মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-১১ + বোনাস পর্ব

0
589

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১১]

১৯,
আজ সকাল থেকে রান্নার কাজে খুব আছেন সৈয়দা মাহবুবা। স্কুলেও যাওয়া হয়নি তার। সকল থেকে এপর্যন্ত শুধু রান্না করছেন তিনি। মেহের ব্যাস্ত ঘর ঘুছাতে। মৌ- কে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। হ্যাঁ আলিহান ওর তার বন্ধুরা দেখতে আসছে মৌ-কে। সৈয়দা মাহবুবার জ্বর কিছুটা কমে এলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মৌ-য়ের বিয়ে আগে দেওয়ার। মেহেরকে পরে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাবেন তিনি। মৌ-কে ওর পছন্দের কথা জিগ্যেস করতেই মৌ আলিহানের কথা জানায় সৈয়দা মাহবুবাকে। সৈয়দা মাহবুবা তার দুই মেয়ের সাথে বন্ধুসূলভ তাই হয়তো মৌ তার পছন্দের কথা তাকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে নি। সৈয়দা মাহবুবা মৌ-য়ের পছন্দকে সামর্থ্য জানিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে চান। মৌ শাওয়ার নিয়ে নিজের রুমে জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে অজানা ঝড়। আচ্ছা সৈয়দা মাহবুবার পছন্দ হবে তো আলিহানকে। নাকি সে আলিহানকে রিজেক্ট করে দিবে। যদি সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে অপছন্দ করে তাহলে কি হবে! মৌ-কি পারবে আলিহানকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করতে। না এটা সম্ভব না কখনো। জানালায় খিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরের ওই রাস্তায়। এখান দিয়েই আসবে আলিহান।

– মৌ, তুই এখনো রেডি হোস নি। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রপক্ষ চলে আসবে। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল মেহের।

মেহেরের কথার কোন জবাব দিলো না মৌ। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকটায়। মৌ-য়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মেহের ধীর পায়ে মৌ-য়ের পাশে দাঁড়ায়। মৌ-কে এমন গম্ভীর হয়ে ভাবতে দেখে মেহের মৌ-য়ের কাধে হাত রেখে বলে,

– এত মনযোগ দিয়ে কি ভাবছিস মৌ?

কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে সামনে তাকায় মৌ। মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু সূরে বলে,

– মেহু তুই?

– তোর কি হয়েছে বলতো মৌ। সকাল থেকে দেখছি কেমন মন মরা হয়ে বসে আছিস। তোর কি কোন কারনে মন খারাপ।

মেহের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মৌ। বিছানায় এসে বসতে বসতে বলে,

– নারে, ভাল্লাগছেনা।

– সেটাই তো জানতে চাই। কেন ভালো লাগছে না তোর? তোর পছন্দের মানুষটাই তো তোকে দেখতে আসছে তাহলে ভালো লাগছে না কেন? মেহের মৌ-য়ের পাশে বসতে বসতে বলল। মেহের কথা শুনে মৌ ওর দিকে করুন চোখে তাকালো। অতঃপর বলল,

– আন্টি আলিহানকে পছন্দ করবে তো, মেহু। অভিযোগের সূরে কথাটা বলল মৌ। মৌ-য়ের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে দেয় মেহের।

– এইজন্য এমন গাল ফুলিয়ে বসে আছিস। মেহের মৌ-কে জড়িয়ে ধরে আর বলে,শান্ত হো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মৌ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– আমার খুব ভয় হচ্ছে মেহু। আসলে নিজের পছন্দের মানুষ দেখতে আসছে তো তাই এত টেনশন হচ্ছে। আন্টি যদি আলিহানকে পছন্দ না করে।

মেহের মৌকে ছেড়ে ওর গালে হাত রেখে বলে,

– ধুর পাগলী, কেন এত চিন্তা করছিস। সব ঠিকঠাকই হবে। তুই এখন রেডি হয়ে নে। আমি যাই মা-কে একটু হেল্প করি। মেহেরের কথার সম্মতি স্বরুপ মাথা নাড়ায় মৌ। অতঃপর মেহের চলে যায় আর মৌ রুমে বসে রেডি হতে থাকে

