মেঘের পালক চাঁদের নোলক পর্ব-১২+১৩

0
219

#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১২
#অধির_রায়

নিজেকে প্রমাণ করার বড় মাধ্যম হলো পরীক্ষা। পরীক্ষায় বলে দিতে পারে কে কতটা সেরা৷ জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হলে পরীক্ষার কোন বিকল্প নেই৷ আজ নিধির মেডিকেল এডমিশন পরীক্ষা৷ এডমিশন পরীক্ষার সিট পড়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চার নাম্বার ভবনে৷ রাস্তায় অনেক জ্যাম৷ অতি কষ্টে পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছাতে পেরেছে। ভয়ে নিধির মুখটা চুপসে গেছে। জীবন যুদ্ধে হেরে যাবে না তো৷ আলোর প্রতীব কি এখনেই নেতিয়ে যাবে৷ শাওন নিধিকে অভয় বানী দিয়ে বলল,

“মেডিক্যাল চান্স পাওয়া না পাওয়া বড় বিষয় নয়৷ বড় বিষয় হলো তুমি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছো৷”

নিধি ভয়ে মুখ চুপসে আছে৷ আজ এক ঘন্টা সময় চার হাজার ছাত্র ছাত্রীর জীবনের উজ্জ্বল পথ দেখাবে৷ অনেকে ঝড়ে পড়বে৷ নিধি মুখে শুকনো হাসির রেখে টেনে বলল,

“আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব৷ আল্লাহ পাক চাইলে নিশ্চিয় আমার চান্স হবে৷ আগে নিজে থেকে আমায় চেষ্টা করতে হবে৷ আমি চেষ্টা করলেই তো আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবে৷

নিধি পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে৷ শাওনের মুখে চিন্তার ছাপ দৃঢ়মান৷ শাওনের চিন্তা এখন নিধিকে নিয়ে৷ নিধির চান্স ঢাকার বাহিরে হলে তাকে না দেখে থাকবে কীভাবে? নিজের মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছে না৷ নিজেকে পা/গল পা/গল লাগছে৷ তবুও নিধির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছে৷ যেন পিচ্চি নিধির স্বপ্ন পূরণ হয়৷ ভালো মেডিক্যাল কলেজে চান্স হয়৷

এক ঘন্টার পর নিধি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসে৷ মুখে ডিপ্রেশনে ছাপ দেখাচ্ছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইল না শাওন৷ হাসিমুখে বলল,

“ভয়ের কিছু নেই৷ তোমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া৷ আল্লাহর উপর ভরসা রাখ৷ তোমার স্বপ্ন পূরণে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না৷”

নিধি টলমল দৃষ্টিতে শাওনের দিকে তাকায়৷ ভেবে পাচ্ছে না একটা মানুষ কতকিছু করছে৷ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না৷ কিছু হাসার চেষ্টা করে বলল,

“চলেন, ভালো লাগছে না কিছু ৷ ভীষণ খারাপ লাগছে৷ মনের মধ্যে ভয় এসে বাঁধা বেঁধেছে৷”

“ভয়ের কিছু নেই৷ নিজের উপর বিশ্বাস রাখ৷ আল্লাহ যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন৷”

নিধি আর কোন কথা বলল না৷ গাড়ির দুয়ার খুলে গাড়িতে উঠে পড়ল৷ শাওন কিছু বলল না৷ শাওন গাড়িতে উঠতেই নিধি বলল,

“আপনার ফোনটা দেন। আমি প্রশ্নগুলো উত্তর মেলাব৷”

