#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
পর্ব-১৬
‘ পূর্ব, তিশানকে কারা যেনো কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে দুইদিন হলো৷ ওরা তিশানকে খুব মেরেছে। মুক্তিপণ হিসেবে দোলকে চাইছে ওরা৷ টাকা চায়নি! তু..তুমি প্লিজ দোলকে ওদের হাতে তুলে দাও। নাহলে তিশানকে ওরা মেরে ফেলবে! ‘
উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত! সকলের মৌনতা পালনের মধ্যে হটাৎ আম্মু তড়িৎ বেগে এসে আপুর সামনে দাঁড়ায়। মাটি থেকে আপুর হাত টেনে ধরে তাকে দাঁড়ালেন। আশপাশ না দেখে আম্মু আপুকে অনবরত আঘাত করতে থাকলেন তার চর্বিযুক্ত গালে। কেও এসে থামাচ্ছে না আম্মুকে। আর নাই বা আপু! সে নিশ্চুপ! আচানক আম্মু চিল্লিয়ে বললেন,
‘ তুই যে আমার রক্তের সন্তান না তা প্রমাণ করে দিলি দিবা। আমি তোর থেকে এটা আশা করিনি। বোনের মেয়ে বলে কখনো তোকে অবহেলা, অনাদরে রাখিনি। দোলা, সায়ানকে যেভাবে বড় করেছি তার থেকে দ্বিগুণ ভালোবাসা দিয়ে তোকে বড় করেছি। আজ তুই কিনা মুখ দিয়ে এই শব্দ গুলো উচ্চারণ করলি?’
আম্মুর কথা শেষ হতেই আপু তেজী কন্ঠে বলল,
‘ মা! আমি আমার স্বামীকে বাঁচাতে তোমার মেয়ের সাহায্য চেয়েছি বলে তুমি আমাকে তোমার বোনের মেয়ে বানিয়ে দিলে? ‘
‘ বানিয়ে দেইনি! যা সত্যি তাই বলেছি দিবা। তুই আমার মেয়ে না! বড় আপার মেয়ে। আপার গর্ভে তুই আসার পর থেকে আপা খুব অসুস্থ ছিলেন। তার ব্রেনে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। চিকিৎসা করলেই সুস্থ হয়ে যেতো আপা। কিন্তু চিকিৎসা শুরু করলে তোর ক্ষতি হবে বলে আপা চিকিৎসা করেনি। আমরা শতবার বলেও কাজ হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে যখন তুই পৃথিবীতে আসলি তখন আপা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে তোকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলো যাতে তার কথা আমি তোকে কখনো না বলি। তুই আমার মেয়ে এটাই সবসময় জেনে আসিস এটা বড় আপা চেয়েছিলো। আমিও চুপ ছিলাম! কিন্তু বাধ্য হলাম আজ সত্য বলতে। তুইযে দোলার রক্তের সম্পর্কহীন বোন তা নিমিষেই প্রমাণ করে দিলি। এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?’
একে একে সকলে দিবা আপুর ওপরে নিজেদের বক্তব্য আরোপ করতে লাগলো। আমি তখনো বাকরুদ্ধ! আপুর ব্যাবহার গুলো গায়ে লেগেছে। ছোট সময়ে তো ছিলো না আমাদের সম্পর্ক এমনটা। পূর্বের মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলতে দেখা মিললো তার অতীব শান্ত মুখোশ্রী! শান্তি নেত্রযুগল। যেনো স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ হচ্ছে তার সামনে। পূর্বের এহেন ব্যাবহার আমার কষ্ট দ্বিগুণে রূপান্তর করলো। ঠোঁট চেপে আগত কান্না রুখে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসি।
কিয়ৎক্ষণ পর! দেয়ালে পিঠ এলিয়ে নেত্র দ্বারা অশ্রুকণা বর্ষণ করাকালীন স্পষ্টত কারো পদধ্বনির শব্দ কর্ণপাত হলো। নেত্রযুগল উন্মুক্ত করতেই দৃশ্যমান হলো পূর্ব মানবের! তার রাশভারী মুখশ্রী। দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্রে ফেলি! পূর্ব এগোল তখন। এসে পাশে বসলো আমার! নিঃশব্দে! গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ দিবা কে কিছু বলা উচিৎ ছিলো না তোমার দোল? তুমি শান্ত থাকলে অপরপক্ষ কিন্তু তোমায় দূর্বল ভাববে। নিজেকে দূর্বল প্রমাণিত করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া কিছুনা। ‘
তরতর করে রাগ চেপে বসলো মস্তিষ্কে! আমি আপাতত নিজের মধ্যিতে নেই। আকস্মিক জ্ঞান ফেলে ডান দিকে ফিরে পূর্বের শার্টের কলার চেপে ধরি। তৎক্ষনাৎ তার নেত্রযুগল স্বাভাবিক আকৃতি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে কিয়ৎ বড় হয়! অস্ফুটস্বরে বললেন তিনি,
‘ ক..কি করছো?’