আলিহান ও তার তিন বন্ধু এসেছে মৌ-কে দেখতে। এদের মধ্যে রাহনাফ ও এসেছে। সবাইকে বসার রুমে রেখে মেহের ওর মাকে ডাকতে চলে যায়। সৈয়দা মাহবুবা রান্না সেরে গোসল করতে গিয়েছেন মাত্র। প্রায় দশ মিনিট পর সৈয়দা মাহবুবা বসার রুমে আসেন। সৈয়দা মাহবুবাকে দেখে আলিহান দাঁড়িয়ে যায়। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। সৈয়দা মাহবুবা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আলিহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– তুমি দাড়িয়ে গেলে কেন বাবা। বসো।

– ছোটমনি। অস্ফুটভাবে বলল আলিহান। তবে এটা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত ঠিকই পৌছালো। সৈয়দা মাহবুবা তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠলেন,

– কি- কি বললে তুমি।

সৈয়দা মাহবুবার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আলিহান। সে তার আসন ছেড়ে দ্রুত সৈয়দা মাহবুবার কাছ গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দু-হাতে শক্তকরে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,

– ছোটমনি, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। আমি তোমার গুড্ডু। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। কোথায় হাড়িয়ে গেছিলো তুমি। জানো কত খুজেছি তোমাকে আমি। আলিহান সৈয়দা মাহবুবাকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলিহানের পরিচয় শুনে সৈয়দা মাহবুবা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখদুটো তার অশ্রুতে ভরে গেছে। ছলছল করছে পানিতে। তিনি তার হাতদুটি আলিহানের গালে রেখে কান্নামিশ্রত সুরে বললেন,

– গুড্ডু। আমার গুড্ডু, কত বড় হয়েগেছিস তুই। ছোট মনির কথা মনে আছে তোর। সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে তার বুকে জড়িয়ে নিলেন।

পাশাপাশি বসে আছে আলিহান আর সৈয়দা মাহবুবা। ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। এখানে কি হচ্ছে কিছুই ডুকছে না তার ছোট্ট মাথায়। আর এই আলিহানই বা কে? তার মায়ের সাথে আলিহানের কি সম্পর্ক। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। আলিহান তার মা-কে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে কেন? নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে মেহের ওর মাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

– মা, আলিহান ভাইকে তুমি কি করে চিনো। কই আগে তো কখনো তার সম্পর্কে আমাদের বলো নি।

মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন কর্নোপাত হতেই আলিহান সৈয়দা মাহবুবার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়। আলিহানের প্রশ্নের জবাব স্বরুপ সৈয়দা মাহবুবা মৃদু হেসল মাথা নাড়ায়। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে ডাকে। মেহের গিয়ে সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসে তখন পাশ থেকে আলিহান মেহেরের চুল টেনে বলে,

– এটাতো পুরাই পিচ্চি। মেহের বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলিহানের প্রতি। তারপর সে সৈয়দা মাহবুবার দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে,

– গুড্ডু তোর ভাই মেহু। তোর চাচাতো ভাই সে।

সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের। অতঃপর সৈয়দা মাহবুবা আবার বলে,

– গুড্ডু হচ্ছে তোর বড় চাচার ছেলে। তোর বড় চাচা আর চাচি গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় তারপর থেকে আমি যতদিন ছিলাম ওকে দেখাশোনা করেছি।

সৈয়দ মাহবুবার কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় মেহের। দু-হাতে শক্ত করে উড়নাটা চেপে ধরে নিজেকে কঠিন পজিশনে নিয়ে যায়। অতঃপর বলে,

– আমার কোনদিন বাবাই ছিলো না তাহলে চাচা আসবে কোথা থেকে।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা কিছু না বললেও আলিহানের বন্ধুরা বেশ অবাক হয়। আলিহানও অবাক হয়েছে। তবে রাহনাফ একটু বেশীই অবাক হয়েছে, এইতো কিছুদিন আগে মেহের বলেছিল ওর বাবা মারা গেছে তাহলে আজ কেন বলছে ওর কোন দিন বাবা ছিলোই না। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেহেরের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। সে তার লেখিকা সাহেবাকে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না। তার মাথায় যে কখন কি চলে কে জানে। রাহনাফ নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে বলে উঠলো,

– এ আপনি কি বলছেন লেখিকা সাহেবা। আপনার বাবা ছিলো না মানে?

