই হোক, সে তো নতুন জামাই। আর নতুন জামাইয়ের একটা প্রেস্টিজ আছে না! শহর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে বলল,
‘হয়েছে হয়েছে, এতো হাসতে হবে না। তুমি যে রাতের বেলা কী কান্ড ঘটিয়েছো, দেখেছি আমি। ‘
রোদসী ভড়কে গেলো। তাঁর জানামতে সে ঘুমানোর সময় বেশি নড়াচড়া করেনা। তাহলে কীসের কথা বলছে শহর? শহর আড়ালে দুষ্ট হাসি দিলো। এবার একটু আচ্ছা করে জ্বালিয়ে নিবে। সুযোগ পেয়ে সে মোটেও ছাড়বেনা। রোদসী আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কী করেছি আমি?’
‘করেছো মানে! আমার বেচারা বালিশটাকে তো মুখের লোল দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছো। আচ্ছা, এতোবার মুখ বন্ধ করিয়ে দিলাম। তুমি বললে,তুমি নাকি হা করেই ঘুমাবে। ‘
‘ইয়াক ছি! আমি জীবনেও বিশ্বাস করিনা। ‘
‘তা করবে কেনো! আমি কালকে ছবি তুলে রাখবো তখন দেখে নিও। ‘
‘আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলেছি, যে হা করে ঘুমাবো! ‘
‘আরে হ্যা, তুমিই তো বললে। আমি যেই আরেকবার মুখ বন্ধ করালাম, এতেই তুমি রেগে লাথি দিয়ে আমাকে খাট থেকে নিচে ফেলে দিলে! ‘
রোদসী অবাক হয়ে তাকালো। শহর নিষ্পাপ মুখ করে থাকলেও আড়ালেও হাসিটা চোখে পড়ে গেলো রোদসীর। সে বুঝতে পারলো শহর তাঁর সঙ্গে ফাজলামো করছে। রেগে মেগে হাতের কাছের বালিশটা ছুঁড়ে দিতেই শহর সেটা ক্যাচ করে হাসতে হাসতে বলল,
‘এমন হয় হয়, থাক ছোট মানুষ। ‘
রোদসী আরও রেগে তেড়ে এলো। শহরের চুল ধরে টানতে নিলেই শহর দৌড়ে রুমের অন্য সাইডে চলে গেলো। রুমটা মোটামুটি বড় হওয়ায় রোদসী শহরকে নাগালে পেলো না। শহর অন্য পাশে দাঁড়িয়ে হো হো করে হেঁসে মজা নিচ্ছে। রোদসী হার মেনে চলে যাওয়া ভান করতেই শহর সত্যি ভেবে কাছে আসতেই রোদসী শয়তানি হাসি দিয়ে চুল ধরে এলোমেলো করে দিলো। শহর এর বিপরীতে খপ করে রোদসীর হাত দুটো ধরে ফেললো। রোদসী দৌড়ে পালাচ্ছিলো। তৎক্ষনাৎ ধরে ফেলায় পাখির মতো ছটফট করে উঠলো। শহরের শান্ত দৃষ্টি তখন তাঁর মুখের দিকে। শহর আচমকা রোদসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘তোমাকে এমন চঞ্চলে দেখতে ভালো লাগে রোদচশমা। ‘
কানের কাছে শিরশিরে অনুভূতি হওয়ায় কেমন লাগলেও। তাঁর চেয়ে বেশি ভয়ের অনুভূতি ডানা মেললো। এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলো রোদসী। এক ঝটকায় শহরকে দূরে সরিয়ে দিলো। হাঁপিয়ে উঠে বলল,
‘আর কক্ষনও আমার কাছে আসবেন না আপনি। একদম স্বামীর অধিকার দেখানোর চেষ্টা করবেন না! ‘
কথাটা বলেই হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো রোদসী। শহর ওখানেই আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। যদিও সে জানে, তাদের সম্পর্কটা আট দশটা মানুষের সম্পর্কের মতো নয়। শুধু একটু দুষ্টুমি করছিলো সে। কিন্তু এতে যে রোদসী এমন রেগে যাবে ভাবেনি। সম্পর্কটা যাতে স্বাভাবিক থাকে এর জন্যই চেষ্টা করছিলো। রোদসীর ব্যবহারে একটু কষ্টই পেলো সে।
