#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১০
#অধির_রায়
প্রতিটি মানুষ নিজের স্থান থেকে নিষ্পাপ। মানুষদের কর্ম বলে দেয় মানুষটা কতটা ভালো খারাপ। সেজন্য মনী, ঋষি, জ্ঞানীদের কন্ঠে ধ্বনিত্ব হয়েছে জন্ম হোক যথাযথ কর্ম হোক ভালো। শাওন চৌকাঠে পা রেখেও বাহিরে গেল না৷ নেত্রদ্বয় বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল৷
চিন্তা শক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিলে দীর্ঘ শ্বাস নিলে চিন্তা শক্তি ফিরে আসে৷ নতুন কোন ঘটনা মাথায় ঘুরে৷ জানান দেয় নতুন কিছু বেছে নেওয়ার৷ শাওন ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল। নেত্রদ্বয় বন্ধ, মাথা নিচু, চোখের পাতায় আঙুল রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন। নিজেই নিজেকে বলল,
“শাওন বাহিরে যাবি না৷ ড্রিংক্স করবি না৷ কিছুতেই বাজে পথে যাবি না৷ নিধির জন্য তুই সবকিছু ছেড়েছিস৷ তার সামান্য অবহেলায় সে পথে ফিরে যাবি৷ নিজেকে শান্ত রাখ শাওন৷ ভালোবাসলেই পেতে হবে তেমন নয়৷ দূর থেকে না হয় ভালোবাসে যাবি৷ ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার জন্য সামান্য ত্যাগ করতে পারবি না৷”
শাওনের আর বাহিরে যাওয়া হলো না৷ সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা শাওনের মাথায় সু চিন্তার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন৷ শাওন রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে পবিত্র হয়ে নিল৷ আল্লাহর দরবারে দুই রাকা’ত সালাত আদায় করে নিধির জন্য মুনাজাতে ধরেন৷ একটাই চাওনা৷ নিধিকে যেন মুনাজাতে কাছে পাই৷”
_____________
শাওন ভালোবাসার দাবী নিয়ে নিধির সামনে দাঁড়ায় নি৷ বরং নিধির বন্ধু হয়ে নিধির পাশে ছিল৷ গতকাল নিধির পরীক্ষা শেষ হয়েছে৷ আল্লাহর রহমতে পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে৷ দেখতে দেখতে চোখের পলকে সময় চলে গেল৷ প্রায় ১ বছর থেকে নিধি ঢাকা৷ মনমরা হয়ে বসে আছে নিধি৷ শাওন নিধির রুমে প্রবেশ করল৷ শাওনকে দেখে নড়েচড়ে বসে৷ ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাঁসার চেষ্টা করল৷ শাওন চৌধুরী নিধির পাশে বসতে বসতে বলল,
“জোর করে হাসতে হবে না৷ মন খারাপ জীবনের একটা অধ্যায়৷ মন খারাপ না করলে আমরা ভালো দিনের সূচনা খুঁজে পাব না৷ তো বলো, মন খারাপ কেন?”
“মনের উপর আমার কোন হাত নেই। হুটহাট করেই মন খারাপ হয়ে যায়৷ আবার হুট করেই মন ভালো হয়ে যায়৷”
“তার মানে পিচ্ছির মনটা অনেক.. খারাপ। পিচ্চির মনটা ভালো করতে কি করতে পারি?”
” কিছু করতে হবে না৷ আমি ভেবেছি, আমি আজ সবার জন্য নিজের হাতে রান্না করব৷ আমাকে তো কেউ কোন কাজই করতে দেয়না৷ আমি ধীরে ধীরে সব কাজ ভুলে যাচ্ছি। আর আপনি অফিসে যাননি কেন? দাঁড়ান মাকে বলছি৷”
“আজ অফিসে যাব না৷ আজ পিচ্চিটার সাথে ঘুরতে যাব৷ পিচ্চিটার মন খারাপ। আমি কি পিচ্চিটার মন খারাপ রাখতে পারি?”