আমি তেতে উঠে বলি, ‘ আপনি কিছু বললেন না কেনো? আপনার ঠোঁটে কস্টিপ লাগানো ছিলো? নাকি সেলাই করা ছিলো? একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি আপনি! একজন তার স্বামীকে উদ্ধার করতে আমায় ফেলনা বস্তুর ন্যায় আমায় ছুঁড়ে ফেলতে বলছে আপনি তা শুনে চুপ রইলেন?’
পূর্ব স্বাভাবিকতা আনলেন নিজ মুখোশ্রীতে। কপালে ভাজ পড়া চামড়া সমান হলো! লম্বা দম ফেলে বললেন,
‘ আমি কেনো বলবো? দিবা কি আমায় বলেছে? হুম? নিজেকে রক্ষা নিজে করতে শেখো দোল! তুমি নিশ্চয়ই হেল্পলেস নও! অন্যের আশায় বসে থাকার থেকে নিজেই নিজেকে প্রটেক্ট করা ভালো নয় কি? কে জানে যার আশায় তুমি বসে আছো সে আজ আছে তো কাল নাই থাকতে পারে। মানুষ তো সারাজীবন বেঁচে থাকেনা। ‘
দমে গেলাম বেশ খানিকটা! তবে তার থেকে সরে আসলাম। খেয়ালই নেই আমার কখন তার কোলে উঠে বসেছি।ধীরে অজান্তেই তার বক্ষঃস্থলে আমার মাথা স্থান করে নিলো। দু’হাতে দ্বিধা ফেলে আঁকড়ে নিলাম তার বাহু! সঙ্কোচ, লজ্জা কিছুই আপাতত আমার মস্তিষ্কে প্রাধান্য পাচ্ছে না। নিভৃত বলছে কিছুক্ষণ কারো কাছে শান্তির ঠাই চায়! তা পূর্বই এ মূর্হতে দিতে পারবে বলে মনে হলো আমার, ফুপিয়ে কেঁদে বললাম,
‘ আপু কিভাবে আমায় ঐ লোকগুলোর কাছে তুলে দেয়ার কথা ভাবলো বলুনতো? ওরা তো আমায় মেরেও ফেলতে পারে। আর সবকিছু ছেড়ে লোকগুলো আমায় চাইলো কেনো পূর্ব? দিবা আপু আমার কাজিন হয় তা আমি সহ পরিবারের সবাই জানতেন দিবা আপি বাদে! সত্যিটা জানার পর আমি কখনো তাকে আপন বোন ছাড়া কাজিনের চোখে দেখিনি। ছোট হয়েও আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলাম আমি। ‘
আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্পর্শানুভূতি অনুভব হয়। আমার মেরুদণ্ডে এবং মাথার পিছনের দিকটায়। পূর্বের হাতজোড়া ধীরস্থির ভাবে কোমলভাবে আগলে নিলেন আমায়। সরে যেতে বিন্দুমাত্র সায় দিলোনা অন্তরাল! তবে লজ্জার রেশ তীরতীর করে বাড়ছে এবার নিজ অবস্থান টের পেয়ে। পূর্ব তার মুক্ত হাত দিয়ে আমার অশ্রকণা মেদহীন গাল থেকে আলত হাতে মুছে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,
‘ ডোন্ট ক্রাই! আমার হৃদপিন্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে এতো জলদি আমায় মেরে ফেলোনা। রিকুয়েষ্ট! কান্না বন্ধ করো। ঘুমাও! ‘