শাওন হাত বাড়িতে ফোন দিল৷ নিধিকে এখনও ফোন কিনে দেওয়া হয়নি৷ নিধিও কখনও মুখ ফুটিয়ে ফোন চাইনি৷ কথা বলার জন্য বাটন ফোন কিনে দেওয়া হয়েছে৷ নিধি গুগল ঘাটাঘাটি করে নিজের প্রশ্ন মেলাতে ব্যস্ত৷ রাস্তায় এত পরিমাণে জ্যাম বলা বাহুল্য। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় সবাই যেন রাস্তায় নেমে পড়ছে৷ অনেকে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উঠছে৷ অনেকের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ অনেকে ডিপ্রেশনে৷ চোখের সামনে যেন ভেঙে যাচ্ছে সবার স্বপ্ন। অভিভাবকের ক্লান্ত দেহ জানান দিচ্ছে অনেক কিছু।
_________________

পড়ন্ত দুপুরে আড্ডায় মেতে উঠেছে শায়লা ভিলা। শায়লা চৌধুরী, নিধি, মাধবী এক সাথে বসে আছে৷ মাধবী নিধির দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,

“নিধি তোমার উপর আমি রেগে আছি৷ তুমি গ্রামে ঘুরতে গেলে আমাকে নিয়ে যাওনি কেন?”

নিধি ক্ষীণ দৃষ্টিতে শায়লা চৌধুরীর দিকে তাকায়৷ কি বলবে বুঝতে পারছে না? শায়লা চৌধুরীর নিধির আগেই জবাব দিলেন,

“মাধবী মা আমার নিধি ঘুরতে গেলে আমিও সাথে যেতাম৷ নিধি গ্রামে গিয়েছিল তার মায়ের কবর মোনাজাত করতে৷ এক পলক মা নামক করবটা দেখতে গিয়েছিল৷ ভালোবাসার পরিপূর্ণ থাকে সেই জায়গা৷ আমরা বরং অন্যদিন ঘুরতে যাব৷”

মাধবীর মাধার উপর দিকে গেল কথাগুলো৷ না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ শায়লা চৌধুরী প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“আমরা একদিন সবাই মিলে সোনারগাঁও ঘুরতে যাব৷ অনকদিন হলো কোথায় ঘুরতে যাওয়া হয়না৷”

মাধবী খুশিতে মেতে উঠে৷ উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলল,

“আমরা কবে ঘুরতে যাচ্ছি? কখন ঘুরতে যাব? আমার দেরি সইছে না৷”

নিধি নিরব দর্শকের মতো শ্বাশুড়ি বউমার কান্ড দেখে যাচ্ছে৷ মাধবী বাচ্চাদের মতো এখনও বাচ্চামি করে৷ শায়লা চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমরা কি এখনই যাচ্ছি? তোমায় দেখে মনে হচ্ছে এখনই যাচ্ছি৷ আমরা সবাই মিলে যাব৷ আমরা ছোট খাটো ফ্যামিলি ট্যুরে যাব৷ শাওন, মুগ্ধকে তো সময় দিতে হবে৷
__________________

সকাল থেকে বিষন্নতায় সময় পার কাছে নিধি৷ আজ তার মেডিক্যাল এডমিশন পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে৷ সকাল থেকে মুখে কিছু তুলছে না৷ শায়লা চৌধুরী জোর করে নিধিকে অল্প পরিমাণ খারাপ খাইয়ে দিলেন৷ খাবার গলা দিয়ে খাবার না নামলেও জোর করে খেয়েছে৷ চোখ দু’টো লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ চিন্তায় যেন সারা রাত ঘুম হয়নি৷ সকাল দশটা থেকে অপেক্ষা করছে৷ কিন্তু রেজাল্ট বের হওয়ার নাম গন্ধ নেই৷ টিভিতে নিউজ দেখতে ব্যস্ত৷ কখন রেজাল্ট প্রকাশ করবে৷ মন বসছে না কিছুতেই৷ নিধির মুখের দিকে সকলেই তাকিয়ে আছে৷ শায়লা চৌধুরী নিধিকে কাছে ডাকে৷ নিধি শায়লা চৌধুরীর কাছে এসে বসে৷ শায়লা চৌধুরী নিধিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

