ম্লান সন্ধ্যায় পর্ব-০১

0
495

#ম্লান_সন্ধ্যায় (০১)

‘মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা মারা গিয়েছিল। সৎমায়ের কাছে বড় হয়েছে।বাবার একটা মুদি দোকান, সেই সাথে কাঁধে চার লাখের মতো ঋণের বোঝা।এপক্ষের দুটো বোন, একটা ভাই রয়েছে। বড় দুজন ১৮ পেরিয়েছে,তাই লোকটার মাথায় চিন্তার পাহাড়। আমি যে মেয়েটার কথা বলছি,তার নাম ‘কোয়েলিয়া’। সমাজবিজ্ঞানে অনার্স করছে, তৃতীয় বর্ষে। গায়ের রং চকচকে ফর্সা না হওয়ায় উপযুক্ত পাত্র জুটছে না।’
ম্যানেজারের কথা শুনে আফসার সাহেব বললো,
‘গুড। এরকম মেয়েই চাচ্ছিলাম। তবে মেয়েটা অনিককে মেনে নেবে!’
‘স্যার, চিন্তার কারণ নেই। আমি সব খোঁজখবর নিয়েই আপনার কাছে এসেছি। আমার পরিচিত ওদের পরিবার। আমার চাচার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে। তাছাড়া প্রতিবেশীরা জানিয়েছে,সৎমা ছোট থেকেই নানাভাবে অত্যাচার করে। কিন্তু মেয়েটা বাবাকে বলা তো দূরে থাক, প্রতিবেশীরা তার কাছে সৎমায়ের দূর্নাম করলে,সে উল্টো, তাদের এসব বলতে নিষেধ করে। দেখুন প্রতিবেশীরা এমনিতেই কারো নামে বদনাম করতে পারলে খুশি হয়, কিন্তু মেয়েটার চরিত্র নিয়ে কোনোরূপ কিছু শুনিনি। যতটুকু শুনেছি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল রমনী। আপনার দেওয়া সবগুলো শর্ত এই মেয়ের সাথে মিলে যায়। শুধু গায়ের রংটা..’
আফসার শিকদার কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
‘তাহলে এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। গায়ের রঙে কি যায় আসে। তুমি সব ব্যবস্থা করো।’

আফসার শিকদারের পিএ তুহিন উসখুস করছে। আফসার শিকদার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ছেলেটা কিছু বলতে চায়। এতক্ষণ ধরে যিনি তথ্য দিচ্ছিলেন, ইশারায় তাকে যেতে বললন। তুহিনের দিকে ফিরে, তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,
‘এত ফর্মালিটি না দেখিয়ে,যেটা বলার বলো।’
‘ইয়ে,মানে, অনিক স্যার যেরকম রাগী।ব্যাপারটা কিভাবে নেবে।’
‘দেখো, আমার একমাত্র বংশধর কে বাঁচানোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। মেয়েরা যেমন পুরুষের জীবনে ধ্বংসের ঝড় আনে, তেমনি গড়েও দিতে পারে। আমার ছেলেকে ভালো করতে পারলে, মেয়েটার জীবন বদলে যাবে। অনিককে রাজী করানোর দায়িত্ব আমার।আশা করছি, তুমি কোনোরূপ বাঁধা দেবে না।’
‘কিন্তু স্যার।দেখা গেল অনিক স্যার মেয়েটাকে মানলো না। তখন কি হবে!’
‘সবকিছু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিয়ের আগে অনেক পুরুষ খারাপ থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে ভালো হবার নজির বহু আছে। আমার সন্তানের ক্ষেত্রে নারীর সেই ইতিবাচক দিকটাই দেখতে চাই। তুমি ভেবো না, মেয়েটার কোন কষ্ট হবে না।’

তবুও তুহিন হাঁসফাঁস করে। আফসার সাহেবের একমাত্র সন্তান অনিক,যে দিনভর পড়ে পড়ে ঘুমায়, রাতভর মদ্যপানে ব্যস্ত। কোন এক মেয়ে ওর সাথে প্রতারণা করেছে,যার দরুন দিনদুনিয়া ভুলে বিদেশি মদ গেলে। দুধের মাছির মতো কয়েকজন উটকো বন্ধু আছে। মাঝেমাঝে সপ্তাহ খানেক লাপাত্তা থাকে। বাবার পরিশ্রমের উপার্জিত অর্থ তার আনন্দের খোরাক যোগায়। এখন সেই ছেলেকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে আফসার সাহেব একবার ও ভাবছেন না। সত্যি বড়লোকরা মহা স্বার্থপর। নিজের ভালোর জন্য খু’ন করতেও দ্বিধা করে না।পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে স্যারের বাড়িতে ওর যাতায়াত আছে।ও জানে, অনিক অনেকটা হিংস্র নেকড়ের মতো।ওর কথার এদিক ওদিক হলেই সার্ভেন্টদের গায়ে হাত তোলে, ভাংচুর করে। জন্মদাতা পিতার সাথেও ওর আচরণ খুব একটা ভালো না। তাছাড়া অনিকের ফুফু খুব একটা ভালো মানুষ নয়।এমনকি ভদ্রমহিলা ওকেও নানাভাবে অপমান করে।তার কথায় স্পষ্ট প্রতিপত্তির অহংকার। এহেন সম্ভ্রান্ত পরিবারে, ঋণগ্রস্ত এক পিতার কন্যাকে,ওরা ঠিক কিভাবে নেবে?