– হ্যাঁ আমার বাবা কখনো ছিলো না, না এখন আছে আর না ভবিষ্যৎ এ কোন দিন থাকবে। আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।

নিজেই একদমে কথা গুলো বলে চলে যায় মেহের। মৌ-য়ের সাথে তার কথা বলতে হবে। এই বিয়েটা যে করেই হোক ভাংতে হবে। কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না এই বিয়ে। না হলে যে পুরো অতীতটা ওদের সামনে চলে আসবে। মেহের ওর মাকে ভেঙে পরতে দেখতে পারবে না কখনো না। মেহের চলে যেতেই আলিহানের এক বন্ধু বলে উঠে,

– আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো পত্রীকে কউ নিয়ে এসো।

মেহের চলেই যাচ্ছিলো তখন সৈয়দা মাহবুবা পিছন থেকে ওকে ডাক দিয়ে বলেন,

– মৌ-কে নিয়ে এসো।

মেহের করুন চখে সৈয়দা মাহবুবার মুখের দিকে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা তার মেয়ের চাওনি উপেক্ষা করেন। বাধ্যে মেহের মৌ-কে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। দেখুক যত খুশি দেখে নিক। দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। এই বিয়ে মেহের হতে দিবে না। সে তার মা আর মৌ কে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে।

বাঙালীর একটা রীতি আছে, পাত্রী দেখার সময় পাত্রীকে সম্মান স্বরুপ কিছু টাকা উপহার দেওয়া হয়। সেই রীতিটাই পালন করতে মেহের আলিহানের কাছে টাকা দাবি করে। প্রতিউত্তরে রাহনাফ বলে উঠে,

– আসলে আসার সময় আমরা কেও টাকা নিয়ে আসে নি। বিশ্বাস না হলে আপনি আমাদের পকেট চেক করতে পারেন লেখিকা সাহেবা।তবে আমার বিকাশে কিছু টাকা আছে! আপনি যদি আপনার বিকাশ নাম্বার দিতেন তাহলে আমি এখুনি সেন্ড মানি করে দিতাম।

রাহনাফের কথা শুনে মেহের সহ উপস্থিত সকলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মেহের ড্যাবড্যাবিয়ে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে ভাবে,

– পাত্রী দেখতে এসে সেন্ড মানি করতে চায়, এটা কি মজা করছে নাকি সত্যিই ওনাদের কাছে টাকা নাই। বেপারটা ওর কাছে কেমন লাগছে। মেহের কোন কথা না বাড়িয়ে বলে,

– ঠিক আছে, টাকাটা আপনি পরে দিয়ে দিয়েন। সেন্ড মানি করার কোন প্রয়োজন নেই। তারপর সে মৌ-কে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। মেহেরের এমন কান্ডে রাহনাফের মনটা ছোট হয়ে যায়। কত আশা নিয়ে নাম্বারটা চেয়েছিলো সে। ভাবছিলো এই সুযোগে সে মেহেরের নাম্বারা জেনে যাবে। কিন্তু সেটাও হলো না। মেহের তার সব আশায় পানি ঢেলে চলে গেলো। মেহের মৌ কে রুমে নিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। মৌ শাড়ির ক্লিপ খুলতে খুলতে বলে,

– কি হয়েছে মেহু, একরম করছিস কেন?

– তুই এই বিয়ে করবি না মৌ।

মেহেরের কথা শুনে মৌ-য়ের হাত থেমে যায়। সে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। আর ভাবতে থাকে সবই তো ঠিক আছে তাহলে এই মেহুর আনার হলোটা কি??