” সামান্য একটা রেজাল্ট নিয়ে এভাবে চিন্তা করতে হবে না৷ আল্লাহ যা করবেন ভালোই জন্যই করবে৷ আল্লার উপর ভরসা রাখ।”

নিধির কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না৷ কণ্ঠনালীতেই কথা আটকা পড়ছে৷ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ ঠোঁট জোড়া কাঁপছে কথা বলার জন্য। কিন্তু ধ্বনি বের হচ্ছে না৷ মন থেকে চিন্তামুক্ত হতে পারছে না৷ স্বপ্ন কি চিরকাল স্বপ্নই থেকে যাবে? অধীর আগ্রহে বসে আছে রেজাল্টের জন্য৷ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রকাশ করল রেজাল্ট৷ নিধির হাত কাঁপছে। কিছুতেই মােবাইলে রোল নম্বার এন্টি করতে পারছে না৷ মাধবী নিধির হাত থেকে ফোন নিয়ে রেজাল্ট দেখে৷ মাধবীর মুখ শুকিয়ে যায়৷ নিধিকে ফোন না দিয়ে শাওয়ার চৌধুরীর দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল৷ শায়লা চৌধুরী রেজাল্ট দেখে কিছু বলল না৷ নিধি দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ গম্ভীর হয়ে বসে আছে৷ নিধি ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারছে না৷ নিধি শায়লা চৌধুরীর হাত থেকে ফোন নিল৷ নিধি ফোনের মেসেজে দৃষ্টি পড়তেই হাত থেকে ফোন পড়ে গেল৷ নিধি ধাপাস করে মাটিতে বসে পড়ল৷ মেডিক্যাল চান্স হয়নি নিধির৷ ওয়েটিং এ আছে৷ নেত্রদ্বয় ভিজে উঠে। কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ মস্তিষ্কের নিউরন নিধির হার মানা রেজাল্ট নিতে পারল না৷ সারাদিন না খাওয়া এবং চিন্তায় নিধি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷

নিধির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাওন৷ নিস্প্রভ দৃষ্টি নিধির চুপসে যাওয়া মুখ মণ্ডল কষ্ট দিচ্ছে শাওন চৌধুরীর নিউরনের প্রতিটি স্নায়ুকে। বুকের ভিতর তীব্র ব্যথা অনুভব করছে৷ ভালোবাসার দাবী নিয়ে কখনও দাঁড়ায়নি শাওন৷ আজ ইচ্ছা করছে জড়িয়ে ধরে পিচ্চিকে স্বান্তনা দিতে৷ ভালোবাসা দিয়ে কষ্ট ভুলিয়ে দিতে৷ নিধি আঁখি মেলে শাওন চৌধুরীকে দেখতে পেল৷ রুমে সবাই ছিল৷ শাওন সবাইকে চলে যেতে বলে৷ কারণ সে নিধিকে ঠিক বুঝিয়ে আগের নিধির বানিতে পারবে৷ নিধি কোন কিছু না ভেবেই শাওনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ স্বপ্ন ভেঙে গেল। নিধির কাছে আজ যেন শাওনের বুকটা খুব আপন মনে হচ্ছে৷ মেয়ে মানুষ তখনই ভরসা পাই যখন বিশ্বাসী কাউকে পায়৷ আজ শাওনকে খুব ভরসা এবং বিশ্বাসী মনে হচ্ছে৷ শাওন আলতো করে নিধিকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ নিধির চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“পিচ্চি নিধি আর কান্না করে না৷ অনেক কান্না করেছো৷ এখন কান্না করলে মাথা ব্যথা করবে। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করব৷ তুমি মেডিক্যালে পড়বে৷ আর ভালো ডাক্তার হয়ে বের হবে৷ জনগণের সেবা করবে। সরকারি মেডিক্যালে না পড়ে কী ডাক্তার হওয়া যায়না? আমি তোমাকে পাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করব৷”