নিধি কিছু বলল না৷ শাওনের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখের পাতা নামিয়ে নিল৷ মলিন কন্ঠে জবাব দিল,
“আমি কোথাও ঘুরতে যাব না৷ আমি এমনি ঠিক আছি৷ বাহিরে ঘুরতে গেলে অনেকে অনেক কথা বলবল৷”
শাওন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি পাশে থাকতে কে আমার পিচ্চিটাকে কথা শুনাবে৷ খু*ন করে ফেলব৷ জলদি তৈরি হয়ে নাও৷ আমি এখনই আসছি৷ কোন কথা শুনতে চাইনা৷”
শাওনের প্রস্তান হয় রুম থেকে৷ নিধি বসা থেকে উঠে মনের সুখে নৃত্য করতে থাকল৷ এই প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে নিধি৷ বিষয় টা মাধবী ভাবীর সাথে শেয়ার করতে মন চাচ্ছে৷ কিন্তু শেয়ার করলে শাওন চৌধুরী যদি মানা করে দেয়৷ দ্বিধায় বলা হলো না৷ নিধি সাদা রঙের একটা গাউন পড়ে নিল৷ শাওন চৌধুরী কিছুদিন আগেই কিনে দিয়েছে৷ লোকটা পছন্দ আছে৷ ছেলে মানুষের এত সুন্দর পছন্দ ভাবতেই পারিনি।
____________________
আপন গতিতে রিক্সা চলছে ধানমন্ডির লেগে৷ পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। দু’জনের মাঝে নিরবতা বজায় থাকলেও গাড়ীর হনের অনেক শব্দ। নিধি কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“আপনি গাড়ি নিয়ে বের হলেন না কেন? রিক্সা ভাড়া অনেক। ঢাকার বুকে রিক্সা ভাড়া সোনার দানের থেকেও বেশি৷”
নিধির কথা শুনে শাওন ফীক করে হেঁসে দিল৷ কোন রকম হাসি থামিয়ে বলল,
“এসব জায়গায় গাড়ি নিয়ে ঘুরা যায়না৷ তুমি কি গাড়ি দিয়ে সব জায়গায় যেতে পারবে? ঘুরাঘুরির জন্য রিক্সা ভালো বোকা পিচ্চি। এখানে রবীন্দ্র সরোবরে কিছু সময় পার করে আমরা জিয়া উদ্যানে যাব৷ রবীন্দ্র সরোবরে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস৷ সেগুলো তোমাকে অন্যদিন বলব৷”
নিধি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ নিধি জানে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই৷ নিধি এখন নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করে শাওনকে৷ দৃঢ় বিশ্বাস শাওন তার কোন ক্ষতি হতে দিবে না৷ সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে। সেদিনের পর থেকে আর কোনদিন ভালোবাসার দাবী নিয়ে সামনে আসেননি৷ সব সময় বন্ধু হয়ে পাশে ছিল৷ সকল ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ মানুষটার চরিত্র খারাপ হলেও মনটা অনেক ভালো৷
ধানমন্ডির লেগে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে নিধি শাওন৷ শাওন প্রতিটি দৃষ্টি নিধিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে৷ নিধি নতুন শাওনকে আবিষ্কার করল৷ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ফটো ফ্রেমে বন্ধি করছি কিছু দৃশ্য। বাদ পড়েনি নিধির অপলক দৃষ্টির চাহনি৷ মায়াবী সেই মুখের হাসি৷ আনন্দের সাথে নিধি নিধি সবকিছু উপভোগ করল৷ দুপুরের খাবারের পর রিক্সা ছুটে চলছে বিজয় স্মরনীয় উদ্দেশ্য। বর্তমান উদ্দেশ্য হলো চন্দ্রিমা বা জিয়া উদ্যান৷ গোধূলি বেলায় জিয়া উদ্যানের দৃশ্য অপরুপ। গোধূলি বেলার সোনালী সূর্যের আলো জিয়া উদ্যানের সৌন্দর্য হাজার গুন বাড়িয়ে দেয়৷ চারিপাশ প্রদক্ষিণ করে অপরুপ দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত নিধি৷ কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে জানা নেই? চন্দ্রিমার স্মৃতি ফুটো বন্ধি করতে ভুলেনি৷ সন্ধ্যায় রিক্সা করে বাড়িতে ফিরে আসে৷ সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই মাধবী অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমাকে একা রেখে তোমরা কিভাবে ঘুরতে গেলে৷”
শাওন মাধবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে নিজের রুমে চলে যায়। আটকা পড়ে নিধি৷ নিধিকে দিতে হচ্ছে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর। ঘুরাঘুরি কেমন হলো? শাওন কি তাকে কিছু বলছে কিনা? নিধি কেন মাধবীকে রেখে শাওনের সাথে ঘুরতে গেল?