তার একহাত আঁকড়ে রইল আমার বাহু। মেডিকেল সাইন্সে একটা বাক্য আছে। ‘ কান্নার পর প্রবল ঘুম আসে। ঘুম ভালো হয়! ‘ বাক্যটা কাঁটায় কাঁটায় সত্য। সবকিছু ভুলে নেত্রযুগল অনায়াসে, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে বন্ধ হয়ে আসলো।
___
তীব্র উত্তাপ! গালের উপরিভাগে তপ্ত অনুভূত হতেই নেত্রযুগল ঝট করে উন্মুক্ত হয়। চারিদিকে হলদেটে রৌদ্দুর। প্রভাতের আগমন ঘটেছে তা বিভিন্ন ভাবে জানান দিচ্ছে প্রকৃতি। স্নিগ্ধ, ভুবন ভোলানো বাতাস! কিঞ্চিৎ হেঁসে চারপাশে তাকাতেই নিজেকে পূর্বের বক্ষঃস্থলে আধশোয়া অবস্থায় দেখে মেদহীন গালে আমার রক্তিম আভা ফুটে উঠলো। অতি সন্তর্পণে পূর্বের বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে দুকদম সরে বসি।
ওড়না ঠিক করে উঠে দাড়ানোর পর আমার মস্তিষ্কে আসে কাল রাত্রির কথা। কেমন লাজ-লজ্জা ভুলে পূর্ব মানবের বক্ষঃস্থলে গিয়ে মুখোশ্রী লুকিয়েছিলাম তা স্বরণ হতেই হাঁটু কাঁপা কাঁপির মতো অবস্থা সৃষ্টি হলো! অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি! সকল চিন্তাভাবনা দূরে ঠেলে পূর্বের পানে দৃষ্টিপাত ফেলতে দৃশ্যমান হলো তার বেকায়দায় ঘুমানোর অবস্থা। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছেন। অনুতপ্ততা জন্মালো হটাৎ। ইশ! মানুষটার নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট হয়েছে। এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেলকনিতে ঘুমাতে। তার ওপর রেলিঙ এ এলোমেলো করে মাথা এলিয়ে রেখেছেন। ঘাড় নিশ্চিত প্রচুর ব্যাথা করবে।
পূর্বের শান্তির ঘুম দর্শন করা মাত্র ইচ্ছে হলোনা তাকে জাগাতে। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে মনে হলো এখন তাকে না জাগালে ঘাড়ে ব্যাথা বেশি করবে। হাঁটুগেড়ে বসে ক্ষীণ কন্ঠে তাকে ডাক দিই। দুই – তিনবার ডাক দেয়ার পরে পূর্ব নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলেন। আমার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বিরক্তি সুরে বললেন,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড? এতো ডাকাডাকি করছো কেনো? ঘুমাতে দাও আর নিজেও ঘুমাও। ‘
কথন শেষেই তিনি আমার হাত টেনে ধরলেন। নিজের বক্ষঃস্থলের সাথে আমার কোমল হাত চেপে ধরে ফের ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি অস্বস্ত্বি নিয়ে বলে উঠি,
‘ আ..আপনি র..রুমে গিয়ে ঘুমান। ঘাড়ে ব্যাথা করবে এভাবে ঘুমালে। ‘
তিনি পিটপিট করে তাকিয়ে বললেন, ‘ কাঁপা কন্ঠে কথা বলছো কেনো?’
