#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
পর্ব- ১৩+১৪
হাতের ব্যাথার অসহনীয় যন্ত্রণা! নেত্রপল্লবের উপর- নিচপিঠ আঠালো ন্যায়! নেত্রযুগল টেনে খুলতেই বোধগম্য হয় আমার একহাত অন্য কারো অধীনে আবদ্ধ। হাত বেশ ভারী ভারী ঠেকছে। স্পষ্টত তাকাতে দৃশ্যমান হয় পূর্বকে। সে আমার সুস্থ হাত বেশ শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছেন। সর্ব মুখোশ্রীতে তার অদৃশ্য যন্ত্রণাভাব বিরাজমান।
কিয়ৎ স্পষ্টত খেয়াল করতেই দেখা মিললো পূর্বের বর্তমান দশা। তার এক কাঁধ শুভ্র ব্যান্ডেজ দ্বারা মোড়ানো। পূর্বের এই কাধেই গুলি করা হয়েছিলো তা আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে। পূর্ব শার্টলেস!উন্মুক তার বক্ষঃস্থল! পাশেই পরে আছে হসপিটাল থেকে দেয়া রোগীদের জন্য বিশেষ সেই পোশাক। হয়তো খুলে রেখে দিয়েছে।গরম লাগছে কিছুটা। এসি অফ?যদিও ভালো হয়েছে এতে। এসির বাতাস সহ্য হয়না! জ্বর এসে কাহিল অবস্থা হয়ে পড়ে কোল্ড এলার্জি থাকার কারণে। পূর্বকে এখানে দেখে ক্ষনে ক্ষনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে নিভৃতে। কিন্তু উত্তর কে দেবে? পূর্ব মানব যে ঘুমে বিভোর!
তার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। আড়মোড়া ভেঙে ফের নিজে ঘুমোতে নিলেই পূর্ব তার আঁখিযুগল খুলে আমার দিকে ঝুঁকে আধশোয়া হলেন। পূর্বের মুখোশ্রীতে বিদ্যমান উদ্বিগ্নতা! অস্থির হয়ে বললেন,
‘ ব্যাথা করছে কাঁধে? অথবা হাতে? যন্ত্রণা হচ্ছে বেশি?’
আমি ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে বলে উঠি, ‘ উঁহুম! কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? আপনার রেষ্ট প্রয়োজন। নিজের কেবিনে যান। ‘
‘ রেষ্টই তো করছি এখানে। চোখে পড়ছে না? ‘
‘ এতো ছোট বেড! আপনার তো ঠিকমতো জায়গাই হচ্ছেনা। নিজের বেডে গিয়ে ঘুমান যান। ‘
পূর্ব ফের নিজের জায়গাতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লেন। এক পা গুটানো আরেক পা তার বেডের বাহিরে অবস্থান করছে। হাই তুলে ঘুমো ভাব নিয়ে বললেন,
‘ উঁহু! আমি এখানেই ঠিক আছি। ‘
পূর্বের আঁখিজোড়া বন্ধ হতেই আনি উশখুশ করতে লাগলাম। খুদা লেগেছে প্রচন্ড। কিন্তু কাকে বলবো? পূর্ব অসুস্থ নিজেও! আশপাশে শূন্যতা। কেও নেই।
‘ খুদা লেগেছে? খাবে কিছু? ‘
পূর্বের ভরাট কন্ঠ! ডানে তাকাতে দেখি সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন। আমি ইতস্তত বোধ করে বললাম,
‘ হু! কিন্তু আশপাশে কাওকে দেখছি না কেনো? বাসায় কেও জানেনা আমাদের অবস্থান?’
‘ জানে। তুমি জানো কতদিন ধরে সেন্সলেস ছিলে?পুরো ২ দিন! সবাই এই ২ দিন ধরে হসপিটালেই ছিলো।আজ আমি জোর করে বাসায় পাঠিয়েছি সবাইকে। তাই কেও নেই! ‘
আমি চমকে বলে উঠলাম, ‘ ২ দিন?’