মাধবী অনেক ভালো মেয়ে। সব সময় নিধিকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে৷ মাধবীকে পেয়ে তিতিরের কষ্ট ভুলে গেছে৷ মাধবীও নিধিকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। ঘুরাঘুরি নিয়ে চলছে দু’জনের মাঝে তুমুল ঝগড়া। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়৷ ঝগড়া বলতে ভালোবাসার ঝগড়া৷ নেই কোন অন্য অভিযোগ অন্য অভিমান৷ মুগ্ধ রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,
“এবার ঝগড়া থামাও। মাধবীকে আমি ঘুরতে নিয়ে যাব৷ আর আমাদের সাথে নিধিও যাবে৷ আমরা নিধি, শাওনের মতো ছোট মনের মানুষ নয়৷ আমরা একাধিক মানুষকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারি৷”
নিধি অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমি যাব না তোমাদের সাথে৷ তোমাদের মাখে কাবাবের হাড্ডি হতে চাইনা৷ আমি ঘুরতে গেলে শাওন চৌধুরীর সাথে ঘুরতে যাব৷”
নিধি ভেংচি কেটে চলে যায়৷ নিধি চলে যেতেই মুগ্ধ, মাধবী অট্টহাসিতে মেতে উঠে৷ রুমে এসে মনে পড়ে নিধি ভুল বলে ফেলছে৷ আসলে এত কথার মাঝে আসল কথাই ভুলে গেছে৷ মনে মনে নিজেকে হাজারটা গা/লি দিচ্ছে। মুখ ফুটে শাওন চৌধুরীর নামই বলতে হলো৷ আর কোন নাম ছিল না৷
_____________________
ঘুম নেই চোখের পাতায়৷ সারাদিনের ঘটনা চোখের পাতায় নাড়া দিচ্ছে। শাওন চৌধুরীর সাথে পুরো একটা দিন ঘুরাঘুরি করেছে৷ খারাপ লাগে নি বরং ভালোই লাগছে৷ নিধি নিজেই নিজেকে আবারও গা/লি দিচ্ছে৷ কেন বারং বার শাওন চৌধুরীর কথা মাথায় আসে? রাতের শীতল হাওয়া গায়ে মাখাতে নিধি চলে আসে ছাঁদে। ছাঁদের দোলনায় অনেক আগে থেকেই বসে আছে শাওন৷ যেন নিধির জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিল৷ নিধি আসতেই শাওন চৌধুরী নিধিকে পাশে বসতে বলে৷ নিধি কোন ভনিতা না করে পাশে বসে পড়ল৷ শাওন চৌধুরী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঘুম আসছিল না তন্দ্রাবিলাসী। যে মেয়ে তন্দ্রাঘোরে মগ্ন থাকে তার চোখের পাতায় ঘুম নেই! অনেক হাঁটাহাঁটি করছো ঘুমানোর কথা তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমি ভিন্ন দেখছি৷”
নিধি মলিন মিহি কন্ঠে জবাব দিল,
“ঘুম আসছিল না৷ গায়ে শীতল হাওয়া লাগাতে ছাঁদে আসলাম৷ রাতের বেলা ঢাকার বুকে শীতল হাওয়া খুব ভালো লাগে৷ দিনের বেলা থাকবে সূর্যের প্রখর তাপ৷ কিছু ভালো লাগে না৷”
“সবই বুঝলাম৷ তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? কোনদিন তো বললে না তোমার স্বপ্নের কথা!”
