মেঘের উল্টোপিঠ পর্ব-২৮

0
584

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#লেখনীতে-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব_২৮

অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বার্তা যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে লঘু মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছায় তখন হটাৎই সবকিছু যেনো লহমায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। বারংবার কর্ণকুহরে প্রতিফলিত হতে লাগলো মায়ের বলা শব্দফালি। হাত, পা তুমুল কাঁপছে। চঞ্চল নেত্র যুগল আই.সি.ইউ এর মধ্যে থাকা ব্যাক্তিকে দর্শন করার ইচ্ছে পোষণ করে তুমুল অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। নেত্রযুগল বন্ধ করে অন্তঃস্থল কে মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার প্রয়াসে ব্যার্থ হতেই আঁখি দ্বারা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।

‘ দোল প্লিজ! এতোটা হাইপার হতে নেই। শান্ত হও।পূর্ব ঠিক হয়ে যাবে ডক্টর বলল না?’

আহত দৃষ্টিতে তারা আপুর পানে চাহনি নিক্ষেপ করলাম ধীরে। শেষে নিষ্প্রভ কন্ঠে বলি,

‘ মাথায় উনি অনেক আঘাত পেয়েছে আপু। পায়ে ফ্রেকচার। একহাত ভেঙে গিয়েছে। ঘাড়ের রগে টান লেগেছে। শরীর ক্ষতবিক্ষত তার। তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো? পূর্ব কতটা কষ্ট পাচ্ছে জানো তুমি আপু? ‘

তারা আপু তপ্তশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ হয়ে বললেন,

‘ বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। বুঝতে পারছি পূর্ব’টার অবস্থাও। কিন্তু পূর্বকে ঠিক রাখতে তোমায় নিজের খেয়াল রাখতে হবে না? নিজের কি হাল করেছো দেখেছো? সেই সকালে এসেছো। না খাওয়া সারাদিন। এখন রাত শেষ হতে চললো। একটু খাও বোন। অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। পূর্ব তোমার এই অবস্থা দেখলে কতটা কষ্ট পাবে জানো? দেখি ‘ হা ‘ করো তো। কান্না থামাও। ‘

খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকা সত্বেও জোরপূর্বক অল্পস্বল্প খেতে হচ্ছে। আসলেই তো! পূর্ব তার আহত অবস্থার ব্যাথা থেকে আমায় দেখলে পাগলপ্রায় হয়ে যাবেন। এতদিনে তার ব্যাবহার, আচরণ এবং বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান তো আহরণ হয়েছে আমার।
পূর্বকে আরেকটু পর বেডে দেয়া হবে। আঘাত গুলো গুরুতর হলেও এখন একটু হলেও সুস্থ তিনি। তার এক্সিডেন্টের পিছনে কে দায়ী? তা জানার জন্য পুলিশের কাছে গিয়েছে অভ্র ভাইয়া। সম্ভবত রিপোর্ট লিখতে। পূর্বের এহেন অবস্থা দর্শন করার পর ঠিকমতো শ্বাস নেয়াও যেনো দায় হয়ে পড়েছে আমার। এতোটা দূর্বল হয়ে পড়েছি তা প্রতি?তার বিন্দু লেশ খেয়াল নেই আমাতে।

কিয়ংদশ বাদে পূর্বের জ্ঞান ফিরলে তাকে বেডে দেয়া হয়। একে একে সকলে সাক্ষাৎ করে আসেন তার সাথে। শেষে আমাকে ভিতরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতেই আমি আমতা আমতা করে ব্যাপারটা কাটিয়ে নেই ক্ষনিকের জন্য। সবাইকে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য বাসায় পাঠিয়ে দেয়া শেষে পূর্বের কেবিনের দিকে অগ্রসর হতেই কেবিন হতে একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এসে বলল,

‘ দোলা ম্যাম! জলদি ভিতরে যান প্লিজ। পূর্ব স্যার অনেক পাগলামো করছেন। ওনাকে ঔষধ খাওয়ানো যাচ্ছেনা। বারবার আপনার নাম ধরে চিল্লাচ্ছেন তিনি। স্যালাইনের ক্যানেলাও খুলতে নিয়েছিলো। বহুকষ্টে থামিয়েছি। আপনি প্লিজ দ্রুত যান তার কাছে। ‘