পূর্ব উঠে বসলেন এবার। বেডের পাশের অবহেলায় পড়ে থাকা নীল রঙের হাফ শার্টটা তুলে পড়া শুরু করলেন। মাঝে বিরতি নিয়ে বললেন,
‘ জি! ২ দিন। রেষ্ট নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি। ‘
‘ আপনার যাওয়ার দরকার কি? ফোন করে কাওকে বললেই তো হয়। আপনি নিজেও অসুস্থ। উঠবেন না! ‘
পূর্ব আমার কথা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই বেড থেকে নেমে পড়েছেন। দু’হাত পকেটে গুঁজে নিয়ে বাম চোখের ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে আছেন এ মূর্হতে। এই লোক সর্বদা এভাবে রাশভারী দৃষ্টিতে তাকায়। আগে ভয় করতো এই দৃষ্টি! কিন্তু এখন, এভাবে তার তাকানো যেনো আমার অন্যরকম এক ভালো লাগা। পূর্ব রাশভারী কন্ঠে বললেন,
‘ রেস্ট তাও আবার ডাক্তারদের? হাহ্! এই ২ দিনে কমপক্ষে ৮ টার বেশি সার্জারী করতে হয়েছে আমাকে। অসুস্থ বলে ছাড় দেয়নি কতৃপক্ষ! তাছাড়া আমি ঠিক আছি। এতটুকু আঘাতে কিছু হয়না আমার। ‘
পূর্ব ত্রস্ত গতীতে বের হয়ে গিয়েছেন তৎক্ষনাৎ। আমার এতো কথার মধ্যে জিজ্ঞেসই করা হলো না আসলে আমাদের দু’জনকে আঘাত করলো কে?তাও গুলি?
.
পূর্ব বেশ মনোযোগ সহকারে আমার মেডিকেল রিপোর্ট দেখছেন। একদম নিশ্চুপ ভঙ্গিতে! মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা বলছেন অরণ্য ভাইয়ার সাথে। অরণ্য ভাইয়া পূর্বের বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু! বেষ্টফ্রেন্ড যাকে বলে। অরণ্য ভাইয়া’ও একজন ডাক্তার। তার আন্ডারেই মূলত আমার চিকিৎসা হচ্ছে।
পূর্বের সাথে কথা বলার জন্য বারংবার উদ্যক্ত হতেই সে হাত দিয়ে আমায় থামিয়ে দিচ্ছেন প্রতিবার। ইশারায় কর্কশ ভঙ্গিতে বলছেন, ‘ আগে খাওয়া শেষ করো। তারপর কথা। খাওয়া শেষ না হওয়া অব্দি একটা শব্দও যেনো ঠোঁট দিয়ে উচ্চারিত না হয়।’
শাষাণোর ভঙ্গিতে কথাগুলো ইশারায় দূর হতে বললেন পূর্ব। অরণ্য ভাইয়া হাসছেন পূর্বের বলার ভঙ্গি দেখে। আমার হাসি পেলেও তা রাগের আড়ালে চাপা পড়ে যায়।হুহ্ যত্তসব! যখন তখন উদ্ভট আদেশ দিয়ে ক্ষ্যান্ত হন! আমাকে না জ্বালালে এই লোকের পেটের ভাত হজম হয়না মেইবি।
অরণ্য ভাইয়া আমার পাশে এসে টুল টেনে বসে গাল ধরে টেনে বললেন, ‘ কেমন আছে লিটল গার্ল?’
ভাইয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুখোশ্রী পাংশুটে করে নিয়ে বললাম,
‘ ভাইয়া তুমি এই “লিটল গার্ল ‘ বলা কবে ছাড়বে?আমি তো এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। ছোট নেই। এটদ বলে ডাকবেনা আমায়! ‘
অরণ্য ভাইয়া একগাল হাসলেন। এই ব্যাক্তি সর্বদা আমার এ কথার পরিবর্তে শুধু হাসেন। উত্তর দেননা! আর না অন্য কিছু প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন। আমি খানিক বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম,
‘ তোমার হাসি অন্য মেয়েদের দেখিয়ে তাদের হার্ট অ্যাটাক করাও ভাইয়া আমাকে এই হাসি অযথা প্রদর্শন করাবে না। আই নিড এন্সার। ‘
অরণ্য ভাইয়া চুলে হাত গলিয়ে বললেন, ‘ আমি কি পূর্বের থেকে কম হ্যান্ডসাম দোল?’