নিধি ভেজা গলায় জবাব দিল,

“সেখানে শুধু টাকার খেলা চলে৷ আপনি আমার জন্য কেন এত টাকা খরচ করবেন? একজন অচেনা অজানা মেয়েকে বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন। এটাই নিধির কাছে অনেক পাওয়া৷”

“কিছু পাবার আশায় আমি কিছুই করি না৷ আমি তোমার জন্য যা করি তোমার ভালোর জন্য করি৷ আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার জন্য সবকিছু করতে পারি৷”

“আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না৷ তাবুও কেন আমার জন্য এত কিছু করেন?”

শাওন বুকে পাথর চাপা দিয়ে তীব্র কষ্ট কমিয়ে বলল,

“ভালোবাসলেই কাছে পেতে হবে এমনটা নয়৷ আমি না হয় আমার সেই পিচ্চি নিধিকে সারা জীবন ভালোবেসে যাব৷ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমার জন্য তোমার কোন ক্ষতি হবে না৷ তোমার জীবনে আমি কখনও জোর করে আসব না৷ ভালোবাসার দাবী নিয়েও কখনও আসব না৷ আমার ভালোবাসা এক প্রেক্ষিক৷ সে ভালোবাসা নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিব৷”

নিধি নিজের ভাষা হারিয়ে ফেললে। একটা ভুলের জন্য মানুষটা সারাজীবন কষ্ট পেয়ে যাবে৷ সেই চারটা বছর থেকে কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে৷ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে৷ আজও মেনে নিতে কষ্ট হলেও নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে৷ ক্ষমা মহৎ গুণ৷ আল্লাহ মানুষ নিষ্পাপ মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেন৷ নিজের কর্মে মানুষ পা”পী হয়৷ মন থেকে পাপ কাজ থেকে দূরে সরে আসলে তাকে ক্ষমা করা যায়৷ নিধি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“আপনি বিয়ে করছেন না কেন? সারা বছর সন্ন্যাসী হয়ে থাকবেন৷”

শাওন মুচকি হেঁসে বলল,

“যার জন্য ভালোর পথ বেছে নিলাম সেই মানুষটাই হলো না৷ অন্য কেউ কেন হতে যাবে? আমি তো ধোয়া তুলসীপাতা নয়৷ যে আমাকে ভালোবাসতে আসবে৷”

“আপনার কথাগুলো কেমন জানি গভীর গভীর লাগছে৷ আমার একটা কথা রাখবেন?”

“তোমার কোন কথা অমান্য করেছি৷ আজ অব্দি তোমার সব কথা শুনে এসেছি৷ নিশ্চিত থাকো তোমার এই কথা রাখার চেষ্টা করব৷”

“মা অনেকবার আপনাকে বিয়ের কথা বলেছে৷ এবার জিৎ না করে বিয়েটা করে নেন৷ বিয়ে করা ফরজ কাজ৷ বংশ বৃদ্ধির হাতিয়ার। সবথেকে বড় কথা হলো শেষ সময়ে ছেলে মেয়েদের সাথে আড্ডা দেওয়া। নাতি নাতনীর সাথে খেলা করা৷ পৃথিবীটা অনেক জটিল৷ কোন কিছু না থাকলেও জীবনে একটা জীবন সঙ্গী প্রয়োজন। যে আপনাকে মন থেকে ভালোবাসবে৷”

“আমি ভালোবাসার যোগ্য নয়৷ ভালোবাসার যোগ্য হলে এতদিন ভালোবাসা পেয়ে যেতাম৷ তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি৷ তোমার জন্য সব করতে পারি৷ কই তুমি তো কোনদিন সাড়া দিলে না৷ পারলাম না তোমার মনে এক চিলতে জায়গায় করে নিতে৷ ব্যর্থ হয়ে আজও তোমার সাথেই আছি৷ আমার কাছে ভালোবাসা শুধু পাওয়া নয়৷ আমি চাই আমার ভালোবাসার মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে৷”