আমি বিস্মিত হয়ে শুভ্র দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো পূর্বের রুষ্ট দৃষ্টিপাত। ক্ষুব্ধ হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। শব্দ হতেই তিনি আমাতে দৃষ্টি ফেলে মুখোশ্রী স্বাভাবিক করে বললেন,

‘ তুমি এসেছো? ‘

প্রতিত্তুর করার আগেই কেবিনে উপস্থিত ডাক্তার মুচকি হেঁসে বললেন,

‘ নিন এবার নিজের স্বামীকে সামলান। তিনি তো আপনার জন্য প্রায় পাগল করে তুলছিলো আমাদের। ইউ আর সো লাকি দোল! পূর্ব তোমায় অনেক বেশিই ভালোবাসে। ওকে খাইয়ে দিয়ে ঔষধ গুলো খাওয়ায় দিও। ‘

ডাক্তার চলে গেলেন। সাথে তার সাথে থাকা ইন্টার্নি করা ডাক্তার’টাও। যাওয়ার আগে শেষোক্ত কম বয়সী ডাক্তার চোখ টিপ দিতেই লজ্জা কাজ করলো। অদ্ভুত! এতোটা পাগলামো করার কি আছে? কেবিন শূন্য হতেই তড়িৎ বেগে পূর্বের সম্মুখে গিয়ে কড়া কন্ঠে বলে উঠি,

‘ এমনটা করার মানে কি পূর্ব? ‘

পূর্ব আমার বাহু টেনে ধরে তার পাশে বসালেন। হাতে তার ওষ্ঠাধর স্পর্শ করে আলত সুরে বললেন,

‘ কেমনটা?’

আমি একটু মিইয়ে যাই৷ পূর্বের আলত কন্ঠ আগত রাগকে দমন করে পানিতে পরিণত করলো। কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলি,

‘ সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে আসতে লেট হচ্ছিলো। সেই কারণে আমার আসতে লেট হয়েছিলো। তাই বলে এমন পাগলামো করলেন কেনো? আমি তো আপনার কাছে আসতামই। ‘

পূর্ব নিরুত্তর। সে নিজ ঘাড় খুব সাবধানে পিছনে এলিয়ে আমায় সুস্থ হাতটা দ্বারা আঁকড়ে নিলেন। চুল নিজের ওষ্ঠাধর ছুঁইয়ে ভরাট কন্ঠে বললেন,

‘ পুরো ১৮ ঘন্টা ১৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ড আমি আমার স্নিগ্ধময়ী কে এক পলক দেখিনি। আমার কি অস্থির হওয়াটা জায়েজ না দোলপাখি?হুহ্?’

মৌনতা বজায় রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। এতটুকু সময়ের মাঝে মনে হচ্ছে তার মুখোশ্রীতে মলিনতা এসে ভর করেছে। সতেজতা ঠেলে রাজত্ব নিয়েছে ক্লান্ততা! কপাল’টা শুভ্র ব্যান্ডেজ দ্বারা আবৃত। ঘাড়ের পেছনটায় একই ব্যান্ডেজ। হাতে প্লাস্টার ঝুলানো। পায়ের মাঝেও অধিকার খাটিয়ে নিয়েছে ব্যান্ডেজ এর দল। সবকিছু এলোমেলো রূপে পরিণত হলেও প্রাণবন্ত আছে তার নীল মনি’বিশিষ্ট আঁখি জোড়া।

অন্তঃস্থল ভার হলো। নেত্র যুগল হতে অশ্রুকণা বারংবার গড়িয়ে পড়ার অনুমতি চাচ্ছে। নিজেকে সর্বোচ্চ ধাতস্থ করে বললাম,

‘ আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? ‘

আমার কন্ঠস্বর শুনে পূর্ব হয়তো আন্দাজ করতে পারলো আমার অন্তঃকরণের বার্তা। শোচনীয় অবস্থাটা। তিনি উদগ্রীব হয়ে বললেন,

‘ একটুও ব্যাথা করছে না আমার। বিশ্বাস করো। ইনজেকশন দিয়েছে একটু আগে। ব্যাথা করবে কি করে? আ’ম অলরাইট! বাট তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? আর ইউ ওকে? রাতে খেয়েছো?’