অভিমানের প্রলেপে ঢেকে গেলো হাস্যজ্জ্বল মুখটা। সকালে উঠে রোদসীকে হাসতে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেছিলো। পরমুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো। যা ইচ্ছে করুক মেয়েটা। ওকে আর শহর ঘাটবে না। চুপচাপ বাহিরের সাইড ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দিলারার সকাল বেলা ওকে বের হতে দেখে খটকা লাগলেও কিছু বললেন না। খাবার হাতে নিয়ে রোদসীর কাছে গেলেন। রোদসী গোসল সেরে বের হয়ে গলায় চেইন পড়ছিলো। এসব পড়ার অভ্যাস নেই। তবুও মা আগেই বলে দিয়েছে এটা পড়তে হবে। দিলারা ঢুকে হাসিমুখে বললেন,
‘নাও মা, খেয়ে নাও। ‘
রোদসী তাকিয়ে দেখলো দিলারা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভালো লাগলো ওর। যদিও আগে থেকেই রোদসী জানে, শহরের মা টিপিকাল শ্বাশুড়ির মতো ব্যবহার কখনো করবেন না। তবুও কেমন এলটা আশঙ্কা কাজ করছিলো মনে। রোদসী দিলারা’কে বলল,
‘মা, আপনি কষ্ট করে আনলেন কেনো? আমি নিচে যাচ্ছিলাম। ‘
‘দরকার কী! বিয়ে হয়েছে বলেই কাজে লেগে যেতে হবে নাকি! তুমি আমার আরেকটা মেয়ে এখন থেকে। ‘
রোদসী মুগ্ধতায় ডুবে গেলো। মানুষটা আসলেই খুব ভালো। তিনি নিজের হাতে রোদসীকে খাইয়ে দিলেন।
খাওয়া শেষে তিনি বললেন,
‘রোদসী মা, শহর কোথায় গেলো কিছু জানো? ‘
রোদসীর মনে পড়লো শহরকে সে কী বলেছিলো। হঠাৎই একটা অপরাধ বোধ তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। রাগের মাথায় এমনটা করা উচিত হয়নি। শহর তো আর জানেনা, রোদসীর অমন করার কারণটা। মনে মনে ভাবলো, শহরকে সময় সুযোগ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। অতীতের বিষাক্ত কথাগুলো এবার না জানালেই নয়। রোদসী মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না মা, তিনি বলেননি। ‘
দিলারা তেমন কিছু বললেন না। ছেলে যে হুটহাট এমন বেরিয়ে যায় তিনি জানেন। কোনোরূপ সন্দেহ না করেই তিনি রোদসীকে বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন।
বসে বসে এটা ওটা করে সময় কাটছিলো রোদসীর। তবে মনটা যেনো অন্য কোথাও। ভালো লাগছে না, ছেলেটা আসছেনা কেনো এখনো! দশটার বেশি বেজে গেলো। সকালের খাবারও তো খায়নি। এতো রাগ, এতো অভিমান! রোদসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবতে থাকলো, সে কী একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেললো! রোদসীর চিন্তা ভাবনাই এমন। প্রথমে কোনো কিছুতে ভুল করে ঠিকই। কিন্তু পরবর্তীতে তা নিয়ে ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। রৌদ্রস্নাত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রোদসী অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলো, সে অভিমানী বালকের।
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১৭.
