মেঘের দেশে রোদের বাড়ি পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
761

মেঘের দেশে রোদের বাড়ি
{তৃতীয় ও শেষ পর্ব}

কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলো ফিজা। সাড়ে সাতটা বাজে। এদিকে উৎসব এখনও শিশু। এর মধ্যেই বড়আপু লিজার সাথে দুবার কথা হয়ে গেছে ওর। প্রথমবার লিজাপুর টোন ওর মতোই দ্বিধাবিমুখ ছিলো। একটু আগে আবার যখন কথা হলো তখন লিজাপুর কণ্ঠস্বর ছিল পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
লিজার বক্তব্য হলো, তুই হলি গিয়ে আইনজীবি। তোকে এতো কনফিউশন মানায়না। তাছাড়া মারিয়া আন্টির মতো মানুষ যখন তোর জন্য পাত্র বাছাই করেছেন। সেই পাত্র একেবারে ফেলনা হবেনা অন্তত। ফু দিয়ে উড়িয়ে না দিয়ে একটু মনোযোগী হ। কথাটথা বল। পছন্দ হয়ে গেলে বাসায় ইনভাইট কর। এ পর্যন্ত শুনেই রেখে দিয়েছে ফিজা। ওর মন বলছে এটার যোগানদাতা নিশ্চয়ই দুলাভাই এবং তিনি আপুকে এসব বলার বুদ্ধি দিয়েছেন। নইলে প্রথমবার তো আপু এসব কিছুই বলেনি। তবে আপু দুলাভাই দুজনেরই এই এক সমস্যা। ওর বিয়ের কথা শুনলেই এরা লাফ দিয়ে উঠবে। যেন ফিজা ওদের ঘাড়ে বসে ঘাড় ভারি করে রেখেছে। কোনরকমে নামাতে পারলে বাঁচে। অজানা এক অভিমানে ছেয়ে যায় ফিজার অন্তরটা।

” ফিজা ? ” মারিয়া আন্টির ডাকে ফিরে তাকালো ফিজা। তাকে দেখতে পেয়ে ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো। মারিয়া আন্টি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ওর দিকে। তার সাথে যিনি এলেন তাকে ফিজা চেনেনা, এর আগে কখনও দেখেনি। তবে তার একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেবার ভঙ্গিটা ভাল লাগলো ফিজার।

মারিয়া আন্টি পরিচয় করানোর ভঙ্গিতে বললেন,” খালিদ, এই হচ্ছে আমাদের ফিজা। তোমার শফিক স্যারের সাথে জুনিয়রশিপ করছে। বেচারির বাবাটা মারা গেলো কয়েক মাস আগে। ও এখন বগুড়ায় ফিরতে চাচ্ছে। আর ফিজা ও হলো খালিদ। তোমার শফিক স্যারের প্রিয় ছাত্র। এখন তো নিজেই প্রফেসর হয়ে গেছে।”

ফিজা সালাম দিলে লোকটা স্পষ্ট সুরে তার জবাব দিলো। মারিয়া খালিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” তোমরা কথা বলো। আমি একটু ঐদিক থেকে আসছি।”

খালিদ সামান্য সরে গিয়ে তাকে যাবার পথ করে দিলো। তারপর ফিজার দিকে ফিরে মাপা হাসিতে বললো,” চলুন বসা যাক। ”

” জি, নিশ্চয়ই।”

ফিজার সম্মতি পেয়ে খালিদ অর্ধবৃত্তকারে ঘুরে এসে একটা চেয়ার টেনে বসলো। আর এই পরিসরে তাকে আপাদমস্তক দেখে নেবার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না ফিজা। দেখতে গিয়ে আপনা হতেই ওর নিচের ঠোঁট উল্টে গেল। তবে লোকটা তাকাবার আগেই দ্রুত ঠোঁট সোজা করে ফেললো। ওর কাছে খুব বেশি ফ্যাশনেবল মনে হলো না লোকটাকে। একটু যেন ব্যাকডেটেডও। পরেছে ধবধবে সাদা ফুলহাতা সাদা শার্ট সাথে ছাই বর্ণের ঢোলা একখান প্যান্ট তাও আবার টাখনার উপরেই শেষ। হায়রে, মারিয়া আন্টি শেষ পর্যন্ত ওর জন্য এঁকেই যোগাড় করলেন ! এর মধ্যে তিনি কী বিশেষত্ব খুঁজে পেলেন ফিজার বুঝে এলোনা। তবে সে মনে মনে কিছুটা দমে গেলো। সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাসও চাপতে হলো ওকে।
আজকাল বোরকা আর স্কার্ফ পরে হুলিয়া বদলেছে বলে লোকজন ওর জন্য মোল্লা টাইপ পাত্র ধরে আনা শুরু করেছে। ভাবতে গিয়ে মনটা তেতো হয়ে গেলো ফিজার। এটা পুরোটাই আম্মুর দোষ। এই পোশাকটা তার চাপাচাপিতেই পরা। ফিজার নিজেরও ততটা খারাপ লাগেনা। তাই বলে ওর সুকুমার মনটা তো আর মরে যায়নি। ওরও তো ইচ্ছে করে কারো হা ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে। নাকি এই মোল্লার সাথে গুরুগম্ভীর কথা বলতে। ধুর।

সরাসরি তাকাতে ইচ্ছে করছে না লোকটার দিকে। না তাকালেও ফিজা জানে লোকটা নিশ্চয়ই হা করে গিলছে ওকে। দেখুক গে। দেখে কোনো লাভ নেই। এটা এমনিই রিজেক্টেড। ফিজা অযথাই মোবাইল বের করে একটা ভিডিও অন করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ মনে হলো লোকটা ওকে লাজুক ভেবে বসতে পারে। নাহ্, তাকে এমনটা ভাবতে দেয়া ঠিক হবেনা। তাকে নিরাশ করা দরকার।