নিধি আনন্দের সহিত বলল,
“আমি ডাক্তার হতে চাই৷ যারা বিনা চিকিৎসায় মা/রা যান আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই৷ বিনা ভিজিটে আমি রোগী দেখতে চাই৷ আমার মতো কেউ যেন মাতৃহারা না হয়৷”
মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ মায়ের ভালোবাসা পাওয়া হলো না জীবনে৷ সৎমায়ের সংসারে সইতে হয়েছে অমানবিক অত্যাচার৷ নিধিকে শান্ত করতে শাওন পুনরায় বলল,
“আর কিছু চাওয়ার নেই৷ তবে আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি৷ আমিও চাই তুমি গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াও৷”
নিধি আমতা আমতা করে বলল,
“আপনাকে একটা কথা বলব বলব বলে বলা হয়নি৷ কিন্তু কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না?”
শাওন অভয় বানী দিয়ে বলল,
“ভয়ের কিছু নেই৷ মনে যা আছে বলে দাও৷ কখনও কিছু চেপে রাখতে নেই৷”
শাওনের ধারণা নিধি তাকে ভালোবাসার কথা বলবে৷ কিন্তু শাওনের ধারণা ভুল প্রমাণ করে নিধি বলল,
“এখন নিষিদ্ধ পল্লীতে যান না কেন?”
নিধির এমন প্রশ্নে শাওন ঘাবড়ে গেল৷ নিজেকে সামলিয়ে বলল,
“প্রয়োজন নেই৷ যাকে ভালোবেসেছি তাকেই পাইনি৷ অন্য কাউকে পাওয়ার চেষ্টা নেই৷”
“আপনি একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আমি যা চাইব আপনি তাই দিবেন৷ আজ আমি সেই জিনিস চাই৷ আমাকে দিতে হবে৷”
শাওন সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিধির দিকে৷ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
“সাধ্যের মাঝে হলে এখনই দিব৷ কঠিন কিছু হলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব৷”
শাওনের উত্তরে নিধি খুব খুশি হলো৷ নিধির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল উজ্জ্বল হাসি৷ কোন রকম ভনিতা না করে বলল,
“নিষিদ্ধ পল্লীতে শ্যামলী নামে একজন মেয়ে থাকেন৷ উনাকে সেই নরক থেকে আপনাকে মুক্ত করতে হবে৷”
শাওন বিচলিত দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকাল৷ তবুও নিধিকে প্রশ্ন করল না কিছু৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাল শ্যামলীকে দেখতে পাবে৷ আল্লাহ যদি আমার সহায় হোন তাহলে আমি শ্যামলীকে নরক থেকে মুক্ত করব৷”
চলবে……
#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১১
#অধির_রায়
মৃত্যুর উপর কারো কোন হাত নেই৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিনটাই আল্লাহর হুকুমে হয়৷ মানুষের জীবনে মৃত্যু অনিবার্য। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অনিবার্য। সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে৷ কারো মৃত্যু সুখের, কারো কষ্টের, কেউ আবার এক চিলতে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা।
নিধি শাওনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে৷ উৎসাহ নিয়ে নিরবে নিভৃতে বসে আছে ঘরের কোণায়৷ কখন নিজের চোখে শ্যামলীকে দেখবে? অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শাওন রুমে প্রবেশ করল৷ অবাধ্য চুলগুলো পাখার হওয়ায় বারবার নাড়া দিচ্ছে। নিধি উৎসাহ নিয়ে বলল,
“শ্যামলী আপু কোথায়? ডাইনিং রুমে শ্যামলী আপু?”
