মেঘের দেশে রোদের বাড়ি পর্ব-০১

0
762

মেঘের দেশে রোদের বাড়ি
মোর্শেদা হোসেন রুবি

[এক]
প্রতিদিনের মতো আজও চেম্বারে ঢুকে চিরাচরিত নিয়মে গা থেকে কোট খুলে ব্যক্তিগত সহকারী মুকিতের হাতে দিলেন ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম । তারপর চেয়ারে বসে যথানিয়মে বাকি সদস্যদের দিকে তাকালেন। মার্জিত স্বরে কুশালাদি জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিতে বললেন,” ভালো আছেন তো সবাই ? ”
এখানেই শফিকুল ইসলামের বড়ত্ব। অত বড় মাপের আইনজীবি হবার পরেও তাঁর মুখ থেকে কখনও আপনির পরিবর্তে তুমি শব্দটা প্রকাশ পায়নি। চেম্বারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের ব্যপারেও তাঁর একই রকম সম্মানজনক আচরণ। তবে এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম তাঁর বন্ধুকন্যা জুনায়না ফিজা। যাকে তিনি নিজ কন্যাসম মনে করেন। কোনরকম বিশেষণ ছাড়াই তাকে পরমাদরে ফিজা বলে ডাকেন এবং ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। স্বভাবতই আজও তাঁর প্রিয়পাত্রী ফিজার অনুপস্থিতি চোখে পড়লো তার। ভারী স্বরে জানতে চাইলেন ,” ফিজা আজ আসেনি নাকি ? ”
সংবাদটা দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা অপর এক জুনিয়র যে কিনা ফিজার ফোন পেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে চলে যাবার রাজসাক্ষী। সেই মুনা তৎক্ষণাৎ রুদ্ধশ্বাসে জানিয়ে দিলো ফিজার বাবা মিসবাহউদ্দিন আজ সকালেই মারা গেছেন। ব্যারিস্টার স্যার তখন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় এজলাসে ছিলেন বলে ফিজা তাঁকে বলে যাবার সুযোগ পায়নি। একারণে সে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে। সংবাদটা শোনার পর ব্যারিস্টার শফিক সহ পুরো চেম্বার কয়েক মিনিট নিরব রইলেন। প্রবীণ সহকর্মী আশরাফ হোসেন নিরবতা ভেঙে বললেন,”
বেচারি মেয়েটা। মাথার উপর অভিভাবক বলতে আর কেউ রইলো না।” বিমর্ষচিত্তে কথাটা বলে ব্যারিস্টার স্যারের দিকে তাকালেন তিনি। শফিকুল ইসলাম তাঁর কথার মর্ম অনুধাবন করতে না পারার মতো অর্বাচীন নন। মিসবাহের পরিবারের সমস্ত খবরাখবরই তিনি রাখেন। তিনি মুকিতের দিকে তাকালেন। গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন।

” মুকিত, ফিরোজকে গাড়ি বের করতে বলো। আমরা মিসবাহের জানাযাতে যাবো।”

” জি, স্যার অবশ্যই। আপনি অনুমতি দিলে আমরা সবাই নাহয়…!”

” নাহ, সবাই না। দিনের বাকি পেন্ডিং কাজগুলো দেখো তোমরা। লোয়ার কোর্টে দুটো ইঞ্জাঙ্কশন পিটিশন ছিলো। ওগুলোও তো দেখতে হবে। ফিজা থাকলে সেই দেখতো। যাই হোক, তোমরা থাকো। আমি আরেফিন আর আশরাফকে নিয়ে যাচ্ছি।”

” স্যার যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলি।” মুকিত অনুমতি চাইলো।

শফিক তাকালেন ,” বলো।”

” একবার ফোন করে জেনে নিলে ভালো হতো না স্যার। ফিজা মামনি যখন সকালে ফোন পেয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন সে রিক্সা থেকেই আমাকে কল করেছিলো আর বলেছিলো ওকে হয়তো ওদের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হবে। যেহেতু ওর বাবার দাফন ঢাকায় না, ওদের গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্থানে সম্পন্ন হবে। এদিকে বেলা এখন বাজে সাড়ে তিনটা। স্যার আমি বলছিলাম কী…..।”