‘ খেয়েছি। ‘

উত্তর দেয়া শেষে চট করে পূর্বের খাবারের কথা মনে পড়লো। তাকে তো খাওয়ানো হয়নি এখনো। গহীনে নিজেকে শ’খানেক গালি দিয়ে উঠতে নিলেই পেছন থেকে হাত চেপে ধরলেন পূর্ব। উত্তেজিত হয়ে বললেন,

‘ এই মেয়ে কই যাচ্ছো? আমার পাশ থেকে বিন্দু মাত্র নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছিনা?’

‘ আপনার খাবার আনতে যাচ্ছি। এখনো তো কিছুই খাননি। ঔষধ খাওয়াও বাকি। বসুন! এখনি আসছি। ‘

পূর্ব হাত ছেড়ে দিলেন। চটপট ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে বেড সাইড টেবিলে পড়ে থাকা প্লেট হাতে তুলে নিয়ে পূর্বের পাশে বসি। খাবার মাখিয়ে তার ওষ্ঠাধর সম্মুখে ধরতেই তিনি আঁখি যুগল বড়সড় করে তাকালেন। আমি খানিক ইতস্তত বোধ করে বলি,

‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো?অদ্ভুত! ‘

পূর্ব কন্ঠে অবাকের রেশ টেনে বললেন,

‘ তুমি আমায় খাইয়ে দিচ্ছো, আই কান্ট বিলিভ! যেই মেয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে অব্দি লজ্জায় কাঁপতে থাকে সে আমায় আজ নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে? গড! এই মোমেন্ট’টা এটলিষ্ট ছবি তুলে ইতিহাসের পাতায় লাগিয়ে রাখা উচিত। ‘

‘ আপনার কি সৃতিশক্তি চলে গিয়েছে পূর্ব? এতো কথা বলছেন তাও আবার অযৌক্তিক কথাবার্তা। আগে তো একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের হতো বহু কষ্টে। যাইহোক! আপনি কি খাবেন? নাকি আমি চলে যাবো?’

পূর্ব কথা মতোন ‘ হা ‘ করলেন। খাবার গলাধঃকরণ করার পূর্বে এবারও আঙুলে কামড় দিতে ভুললেন না। এই লহমায় তার প্রতি রাগ উঠলো না। বকতে ইচ্ছে করলো না। বরঞ্চ তিনি যা করছেন সেগুলো নোট করে মস্তিষ্কে এঁটে রাখতে ইচ্ছে জন্ম নিলো অন্তঃকরণে। কি অদ্ভুত!

পূর্ব খাওয়া শেষেই হুট করে আমার কোল দখল করে শুয়ে পড়লেন। তার এহেন কান্ডে হকচকিয়ে বলি,

‘ কি করছেন? ঘাড়ে ব্যাথা পাবেন তো। বালিশে মাথা রাখুন। ‘

পূর্ব কুঁকড়ে গিয়ে আমাতে আরো নিবিড় হয়ে নিচু স্বরে বললেন,

‘ উঁহু! ব্যাথা লাগবেনা বরং শান্তি লাগবে। ‘

পূর্ব তার নেত্রযুগল বন্ধ করতেই আমি আমার কাঁপা কাঁপা হাত তার চুলের মাঝে ডুবিয়ে দেই। আস্তে আস্তে স্থির হাত স্থিতিশীলতা ফেলে চলমান হয়।পূর্বের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া শুরু করতেই দৃশ্যমান হয় সেই ব্যাক্তির অধর কোণের মৃদু হাসি।পরিশেষে নিঃশব্দ রুমে ভারী নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে দেয়। রাতে যখন অরণ্য ভাইয়া রাউন্ডে আসেন পূর্বকে দেখতে তখন তার অবস্থান আমার কোলে দেখে মুচকি হাসেন। সেই ক্ষণে লজ্জায় চুপসে নতজানু হয়েছিলাম। অরণ্য ভাইয়া রুম থেকে প্রস্থান করতেই হাফ ছেড়ে বাঁচি। ঘুমন্ত পূর্বকে শেষোক্ত দর্শন করতেই বিড়বিড়িয়ে বলি,