কিয়ৎ ভড়কানো কন্ঠে বলি, ‘ নাহ্ তো। আমি কি সেটা বলেছি? কিসের ভিতর কি বলছো? ‘
‘ তাহলে তোমার মতো কোনো কিউট মেয়ে এখন অব্দি প্রপোজ করলো না। আমি তো সেই শোকে কাহিল! ‘
অরণ্য ভাইয়ার কথায় খিলখিল করে হেঁসে দেই। পূর্ব স্বাভাবিক! থাকারই কথা। এই ব্যাক্তি আবার হাসতে জানে নাকি?হুহ্!
অরণ্য ভাইয়া চলে গেলেন আমার ক্ষতস্থান শেষ বারের মতোন দেখে। খাবার শেষ হতেই পূর্ব এগিয়ে এসে ট্রে অন্যত্রে রাখলেন। হাতে ঔষধ আর পানির গ্লাস তুলে দেয়ার পর চটপট সব কিছু শেষ করে ব্যাকুল হয়ে বললাম,
‘ এবার আমি বলি?’
তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ বলো! তবে জলদি, সময় নেই আমার। ‘
‘ গুলি কারা করলো আমাদের? কেনোই বা করলো?’
পূর্ব তপ্তশ্বাস ছেড়ে উঁচু কন্ঠে বললেন, ‘ এহসান লোকটাকে ভেতরে ডাকো। ‘
সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের দরজা খুলে আগমন ঘটে একজন মধ্যবয়স্ক লোকের। মধ্যবয়স্ক বললে ভুল হবে যদিও। সামনে অবস্থানরত ছেলেটার বয়স কমপক্ষে ২৮+ হবে। হাত – পায়ে ব্যান্ডেজ। প্লাস্টার দিয়ে ঝুলছে দু’হাত। মাথায় বেশ বড় এক ব্যান্ডেজ করা। আমি লোকটাকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলি,
‘ এই লোকটাকে ডেকেছেন কেনো?’
পূর্ব ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, ‘ এই ব্যাক্তিই গুলি করেছে আমাদের। ও একজন সিক্রেট ইনফর্মার। ভাব দেখাতে বেশ বড় দু’জন অপরাধী কে ধরতে নিয়েছিলো। ক্রিমিনাল’দের মধ্যে একজন ছেলে একজন মেয়ে ছিলো। আনফরচুনেটলি ক্রিমিনাল দু’জনের ড্রেসআপ আমাদের মতোই ছিলো কিছুটা তবে পুরোপুরি নয়। আর এই বেকুব! আমাদের ঐ দু’জন ক্রিমিনাল ভেবে দূর থেকে গুলি করেছে আটকাতে। ষ্টুপিড অফিসার! অফিসার নামের কলঙ্ক একটা। ‘
শেষোক্ত কথা চিবিয়ে বলে লোকটির দিকে রক্তিম আঁখিতে তাকালেন পূর্ব। আমি হতভম্ব! সিক্রেট ইনফর্মার এত বেকুব হয়? এতোটা কেয়ারলেস? হজম হচ্ছেনা! আমি ধাতস্থ হয়ে বলি,
‘ ওনাকে এভাবে মেরেছে কে?’
পূর্ব ডোন্ট কেয়ার ভাবে উত্তর দেন, ‘ আই ডোন্ট নো! ‘
‘ শাস্তি হয়নি তার?’