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর।
#বোনাস_পার্ট।

– আমি এই বিয়ে করবো না মানে! কি বলতে চাইছিস তুই মেহু। অবাকের সুর কথাটা বলল মৌ।

– বিয়ে করবি না মানে করবি, ব্যাস। আলিহানের সাথে তোর বিয়ে হবে না। কাটকাট জবাব দেয় মেহের।

মেহেরের এমন জবাবে কিছুটা ক্ষিপ্ত হয় মৌ। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহেরের দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌ। অতঃপর বলে,

– তুই পাগল হয়ে গেছিস মেহু। তাছাড়া আন্টি যেখানে আলিহানকে মেনে নিয়েছে সেখানে তোর কিসের প্রবলেম। আর তুই ভুলে যাচ্ছিস মেহু আমি আলিহানকে
ভালোবাসি।

– আমি কিছুই ভুলিনি মৌ। চিৎকার করে বলে মেহের। মৌ তুই ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিস, আলিহান তোর জন্যে সঠিক নয়। কি গ্যারান্টি আছে আলিহান তোকে ঠকাবে না। বলতে পারবি তুই মৌ, যেটা আমার মায়ের সাথে হয়েছে সেটা তোর সাথে হবে না। মৌ তুই এই বিয়েটা করিস না।

এতক্ষণ ভালো শ্রোতার মতো মনোযোগ দিয়ে মেহেরের বলা কথা শুনছিল মৌ। মেহেরের বলা শেষ কথাটা মৌ -য়ের ভাবনা আরো বাড়িয়ে তুলে। সে মেহেরের কাছে এসে ওর দুই বাহু ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তারপর মেহেরের অন্যপাশে বসে মৌ। মেহেরের একটা হাত শক্তকরে চেপে ধরে মেহেরকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নেয় মৌ। অতঃপর বলে,

– মেহু, আমার চোখে চোখ রেখে বলতো কি হয়েছে তোর। দেখ আন্টি যখন আলিহানের সাথে দেখা করতে চাইছে তখন সবচেয়ে বেশী এক্সাইটেড কিন্তু তুই হয়েছিলি। আজ সকালেও তুই আমাকে শান্তনা দিয়েছিস দুঃচিন্তা না করতে। তাহলে এখন কেন বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলছিস বলতো। কি হয়েছে তোর?

মেহের মাথা নিচু করে বসে থাকে। কোন কথা বলে না সে।

– কি হলো মেহু তাকা আমার চোখের দিকে। বল কেন করছিস এমন।

মেহের মৌয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকায়। হাত কচলাতে কচলাতে জবাব দেয়,

– আলিহান সৈয়দ নওশাদ আহমেদের বড় ভাইয়ের ছেলে। এটাই প্রবলেম। মৌ, আমার মা ও বাড়িতে টিকতে পারেনি। যদি তোর সাথে এমনটা হয়। যতই হোক আলিহান ও বাড়ির -ই ছেলে। ওদের আদর্শ মানুষ হয়েছে। যে বাড়িতে নওশাদ আহমেদের মতো একটা মানুষ আছে সেই বাড়িতে তোকে কি করে পাঠাই বলতো মৌ। কথাগুলো বলেই মেহের মৌকে জড়িয়ে ধরে। মৌ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মেহের বাহিরে যতটা স্টোং দেখাক না কেন আসলে যে তার স্বভাবটা এক্কেবারে বাচ্চাদের মতো। নিজের প্রিয়জনদের ভালো রাখার এক প্রখর নেশা কাজ করে ওর মধ্যে। সব সময় আপন জনের হাসি মুখ দেখতে চায় সে।

– আর যদি আমি মৌ-কে নিয়ে আলাদা থাকি তাহলেও কি তোর আপত্তি আছে মেহু।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল আলিহান। আলিহানের কণ্ঠস্বর শুনে মেহের মৌকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। ততক্ষণে আলিহান ভিতরে প্রবেশ করে নেয়। মৌ আলিহানের দিকে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যার ফলে আলিহান চোখের ইশারায় মৌ-কে শান্ত হতে বলে মেহেরের পাশে গিয়ে বসে। মেহের কিছুটা দূরে সরে যায়, আলিহান আবার গিয়ে মেহেরকে ঘেসে বসে। এবার মেহের উঠে চলে যেতে চাইলে আলিহান মেহেরের এক হাত ধরে বলে,