আকাশে তখন সূর্যের আলসে দৃষ্টি। পাখির ক্ষুধার্ত ডাক। রোদসীর ক্লান্ত চোখদুটো হাহাকার করে বুজে আসতে চাইছে। সেই যে জানালার পাশে এসে বসেছে। অপেক্ষার অবসান আর হচ্ছে না। রোদসীর মুখ অল্পখানি রোদেই লাল হয়ে গেছে। তবু, কেনো শহর এখনো এলো না ভেবে হতাশা গ্রাস করে নিলো। কাঁধের উপরে আঁচল ভালো করে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। হাহ্ আজ কী আর আসবে না অভদ্র ছেলেটা! উঠে চলে যেতে নিয়েও আরেকবার জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। রোদসীকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই
শহর রাস্তা দিয়ে এই লাইনে ঢুকছে। থমকে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো রোদসী। শহরের ঘামে ভেজা মুখ আর উষ্কখুষ্ক চুল তাঁকে ভাবালো। রোদসী মনে মনে ভাবলো, তাঁর অমন করায় কী শহরের বেশি খারাপ লেগেছে! তবে তো ক্ষমা চাইতে হয়। আহা! কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মানুষদের একজন মনে হলো। যতই হোক, মানুষটার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। খারাপ ব্যবহার করা তো আর ঠিক না তাইনা? বাসায় আসলেই ক্ষমা চাইবে সে। হাতজোড় করে চাইবে। শহর ক্ষমা না করলো সারা রাতে ঘুম হবে না তাঁর। অদৃশ্য অপরাধবোধের কবলে ছটফট করতে থাকবে। অস্থির হয়ে নিচে ছুটে গেলো।
মাথায় আঁচল টেনে নিতে ভুলল না। মুখে হালকা সাজ। যেমনটা নতুন বউয়ের মুখে থাকে। পড়নে হালকা লাল শাড়ি। পিঠে এলিয়ে থাকা চুল গুলো আঁচলে চাপা পড়ে গেলো। এ বাড়িতে প্রতি দিন শিশিরকে পড়াতে এলেও অন্য ঘর গুলোতে যায়নি কখনো। দুটো বেডরুমই দেখেছিলো। একটা শহরের অন্যটা শিশিরের। তাই তেমন চেনা না থাকায় রোদসী ইতস্ততভাবে রান্না ঘরের দিকে গেলো। বেলা বাজে এগারোটা। গুটিগুটি পায়ে সেদিকে যেতেই রোদসী দেখলো দিলারা ও রুমা দুজন মিলে গল্প করতে করতে রান্না করছেন। তাদের প্রচুর মিল। সাধারণত দুই জায়ের এতো মিল থাকেনা। খুব কমই এমন দেখেছে সে। রোদসীকে বাহিরে দাঁড়াতে দেখে দিলারা ব্যস্ত হয়ে গেলেন। অস্থিরভাবে বললেন,
‘একি! তুমি এখানে কেনো এলে? ক্ষুধা লেগেছে বুঝি?’
এমনটা বলায় একটু লজ্জা পেলো রোদসী। ধীরগতির সাথে বলল,
‘না না, আসলে রুমে বসে ভালো লাগছিলো না। ‘
দিলারা হেঁসে বললেন,
‘ওহ, আচ্ছা। গরমে কষ্ট হলে ড্রইং রুমে বসো। আমাদের বাসায় তো আর তোমার সমান কেউ নেই। শিশিরটা এতো চুপচাপ। ওটাও স্কুলে গেছে। আর ইরামিও ছোট। শহরটা সেই যে বের হলো। এখনো আসছেনা। ‘
বলতে বলতেই কলিং বেল বাজলো। রোদসী জানে শহর এসেছে। মনে মনে একপ্রকার অস্বস্তি কাজ করছে। আবার অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ায় ভালোও লাগছে। রুমা রান্না করছিলেন। তাই দিলারাই দরজা খুলে দিলেন। ছেলের চোখমুখ ফ্যাকাশে দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন। শহর ক্লান্ত মুখে হাসলো। একটু দূরে রোদসী এক ধ্যানে শহরকে দেখছে। শহরের নজর এড়ালো না। সেদিকে কোনো প্রতিউত্তর না করে বলল,
‘মা, পানি দাও। ‘
দিলারা দ্রুত পদে পানি নিয়ে ছুটে এলেন। শহর ঢকঢক করে পানিটুকু পান করে পাশে রেখে দিলো। দিলারা শহরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘তোর কী হয়েছে বাপ? এমন শুকনো লাগছে কেনো চোখ মুখ! ‘