‘ হয়নি মানে? চাকরি থেকে বের করে জেল দিয়েছে। এমন ফাউল লোককে এতোটা ইম্পর্ট্যান্ট পদে কে রাখে? একে এলাউ করেছে কে? কে জানে! ‘
এবার মুখ খুললো সেই ব্যাক্তি। কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
‘ মাফ করে দিন স্যার, ম্যাম! প্রমোশন পাওয়ার লোভে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই দু’জন ক্রিমিনাল কে ধরলে আমি বেশ বড় পদে যেতে পারতাম। তাছাড়া ঐ দু’জন ক্রিমিনাল কে পেছন থেকে হুবহু আপনাদের মতো দেখতে লাগে। তাই.. মাফ করে দেন স্যার! আর মাইর – টাইর দিয়েন না। ম্যাম তো ভালো হয়ে গেছে। আপনি বলছিলেন ম্যাম সুস্থ না হওয়া অব্দি মারতেই থাকবেন। এখন ছেড়ে দেন স্যার! ‘
আমি বাঁকা চোখে পূর্বের দিকে তাকাতে সে এহসান কে নির্দেশ দেয় লোকটিকে বাহিরে নিয়ে যেতে। অতঃপর আমার কাছে তড়িৎ বেগে এসে পড়নের ব্লাঙ্কেট ঠিকমতো দিয়ে চটপট বললেন,
‘ রেষ্ট করো। বেড থেকে নামবেনা। দরকার হলে নার্সকে ডাকবে। একটু পর বাসার সবাই আসবে। আমি যাচ্ছি! অপারেশন করতে হবে। ‘
পূর্ব কথা শেষ করে আমায় কিছু বলার বিন্দুক্ষণ না দিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলেন কেবিন থেকে। আমি ক্ষুদ্ধ বেশ! পূর্বই যে এই লোকটাকে মেরে আধমরা করেছে তা বেশ নিশ্চিত আমি। কিন্তু লোকটা যা বলল? তাও সত্যি বলে মনে হচ্ছেনা। তার নেত্রযুগল তাই বলছিলো। কিছু তো আছে যা সে লুকিয়েছে। নয়তো ক্রিমিনাল ভেবে কাওকে গুলি?
_____ (১৪)…
বাসায় এসেছি আজ ৪ দিন। পুরোপুরি সুস্থ এখন বলা চলে। তবুও বাসার বহির্ভাগে পা ফেলা তবুও আমার পুরোপুরি নিষিদ্ধ! এই নিষিদ্ধকরণ আরোপ করেছে পূর্ব। এই ব্যাক্তি কানাডা গিয়েও আমার থেকে দৃষ্টি তার এক বিন্দুও নড়েনি। সর্ব মূর্হত আমি কি করছি? না করছি সব খবরা-খবর অদৃশ্য ভাবে পূর্ব জেনে যেতেন। বাসা থেকে বের হতে উদ্যক্ত হলেই পূর্বের কল আসতো ঠিক সেই ক্ষণটাতে! বড় কয়েকটা ঝাড়ি, কর্কশ কন্ঠে ধমক দিয়ে আঁটকে রাখতেন আমায় বাসাতেই! পূর্বের কান্ডে ঠোঁট চেপে সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আমার। তার বিরুদ্ধে যেতে নিলেও মা, ভাইয়ের ধমক আলাদা ভাবে এসে আমার ওপর আরোপ হয়! লোকটা দূরে গিয়েও শান্তি দিচ্ছেনা। বিশাল যন্ত্রণা!
পালিত খরগোশ যুগলকে খাবার দিয়ে কফি মগ হাতে ডিভানে বসতেই একফালি কর্কশ ধ্বনি কর্ণপাত হলো। না দেখেই আমার বোঝার বাকি রইলো না এই মধ্যরাতে কে ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে স্পিকার অন করে পাশে রাখতেই অপাশ হতে পূর্ব গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললেন,
‘ রাতে না ঘুমিয়ে বেলকনিতে কেনো এসেছো?আর হাতের কফি এখনি ফেলে দাও। এখন কফি খেলে ঘুম আসবে না। রুমে গিয়ে বেডে যাও ফাস্ট! ‘
পূর্বের কথায় চমকালাম না। এটা জানা ব্যাপার। সে আমার সব করা কর্ম কিভাবে যেনো জেনে যান! ব্যাপারটায় আগে কৌতূহল লাগতো। কিন্তু এখন স্বাভাবিক! জিজ্ঞেস করে উত্তর না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে শান্ত হয়ে গিয়েছি।
‘ কি হলো যাচ্ছোনা কেনো এখনো? ‘
আমি অতীব শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠি, ‘ আপনার রুমের ঠিক কোন কোন জায়গায় আপনি সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন বলুন তো? ঝটপট বলুন! খুঁজে বের করে আমি এক – একটা ক্যামেরা চুরমার করে ভাঙবো! ‘
পূর্ব নিঃশব্দে যে কিয়ৎ হলেও হেঁসেছেন তা ঢের বুঝতে পারলাম। প্রতিবারের মতো সে আমার প্রশ্নে পানি ঢেলে ফিচেল কন্ঠে বললেন,
‘ ফালতু কথা ফেলে ঘুমাও যাও! ‘
টুট! টুট! শব্দ ফোন কেটে যাওয়ার পর আজও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হলো। এতো এতো প্রশ্ন আমার! উত্তর তো দিলোনা একটারও। এই কারণে কবে যেনো পূর্ব নামক ব্যাক্তিটাকে খু-ন করে ফেলি!