” আচ্ছা, ফোন দাও ফিজাকে। ” মুকিতকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন শফিকুল ইসলাম। মুকিত ফোন দিলো। কথা বললো কারো সাথে। ততক্ষণ স্থির হয়ে বসে মুকিতের কথা শেষ হবার অপেক্ষা করলেন শফিক । ফোন রেখে মুকিত জানালো ফিজার কোন এক আত্মীয় ফোন রিসিভ করেছেন এবং তারা ইতোমধ্যেই গ্রামে চলে গেছেন। শফিকুল দুঃখিত হলেন। খানিক ইতস্তত করে মুকিতকে ফের ফোন লাগিয়ে দিতে বললেন। ফিজার সাথে সরাসরি কথা বলতে চান তিনি। মুকিত চট জলদি ফোনে ফিজাকে খুঁজে বের করলেন। ব্যারিস্টার শফিকুল আন্তরিক সমবেদনা জানালেন কন্যাসম জুনিয়রকে। সব রকমের সহযোগীতার আশ্বাস দিয়ে তাকে মনোবল না হারানোর এবং ঢাকায় ফিরে কাজে যোগদানের উৎসাহ দিলেন।
ফোন রাখার পরেই চেম্বারের পরিবেশটা কেমন যেন বদলে গেলো। ব্যারিস্টার শফিকুল ভাবনাক্রান্ত হয়ে পড়লেন এবার।

আচমকা এই দুঃসংবাদটার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম। মিসবাহউদ্দিন তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং সহকর্মী। অনেকদিন থেকেই সে অসুস্থ ছিল। আজ সকালেই সে মারা গেলো। খবরটা শোনার পর শফিকুল ইসলাম রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেছেন। বাকি মুহূর্তগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কোন কথা বলতে পারলেন না। বারবার স্মৃতিতে ভেসে উঠতে চাইছে পুরোনো দিনের কথাগুলো।

মিসবাহউদ্দিন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী হলেও দুজনের সম্পর্কের বয়সটা আরো অনেক পুরোনো। হয়তো সেকারণেই আঘাতের তীব্রতাও একটু বেশি। সংক্ষেপে বলতে গেলে দুজনের পড়াশোনার পুরো অধ্যায়টা সম্পন্ন হয়েছে একই চত্বরে। পার্থক্য এই যে, শফিকুল ইসলাম তার অর্থবলের কারণে আজ বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার আর মিসবাহউদ্দিন তার নিজ পেশায় বাহুল্যতাবর্জিত একজন সাধারণ মানের আইনজীবি।
দুজনের শুরুটা একসাথে হলেও জীবনের পথ বারবারই বেঁকে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একই মোহনায় এসে ঠেকেছে। মিসবাহ যখন তার পেশাগত জীবনের শুরুতে জুনিয়রশীপ করতে গিয়ে সিনিয়রদের পেছনে ঘুরে ঘুরে জুতোর তলা ক্ষয় করতে শুরু করেছিলেন সেসময়টায় শফিক মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে ভূঁইয়া একাডেমীতে ভর্তি হয়ে গেছেন এবং বার এট ল করার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখছেন।
পরবর্তীতে অনেক বছর পর দুই বন্ধুতে আবার দেখা হয়েছিলো তাদের পেশাগত জীবনের কেন্দ্রস্থল আদালতের এজলাসে। ততদিনে মিসবাহ নিম্ন আদালতের ফৌজদারী মামলার প্রথিতযশা আইনজীবি হিসেবে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। বাকিদের মতো চোখ বন্ধ করে মোটা অঙ্কের রেট হাঁকাননা বলে ক্লায়েন্ট মহলে তিনি কসাই শব্দ দ্বারা ভূষিত হওয়া থেকেও বেঁচে গেছেন এবং মোটামুটি মাঝারি মানের চেম্বার আর জনাদুয়েক জুনিয়র খাটিয়ে কোনরকম বেঁচে বর্তে ছিলেন। তার এই বেঁচে থাকাকে উঠে দাঁড়ানো না বলে চলমান স্রোতে বহমান খড়কুটো বললেও অত্যুক্তি হয়না। বলতে গেলে মিসবাহের উঠে দাঁড়ানোটা বন্ধু শফিকুল ইসলামের মতো ততোটা রাজকীয় হয়নি। এদিকে শফিক ততদিনে ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম বনে গেছেন। যার হাইকোর্টে রয়েছে রাজকীয় চেম্বার এবং ডজন খানেক সহকারী। যারা তাঁর অগণিত মোকদ্দমা সামলাতে প্রতিদিনই দৌড়ে বেড়ান হাইকোর্ট আর জজকোর্ট চত্বর।