ফিজা চোখ তুলে সরাসরি তাকালো লোকটার দিকে। যা ভেবেছিলো তা মেলেনি। কিছুটা ধাক্কা খেলো ফিজা। লোকটা কখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায়নি। সে এখন উল্টোদিকে মুখ করে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। ফিজা তাকানো মাত্রই ফোনে কথা শেষ করে মোবাইলটা পকেটে রেখে ফিজার দিকে তাকালো। ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বললো,” দুঃখিত, একটা জরুরী কল ছিল।”

” সমস্যা নেই। কী করেন আপনি ? ” নিজের ভেতরকার প্রোটাগনিস্ট সত্তাকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়ে হাসলো। জানে প্রশ্নটা অনর্থক তবু করলো। লোকটাকে হতাশ করতে চায় সে। একে দেখে প্রথম দর্শনেই যে বিরক্তি জন্মেছে তা কাটানো সহজ হবেনা। ফার্স্ট ইমপ্রেসন বলে কথা। কেউ দর্শনধারী হিসেবে মনমতো না হলেও অভদ্রতা নিশ্চয়ই তার প্রাপ্য নয়। ফিজা তার চেহারায় বিরক্তির চিহ্নটুকু লুকিয়ে ফেললো। তবে ওর প্রশ্নে ম্লান হাসলো লোকটা। আর এটা প্রমান করে সে নিজেও কিঞ্চিত বিরক্ত।

খালিদ বললো, ” ছাত্র পড়িয়ে খাই। একটু আগেই মারিয়া আন্টি বলেছেন। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি।’

” ও হ্যাঁ, তাই তো। ফিজা খেই হারিয়ে ফেললো। ধুত্তোর, শুরুটা ভারি বিশ্রী হয়ে গেলো। ক্যাবলাটাকে ইগনর করতে গিয়ে নিজেকেই আনস্মার্ট বানিয়ে ফেললো ফিজা।
অস্বস্তি লুকাতে মুচকি হেসে বললো, ” আসলে আমি এই মিটিংটার জন্য তৈরী ছিলাম না। ইনফ্যাক্ট, পার্টিটাই আনএক্সপেক্টেড ছিলো। খুব নার্ভাস লাগছে। ” কৈফিয়ত দিলো যেন ফিজা। সে তুলনায় লোকটা বেশ সপ্রতিভ।

” সে কি ! আপনি আইনজ্ঞ। এতো অল্পে নার্ভাস হলে চলবে? আনএক্সপেক্টেড বিষয়ের সাথে মল্লযুদ্ধ তো প্রতিদিনই করতে হয় আপনাদের। আমি কী ভুল বললাম! ” ফিজা সামান্য চমকালো উত্তরটা শুনে। লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো এবার। খুবই সাধারণ একটা মুখ। সরলতাই বৈশিষ্ট্য। ছোট করে ছাঁটা গোফ আর চাপদাড়িতে লোকটার ব্যক্তিত্ব ভিন্ন আভা ছড়াচ্ছে।
চোখ সরাতে গিয়ে অদূরে দাঁড়ানো তৌহিদের ওপর ফসকে গেলো দৃষ্টিটা। বেহায়াটা ওকেই দেখছে। কী অদ্ভুত এই ছেলে। নিজে বিয়ে করে বসে আছে আর এক্সকে ভিন্ন লোকের সাথে দেখে পাহারা দিচ্ছে। আস্ত বেয়াদব একটা।

ফিজার খুব রাগ হয়ে গেলো এবার। সেটা কাটাতে সহজ ভঙ্গিতে আলাপ শুরু করলো লোকটার সাথে। তৌহিদকে একটা মেসেজ দেয়া দরকার। ফিজা আন্তরিক হলো।
” আচ্ছা, কী বিষয়ে পড়ান আপনি ? ”
আলাপ করতে করতেই চোখের কোনে তৌহিদ কে সরে যেতে দেখলো। ততক্ষণে ফিজা নিজেও আলাপে ডুবে গেছে। এর প্রধান কারণ হয়তো লোকটার অনর্থক ইমপ্রেসন জমানোর চেষ্টা না থাকা।
কিছুক্ষণ আলাপ করেই ফিজার মনে হলো লোকটা কেবল দেখতেই না স্বভাবেও সাধাসিধে ধরণের। কোন প্রশ্নই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছেনা। একদম সরাসরি বলে ফেলছে। যেমন তার একটু আগের প্রশ্ন ছিল , ” বিয়ের পরেও কী প্রফেশনে থাকতে চান ? ”

প্রশ্নটা শুনে কপাল কুঁচকে জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলো ফিজা। হঠাৎ তৌহিদকে বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো ওর। দুজনের সম্পর্ক যখন তুঙ্গে তখনই একদিন ফিজা কথাপ্রসঙ্গে ওকে বলেছিলো,’ বিয়ের পরে আমি সব ছেড়ে দেবো৷ শুধু শুয়ে বসে থাকবো আর খাবো। সারাদিনের এতো দৌড়ঝাঁপ আমার পোষাবে না। সোনার বরণ কালো হয়ে যাচ্ছে রোদে পুড়ে।” ফিজা ঠাট্টাচ্ছলে কথাটা বললেও তৌহিদ সিরিয়াসলি নিয়েছিলো।

সে দারুণ অবাক হয়ে বলেছিলো ‘ কী বলো এসব ? তুমি কী পরনির্ভরশীল থাকতে চাও ? এখনকার মেয়েরা সবাই যেখানে স্বাবলম্বী হতে তৎপর সেখানে তুমি কিনা শুয়ে বসে সানন্দা পড়ে সময় কাটানোর কথা ভাবছো ? তুমি চলবে কীভাবে ? ”

” ওমা, চলবো কীভাবে মানে ? তখন তো তুমিই আমার সমস্ত প্রয়োজন পুরো করবে।”
উত্তর শুনে তৌহিদ আরো অবাক হয়ে বলতো, ‘কী সিক চিন্তা তোমার ! আত্মসম্মান বোধ বলে কিছু নেই। বিড়বিড় করে বলেছিলো তৌহিদ। আরো বলছিলো, আজকালকার মেয়েরা নিজের পয়সা নিজে যোগাড় করে। আর তুমি কী অবলীলায় বলছো, আমি তোমার সব প্রয়োজন পূরণ করবো।”