– আমি কি অপরাধ করেছি মেহু।

– মেহু নয় মেহের।

– আমার কাছে তুই মেহু। আমার ছোট্ট মেহু। বস এখানে। মেহেরকে টেনে আলিহান তার পাশে বসিয়ে নেয়। তখন সৈয়দা মাহবুবা রুমে প্রবেশ করে রুমে। আলিহান মেহেরের হাত ছেড়ে মৌ-য়ের দিকে এক পলক তাকায়। তারপর সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

– ছোটমনি, মেহু মৌ তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না আমি কেন আমার গার্ডিয়ান না এনে বৃন্ধুদের নিয়ে আসলাম।
যেখানে ছেলেপক্ষ পাত্রী দেখতে আসে গার্ডিয়ান নিয়ে সেখানে আমি কেন বন্ধু নিয়ে আসলাম। তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে না। আচ্ছা আমিই বলছি, আমার পরিবার নেই ছোটমনি। ছোট বেলাতে মা বাবাকে হাড়িয়েছি তারপর আমি আমার ছোটমনিকে পেয়েছিলাম কিন্তু বছর যেতে না যেতেই আমার ছোট মনিও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। একদম একা হয়ে যাই আমি। কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় আলিহান। পকেটে দু-হাত গুজে দিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলে তারপর সৈয়দা মাহবুবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,

– তুমি চলে আসার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে ছোটমনি। যেদিন যদি একবার পিছনে ফিরে তাকাতে তাহলে দেখতে পেতে, প্রিয়জন শুধু তুমি নয়, আমরা সবাই হাড়িয়েছিলাম। ছোট চাচা যখন তার নতুন বিয়ে করতে যায় তখন তার সুন্দরী বউ নিজের দেনমোহর হিসাবে বাড়িটা নিজের নামে করে নেয়। সুন্দরী বউ পাওয়ার লোভ ছোট চাচাকে এতটাই বেকে ধরেছিলো যে নিজের বাড়িটা তার নামে করে দিতে দুবার ভাবে নি সে। বিয়ের পর সে ফুপ্পিদের এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। সারাক্ষণ পার্টি বন্ধু নিয়ে মেতে থাকতো সে। আমি আর দাদি ঘরের এক কোনে পরে থাকতাম। মাঝে মাঝে দাদি তার এমন আচরনের প্রতিবাদ করতো বলে
বিয়ের তিনমাস যেতে না যেতে ছোট চাচার নতুন বউ দাদিকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। এতে ছোট চাচা প্রতিবাদ জানালে সে স্পষ্ট জানান দেয়, এটা আমার বাড়ি আমি যাকে খুশি বাড়িতে রাখবো আর যাবে খুশি উচ্ছেদ করে দিবো। ছোটা চাচা নতুন বউয়ের কথায় উঠতো বসতো। দাদিকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর পর ছোট চাচার সুন্দরী বউ বাড়িকে মদের আসর বানিয়ে রাখতো। রাত ভোর পার্টি করতো নেশা করতো। ছোট চাচা সবটা মুখ বুজে সহ্য করে নিতো। তখনো প্রতিবাদ করতো না।এদিকে আমিও এসব সহ্য করতে পারতাম না তাই বাধ্য হয়েই বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। তারপর থেকে নানার বাড়িতেই বড় হয়েছি আমি। কখনো ও বাড়িতে পা রাখিনি আমি। এখন আমার গার্ডিয়ান বলতে আছে শুধু আমার নানা নানি আর আমার ছোটমনি। ছোটমনি আমি মৌ-কে খুব ভালোবাসি। তুমি তোমার মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দিবে ছোটমনি। কথা দিচ্ছি আমি কখনো তোমার মেয়েকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবো তোমার মেয়েকে।

আলিহানের কথা শুনে চোখের কোনে অশ্রু জমে গেছে সৈয়দা মাহবুবার। ছলছল নয়নে আলিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন সে। আলিহান একপলক মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে মেহেরের হাতদুটি আবার তার হাতের মুঠিতে নিয়ে নিলো অতঃপর বলল,