‘ আপনি পৃথিবীর সবথেকে শুদ্ধতম সুদর্শন পুরুষ পূর্ব। আপনার প্রণয়ের পবিত্র বহিঃপ্রকাশ আজ আমার মতোন কঠিন মেয়েকে আপনার প্রণয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। ‘

_________________

প্রভাতের বিশুদ্ধ অনিল যখন সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে গেলো তখনই চট করে নেত্র যুগল উন্মুক্ত করতেই দৃশ্যমান হয় পূর্বের মুখোশ্রী। আমার অবস্থান তখন তার বক্ষঃস্থলে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম তৎক্ষনাৎ। কিন্তু যতদূর আমার স্বরণে আছে আমি ঘুমে মগ্ন হওয়ার পূর্বে বিছানার সাথে মাথা এলিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পূর্বের বক্ষঃস্থলে কখন আসলাম আমি? নিশ্চিত পূর্বের কাজ। লোকটা পাগল! ব্যাথা পেলে তখন? ক্ষতগুলো কাঁচা এখনো। রেগেমেগে তার মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টি ফেলে বিছানা থেকে নেমে পড়ি। চোখে পানি দেয়া প্রয়োজন। আখিদুটো জ্বলছে ভীষণ। কাল তাড়াহুড়োর চোটে নেত্রে ড্রপ দেয়া হয়নি।

ওয়াশরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মুখোশ্রী মুছতে মুছতে বের হতেই দৃশ্যমান হয় পূর্ব তার একহাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। আমি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে চটজলদি তাকে ধরে বসিয়ে দিয়ে কড়া কন্ঠে বলি,

‘ পাগল হয়েছেন? একা একা বসতে যাচ্ছেন কেনো? আমাকে ডাকলেই পারতেন। ‘

পূর্বকে ইতস্তত দেখালো। তিনি হাসফাস করা শেষে বললেন,

‘ আমাকে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাবে?’

‘ আসুন। এভাবে বলার কি আছে?’

‘ আব.., আমার ভর নিতে পারবে? ‘

পূর্বের কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে। সন্দিহান গলায় বলি,

‘ আপনি এভাবে বলছেন যেনো আপনার ওজন ১০০+! আপনাকে দেখতে ভীষণ স্লিম লাগে জানেন?’

পূর্ব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমার হাত রেখে ওয়াশরুমে সামনে এসে আমায় বাহিরে থাকতে বলে নিজে ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিয়ৎ বাদে বেড়িয়ে আসলেন তিনি। পূর্বকে ধরে বেডে বসিয়ে সরে যেতে নিলেই সে আমার একহাত হেঁচকা টানে নিজের নিকট নিয়ে নিবিড় ভাবে জরীয়ে ধরলেন। কানের নিকট ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ আমার এক্সিডেন্ট কে করেছে জানো? আয়াফ! ও দায়ী। ওর মূল উদ্দেশ্য আমায় আহত করে রাস্তা খালি করা। অতঃপর ‘ তুমি ‘ আয়াফের মূল লক্ষ্য। আমার থেকে এক বিন্দুও দূরে থেকোনা দোলপাখি, একবার আয়াফের কবলে তুমি চলে গেলে তোমায় আমি ফিরিয়ে আনতে পারবো কিনা নিশ্চয়তা নেই,’

পূর্বের নিষ্প্রভ কন্ঠ। আমি থম মেরে আছি। কিছুক্ষণ বাদে অনুভূত হলো কানের নিচের অংশটায় কোমল স্পর্শ। অনবরত সেই স্পর্শ গভীর হচ্ছে ধীরে ধীরে…!

চলবে,

#নোট- রি- চেইক করা হয়নি।