শহর মাথা চুলকে নতমুখী হয়ে বলল,
‘আসলে, এক রোগীকে রক্ত দিতে গিয়েছিলাম। ‘
দিলারা চট করে হাত সরিয়ে ফেললেন। চোখে মুখে রাগ দেখা গেলো৷ রোদসী তখন একটু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দিলারার পেছনে। রক্ত দেয়ার কথা শুনে অবাক হলো। দিলারা একই অভিব্যাক্তিতে বললেন,
‘কয়েক দিন আগেই তো দৌড়ে গেলি কাকে যেনো রক্ত দিতে। এক মাসও হলো না। আবার কেনো? ‘
শহর বোকা বোকা হেঁসে বলল,
‘সমস্যা কী মা! বৃদ্ধ একজন মহিলা। সেও তো আমার মায়ের মতো। O+ রক্ত পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমি যেহেতু আগেও দিয়েছিলাম ওইখানে। তাই আমাকে সকালে কল করলো। শরীরে রক্ত তৈরি হতে আর কতক্ষণ লাগে! ‘
দিলারা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ছেলে এমনই বলে কিছু লাভ নেই। তবুও মাঝে মাঝে খুব গর্ব হয় তাঁর। এমন ছেলে পেয়ে ধন্য মনে হয় নিজেকে। ছেলেকে ঘরে গিয়ে আরাম করতে বললেন। শহর প্রশস্ত হেঁসে ঘরে ঢুকে গেলো। রোদসী দিলারার দিকে তাকিয়ে ছিলো প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে। তিনি বললেন,
‘এবার তো তুমি এসেছো। দেখো, ছেলেটাকে যদি একটু বোঝাতে পারো। রক্ত দেয় কদিন পরপরই। শরীরের একেবারেই যত্ন করে না। মা হয়ে এসব দেখতে কী ভালো লাগে বলো! ‘
রোদসী ঠোঁট চেপে রাখলো। কী বলবে বোধ হলো না ঠিকঠাক। শহর নামের যে বোকাসোকা, সহজ সরল আর একটু অভদ্র ছেলেটাকে মনে হয় আজ নতুন করে একবার চিনলো সে। অন্তরালের কথাগুলো বাহিরে আসায় অবাক হয়ে গেছে রোদসী। শহর যে এখনো রোদসীর নিকট অনেকটাই অচেনা তা বুঝতে আর বাকি রইলো না৷ রোদসীর উদ্দেশ্য দিলারা বললেন,
‘ওর খাবারটা গরম করে এনে দিচ্ছি। তুমি কষ্ট করে একটু উপরে নিয়ে যাও তো মা। ‘
রোদসী সম্মতি দিতেই তিনি তাড়াতাড়ি খাবারের প্লেট নিয়ে হাতে দিলেন। রোদসী সেটা নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো হাত মুখ না ধুয়েই বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে আছে। এমনকি জামাটাও বদলায়নি। মুখ কুঁচকে গেলো রোদসী। ও যে মোটেও অপরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে না। শহর এতো অগোছালো নোংরা এটা টের পেয়েছে। ইচ্ছে করছে টেনে উঠিয়ে বাথরুমে ঠেলে দিতে। কিন্তু আরেক মনে ভাবলো, থাক বেচারা রক্ত দিয়ে এসেছে। একটু সহমর্মিতা দেখানো উচিত। আর সকালের ব্যবহারের জন্যও ক্ষমা চাওয়া দরকার। রোদসী হাতের প্লেটটা বেডসাইডে রেখে শহরকে ডাকলো,
‘এই যে, শুনছেন? ‘
শহর চোখ মেলে তাকালো। পুনরায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। রোদসী ভ্রু কুচকে বলল,
‘কী আশ্চর্য! উঠুন। হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেতে হবে। ‘
শহর মুখ ঘষে উঠে দাঁড়ালো। কোনো কথা বললো না।