” তারমানে কী তোমার রান্না তুমি নিজে করবে ?’ ফিজাও কম তার্কিক ছিল না।

” কেন, আমি নিজে করবো কেন ? তুমি করবে। এটা ওয়াইফ হিসেবে তোমার দায়িত্ব হবে।”

” ও তাই ? হিসাবটা তো তাহলে মিললো না তৌহিদ। আচ্ছা, এবার বলো, আমি তোমাকে ফ্রি তে রেঁধে খাওয়াবো কেন ? ”

” কী সব অদ্ভুত প্রশ্ন। এভাবে কেউ ভাবে নাকি। রাঁধতে তো আমিও জানি। কিন্তু আমার যা প্রফেশন তাতে দম ফেলার সময় থাকেনা।”

” সেটা কী আমারও থাকেনা ? ”

” ওটা নিয়ে ভেবোনা। ওটা আমরা ঠিক করে নেবো। আমি তো ঠিক করেছি, আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ দুজনে মিলে চেম্বার চালাবো। জমিয়ে টাকা রোজগার করবো। তুমি বিকেলেই বাসায় চলে যেতে পারবে। কাজেই তোমার চাপটা কম থাকছে। ”

ফিজা দীর্ঘশ্বাস চেপে একগুঁয়ে সুরে বলেছিলো , ” তারমানে আমি দিনে তোমার চেম্বার সামলাবো, বিকেলে রান্নাঘর আর রা…!”

” ওফ, একদম ভিলেজ উইম্যানদের মতো মেন্টালিটি। ” বলেই তৌহিদ রাগ করে সরে গিয়েছিলো। কথা আর সামনে এগোয়নি।
এই মুহূর্তে সে কথাটাই মনে পড়লো ফিজার। দীর্ঘশ্বাস চেপে হাসিমুখে বললো ,” বিয়ের পরেও আমি প্রফেশনেই থাকতে চাই। কারো ঘাড়ে বোঝা হতে চাইনা। ”
খালিদ লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ” তাহলে তো আপনার ঘাড়েও তার বোঝা চাপতে দেবেন না দেখা যাচ্ছে।”

” সে আমার ঘাড়ে চাপবে কেন ? কী অদ্ভুত কথা। সে তার জব করবে আমি আমার প্রফেশনে থাকবো।”

” মানে সমানে সমান ? ” খালিদ কৌতুহলি হলো।

ফিজা চিবুক উঁচু করলো, ” একদম ঠিক ধরেছেন।”

খালিদ কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ” নিয়মটা কী অযৌক্তিক মনে হয় না আপনার কাছে ? ”

” অযৌক্তিক কী দেখলেন ? পুরুষরা কী একাই মানুষ, নারীরা মানুষ না ? ”

” নারী মানুষ অবশ্যই। তবে মেয়ে মানুষ।”

ফিজার মুখ লালচে হয়ে এলো। রাগে ভাষা হারালো। সংযম ধরে রেখে বললো,” আমাকে কেউ মেয়েমানুষ বললে খুব রাগ হয় আমার।”

” রাগ হয় ? কেন ? আপনি তো একজন মহিলা। রাগ হবে কেন ? ”

” মেয়েমানুষ শব্দটায় কেমন যেন তাচ্ছিল্য মিশে আছে।”

” বাহ্, আর পুরুষ শব্দটায় পৌরোষ ? ” খালিদ কৌতুহলি চোখে তাকালো। ” এভাবে ভাবলে মেয়েদের খাটো করা হয়না ? ”

” আমি ‘মেয়ে’ শব্দটা খারাপ বা ‘পুরুষ’ একটা ভালো শব্দ বলছিনা। বলছি সবাই এভাবেই দেখে। মেয়ে শব্দটাতেই একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য মিশে থাকে। অথচ আমরা মেয়েরা পুরুষের সমানাধিকারটুুকু পেলেই খুশি।”

” সমানাধিকার বলতে যা আমি পাবো তাই আপনি পাবার অধিকার রাখেন এই তো ?”

” জি।”

” এই চাওয়াটা ঠিক আছে কিন্তু সেটা স্থান কাল পাত্রের বিবেচনায়।”

” যেমন?”

” ধরুন, বাসে বা বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে। আপনি বাসে চড়ে যাতায়াত করেছেন তো?”

” প্রায়ই করি। বগুড়া থেকে তো বাসেই এলাম।”

” সেটাই বলছি। আপনি নিশ্চয়ই একগাদা ছেলের সাথে গাদাগাদি করে তাদের গায়ের সাথে মিশে দাঁড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। এখানে আপনার দাবীটা কিন্তু সমানের চেয়ে একটু বেশিই থাকতে হবে। ঠিক? ”

” আপনি ভুল ব্যখ্যা করছেন। ”