বন্ধু মিসবাহের দৈন্যদশা শফিকুল এর ক্ষুরধার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তাঁরই প্রবল উৎসাহে মিসবাহউদ্দিন তার একমাত্র কন্যা জুনায়না ফিজাকে ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এনরোলমেন্ট করার সম্মতি দান করেন। এরপর থেকেই ফিজা এই চেম্বারের নিয়মিত সদস্যা । শুধু তাই নয়, বর্তমানে সে ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম এসোসিয়েশনেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন।

অবশ্য ফিজা নিজেই কারো অনুকম্পার পাত্রী হয়ে থাকার মেয়ে নয়। চেম্বারে যোগ দেবার পর থেকে সে তার যোগ্যতার প্রমান দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সে যে কেবল অনুগ্রহের জোরেই এখানে আছে একথাটা ভুল প্রমান করতে ফিজা সদা তৎপর। কাজেও তার ছাপ মিলছে। শফিকুল ইসলাম নিজেও ফিজার পারফরমেন্সে সন্তুষ্ট। এবং এটি তিনি অকপটে স্বীকার করেন। ফিজার উপস্থিতিতে তো বটেই অনুপস্থিতিতেই বরং তার কর্মপটুতার ব্যপারে অধিকতর প্রশংসায় মেতে ওঠেন শফিকুল। যে কোন কাজ ফিজার দায়িত্বে দিলে যতটা নিশ্চিন্ত হন ততটা যেন অন্য কারো কাজে হতে পারেন না এমনটাই তাঁর বক্তব্য। এ নিয়ে চাপা ঈর্ষাও চলে চেম্বারে। অবশ্যই তা মহিলাদের মধ্যে। পুরুষ সহকর্মীরা এসব শুনে হিংসা তো করেনই না বরং আরেক কাঠি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফিজার ব্যপারে। সৌন্দর্য আর বুদ্ধিমত্তার এমন বিরল চিত্র মেয়েদের মধ্যে কমই দেখা যায়।

=====

অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে ফিজা । বসতে তার খুব একটা খারাপ লাগছেনা যদিও। সামান্য অস্বস্তি লাগছে এই যা। অস্বস্তির কারণ দুটো। প্রথমত বাড়িটা রাজকীয় ধরণের। দ্বিতীয়ত ঐ এলসেশিয়ানটা। যেটা কিছুক্ষণ পরপরই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওর দিকে তেড়ে আসতে চাইছে কিন্তু পারছেনা ওর নিয়ন্ত্রণ দারোয়ানের হাতে থাকায়। তবে আসতে না পারলেও থেকে থেকেই খেউ খেউ ধরণের শব্দ করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে ফিজাকে। তার ভাবখানা এমন যে ছাড়া পেলেই কামড়ে দেবে ফিজাকে। ওর লম্ফঝম্ফ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে দুরে সরে এসেছে ফিজা। ঝুঁকি নেবার দরকার কী। এমনিতেই আজ যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে সে। প্রথমত বগুড়া থেকে একা ভ্রমন করে ঢাকা এসেছে। দ্বিতীয়ত কারো সাহায্য ছাড়াই ব্যারিস্টার স্যারের বাসাটা খুঁজে বের করেছে। এর কারণ স্যারের সাথে দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করলেও স্যারের বাসায় কখনও আসার সময় বা সুযোগ হয়নি। আজ এখানে আসতে হয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত হাইকোর্ট আগামী একমাসের জন্য ছুটিতে আছে। দ্বিতীয়ত ব্যারিস্টার স্যারের সাথে তার দেখা করাটা ভীষণ রকম জরুরী। যেটার জন্য ফিজার পক্ষে আরো একমাস অপেক্ষা করা সম্ভবপর নয়। যার কারণে আজ সরাসরি বাসভবনে চলে আসা।