___
পরেরদিন শুভ্র সকালের আগমন ঘটতেই বাসায় মানুষ ভর্তি! গিজগিজ করছে। পা ফেলার জায়গা বলা চলে নেই। ভাইয়ার এংগেইজমেন্ট আজ। তাই নিকট আত্মীয় স্বজনরা সকাল সকালই চলে এসেছেন আব্বু আম্মুর কাজে হেল্প করতে। পুরো ফ্লাট নিঃশব্দে অবলোকন করে সোফায় বসে পড়ি। বসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা মিললো পূর্বের। তাকে এতো সকালে এখানে দেখে কিয়ৎ ভড়কে যাই। উঠে দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে এগিয়ে নম্র কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি এখানে? ‘
‘ তোমাকে নিতে এসেছি। তৈরি হও! আজ থেকে ক্যাম্পাসে যাচ্ছো তুমি। ‘
পূর্ব মানবের দৃষ্টি ফোনে স্থির। সেভাবেই প্রতুত্তর করলেন। আমার খুশিতে গদগদ অবস্থা। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠি, ‘ বসুন একটু। আসছি আমি! ‘
রুমের দিকে যেতে নিতেই ফুপাতো ভাইয়ের পাঁচ বছরের মেয়ে তুয়া এসে আমার রাস্তা রোধ করে দাঁড়ালো। দু’হাত কোমড়ে রেখে আঙুল উঁচু করে বলল,
‘ দোলফুপ্পি? ঐ ভাইয়াটা কে? ‘
তুয়া পূর্বের দিকে আঙুল তাক করলো। কিছু বলতে নিয়ে থেমে গিয়ে খানিক দুষ্টু কন্ঠে বলি,
‘ ঐটা ভাইয়া না। ঐটা তোমার নানা হয় তুয়া। সে আমার মামা হয় বুঝলে? আমি তার ভাগ্নী।’
তুয়া বোধহয় বিশ্বাস করলো না। তবুও মাথা নেড়ে বিজ্ঞদের মতো বলল, ‘ ওহ! আমি নানার কাছে যাবো?’
তুয়াকে ইশারায় যেতে বলে আমি আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। তুয়ার মুখে ‘ নানা ‘ ডাক শুনে পূর্বের ঠিক কেমন রিয়াকশন হয়, তা দেখার জন্য তুয়াকে মিথ্যা বলা আমার।
পূর্ব পানি খেতে নিচ্ছিলেন তৎক্ষনাৎ তুয়া তার সামনে গিয়ে উঁচু কন্ঠে বলল, ‘ নানাভাই। ‘
পূর্ব ফিক করে মুখ থেকে পানি ফেলে দেয়। নেত্র যুগল বিশাল করে তুয়ার পানে দৃষ্টি তার। থেমে বললেন, ‘ নানা? আমি তোমার নানা হই?’
‘ জি। দোলফুপ্পি বলেছে। আপনি দোল ফুপ্পির মামা হন না? ফুপ্পির মামা তো আমার নানা হয়। ‘
ঘাড় কাত করে পূর্ব আমার রুমের দিকে দৃষ্টি দিতেই সরে পড়ি। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ খিলখিলিয়ে হেঁসে ওয়াশরুমে একসেট পোশাক নিয়ে ঢুকে পড়ি চেঞ্জ করতে!
.