আফসার শিকদার প্রথমে তুহিনকে বলেছিল, একজন অনাথ মেয়ের খোঁজ করতে। তুহিন জেনেশুনে এই দায়িত্ব নিতে অপরাধবোধে ভুগছিল।তাই সে জানিয়েছিল,তার জানামতে এমন কোন মেয়ে নেই। আফসার শিকদার হয়তো বুঝেছিল,তাই জোর করেননি। ভদ্রলোকের সবকিছুতেই স্বার্থ।এইযে অনিক তার একমাত্র বংশধর বলে, তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন, ছেলের খেয়াল রাখতে একজন বৌরূপী অবৈতনিক দাসী নিয়োগ করতে।যদি আরও দুটো ছেলে থাকতো, তবে কি এই উচ্ছন্নে যাওয়া যুবককে নিয়ে ভাবতো!
টাকা কি না পারে।এই টাকা একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে।মদ্যপ কাওকে ভালো করা এতটাই সোজা!নাহ্, তুহিন জেনেশুনে এমন অবিচার মেয়েটার সাথে করতে পারবে না।
*
দরিয়া বেগম কোয়েলিয়ার ওপর মনে মনে ক্ষেপে আছে।তার ওমন সুন্দর সুন্দর দুটো মেয়ে থাকতে, শেষমেশ ওই কালীর জন্য কি না, এতবড় ঘর থেকে সমন্ধ এলো। ওইতো গায়ের রঙের শ্রী।তার ওপর মুখে ব্রণ। দেখলেই অরুচি চলে আসে।কাক ও ফিরে তাকাবে না,ওমন মুখের দিকে। গরুর মতো দুটো চোখ,ম্যাগীর মতো কোঁকড়ানো চুল। কালো মেয়েদের চুল হয় বৈশাখের বিকেলের মেঘের মতো। কিন্তু এমেয়ের চুল তো সেই আফ্রিকানদের মতো। অথচো এই মেয়ের কি না, রাজকীয় পরিবারে বিয়ে হবে! সারাজীবন পায়ের ওপর পা তুলে সংসার করবে!নাহ্,সতীনের মেয়েকে ভালো থাকতে দেখার মতো ওমন উদার সৎমা সে না।
মোতালেব মোল্লা বাড়িতে এলে দরিয়া বেগম ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলল,
‘কোয়েলির সম্বন্ধির ব্যাপারে কিছু ভাবছেননি?’
দরিয়া বেগম কোয়েলিয়া উচ্চারণ করতে পারেন না। অবশ্য তাড়াহুড়োর ডাকে কোয়েলিয়ার থেকে কোয়েলিই সহজে মুখে চলে আসে।ওর কথার প্রেক্ষিতে মোতালেব কিছু বলে না।ও জানে, দরিয়া শেষ পর্যন্ত কোন কথা তুলবে। কোয়েলিয়ার ভালো চাইতে গেলে যে সৎমায়ের সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে। ভাত চিবুতে চিবুতে,কচ করে কাঁচামরিচের খানিকটা কামড়ে নিলো। তৃপ্তিসূচক শব্দ তুলে বললো,
‘আরেকটু ডাইল দেও।’
দরিয়া মেঝেতে শব্দ করে ডালের গামলা টা রাখলো। রাগে ওর গা জ্বলে যাচ্ছে।ও আর মোতালেবের পাশে বসলো না।গটগট করে মেয়েদের কক্ষের দিকে গেল। রেণু তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাধছিলো,দরিয়াকে দেখে চমকে উঠে বললো,
‘কিছু বলবা?’
‘তোরে ক্রিম কিনা দিছি, ওগুলো মাখবার পারস না।’
সিজু বিছানায় বসে পড়ছিল।ও বললো,
‘মা,আপা এমনেই ফর্সা।ক্রিম লাগানোর কি দরকার।’
‘তোরে কতা কইতে কইছি!’
মায়ের ধমকে সিজু দমে যায়। রেণুর খুব বিরক্ত লাগে,এইযে মা তার বড়বোনকে সবসময় অপদস্থ করতে চায়। তবুও মায়ের ভয়ে একরকম চুপ থাকে। আজকের ঘটনার রেশ ধরে,মা এখন ওর পিছনে অনেকগুলো টাকা নষ্ট করবে। অথচো ওর বাবার মাথায় পাহাড় পরিমান ঋ*ণের বোঝা।এই মা’টা কেন যে নিজেকে সৎমা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যায়!