নিধির চোখে মুখে আনন্দের হাঁসি৷ ঠোঁটদ্বয় প্রসারিত। দ্রুত কদম ফেলে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে নিলে শাওন নিধির হাত ধরে ফেলে৷ নিধি সন্দিহান চোখে শাওনের দিকে তাকায়৷ শাওন কথায় কথায় নিধির হাত ধরা বন্ধ করে দিয়েছে৷ সেদিন রিক্সায় যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্ব রেখে বসেছিল। সরু দৃষ্টি মেলে তাকায় শাওনের দিকে৷ শাওনের দিকে পলক ফেলে মিনি কন্ঠে বলল,
“আপনাকে উদাস দেখাচ্ছে কেন? শ্যামলীকে আপুকে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে নিয়ে আসতে পারেন নি?”
শাওনের নেত্রদ্বয় অশ্রু কণায় টলমল করছে৷ যেন এখনই টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। মলিন অপরাধী কন্ঠে বলল,
“শ্যামলী নামের মেয়েটি পৃথিবীতে আর নেই৷ নিষিদ্ধ পল্লীতেই কিছুদিন আগেই নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে। আমি তোমার চাওয়া পূরণ করতে পারলাম না৷”
নিধি নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ শ্যামলী আপু নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে এমন কাজ করল! উৎসর্গ করল নিজের জীবনকে৷ এইতো সেদিন বলা হয়েছি উৎসর্গ করবে তারা যারা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে৷ নিধি ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল৷ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ কিছুক্ষণের মাঝেই নিধির দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল৷ নিধির ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে পারেনি৷ শ্যামলীর মৃত্যু তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারেনি৷ নিধি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
_____________
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না৷ দেখতে দেখতে চলে গেছে চারটি বছর৷ এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ শাওনের পরিবারের মানুষগুলো খুব আপন হয়ে গেছে৷ যতই পরিবর্তন আসুক অতীত এসে কড়া নাড়ে চৌকাঠে। নিধি এখন মেডিকেল এডমিশনে কোচিং করছে৷ চলছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার৷ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে আল্লাহকে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে যায় না৷ সকাল থেকে নিধির মন খারাপ৷ আজ মা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন৷ তাঁর সেই ছোট নিধি আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে একটা সুন্দর পরিবার পেয়েছে৷ চোখ যেন খুঁজে চলছে মাকে৷ মায়ের কবরটা খুব টানছে৷ ইচ্ছা হচ্ছে আটপাড়া গ্রামে চলে যেতে৷ মায়ের কবরে বসে মাকে প্রশ্ন বিভিন্ন প্রশ্ন করতে৷
সকাল বেলায় কাঠ ফাটা রোদে বসে আছে নিধি৷ সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷ মায়ের চিন্তায় এতটা মগ্ন হয়ে আছে সূর্যের কিরণের তাপ নিধিকে জানান দিতে পারিনি৷ স্টিলের দোলনা গরমে অগ্নির রুপ ধারন করছে। শাওনের ডাকে নিধির ঘোর কাটে৷
“এভাবে রোদে বসে আছো কেন? নিজের দিকে খেয়াল আছে? ঘেমে একাকার হয়ে গেছো৷ একটু পর তো মাথা ঘুরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে৷ সেদিকে কোন খেয়াল আছে৷”
নিধি নিজের হাত স্পর্শ করে বুঝতে পারল সমস্ত দেহ গরম হয়ে গেছে৷ মাথাটাও একটু ব্যথা করছে। তড়িঘড়ি করে ছায়াযুক্ত স্থানে অবস্থান করে৷ মিহি কন্ঠে জবাব দিল,
“মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছিল৷ সেজন্য কোন দিয়ে খেয়াল ছিল না৷ আজ বারং বার উনার কথা মনে পড়ছে৷ আমি এতটা অভাগী যে কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পেলাম না৷”
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিল৷ তবুও ভেজা ভারী গলায় বলল৷ নিধিকে এক পলক পর্যবেক্ষণ করে শাওন বলল,
“তুমি তোমায় মায়ের কাছে যেতে চাও৷ আমি তো জানতাম তোমার মা মা’রা গেছেন৷ সৎ মায়ের জন্য মন খারাপ লাগছে?”