আমি নিশ্চুপ! অস্বস্তি নিয়ে আশপাশে দৃষ্টি দিতেই তিনি পুনরায় বললেন, ‘ লজ্জা পাচ্ছো? লাইক সিরিয়াসলি? কাল রাতে কিন্তু আমার কাছে তুমিই এসেছিলো। আমার বুকে জায়গা দখল করে আরামে ঘুমিয়েছিলে। তখন লজ্জা কই ছিলো বলোতো?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ দেখুন! তখন আমি হুঁশে ছিলাম না। কান্না করার সময় আমার কোনোকিছুর খেয়াল থাকেনা! তখন কি থেকে কি করেছি আই ডোন্ট নো! ‘
পূর্ব হাত ছেড়ে আমার মুখোশ্রীর প্রতি ঝুঁকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ আচ্ছা? ‘
‘ জি! আপনি রুমে গিয়ে ঘুমান। আমি যাচ্ছি। ‘
উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে রুমের বাহিরে চলে আসি। পূর্বের সাথে আপাতত আর দর্শন না হোক। লোকটা খোঁচা মারবে নিশ্চিত আমি!
___
তিশান ভাইয়াকে কিডন্যাপ কারা করেছে তা আজ দুইদিন পার হলো কারো জানা নেই! বাসায় এ নিয়ে কারো তেমন মাথা ব্যাথা অতোটা নেই। তবে দিবা আপুর অবস্থা নাজেহাল! একে আপু দুই মাসের প্রেগন্যান্ট তার ওপর তিশান ভাইয়ার নিখোঁজ হওয়ার চিন্তায় সে আরো বেশি কুপোকাত। অসুস্থ বেশ! ভাইয়া মা সবার নিকট ক্ষমা চেয়েছে সেদিনের বলা কথার জন্য। সবাই না পেরে মাফ করেছে। দোষ দিবা আপুর! অনাগত জন তো নিষ্পাপ। তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ আছে?
তারই পরিপ্রেক্ষিতে আপুর খেয়াল রাখা হচ্ছে।মাত্রাতিরিক্ত অসুস্থ হওয়ার পর ডাক্তার বলেছেন তাকে চিন্তামুক্ত থাকতে কিন্তু দিবা আপু তা পারছে না। তিশান ভাইয়ার দুশ্চিন্তা তাকে খুবলে খায় প্রতিনিয়ত! তিশান ভাইকে যারা কিডন্যাপ করেছে তারা বারংবার বলছে আমায় তাদের হাতে তুলে দিলে তারা তিশান ভাইয়াকে ছেড়ে দিবে। সকলে হতভম্ব! এ কেমন কিডন্যাপার দল? পুলিশে জানানো যায়নি। পুলিশের নিকট বার্তা পৌঁছাতে গেলেই কোনো না কোনো অঘটন ঘটেছে। এইযে গত সপ্তাহে ভাইয়ার পা ভেঙে গেলো! এ কারণেই। তবুও সু – কৌশলে পুলিশকে জানানো হয়েছে। ফলাফল শূন্য! কিছুই মিলছে না। কিডন্যাপার দল বেশ চতুর! ধূর্ত!
কফিশপে বসে ভাবনা মগ্নকালে থাকাকালীন পূর্বের আগমন ঘটে নিঃশব্দে। সে যে কখনো আমার সামনে বসে খেয়াল নেই! হুট করে তাকে চোখের সামনে দেখে ভড়কে যাই। ধাতস্থ হয়ে বলি,
‘ কখন আসলেন? ‘
‘ একটু আগেই! ‘
রাশভারী কন্ঠে প্রতিত্তুর! আগের দিনকার থেকে একটু বেশিই গম্ভীর মনে হচ্ছে তাকে। কপোলে ঘাম জমলো বিন্দু পরিমাণ। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন ফোন করে জরুরি তলবে ডেকেছেন এই কফিশপে! আমি নিম্নকন্ঠে বললাম,
‘ কেনো ডেকেছিলেন?’
পূর্ব থমথমে কন্ঠে বললেন, ‘ তিশান সম্পর্কে বলতে এখানে ডাকা তোমায়! তিশানকে কিডন্যাপ তোমার অতি সন্নিকটের একজন করেছে ইচ্ছে করেই! তার মূল উদ্দেশ্য ‘ তুমি ‘! তোমাকে হাতে পেতে চায়। ‘
আমি শুষ্ক ঢোক গিলে বললাম, ‘ ক..কে সে?’
চলবে,