” প্লিজ লেট মি ফিনিশ ! আমি যে কলেজে চাকরি করি তার প্রিন্সিপাল একজন মহিলা। তাঁর সামনে আমাকে দারুন তটস্থ থাকতে হয়। আবার তিনি আড়ালে চলে গেলে আমারই কিছু পুরুষ কলিগ তাঁর ফিগার এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে নোংরা কমেন্ট করে। এদিকে আমাদের যে বুয়াটা চা করে আনে, তাকে কেউ মহিলা বলে গণ্যই করেনা। যাচ্ছেতাই ব্যবহার আর বাকিটা নাই বললাম। তার কণ্ঠস্বর আর জেন্ডারটা ছাড়া সে আপাদমস্তক পুরুষ। তারমানে কী, প্রিন্সিপালের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস যাদের নেই তারা সামনে সম্মানের ভঙ্গি করলেও আড়ালে তার সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করছে আবার বুয়া শ্রেনীর মহিলাটা অসহায় বলেই তার সাথে অমানুষের মতো ব্যবহার করছে। তার জায়গায় একজন পুরুষ হলেও সে ঠিক ঐ দুর্ব্যবহারটাই পেতো কিন্তু বাকি নোংরামি থেকে বেঁচে যেতো। তারমানে ব্যপারটা কী দাঁড়ালো, শুধু একজন মহিলা বলেই আপনি র‍্যাসিজম এর স্বীকার হচ্ছেন। এই একটা জায়গায় বুয়া আর প্রিন্সিপ্যাল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। যদি দেশে আইন বলে কিছু না থাকতো তাহলে আমাদের প্রিন্সিপ্যাল ম্যামও বিশেষ সুরক্ষিত থাকতেন না বলেই আমার বিশ্বাস। সম্মাণিত থাকা তো পরের কথা। মনে রাখবেন ভীড়ের মধ্যে মেয়েরাই লাঞ্ছিত হয়। অধিকার আসলে চাইবার জিনিস না, যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করবার জিনিস। আপনি লইয়ার বলেই আইন আপনার পকেটে ব্যপারটা এমন না। আমার তো ধারণা আপনিও এই দুর্ব্যবহারের বাইরে নন।

” আপনার কথাগুলো দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে।” বললেও দারুণ অস্বস্তি বোধ করলো ফিজা। তিক্ত কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। লোকটার কথা ঠিক। গতবছর রমনায় একটা গেট টুগেদার করা হয়েছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে আইনজীবীরা এসেছিলেন। খাবারের প্যাকেট বিতরণের কাজে পুরুষ আইনজীবীদের সাথে একজন নারীও ছিলেন। তার গায়ে কালো কোটও ছিল। কিন্তু শেষদিকে খাবার শর্ট পড়ে যাওয়ায় বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই ভীড়ে সবচেয়ে বিধ্বস্ত পাওয়া যায় ঐ নারী আইনজীবীটিকে। পরে দুজন সহকর্মী তাকে ভীড়ের ভেতর থেকে টেনে বের করলে দেখা যায় তার কী করুণ বিধ্বস্ত দশা। দুর থেকে দৃশ্যটা দেখে ভয়েই আর প্যাকেট আনতে যায়নি ফিজা। না খেয়েই ফিরে এসেছিলো সেদিন। লোকটার কথায় ফিজার ভাবনা জ্বাল ছিঁড়লো।

“দুঃখিত, আমি হয়তো খুব ভালো বক্তা নই। তবে এতোটুকু বলতে পারি, কোন মহিলাকে হস্তগত করার সবচে সহজ উপায় হচ্ছে তার বাউন্ডারি ক্রশ করে তার কাছাকাছি চলে যেতে পারা। যে অধিকারটা সবার থাকা উচিত না। ফলে অধিকার এড়িয়ে সুযোগ নেয়া তখনই সম্ভব হয় যখন পুরুষ নারীর বন্ধু সাজে। আর জানেন তো বন্ধু শব্দটা অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। বন্ধুরা সব পারে, তাদের দোষ ধরা যায়না। আজকাল তো আবার নো স্যরি নো থ্যাঙ্কস এর সিস্টেম চালু হয়েছে। এই সম্পর্কটাকে সীমাহীন করার আরেকটা অপপ্রয়াস। বন্ধু শব্দটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।”

ফিজা তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে। খালিদ হঠাৎ ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে দাঁড়ালো। দশ মিনিটের অনুমতি চাইলে ফিজা অসাঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। খালিদ বেরিয়ে গেলে তার শূণ্য চেয়ারটা হুট করেই দখল করলো মুরাদ। ফিজা মনে মনে চমকে উঠলেও বাহ্যত নির্বিকার রইলো।

” হাই। ব্যস্ত? “মুরাদ আন্তরিক হাসলো। ওর গৌরবর্ণ ত্বকে ফ্লুয়োরোসেন্টের আলো বাড়তি আভা ছড়াচ্ছে। ছেলেটা আসলেই সুপুরুষ সন্দেহ নেই। কেবল ব্যবহারটাই যা। ফিজা মাপা হাসলো।

” না, ব্যস্ত আর কী। এইতো বসে আছি।”

” আমি তো দেখলাম আম্মুর অনুরোধে ঐ বোরিং লোকটাকে হজম করছেন। কোন দরকার ছিল না। সবার সব অনুরোধ রাখতে নেই।”

ফিজা আরক্ত হলো, ” না না উনি অতটাও বোরিং নন। একটু বেশি ভাবেন এই যা।”

” এটা মোল্লাদের স্বভাব। পুরো মানবজাতির চিন্তা করে ওরা। আমাদের অত সময় কোথায় বলুন। আমি কিন্তু আপাতত আপনাকে নিয়েই ভাবছি। কী বিশ্রী একটা কান্ড করে ফেললাম বলুন তো। একটু ভালো করে ক্ষমা চাইতে দিন না।”

” জি? ” ফিজা একইসাথে বিস্মিত আর বিব্রতও হলো। একটু বোধহয় ভালোও লাগলো। বললো, ” আরে না না। ওসব নিয়ে ভাববেন না। ভুল তো ভুলই।”

” একদম ঠিক। কিন্তু যে ভুল থেকে শিখতে চায় তাকে বাধা দেয়া উচিত না। প্লিজ একটু আসুন না আমার সাথে।”

” কোথায়? ”

” আরে ভয় পাবেন না। উড়িয়ে নিয়ে যাবোনা। এখানেই, একটু ভিন্ন আয়োজনে। আমার ক্লোজ সার্কেলে। প্লিজ। ইটস আ রিকোয়েস্ট। ”

ফিজা দ্বিধায় পড়ে গেলো এবার। ছেলেটার কাছে সে হঠাৎ এতোখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ভাবেইনি। বারণ করতেও সংকোচ হচ্ছে ফিজার। স্যারের ছেলে। ফেলনা তো নয়। ফিজা কী বলবে ভেবে পেলোনা। এমনিতেও নিজের সৌন্দর্য নিয়ে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী নয় ফিজা। কাজেই ওটাকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো। ছোকরা দেশ বিদেশ ঘুরেছে। রূপসী কম দেখেনি। ফিজা এমন কোন বেলোয়ারী সুন্দরী না যে তার আছাড় খেতে হবে। তবে ফিজার জানা দরকার সে কী বলতে চায়। জানতে অসুবিধা কী। কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লো ফিজা। এভাবে বোকদের মতো বসে থাকতে আর ভালো লাগছেনা।

মুরাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে পুরো বাড়িটা দেখা হয়ে গেলো ফিজার। স্বীকার করতে বাধ্য হলো বাড়িটা বিশাল। ফিজার বিস্ময় দেখে মুরাদ নিজেই জানালো পুরো বাড়িটা প্রায় বিঘাখানেক জায়গা নিয়ে করা।
ফিজা মনে মনে রোমাঞ্চিত হলো। আজ সকালে যখন ভারাক্রান্ত মনে বাসে উঠেছিলো তখনও মনে হয়নি ওর সন্ধ্যেটা এতো বৈচিত্রপূর্ণ হবে। ‘মর্ণিং সোজ দা ডে’ বলে যে একটা প্রবাদ আছে সেটা পুরোপুরিই অকেজো দেখা যায়।
এলোমেলো ভাবনায় খেয়ালই করেনি সে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ীর অপরপ্রান্তে চলে এসেছে। এখানটায় কোন ভবন নেই অদূরের ঐ কোয়ার্টারটা ছাড়া। ফিজা পেছনে তাকালো। প্যান্ডেল ঘেরা আলোকোজ্জ্বল জায়গাটুকু অনেকটা পেছনে পড়ে গেছে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখাই যাচ্ছে না। পার্টির অত লোকের গুঞ্জন টের পাওয়া যাচ্ছেনা এখান থেকে।
চারিদিকে পচাপাতার গন্ধ আর নাম না জানা ফুলের সুবাস মিলে এক বিচিত্র গন্ধের জন্ম দিয়েছে। এই সন্ধেবেলাতেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে এখানটায়। আচমকা কী মনে হতে থেমে গেলো ফিজা। বিস্মিত হয়ে চারপাশে তাকালো।

” কোথায় যাচ্ছি আমরা ? ”
মুরাদ থামলো না। হাতের ইশারায় সামনের দিকে দেখিয়ে বললো, ” আরে আসুন না। ঐটা আমাদের ক্লোজ ফ্রেন্ডদের রঁদেভু। আমি দেশে এলে ওদের নিয়ে একত্রিত হই। একটু বিদেশী কায়দায় অবশ্য।” বলে চোখ টিপে হাসলো মুরাদ।

ফিজা চলা থামিয়ে পিছিয়ে এলো কয়েক পা। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করলো ওকে। মন বললো আর এগোনো ঠিক হবেনা। স্যারের ছেলে বলে ফেরেস্তা হয়ে যায়নি। পেশাগত জীবনে যত রেপ কেস হ্যান্ডেল করেছে তার বেশিরভাগই দেখেছে পরিচিত পরিবেশ আর জানাশোনা লোকজনের মাধ্যমে ঘটতে। তাদের মধ্যে প্রভবশালী লোকজনের র‍্যাসিও কম না। গত চার মাস আগে চেম্বার ছাড়ার সময়ও এমনই একটা মামলা স্টাডি করেছে যেখানে মেয়েটা তার নিজের বাড়িতে নিজের রুমেই রেপড হয় তারই বাড়ির কর্মচারী দ্বারা। আর সেদিন রাতে তাদের বাড়িতে একটা ফ্লোরে পার্টি চলছিলো। মেয়েটা একা ছিল উপরের ফ্লোরে। সত্যিই একটা মেয়ে কোথাও নিরাপদ নয়। খালিদ মন্দ বলেনি, অপুরুষগুলো সর্বসমক্ষে সম্মানের ভঙ্গি করে ঠিকই। লোকচক্ষুর আড়ালে এদের সবারই অদৃশ্য গজদাঁত দুটো বেরিয়ে পড়ে। তখন ওরা হয়ে যায় রক্তচোষা ড্রাকুলা।

মুরাদ ফিজার থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলো। ফিজার পদশব্দ না পেয়ে সে দৌড়ে ফিরে এলো,” একি দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন ? প্লিজ, কাম। একটা দারুণ সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য। আজকের স্পেশাল গেস্ট আপনি।”

” দুঃখিত, আমাকে একটু পার্টিতে ফিরে যেতে হবে। একটা জিনিস ভুলে ফেলে এসেছি।” ফিজা অযুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। বিপদের গন্ধ পাচ্ছে সে। আজ বিকেলেই যার দুর্ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে হঠাৎ করে তার কাছে দামি হয়ে ওঠার কারনটাও তো বুঝতে হবে। ফিজা তার ফিরে যাবার ইচ্ছায় অনড় রইলো। মাথা নেড়ে ভদ্রভাবেই বললো, প্লিজ, আপনি যান। ফ্রেন্ডদের সাথে ইনজয় করুন। আমি আসলে এসবে অভ্যস্ত নই।” বলে ফিজা সরে যাবার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারলো না। মুরাদ খপ করে ওর কব্জি চেপে ধরে ফেললো। ফিজার মুখের কাছে মুখ এনে বললো, ” আরে বিদেশী কায়দা শুনে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। আপনি আসুন তো। বড্ড বেরসিক আপনি। আইন পড়ে রসকষ সব শুকিয়ে ফেলছেন নাকি? ”
মুরাদের এই কথায় গা রি রি করে উঠলো ফিজার। হাত মুচড়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে গিয়ে চাপা স্বরের ধমক খেলো।
” আশ্চর্য, এরকম করছেন কেন? অামাকে কী রাস্তার ফকির মনে হয় ? মেয়েরা আমার পাশে বসার জন্য ঝগড়া করে আর আপনি..! ইউ শ্যুড বি প্রাউড ফিজ।”
আরেক ঢং। ফিজাকে ফিজ, রিয়াজকে রিজ, সালাউদ্দিনকে স্যাডি। নকলনবিশ জাতি। মনে মনে কষে গালি দিলো ফিজা। মুখে বললো,” আমি কমফোর্ট
ফিল করবো না। প্লিজ, লিভ মি।”
” করবেন। ওখানে অনেক মেয়েও আছে। এবার মুখ বন্ধ করে হাঁটুন। সিনক্রিয়েট করে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না। নিজেই লজ্জিত হবেন। কাজেই ঝামেলা না করে চুপচাপ চলুন, সমস্যা বাড়াবেন না। আমি রেগে গেলে কিন্তু ভয়ংকর। ”