“সৎ মায়ের জন্য নয়৷ মাঝে মাঝে আমার বোন তিতিরের কথা মনে পড়ে৷ রক্ত টান ভুলা যায়না৷ চারটা বছর চলে গেল মায়ের কবর মুনাজাত করা হয়না৷ একটা নজর মায়ের মায়ের কবর দেখতে পেলে মনের তৃপ্তি মিটবে। আমাকে আজ আটপাড়া গ্রামে নিয়ে যাবেন৷? খুব ইচ্ছা করছে।”
শাওন নিধির কথা ফেলতে পারবে না৷ একটু ভেবে বলল,
“আমরা এখনই বের হবো৷ আমরা কিন্তু গ্রামে থাকতে পারব না৷ তোমার মায়ের কবর মুনাজাত করেই চলে আসবে৷”
ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে উজ্জ্বল হাসি৷ কৃতজ্ঞতায় চোখে কোণে অশ্রু জমে৷ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
“আমাকে দুই মিনিট সময় দেন৷ আমি দুই মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে নিব৷”
নিধি দ্রুত পায়ে কদম ফেলে ছাঁদ থেকে চলে গেল৷ শাওন চৌধুরী মুগ্ধর রুমে গেল৷ মুগ্ধ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে৷ মুগ্ধ শাওন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি এখনও রেডি হওনি। অফিসে যাবে না৷ অনেক কাজ পড়ে আছে৷ আমার পক্ষে একা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে৷”
শাওন মুগ্ধর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আজ একটু কষ্ট করে সবকিছু চালিয়ে নাও৷ আজ আমার একটা মিটিং আছে৷ না গেলেই নয়৷ কাল থেকে আমি কন্টিনিউ করে যাব৷”
মুগ্ধ কথা বাড়াল নয়৷ শাওন বিনা কারণে কাজে ফাঁকি দেয়না৷ মুগ্ধ কাজে ফাঁকি দেওয়ায় ওস্তাদ। মুচকি হেঁসে মুগ্ধ অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল৷
________________
গাড়ি চলছে নিজস্ব আপন গতিতে৷ এতটা পথ শাওনের পক্ষে এক ড্রাইভ করা সম্ভব নয়৷ সেজন্য ড্রাইভারকে সাথে নেওয়া হয়েছে৷ নিধি গাড়ির লুকিং গ্লাস নামিয়ে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত৷ শাওন ল্যাবটপে অফিসের কাজ করছে৷ মাঝপথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে৷ তারা গাড়ির ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছে আটপাড়া গ্রামে৷ এখন নিধিদের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা ম্যাপ দেখাচ্ছে না৷ নিধি ড্রাইভারকে রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছে৷ আটপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে পড়ন্ত দুপুর৷ নিধি প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে৷ বাড়িতে যেন শাওন চৌধুরী আর ড্রাইভার একটু বিশ্রাম নিতে পারে এবং ফ্রেশ হতে পারে৷ বাড়ির পরিবেশ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ সৎমা নিধিকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না৷ নিধির সাথে শাওনকে দেখে যেন উনার মাথায় রক্ত উঠে গেল৷ কিছু বলতে যাবে তখনই ড্রাইভার অনেক বাজার নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে৷ নিধির হাতে ছিল সবার জন্য পোশাক৷ পোশাকগুলো সৎমায়ের হাতে দিয়ে বলল,
“এখানে সবার জন্য কাপড় রাখা হয়েছে। আমরা এখানে থাকতে আসিনি৷ এখনই চলে যাব৷ এক ঘন্টার মতো থাকব৷ তাই কোন খারাপ ব্যবহার করবেন না৷”