ফিজা একটু ভেতরে ঢুকে মেইন গেট লাগোয়া বকুল গাছটার নিচে ঘেরাও করে রাখা পাকা চত্বরটার উপর বসলো। জায়গাটায় প্রচুর ছায়া। সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস। ফিজার পথের ক্লান্তি আর মনের উদ্বেগ দুর হবার পক্ষে যথেষ্ট। সেখানে বসেই দারোয়ান আর কুকুরের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলো। দারোয়ান ছেলেটা অল্প বয়সী। দেখে মনে হচ্ছে দারোয়ানের এই কাজটায় সে দারুণ আনন্দ পাচ্ছে। ধোপদুরস্ত ইউনিফর্মে তাকে দেখাচ্ছেও বেশ স্মার্ট । অনেকটা দামী রেস্তোরার ওয়েটারদের মতো। ক্লিন শেভ আর মাথায় ক্যাপ তাকে একেবারে সাহেব বানিয়ে ছেড়েছে।

ক্লান্তি মুছে ফেলতে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে আলতো করে কপালে চাপলো ফিজা । এখানে রোদ নেই তবে তাপটা আছে। ঐটাই ভোগাচ্ছে। অবশ্য ফিজা যেখানে বসেছে সেখানকার পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা আর আরামদায়ক। নারকেল পাতার ঝিরঝিরি বাতাসে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ঘামটা সম্ভবত উত্তেজনা থেকে আসছে। এর আগে কখনও ব্যারিস্টার স্যারের বাসায় আসেনি ফিজা। আজই প্রথম। স্যার যথেষ্ট ভালোমানুষ তারপরেও ব্যাক্তিগতভাবে তাঁর বাসায় দেখা করার অস্বস্তিটা এড়াতে পারছেনা ফিজা। কিন্তু উপায় নেই। দেখা তাকে করতেই হবে এবং সেটা আজই।

ঘড়ি দেখলো ফিজা। পৌণে পাঁচ বাজে। কেয়ার টেকার ছেলেটার ভাষ্যমতে আর পনেরো মিনিটের মধ্যে স্যারের চলে আসার কথা। সময়টা যতোই এগিয়ে আসছে বুকের ধুকপুকানি ততোটাই যেন বাড়ছে। স্যার ওকে দেখলে কী বলবেন কে জানে। আচ্ছা, চিনতে পারবেন তো ? না চেনার কোন কারণ নেই যদিও। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে কেউ নিশ্চয়ই কারো চেহারা ভুলে যায়না। ফিজা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা অস্থিরচিত্তে পায়চারি শুরু করলো এবার। কেয়ারটেকার ছেলেটা প্রথমে ওকে ঢুকতেই দিতে চায়নি। প্রবল অস্বস্তিভরে বলেছে, দেখুন অচেনা কাউকে ভেতরে আসতে দেবার অনুমতি নেই। তখনই ফিজা নিজের পরিচয় দেয়। তাতে বিশেষ মুগ্ধ না হলেও ওর অনুরোধ একেবারে উড়িয়ে দেয়নি ছেলেটা। ফিজা ওদের ব্যারিস্টার স্যারের পরিচিত এবং অধীনস্হ শুনে ঢুকতে দিয়েছে। ছেলেটার ভদ্রতায় ফিজা আপাতত মুদ্ধ।

গাড়ির হর্ণ বাজতেই সাড়া পড়ে গেলো। কেয়ারটেকার ছেলেটার তৎপরতা বাড়লো সাথে এলসেশিয়ানের ঘেউঘেউ। ফিজা নিজেও কম তটস্থ না। গায়ের বোরকাটার দিকে আরেকবার নজর করলো। প্রথম থেকেই পোশাকটাকে এই পরিবেশে বেমানান মনে হচ্ছিলো। কিন্তু বাবার মারা যাবার তৃতীয় দিন থেকেই পড়তে শুরু করেছে। উপকার ছাড়া অপকার হয়নি। নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে সংরক্ষণে রাখতে এটির বিকল্প নেই। তারপরেও প্রখর রৌদ্রতাপ, পথের ক্লান্তি আর খিদের অশনী সংকেত সবমিলিয়ে ফিজার চেহারায় দৈণ্যের ছাপ পড়লে কাউকে দোষ দেয়ার ঠিক হবেনা। শেখ সাদীর আমল সর্বকালে সর্বযুগেই বিদ্যমান। এখনও লোকের গুণের চেয়ে লৌকিকতার কদর বেশি।