নিধি কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বারান্দায় চলে গেল৷ শাওন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিধির পিছন পিছন বারান্দায় যায়৷ নিধি বারান্দার রেলিং ধরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ বার বার আড়াল করছে চাঁদকে। চাঁদ মেঘের আড়াল কাটিয়ে আবারও হাসিমুখে উঁকি দিচ্ছে। শাওন নিধির পিছনে এসে দাঁড়ায়৷ তাদের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব। কেঁপে উঠল নিধির সমস্ত দেহ৷ শাওন নেশা ভরা কন্ঠে বলল,

“সবকিছু থেকে পালানো বা আড়াল করা যায়না৷ মেঘ চাঁদকে আড়াল করতে চাচ্ছে বারং বার৷ তবুও চাঁদ মেঘের আড়াল বেঁধ করে বেরিয়ে আসছে৷ তুমি কবে আড়াল থেকে বের হবে?”

নিধি দেহ যেন হালকা শিহরণ বয়ে গেলে৷ শাওনের দিকে ঘুরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

“আপনি কি বলছেন এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷”

শাওন মুচকি হেঁসে জবাব দিল,

“নিধি এখন তুমি বাচ্চা নেই৷ নিজেকে আড়াল করলেও তোমার কথা বলার ধরণ, বচন ভঙ্গি আড়াল করতে পারবে না৷ সবকিছু তোমাকে জানান দিবে৷”

শাওন কথাগুলো একদম নিধির মুখের উপর বলে৷ শাওনের নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা গরম হাওয়া নিধির মুখে পতিত হয়৷ নিধি খিঁচে নেতাদ্বয় বন্ধ করে ফেলে৷ শাওন মুচকি হেঁসে নিধির চোখর পাতায় ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে৷ নিধির সমস্ত দেহ অবশ হয়ে যায়৷ বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে? আঁখি মেলে তাকানোর সাহস নেই৷ নিধির পাতলা ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। ঠোঁট জোড়া শাওনকে খুব কাছে টানছে৷ নিধি যখন আঁখি মেলে তাকায় তখন…..

চলবে….

#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১৩
#অধির_রায়

নিধিকে ইব্রাহীম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়৷ যা ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত। টপ দশটা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মাঝে অন্যতম। যার শিক্ষার মান বর্তমানে বাংলাদেশকে আলোকিত করছে৷ তৈরি হচ্ছে প্রতিবছর হাজার হাজার ডাক্তার। ঝড়ে পড়া বেশির শিক্ষর্থীর জায়গা করে নিয়েছে ইব্রাহীম মেডিক্যাল কলেজ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মধ্য বা নিম্নবর্গের মানুষের স্বপ্ন থাকলেও হয়ে উঠে না৷

নিধি শাওনের সাথে প্রথম দিয়া বাড়ি আসছে৷ মন ভরে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত৷ ঢাকার মধ্যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কথা বলা বিলাসিতা। যা ছিল কালে কালে তা হারিয়ে গেছে৷ গড়ে উঠেছে মানুষের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে৷ যা মানুষের চোখের সৌন্দর্য দিলেও মনের তৃপ্তি দিতে ব্যর্থ৷ মনের তৃপ্তি একমাত্র দিতে প্রকৃতির মাধুর্য। যা ছুঁয়ে দেয় প্রতিটি স্নায়ু বিন্দুর প্রতিটি শিরা৷

নিধি দু’হাতে মিলে শীতল হাওয়া নিচ্ছে৷ পিছন থেকে শাওন নিধির কানে ফিসফিস করে নেশা ভরা কন্ঠে বলল,

“তোমার এলোমেলো খোলা কেশ আমার মনটা এলোমেলো করে দেয়৷ পিচ্চি তোমায় দেখলে মনে হয় তুমি রুপকথার রাজকন্যা।”