নিধির কথা হজম করতে পারলেন না৷ কড়া গলায় বললেন,
“পর পুরুষ নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই হুকুম চালাচ্ছে। এটা তোর বাড়ি নয়৷ এটা আমার বাড়ি৷ তোর কথায় চলে না৷ আমার বাড়িতে পর পুরুষের আনাগোনা চলে না৷ এটা ভদ্র লোকের বাড়ি৷
আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিধির বাবা চলে আসে৷ বাবাকে দেখে নিধির চোখের কোণায় জল চলে আসে৷ পরক্ষণেই সেদিনের কথা মনে পড়তেই নেত্রদ্বয় অগ্নির ন্যায় রুপ নেয়৷ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বাবা উনি শাওন চৌধুরী। উনাকে বসার ব্যবস্থা করেন৷ আমি মায়ের কবর মুনাজাত করেই চলে যাব৷ আপনাদের ঘরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই৷ শাওন চৌধুরীর একটু ফ্রেশ এবং বিশ্রামের দরকার বলে আসা৷ না হলে নিধি কখন তোমার বাড়িতে পা রাখত না।”
নিধির বাবার দেহে বয়সের ছাপ দেখা দিয়েছে৷ ভেজা ভাঙা গলায় বলল,
“মা ঘরে আসো। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য তোমার পথ চেয়ে বসে থাকি৷”
স্ত্রীকে কড়া গলায় বললেন,
“উনাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো৷ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলছে?”
নিধি কিছু বলল না৷ শাওনকে নিয়ে ঘরে ঢুকে৷ নিধির বাবা শাওনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে৷ কিন্তু নিধি সেই সুযোগ দিচ্ছে না৷ শাওন ফ্রেশ হয়ে আসলে নিধি বলল
“চলেন মায়ের কবর মুনাজাত করেই সেখান থেকেই চলে যাব৷ এখানে আমার ধম বন্ধ হয়ে আসছে৷ যেখানে আমার মায়ের জায়গা হয়নি সেখানে আমি এক মিনিটও থাকতে চাইনা৷”
শাওন কোন জবাব দিল না৷ নিধির কিছু টাকা জনিয়েছিল৷ সেই টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“ভালো ডাক্তার দেখাবেন৷”
বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে৷ নিধির বাবা খাওয়ার জন্য জোর করলেও নিধি খেতে প্রস্তুত নয়৷ দরকার পড়লে বাহিরে খেয়ে নিবে৷ নিধি শাওনকে নিয়েই চলে আসে এলাকার কবরস্থানে৷ এখানেই সমাহিত করা হয়েছে নিধি মা এবং নানীকে৷ মায়ের কবর চিনতে ভুল হয়নি৷ নিধি তার মায়ের কবের পাশে লাগিয়েছিল আমগাছ৷ অনেকে কাটার চেষ্টা করলে করলে নিধি সবাইকে বলে কাটতে মানা করে৷ মুকুলে পরিপূর্ণ আম গাছ। কবরের চারপাশ আগাছায় ভরপুর৷ করবের সামনে এসেই নিধি কেঁদে উঠল৷ মায়ের কবরের উপর শুয়ে পড়ে৷ দুই হাত দিয়ে আগলে রাখে মায়ের কবর৷ কান্না করতে করতে বলল,
“মা তুমি কেন আমায় একা করে চলে গেলে? আমাকে কেন তোমার সাথে নিলে না? মা তোমার মেয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে৷ মা তুমি ফিরে আসো না! তোমায় ছাড়া আমার ভালো লাগে না৷ তুমি ফিরে আসো নয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও৷”
শাওন দৌড়ে এসে নিধিকে টেনে তুলে৷ নিধি কান্না করে বলতে থাকে,
“আমি মাকে ছাড়া কোথাও যাব না৷ মা তোমার নিধিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ মা. ও.. মা। তুমি এখনও ঘুমিয়ে থাকবে? আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না৷”
নিধির কান্নায় চারপাশে লোক জমা হয়ে যায়৷
চলবে……