চোখ মুখে তাঁর সুক্ষ্ম অভিমান। রোদসীকে পাশ কাটিয়ে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। ভদ্রলোকের মতো খাবার খেলো। রোদসী বুঝতে পারলো না কী বলবে। পরিবেশটায় নিজেকে বেমানান লাগছে। শহরের নিশ্চুপ থাকাটা রোদসীর ভালো লাগছে না। শহর তো কখনো চুপ থাকেনা। ওকে মানায়না চুপ থাকা। শহর প্লেট রেখে এসে রেডি হলো। দিলারা বলে গেছেন, রোদসীদের বাসায় যেতে হবে। এটা নাকি নিয়ম। বিয়ের পর দিন যেতেই হয়। রোদসীও প্রস্তুত হলো। কথা বলার জন্য আকুপাকু করছিলো বটে। কিন্তু সুযোগ না পেয়ে মুখ চুপসে রাখলো। দুজন দিলারাকে বলে দোতলায় অর্থাৎ রোদসীর বাসায় গেলো। কেয়া মেয়েকে পেয়ে আপ্লূত হয়ে উঠলেন। অনেক ক্ষণ জড়িয়ে রাখলেন। তারপর শহরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রোদসী মন খারাপ করে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। একটাদিন অন্য জায়গায় থেকে নিজের ঘরটা দেখে অন্য রকম অনুভব করছে। তারপর বারান্দায় গিয়ে তিতুসের কাছে গেলো। তিতুস যেনো ওরই অপেক্ষায় বসে ছিলো। কলকলিয়ে ডাকছে। রোদসী মনে মনে ঠিক করলো, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে কাল। আজকের দিনটা তো এখানেই থাকবে। নিজের বিছানাটা ঝেড়ে নতুন চাদর বিছিয়ে দিলো। পরিপাটি করে বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ পরই শহর আসলো ঘরে। ফোনে কথা বলতে বলতে ঢুকলো। রোদসীকে যেনো চোখেই পড়লো না। কথা বলা শেষে ল্যাপটপ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করলো। রোদসী বারবার বলতে গিয়েও পিছিয়ে যাচ্ছিলো। কেউ যদি এতো কাছে থেকেও না তাকায় তাহলে কীভাবে সেধে কথা বলে! রোদসী তো আর সেই মিশুক না। যে গিয়েই আলাপ জুড়ে দিতে পারবে। আমতা আমতা করে ঘর থেকেই বেরিয়ে গেলো। দুপুরের খাবার দাবার শেষে শহর আবারও বেরিয়ে গেলো। ফিরলো একেবারে রাতে। রোদসী বই পড়ছিলো। নিজে উঠে গিয়ে শরবত বানিয়ে আনলো।
শহরের সামনে ধরলে একপলক তাকিয়ে শহর হাতে নিয়ে গ্লাসটা ধরলো। অল্প অল্প করে শেষ করলো। অবশেষে ঘুমানোর সময় যখন বিছানায় বসেও শহর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিলো তখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না রোদসী। বিছানায় ধপ করে উঠে বসলো। কোনো রকম নাইনুকুড় না করে শহরের হাত থেকে ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিয়ে রেখে বলল,
‘এই ছেলে, আম সরি। সকালে ওরকম বলা আমার উচিত হয়নি। ‘
শহর একটু ভাব নিয়ে তাকালো। হাত ভাজ করে বলল,
‘তো? ‘
‘তো কী! ক্ষমা চেয়েছি। এখন আপনার কর্তব্য হচ্ছে, আমাকে সুন্দর করে বলা, ‘ঠিক আছে আমি কিছু মনে করিনি৷ ‘
শহর বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
‘আর যদি না বলি? ‘
রোদসী ধমক দিয়ে বলল,
‘বলবেন না মানে! এক্ষুনি বলুন। ‘
শহর চুপসে গেলো। এ আবার কী ধরনের মাফ চাওয়া! যদিও সারাদিনে আস্তে আস্তে রাগটা কমেছে। এমন গুন্ডামী করেও যে মাফ চাওয়া যায় জানতো না শহর। ইজ্জতের আর কী বাকি রইলো! তবুও কোনোরকমে বলল,
‘আচ্ছা আচ্ছা, যাও মাফ করে দিলাম। ‘
রোদসী হাসলো একটুখানি৷ শহরের শার্টের কলারটা ধরে টাইট দিয়ে বলল,
‘এবার ঠিক আছে, ঘুমান। ‘
শহর লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপ করে শুয়ে পড়লো। রোদসী মনে মনে হেঁসে বলল,’সারাদিন ভাব নেওয়া তোমার ছুটাচ্ছি। ‘
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।