শাওনের হঠাৎ এমন কথায় নিধি ভয় পেয়ে যায়৷ একটু দূরে সরে যেতে নিলেই শাওন নিধিকে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। নিধির সমস্ত দেহ শীতল হাওয়ার সাথে কম্পন দিয়ে উঠে৷ খিঁচে আঁখি বন্ধ করে ফেলে৷ নিধির চুলে মুখ লুকিয়ে বলল,

“তুমি আমার কি মায়ার বাঁধনে বেঁধেছো৷ তোমায় ছাড়া শাওন চৌধুরী কিছুই বুঝে না৷ আমি এমন ছিলাম না৷ আমার হিংস্র মনকে শান্ত করে কেন করে তুলেছো দুষ্টু৷”

নিধি আমতা আমতা করে বলল,

“কি করছেন এসব? আমি কিন্তু আপনাকে ভালোবাসিনা৷ প্লিজ আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন৷ আমার ভালো লাগছে না৷”

“আমি নিজেকে অনেক চেষ্টা করে চারটা বছর দূরে রেখেছি৷ আমি পারছিনা তোমায় ছাড়া থাকতে৷ হয় তুমি আমাকে নিজ হাতে হ/ত্যা করো৷ আমি তোমার বিরহে প্রতিটি ক্ষণে মারা যাচ্ছি৷”

নিধির চোখ জল টলমল করছে৷ সে কি শাওন চৌধুরীকে ভালোবাসে৷ তার বলা হ/ত্যা শব্দটা কেন বারবার মাথায় ধ্বনিত্ব হচ্ছে৷ নিধি শাওনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল৷ শাওনের দিকে টলমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরে সরে দাঁড়াল। অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ আঁখি বুঝে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে৷ শাওন নিজ হাতে চোখের মুছে দিয়ে বলল,

“তোমার চোখের জল অনেক মূল্যবান৷ এই চোখ থেকে থেকে এক ফোঁটাও জল না ঝড়ে৷”

নিধি উপলব্ধি করতে পারছে শাওন নামের মানুষটা তার জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে।মানুষটার অতীত খারাপ হলেও মনটা খুব ভালো৷ শাওন নিধির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

“তোমার একটা পা আমার পায়ের উপর রাখ।”

নিধি চোখ বড় করে শাওনের দিকে তাকায়৷ পা শাওনের হাঁটুর উপর রাখতে বলছে৷ নিধি ভুলেও এমন কাজ করবে না৷ নিধি সেখান থেকে সরে আসতে নিলেই ক্ষোভ নিয়ে রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“কথা কানে যাচ্ছে না৷ যা বলি তা করলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে৷ তোমার কাছে আমার কথার কোন গুরুত্ব নেই৷”

নিধি আমতা আমতা করে বলল,

“আপনার দিকে কিভাবে পা বাড়িয়ে দিব? আমার তো পাপ হবে৷ আমি পাবর না.. ”

নিধি কিছু বলতে পারল না৷ তার আগেই শাওন নিধির পা নিজের ঊরুতে (মানবদেহের কুঁচকি থেকে হাঁটু অব্দি) রাখল৷ নিধির চোখ ছানাপড়ার মতো৷ শাওন নিধির পায়ে সযত্নে নুপুর পড়িয়ে দিল৷ শাওনের স্পর্শে কেমন জানি ঘোর লাগা কাজ করছে৷ আঁখি বুঝে রেয়েছে৷ শাওন নিধির কপালে আলতো করতে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল,

“ভালোবাসি প্রিয়৷ এভাবে সারাজীবন তোমায় ভালোবেসে যাব। আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে৷”

শাওন গাড়িতে উঠে পড়ে৷ নিধি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে৷ গাড়ির হর্নের শব্দে ঘোর কাটে৷
___________________