– এই পাগলী একবার ভাইয়া বলে ডাকবি আমার। তুই যখন ছোটমনির পেটে ছিলি তখন আমি ছোটমনিকে কি বলতাম জানিস, তুই হবি আমাদের ছোট্ট প্রিন্সেস। তোকে খাইয়ে দিবো, বউ সাজিয়ে দিবো, চুলে বেনুনী করে দিবো আর মাঝে মাঝে খুব জ্বালাতন করবো তোকে। কিন্তু দেখ তুই যখন এই পৃথীবির আলো দেখলি তখন আমি জানতেই পারলাম না। আর যখন জানতে পারলাম আমার ছোট্টপরির কথা তখন ছোটমনি তার বাপের বাড়ি ছেলে চলে আসে। কোনদিন তোকে আদর করতে পারিনি। ভাইয়া ডাকটা আজও শুনা হয়নি আমার।

– নওশাদ আহমেদের সাথে থেকে থেকে ড্রামাটা ঠিক শিখে নিয়েছো। মৃদু হেসে বলল মেহের। আমি তোমাকে কিছুতেই ভাইয়া বলে ডাকবো না। যে নওশাদ আহমেদকে আমি বাবা বলে স্বীকার করি না তার ভাইয়ের ছেলে আমার ভাই হয় কি করে! তবে আমি তোমাকে দুলাভাই বলে ডাকতে পারি। শুধু একটাই রিকুয়েস্ট নওশাদ আহমেদের থেকে আমার বোনটাকে দূরে রাখবে।

– সেটা আবার বলতে। একবার হুকুম করেন মহারানী। আপনার বোন চিরদিনি আপনার কাছেই থাকবে।

– তোমার কি ঘর জামাই থাকার ইচ্ছে নাকি। স্মিত হেসে বলে মেহের। মেহেরের কথা শুনে আলিহান মৌ সহ সৈয়দা মাহবুবা হেসে দেয়।

২০,
রাতে টিউশন শেষে বাসায় ফিরে যাচ্ছে রাহনাফ। চাদের নির্মল আলোতে রাস্তায় হাটতে ভালো লাগছে তার। অনেকদিন পর রাতের বেলা রাস্তায় হাটছে সে। প্রতিদিন রিক্সা করে বাসায় ফিরে যাওয়া হয়। আজ হঠাৎ করেই রাহনাফের ইচ্চে হলো সে হেটে যাবে। মনের উপর নাকি কারো জোর চলে না। তাই সে মনের মর্জিমাফিক হেটে যাচ্ছে। খুব সুন্দর জোছনা নেমেছে।চাদের মধ্যে হলুদ হলুদ একটা ভাব চলে এসেছে।কালো কালো অংশগুলো কেমন কেমন যেন লাগছে।চাদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।নেশা নেশা লাগে। তার এই নেশাকে আরো তীব্র নেশাক্ত বাড়িয়ে তুলে মেহেরের ভাবনা। ইশ এই সোনালি চাদের আলোয় যদি মেহের হাট ধরে পাশাপাশি হাটতে পারতো সে। উপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে রাহনাফ। বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে উঠে,

– ভালোবাসি লেখিকা সাহেবা। খুব বেশী ভালোবাসি আপনাকে।

রাহনাফের ভাবনার ছেদ ঘটায় ওর মোবাইলের রিংটোন। কিছু সময়ের জন্যে হলেও রাহনাফের মনে হচ্ছিলো এই মোবাইল যদি আবিষ্কার না হতো তাহলো অনেক ভালো হতো। মানুষ শান্তুি মতো ঘুমাতে পারতো। কাজে মনোযোগ দিতে পারতো এমনি প্রাণ ভরে স্বপ্ন দেখতে পারতো। বুক পকেট থেকে মোবাইটা বের করে স্কিনে নাম্বার দেখে চমকে উঠে সে। মনে মনে বলে,

– নওশাদ স্যার। তিনি কেন কল করছেন? নিশ্চয় মেয়ের নেকামো সহ্য করতে না পেরে কল করেছেন। কি করবো কল রিসিভ করবো কি করবো না অনেক ভেবে চিন্তে শেষে কল রিসিভ করে কথা বলে নেয়।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।