” আপনি…আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন ? আমি আপনাদের বাড়ির ক্ষণিকের অতিথি। স্যারের সাথে দেখা করে চলে যেতে এসেছিলাম। সৌজন্যতার খাতিরে রয়ে গেছি। আপনি নিজেই তো আমাকে বিকেলে সহ্য করতে পারছিলেন না। হঠাৎ আমাকে এতোটা খাতির দেখানোর কারণ তো বুঝতে পারছি না। ” কথাগুলো বলতে গিয়ে গায়ে কাঁপুনি এলো ফিজার। শীত বোধ হচ্ছে ওর। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে প্রায়। মুরাদের চেহারা উগ্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিচ্ছিরি করে হেসে উঠলো অমানুষটা। আবারও ফিজার মুখের কাছে মুখ আনলো। ওর মুখ থেকে এবার বোঁটকা গন্ধ পেলো ফিজা।

মুরাদ ফিসফিসিয়ে বললো,
” বিকেলে তো আর জানতাম না যে ঐ বাদুরঝোলার নিচে এই রূপকুমারী আছে। খোলস খোলার পর আপনার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স দেখে অন্তত দশবার ঢোক গিলেছি। মাথায় যতই ত্যানা প্যাঁচান, অমন কোকাকোলার মতো হিপ আর…!” সপাটে চড় কষিয়ে নিজেই চমকে উঠলো ফিজা। দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।মনের অজান্তেই হাত ছুটে গেছে তার। স্যরি বলবে কিনা ভাবছে। তার আগেই দেখলো মুরাদ ভীষণ উগ্র হয়ে উঠেছে। চড়ের ঝোঁকটা সামলে সে এবার শক্ত করে ফিজার বাহু চেপে ধরলো। সেভাবেই সামনের দিকে এগোতে লাগলো । ফিজার মনে হলো ও অচেতন হয়ে যাবে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো ফিজা। চারপাশে তাকিয়ে আত্মরক্ষার মতো কিছু পেলো না। এদিকে লোকজনও নেই। রাস্তার লাইটপোস্টের আলোটাও ভালভাবে আসতে পারছেনা গাছের কারণে। মিনিট দুয়েক হেঁটে মুরাদ ওকে নিয়ে একটা দরজার সামনে থামলো। বাম হাতে বেল বাজালো। ওর চেহারা ভীষণ রুক্ষ দেখাচ্ছে।

ফিজা চারিদিকে তাকিয়েই বুঝলো এটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। দরজাটা খুলে গেলো। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে টকটকে লাল রঙা শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে দরজাটা খুলেছে। তার সাজ পোশাকের উগ্রতাই বলে দিচ্ছে সেও মুরাদের মানসিকতারই কেউ। মেয়েটা ওদের দেখে ‘ হাই ‘ বলে চিৎকার করে উঠলে মুরাদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, ” দেখি, সরো এখান থেকে।”
মেয়েটা সরে ওদের যাবার পথ করে দিলে ফিজার টনক নড়লো। সে ভীষণ মরিয়া হয়ে গেলো এবার। চিৎকার দিয়ে উঠে মুরাদের হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় আচমকা ওর হাতে কামড় বসিয়ে দিলে মুরাদের হাতটা সামান্য আলগা হয়ে গেলো। অতটুকুরই অপেক্ষায় ছিলো ফিজা। ছাড়া পেয়েই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলো সে। পেছন থেকে মুরাদের বিজাতীয় ভাষার খিস্তি শুনেও কোন প্রতিবাদ করলো না। ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা। এখান থেকে সরে যেতে হবে। যতটা দ্রুত সম্ভব।

এলোপাতাড়ি দৌড়ানোর পর একসময় প্যান্ডেল ঘেরা জায়গাটা চোখে পড়লো ওর। গুঞ্জনের শব্দ কানে বাজছে। ফিজা থেমে গিয়ে হাঁপাতে লাগলো। প্রবল উত্তেজনায় হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করতে লাগলো ওর উর্ধ্বাংশ। এমন সময়ই খালিদকে দেখা গেলো মেইন গেটের দিক থেকে আসছে।
সে তার মাথার টুপি খুলে পকেটে রাখছে। তারমানে লোকটা নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। টুপি খোলা শেষে দুহাতের আঁচড়ে চুলগুলো পরিপাটি করতে গিয়েই ফিজাকে দেখলো খালিদ। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে
চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও ফিজাকে ওর দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো, ” কী হয়েছে আপনার ? অমন হাঁপাচ্ছেন কেন ? অসুস্থ বোধ করছেন ?