নিধির সামনে বসে আছে পরিবারের সকল সদস্য। যেন নিধি বিশাল বড় অপরাধ করেছে৷ তাকে এখনই শাস্তি দিবে৷ আবার এমনও হতে পারে তারা অপরাধী। নিধির কাছে শাস্তি দাবী করছে৷ শাওন নিধিকে হারাতে চাইনা৷ নিধির মনে শাওনের জন্য চার বছর ভালোবাসা বিরল ছিল৷ এখন একটু একটু প্রকাশ পাচ্ছে৷ যদি সামান্য ভালোবাসা টুকুও বিরল হয়ে যায় তাই বিয়ে করতে চাচ্ছে শাওন৷ শায়লা চৌধুরী নিধির হাত ধরে অপরাধী কন্ঠে বলল,

“মা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিও না৷ তোমাকে প্রথম দিন থেকেই ভালোবাসে৷ তার হয়ে আমি কথা দিচ্ছি এ বিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ জীবনে কোন সমস্যা সৃষ্টি করবে না৷”

নিধি বুঝতে পারছে না৷ কি উত্তর দিবে? নিজের মা বেঁচে থাকলেও এতটা করতো না৷ যা নিধি এ পরিবার থেকে পেয়েছে৷ যাদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাওয়া৷ তাদের কষ্টের সাগরে দেখতে পারবে না৷”

মুগ্ধ নিধির মাথায় আলতো করে হাত ভুলিয়ে বলল,

“তোমাকে আমি বোনের নজরে দেখি৷ আমি জানি শাওন অনেক খারাপ ছেলে ছিল৷ নিজেকে বাজে কাজে লিপ্ত রাখতো৷ শাওন সবই তোমার কাছে স্বীকার করছে৷ ধরে নাও তুমি শাওনের জায়গায় অন্য কাউকে বিয়ে করলে৷ তুমি কি জানবে তার অতীত কেমন? সে কি জীবনে কোন পাপ কাজ করেনি৷ সে কি এক নারী আ’স’ক্ত? তবে আমি কথা দিতে পারি, শাওন শুধু তোমার প্রতি আ’স’ক্ত।”

নিধি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে মুগ্ধর দিকে তাকায়। চোখের ভাষা অনেক কিছু বলে দিচ্ছে৷ মস্তিষ্কের নিউরন বলছে মুগ্ধ ভাইয়া ঠিক বলছেন৷ শাওনের জায়গায় অন্য কেউ হলে সে কি সৎ হবে? সে কি কোনদিন নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়নি৷ বর্তমানে সবকিছু কুয়াশার মতো হয়ে যাচ্ছে৷ দূরে কোথাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷ নিধি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে সাইন করে দিল৷ ইসলামের দৃষ্টিতে তিন বার কবুল বলে শাওনকে নিজের জীবনে গ্রহণ করল৷ শায়লা চৌধুরী নিধিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন৷ এ যেন সুখের কান্না৷ তিনি এত বছর যেন এটাই চেয়ে আসছেন।

মুগ্ধ মাধবীকে নিধির পাশে বসিয়ে সবার উদ্দেশ্য বলল,

“আজ এই খুশীর দিনে আরও একটা খুশীর খরব দিতে চাচ্ছি৷ সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত তো৷”

শাওন নিধির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,

“কি এমন খুশীর খরব? যা শুনে আমরা সবাই হার্ট অ্যাটাক করব৷”

শায়লা চৌধুরী নিধিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“হার্ট অ্যাটাক করলে ডাক্তার সাথেই আছে৷ ড. নিধি আমাদের সকলের চিকিৎসা করবে৷ এখন সু সংবাদ দাও৷”