রাতে ঘুমানোর আগে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘কোয়েলি বদলি,আমাগে রেণুরে দিলি কেমন হয়?’
‘তারা কোয়েলিরেই চায়।’
‘আমার কিন্তু একখান সন্দেহ হইচ্ছে।পোলার আবার সমেস্যা নাই তো?’
‘যাইবার সুমায় তো শুইনলাম,কইলো তো নাই। মেম্বারের ভাইরবিটা মাকসুদ হইলো ঘটক।হেই কোম্পানির ম্যানেজার,হেতিই সব কইলো।’
‘আমাগে রেণুর কথা একবার পাইড়া দেহো।ওরে দেখলি নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।’
‘আচ্ছা,কইয়ে দেখবানি।’
‘দেখা লাগবে না, এহনি ফোন লাগাও।’
বাধ্য হয়ে মোতালেব মাকসুদের নাম্বারে কল করে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে সালাম বিনিময় হবার পর, মোতালেব ছেলের ব্যাপারে কথাবার্তা জিজ্ঞেস করে।
‘কাকা, আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।ছেলে একটু রাগী, কিন্তু ওর কোন সমস্যা নেই। বিশ্বাস না হলে আগামীকাল সকালে চলে আসুন, ছেলে দেখিয়ে দেব।’
‘কি যে কও না, তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।তয় আরাক্ষান কথা আছে। তুমি কোয়েলির আম্মার সাথে কথা কও।’
দরিয়া ফোন নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। কথায় কথায় কোয়েলিয়ার পরিবর্তে রেণুর বিয়ের কথা তুললে মাকসুদ বলে,
‘কাকি,স্যার নিজেই কোয়েলিয়াকে পছন্দ করেছে। এখানে আমার কিছু করার নেই।’
মাকসুদ ফোন কেটে দেয়। দরিয়া মোতালেবের দিকে ফোন ছুঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
মোতালেব মোল্লা আপাতত খোশমেজাজে আছে।বড়মেয়েটার ময়লা রঙের জন্য সবসময় উনি চিন্তিত ছিলেন।এমনকি ঋণ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকে কিছু টাকা রেখেছিলেন। এখন সব চিন্তার অবসান হলো।কমতো আর মেয়ের প্রতি অবিচার করেননি। এখন মেয়েটার ভালো ঘরে বিয়ে হবে, ভালো থাকবে এইতো চাওয়া। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন।
*
তুহিনের মনটা খারাপ হয়ে আছে। মানুষের বিশ্বাস অর্জন কতই না সহজ।এইযে মাকসুদ কতো সহজেই মোতালেব মোল্লাকে রাজী করিয়ে,তার বিশ্বাসভাজন হলো। গোবেচারা লোকটার মস্তিষ্কে এমনভাবে কথাগুলো গেঁথে দিয়েছে যে লোকটা একবার শহরে এসে ছেলের খোঁজখবর পর্যন্ত নিলো না।কথা’র কি আশ্চর্য ক্ষমতা। তুহিন চেষ্টা করেছিল, মেয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার। আফসার শিকদার হয়ত কিছু আঁচ করতে পেরেছিল, ওকে সোজা দিল্লিতে কুতুবমিনার দেখতে পাঠিয়ে দিলো। অবশ্য ঝানু ব্যবসায়ীর কাছে চেহারা দেখে মনের কথা আঁচ করা কঠিন কিছু না। দিল্লীতে কাজ বলতে তেমন কিছুই না। এখানে শেয়ারে ব্যবসার জন্য উপযুক্ত কিনা, তদারকির জন্য ওকে পাঠানো হয়েছে। তুহিন চাইলেও ফিরে গিয়ে বিয়ে আটকাতে পারবে না। উপরন্তু আফসার শিকদারের শ*ত্রু*তার খাতায় নাম লেখাবে।সংসারী মানুষের পদে পদে বাধা। তুহিন এখন কিছু করতে উদ্যত হলে,ওর পরিবার না খেয়ে মরবে। ছোট ভাইটার পড়া হবে না।বাবা মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় হবে না।
বিকেলের আকাশ ম্লান হয়ে আসছে। কুতুবমিনার দেখার অনেক শখ ছিল। তবে এই মুহূর্তে ও সেটা উপভোগ করতে পারছে না। অগোচরে তো রোজ কতো নারীর কপাল ভাঙছে। কিন্তু চোখের সামনে কি সেটা সহ্য হয়! মেয়েটাকে ও দেখেনি, তবুও একজন পুরুষ হয়ে মনের কোণে তার জন্য ব্যাথা অনুভব করছে। আগামীকাল হয়তো ওর বিয়ে হবে, তারপর ও পড়বে এক জ*লন্ত অগ্নিকুণ্ডে। ওকে বাঁচানোর কেউ থাকবে না,না পাশে কেউ।

চলবে..
®️ সুমি খানম