ফিজা জবাব দিতে পারলো না। মাথা নাড়লো কেবল। নিঃশ্বাসের আন্দোলন এড়াতে দ্রুত আঁচল টেনে কাঁধ ঢাকলো। ওকে বেতসলতার মতো কাঁপতে দেখে খালিদ কী বুঝলো কে জানে। ভারি স্বরে জানতে চাইলো। ” কোন সমস্যা? ”

ফিজার চোখে পানি চলে এলো এবার। রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করলো,” মুরাদ।”

খালিদ সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” বেজন্মাটাকে দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিলো আমার। দুর থেকেই আপনাকে গিলে খাচ্ছিলো। বাদ দিন, ভেতরে চলুন। আর ঘামটা মুছে নিন। এসব কাউকে বলা যাবে না, দেখানোও যাবেনা। বললেও যে বিরাট লাভ হবে তেমনও না।” বলে পকেট থেকে কড়কড়ে একটা রুমাল বের করে ফিজার দিকে বাড়িয়ে ধরলো,” একদম নতুন। এখনও ব্যবহার করিনি। ”

ফিজা কাঁপা হাতে রুমালটা নিয়ে কপালে নাকে গন্ডে চেপে ধরতে লাগলো। সেই অবস্থাতেই ভেতরে গেলো ওরা। মারিয়া ওদের দেখতে পেয়েই ছুটে এলেন।
” আরে জুনায়না, কোথায় ছিলে তুমি ? আমি তোমাকে খুঁজে হয়রান। এসো, ডিনার সার্ভ করা হয়ে গেছে। তোমার চেম্বারের সবাই তোমার সাথে বসবে বলে সেই তখন থেকে অপেক্ষা করে আছে। ”

ফিজা সামনের দিকে তাকালো। মারিয়া আন্টির কথাই সত্যি। গোলাকার টেবিলের সবগুলো চেয়ারে ওদের চেম্বারের সবাই বসে আছে। এমনকি তৌহিদ আর ওর নবপরিণিতা স্ত্রীও। মুনা ফিজাকে দেখে ছুটে এলো।

” এ্যাই ফিজা। কোথায় গিয়েছিলে তুমি ? মারিয়া আন্টির কাছে তোমার আসার খবর শুনে আমি পুরো পার্টি তিনবার চক্কর মেরে ফেলেছি কিন্তু তোমার পাত্তা নাই। কোথায় ছিলে ? ”

” ও…ওয়াশরুমে।” কোনমতে উচ্চারণ করলো ফিজা। বলতে বলতেই আলগোছে পেছনে তাকালো। খালিদ নেই। ওকে এদের সাথে ভিড়তে দেখে সরে গেছেন উনি। ফিজা স্বাভাবিক হতে পারছেনা। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা বন্ধ হচ্ছেনা এখনও। কেবলই মনে হচ্ছে, সময়মতো সরে আসতে না পারলে কী হতো আজ ওর সাথে ? ও কী সম্মান নিয়ে ফিরতে পারতো ? নাকি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে মুরাদের অপকীর্তি বর্ণনা করতে পারতো। লম্বা করে দম টেনে সন্তর্পনে তা ছেড়ে দিয়ে চোরাচোখে খালিদকে খুঁজলো এবার। লোকটার রুমাল রয়ে গেছে ওর কাছে। এদিকে মুনা ওর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।

” ভুতে ধরেছে নাকি আজ তোমাকে ? এতো প্রশ্ন করছি কোন জবাবই যে দিচ্ছো না। ”
ফিজা আহত চোখে তাকালে, ” স্যরি, একদম খেয়াল করিনি। কী জানতে চেয়েছিলে আবার বলো। “প্রানপণে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো ফিজা।

” বগুড়া চলে যাচ্ছো শুনলাম। ওখানেই কী পার্মানেন্ট হবার ইচ্ছা ? ”

” হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো। ওখানেই পার্মানেন্ট হবো।” বলতে বলতে তৌহিদের দিকে চোখ পড়লো। সে অনেকক্ষন থেকেই ফিজার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলো। ফিজাকে তাকাতে দেখেই সৌজন্যতার হাসি হেসে মাথা ঝাঁকালো। তারপর বউকে ডেকে দেখিয়ে বললো, ” এটা তোমার ভাবি, সুচরিতা। আর রিতা ও হলো ফিজা। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। একেবারে ছোটবোনের মতো স্নেহ করতাম ওকে।” তৌহিদের কথা শুনে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইলো ফিজা। ওর এখন কষ্ট বা আনন্দ কোনোটাই হচ্ছে না। এমন সময় ডিনার চলে এলে টুংটাং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো জায়গাটা। ফিজা কিছুই খেতে পারলো না। কেবল ঠান্ডা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে ফেললো।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যখন বিক্ষিপ্ত ভাবে ইতিউতি হাঁটছিলো তখনও ফিজা ভীত চোখে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। বুকের ভেতর ভয়টা এখনও ঘাপটি মেরে বসে আছে। মন বলছে ওর বাড়ি ফেরার পথে ঐ অমানুষ ছোকরাটা ঝামেলা করতে পারে। আচ্ছা, যদি বলে বসে সেও যাবে ফিজাকে পৌঁছে দিতে ? শয়তানের তো চাতুরির অভাব হয়না। অথবা যদি চালাকি করে ওর সাথে গাড়িতে উঠে পড়ে ? একা অথবা বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে? আবার এমনও তো বলতে পারে, আমার বন্ধুরা যাচ্ছে। ওদের গাড়িতেই ফিজাও যাক। যদি এটা বলে বসে ? স্যারতো তখন ছেলেকেই বিশ্বাস করবেন। আতঙ্ক নতুন করে দানা বাঁধতে শুরু করলো ফিজার মনে। অসহায়ের মতো চারিদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মুরাদের মতো কাউকে দেখলেই কেঁপে উঠছে অন্তরটা। আচ্ছা, স্যার কী জানেন, তার ছেলেটার এইরকম স্বভাবের ? এমন চমৎকার যার পিতামাতা। তার সন্তান কী এমন হতে পারে ? বেগতিক ভাবনার ঝড় অস্থির করে তুললো ওকে। তবে বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ পেলো না ফিজা। তার আগেই দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এলো ফিজার জীবনের নতুন যন্ত্রণাটা।
দুর থেকেই চোখটা কয়েকবার পিটপিট করলো মুরাদ। ফিজার মনে হলো, সে যেন ফিজাকে ব্যঙ্গ করেই হাসছে। কিছু বলতে চাইছে বা বোঝাতে চাইছে। চাহনীটা নতুন করে ভীতির জন্ম দিলো ফিজার মনে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের বেগ বাড়লো। স্কার্ফের নিচে ঘেমে জবজব করছে চুলগুলো। দৌড়াদৌড়িতে যে দুচারটা চুল বেরিয়ে এসেছে সেগুলোও লেপ্টে গেছে গালে আর গলায়।
মুরাদ ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো মন্থর গতিতে। কেউ ওদের খেয়াল করছে না কারণ সবাই এখন বিদায়ের আগের মুহূর্তের গল্পে মত্ত। ফিজা স্পষ্ট বুঝতে পারছে মুরাদের মতলব মোটেও ভালো না। এই ছেলে আজ সহজে পিছু ছাড়বে না ওর। সে চারপাশে তাকালো। অবচেতন মন খালিদকে খুঁজলো। কোথায় গেলো লোকটা? গায়েব হয়ে গেলো নাকি ? এই লোকও কম না। এতো পছন্দ করে পাত্রী দেখতে এলো আর কোন পাত্তাই নেই। এই বুঝি তার পছন্দ ? নাকি ওকে পছন্দই হয়নি কে জানে। তার উপর ঐরকম তর্ক। পছন্দ না হবারই কথা।
ফিজার কাছে যেমন খালিদকে গুমোট মেঘ বলে মনে হয়েছে, তেমনি খালিদের কাছেও ওকে হয়তো বজ্রপাতের ঝলকানি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। সে কেন আসবে ওর কাছে। খালিদ নির্ঘাত আগ্রহ হারিয়েছে ওর প্রতি। হতাশা গ্রাস করলো ফিজার মনে।
মুরাদকে কয়েক গজ সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো ফিজার। হিপনোটাইজড মানুষের মতো মুরাদের চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। মুরাদ নিজেও এর তার সাথে হাই হ্যালো করলেও নজর রেখেছে ফিজার দিকে।