মুগ্ধ মাধীর দিকে চোখের পাতা তুলে তাকাল৷ মাধবী লজ্জায় মুগ্ধর দিকে তাকাতে পাচ্ছে না৷ তবুও মুগ্ধর মুখটা দেখার জন্য চোখের পাতা উপরে তুলতেই মুগ্ধ চোখ টিপল দিল। সাথে সাথে মাধবী মাথা নিচু করে ফেলে৷ মুগ্ধ মাধবীর দিকে তাকিয়ে উল্লাসের সাথে বলল,

“আমি বাবা হতে চলছি৷ আমাদের বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে৷”

মাধবী দুই হাত দিয়ে মুখ ঠেকে ফেলে৷ ইচ্ছা হচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে পড়তে৷ শায়লা চৌধুরী নিজের হাতে যেন জান্নাত পেলেন৷ মুগ্ধ খুশিতে নৃত্য করছে৷ একে একে সবাই মাধবীকে ভালোবাসা জানাল৷ মুগ্ধ মাধবীকে সবার সামনে পাঁজা কোলা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে গেল৷
_______________

নিধির ঘুম আসছে না৷ বিছানার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ তার জীবনে আজ বিশাল পরিবর্তন এসেছে৷ বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও দু’জন আলাদা আলাদা ঘরে। শায়লা চৌধুরী কড়া গলায় বলে দিয়েছে সেদিন নিধি শাওনকে মন থেকে মেনে নিবে সেদিন তাদের ঘটা করে বিয়ে দিবে৷ আর মন থেকে মেনে নিলেও নিধি মেডিক্যাল পড়া শেষ হলে বিয়ে হবে৷ ততদিন শাওনকে অপেক্ষা করতে হবে৷ শায়লা চৌধুরীর কথা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। হুট করেই বারান্দা থেকে শাওন রুমে আসে৷ নিধি ভুত দেখার মতো শাওনকে দেখে৷ চোখ ঢলতে ঢলতে বিছানার উপর বসে পড়ল। কিছু বুঝার আগেই শাওন নিধিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল৷ রীতিমতো নিধির সমস্ত দেহে কম্পন শুরু হলো৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

“আ..প..নি এখানে কিভাবে আসলেন? আমি কিন্তু চিৎকার করে মাকে ডাকব।”

“শাওন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

” আমি তোমার রুমে আছি৷ মা আসলে বলব তুমি আমাকে নিজে থেকে টেনে এখানে নিয়ে আনছো৷”

নিধি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

“কি! আপনি এখনই রুম থেকে বের হোন৷ কিভাবে আসলেন?”

“আমি জানতাম মা আমাদের এক সাথে থাকতে দিবে না৷ সেজন্য আমি আর মুগ্ধ মিলে এ মহান কাজটা করছি৷ আমি বের হবো কেন? আমি আমার বিয়ে করা বউয়ের সাথে থাকতে আসছি৷ কথা না বলে ঘুমাতে দাও৷ বেশি কথা বললে সবকিছু হয়ে যাবে৷”

“নিধি আর কথা বাড়াল না। শাওন নিধিকে দুই বাহুর মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে৷ বাদ্য হয়ে নিধি শুয়ে আছে৷ মহারাজ জড়িয়ে ধরে সেই কখন ঘুমিয়ে পড়ছে৷ নেই তন্দ্রা নিধির চোখের পাতায়৷ কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে৷ শাওনকে ধাক্কা দিলে জেগে যাবে৷ যদি অন্য কিছু হয়ে যায় তাহলে নিধি শেষ৷ বাধ্য হয়ে ছোট বাচ্চার মতো শাওনের বুকে শুয়ে আছে৷ নিধি পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলল,

«অধির আজ দুই দুইটা খুশীর খবর দিল। কিন্তু কেউ অধিরকে গিফট দিল না৷ না জানি পাঠকদের জন্য আমাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে৷ পাঠকটা অধিরকে বেশি বেশি গিফট করো৷ গিফট হিসেবে পাশে থাকলেই হবে৷ অল্পেই তুষ্ট বাচ্চাটা৷»

চলবে……