ফিজা দ্রুত বকুলগাছের আড়ালে চলে গেল। কোন কারণ নেই তবু অজানা সংকোচ থেকে সরে আসা।
আচমকা বাঁজখাই কণ্ঠে দারুণ চমকে গিয়ে দ্রুত হিজাবের বর্ধিতাংশ দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢেকে ফেললো। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবক।
একজনতো বেরিয়ে এসে ওর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে নাড়ছে।
ওদেরকে দেখেই ফিজা বুঝতে পারছে যে এরা ঐ গাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এবং এরা স্যারের কোন আত্মীয়। তারমানে স্যার এখনও আসেননি। কিন্তু এরা আসলে কারা ? আর ওকে এভাবে বিশ্রীভাবে আঙুল তুলেই বা ডাকবে কেন। ফিজাকে ওরা কী ভেবেছে আসলে ?

প্রানপণে বাড়তি সংকোচটুকু ঝেড়ে ফেললো ফিজা। নিজেকে যথাসম্ভব পরিপাটি করার ব্যর্থ প্রয়াসে দুহাতে বোরকার কোঁচকানো অংশটুকু ডলে ইস্ত্রি করার চেষ্টা চালালো। এতে যদি কাপড়টা নিভাঁজ হয়ে যায়। কাজটা করতে গিয়েই সামান্য দেরি হলো আর রুক্ষস্বরের ধমকটা খেলো।
” এ্যাই , কাম হিয়ার।”
বিপদে পড়লে অপমানবোধ লোপ পায়। ফিজারও তেমন কিছুই হচ্ছে। অসাঢ় একটা অনুভূতি। দ্বিতীয় ধমকে শুনল,
“কে তুমি ? হু আর ইউ ?ভেতরে ঢুকলে কী করে? ” ফিজা জবাব দেবার জন্য মুখ খুলেও থেমে গেলো কারণ প্রশ্নকর্তার ধৈর্য শূণ্যের কোঠায়। সে কথাটা বলেই দারোয়ানকে ডাক দিলো। ” এ্যাই হাশেম ? ”
দারোয়ানের নাম জানা হয়ে গেলো ফিজার। হাশেমও দৌড়ে এলো। ” জি, স্যার? ”
‘এটা কী তোমার গেস্ট ?’ বাজখাঁই গলায় বললো ছেলেটা , ”
” জি না স্যার।”
” তাহলে সে এখানে কেন? ”
” ছোট স্যার, উনি বড় স্যারকে চেনেন। ” দ্রুত নিষ্পত্তির চোষ্টা করলো হাশেম। ছেলেটা রেগে গেলো।
” আধা বাংলাদেশ বাপিকে চেনে। সবাইকে ধরে এনে বসাবে তুমি? ছাগল কোথাকার? ” বলেই ফিজার দিকে ফিরলো। ” এই মহিলা, এদিকে এসো। মামলার কাজে এসেছো? ”
ফিজা কী বলবে ভেবে পেলনা। ওর ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এটা ব্যারিস্টার স্যারের ছেলে। পিতার এমন বিপরীত চরিত্র? নাকি ইনিও সূর্যের উত্তাপে উত্তপ্ত বালু ? ফিজা স্থির করলো সে শান্ত থাকবে। ছেলেটার প্রশ্নে সে কোনমতে মাথা নাড়লো।

ছেলেটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে ফিজার বাহ্যিক অবয়ব জরিপ শেষে বললো,” তো এখানে কেন, চেম্বারে যাও। বাসায় কী। বাপি বাসায় ভিজটরস এটেন্ড করেনা।” কিছুটা দ্বিধার সুর থাকলেও ফিজার মতো গ্রাম্য শ্রেনীর আগন্তুককে আপনি বলাটা বোকামী হবে কিনা বুঝতে না পেরেই হয়তো তুমি বলছে।

ফিজা নিজের নাম, গ্রামের নাম, আগমনের কারণ বলতেই যাচ্ছিলো তার আগেই দ্বিতীয়দফা হর্ণ বাজলো। ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে আরেকদফা ফিজাকে দেখলো তারপর ভেতরে চলে গেলো। দ্বিতীয় গাড়িটা থামলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ব্যরিস্টার শফিকুল ইসলাম। ফিজাকে একনজর দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। ওকে দেখেই হাত উঁচিয়ে ডাকলেন। তাঁর দিকে হেঁটে যাবার সময় ফিজার মনে হলো সে আসলে হাঁটছে না আকাশে উড়ছে। (চলবে)