পেছনের দিকে সামান্য সরে এলো ফিজা। টেবিলের কোণটা আঁকড়ে ধরলো সভয়ে। ডুবন্ত মানুষ যেমন বাঁচার আকুতিতে খড়কুটা হাতড়ে বেড়ায় ফিজারও তেমনই অবস্থা দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে চেয়ারের হাতলটা ধরতে গেলে ওর হাতের ধাক্কায় টেবিলের ওপরের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে সশব্দে চুরমার হলো। কাঁচ ভাঙার শব্দে সচকিত হলো সবাই। ফিজার হঠাৎ মনে হলো, আহা, যদি পালিয়ে যেতে পারতাম কোথাও।
এমন সময় কানের কাছে সদ্য পরিচিত শব্দটা শুনলো। মনে করতে পারলো না কোথায় শুনেছে। তবে মনে পড়লো, এই শব্দের উৎসটাকেই অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে চলেছে ওর ক্লান্ত ভীরু চোখগুলো।

” এতো ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি মিস ফিজা। বি ইজি। ঐ ছুঁচোটা কিছুই করতে পারবেনা। আপনি ভয় পাচ্ছেন বলে ভয় দেখাচ্ছে। ঐ দেখুন আমার সাথে কথা বলতে দেখে কেমন লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে।” মেঘ গুড়গুড় শব্দে বলে উঠলো খালিদ। ফিজা তাকিয়ে দেখলো, সত্যিই সরে গেছে মুরাদ। অপার শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে খালিদের দিকে ফিরলো সে।
কাতর স্বরে বললো ,” একটা অনুরোধ করবো রাখবেন ? ”

” তার আগে আমার অনুরোধটা রাখুন। আমার আপারা বাড়ি যাচ্ছেন। ওদের অনুরোধ করেছি যেন আপনাকে তাদের সাথে নিয়ে যান। একটু ঘুরপথ হবে। তাতে সমস্যা নেই। মুশকিল হলো মারিয়া আন্টি এটা শুনে বেশ খুশি হয়ে গেছেন। খারাপ লাগছে যে বেচারী ভুল মেসেজ পেলেন। তার ধারণা, আমরা বুঝি এক হতে যাচ্ছি। ” বলেই থেমে গেলো খালিদ।

ফিজা মৃদু শব্দে বললো,” এটাকে ভুল মেসেজ বলে মনে কেন মনে হলো আপনার ? ”

খালিদ চট করে ফিজার দিকে তাকালো এ কথায়। ওর চোখে দুর্বোধ্য চাহনি।

ফিজা ক্লান্ত স্বরে বললো,” বাহ্যত আপনি মেঘ হলেও আমি জানি, মেঘের পেছনেই থাকে রোদের বাড়ি। রোদ সবসময় মেঘকে আশ্রয় করে লুকিয়ে থাকে। মেঘ সরলেই সে উঁকি দেয়। আমি কখনোই বজ্রপাতের ঝলকানি হতে চাইনি। যা মানুষকে আলগা দাপট দেখিয়ে চলে যায়। ধরাধামে যার কোন উপকার নেই। আমি তো সবসময়ই এক টুকরো রোদ হতে চেয়েছি যার আলোতে পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে যাবে। আমি আমার ঘরে স্থির হতে চাই। আমার নিজেকে আড়াল করার জন্য এক টুকরো মেঘ দরকার।” বলেই অবাক হয়ে গেলো ফিজা। কী অবলীলায় নির্লজ্জের মতো করে কথাগুলো বলে গেলো সে।

খালিদের চেহারায় রোশনাই ছড়িয়ে পড়লো। হাসি চেপে বললো,” শেষ পর্যন্ত আমি মেঘ হয়ে গেলাম।”

” উঁহুঁ, সাদা মেঘ। যার বুকে লুকানো থাকে অজস্র বৃষ্টি। যার আড়ালে রোদের আশ্রয়। মেঘের দেশেই এই রোদের বাড়ি। ”

” হম, জানলাম। এবার আমার রুমালটা ? ”

” ওটা আমার কাছে আছে। সবসময় আমার কাছেই থাকবে।” খুবই হালকা গলায় বললো ফিজা।
খালিদ আর কিছু না বলে মারিয়া আন্টির খোঁজে চারিদিকে তাকাল।

~সমাপ্ত~