খানিকক্ষণ বাদে পরিপাটি হয়ে ওয়াশরুমের বাহিরে পা রাখতেই হাতে হেঁচকা টান পড়লো। হাত ধরে টান দেয়া ব্যাক্তি ছিলেন পূর্ব। সে আমায় কাবার্ডের সাথে আলত করে আঁটকে নিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বললেন,
‘ মামা হই আমি তোমার না?’হুহ্? ‘
আমি কৃত্রিম উত্তেজনা দেখিয়ে বললাম,’ ছিহ্! কি বলছেন এসব? আপনি তো আমার স্বামী হোন! মামা টানছেন কেনো?’
আমার দুই বাহুতে থাকা পূর্বের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন কিছুটা শক্ত হলো। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে পূর্বের পানে দৃষ্টিপাত ফেলতেই তিনি বললেন,
‘ তুয়াকে তাহলে আমি বলেছি না আমি তোমার মামা হই? বেকুব লাগে আমাকে, বেকুব?’
চোরা হেঁসে আশপাশে অবলোকন করি পালানোর নূন্যতম রাস্তা খোঁজার জন্য। কিয়ৎক্ষণ বাদে ব্যার্থ হয়ে নতজানু হয়ে বললাম,
‘ ক্যাম্পাসে যাবেন না? লেট হচ্ছে তো। ‘
‘ যতক্ষণ না তুমি উত্তর দিচ্ছো ততক্ষণ অব্দি তোমাকে ছাড়ছিনা মাইন্ড ইট! সবকিছু ছেড়ে আমায় নিজের মামা মনে করলে কিভাবে?’
হুট করে মুখ ফসকে বলে উঠি, ‘ আপনাকে আমার মামার মতোই লাগে। আমার বড় মামা একদম আপনার মতো গম্ভীর! স্বল্পভাষী! আর প্রচন্ড রাগী! সব গুন মিলে গিয়েছে তাই বলেছি। বুঝলেন? আপনাকে দেখে আমার হ্যাজবেন্ড, হ্যাজবেন্ড ফিলিং’স আসে না। টিচারই মনে করি আপনাকে এখনো। আর কিছু না! স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হয় বুঝি? আপনি তো সর্বদা থাকেন আমায় বকা, ধমক দেয়ার ছলে। এটা কোনো নরমাল ম্যারিড লাইফ না! এটা একজন টিচার এবং স্টুডেন্টের প্রাত্যাহিক দৈনন্দিন কর্মকান্ড। ‘
কথার ইতি টেনে লম্বা শ্বাস ফেলে মুক্ত এক হাত দ্বারা নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরি। এটা কি বললাম আমি? মাই গড! এসব আমিই বলেছি তো?পূর্ব কি ভাবছে আমার কথা শুনে?ছিহঃ! লজ্জা, সঙ্কোচ নিয়ে আঁড়চোখে পূর্বের মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলতেই দৃশ্যমান হলো পূর্বের অধর কোণের ফিচেল হাসি! তিনি তার যুগল ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘ আচ্ছাহ্? আমরা যেভাবে একে অপরের সাথে বিহেভ করছি সেটা হ্যাজবেন্ড – ওয়াইফ টাইপ বিহেভ না? এটাই বলতে চাচ্ছো? ফাইন! সো, মিসেস. মেহরুজ! আপনিই বলুন তো নরমালি হ্যাজবেন্ড, ওয়াইফ এর লাইফ ঠিক কি টাইপের হয়? তুমি বলো নয়তো আমি প্রাক্টিক্যালি করে দেখাই? ‘
নিশ্চুপ আমি! লাজুকলতায় রূপ নিয়ে রীতিমতো লাল, নীল হয়ে যাচ্ছি। কি এক অপ্রতিভ অবস্থা! সেকেন্ড খানিক পর পূর্ব ঝুঁকে বললেন,
‘ এন্সার নেই মিসেস.? ওকে প্রবলেম নেই! আমি প্র্যাক্টিক্যালি করে দেখাই নরমালি হ্যাজবেন্ড এন্ড ওয়াইফ এর লাইফ আসলে কি টাইপের হয়ে থাকে! ‘
চলবে…