যতনে রাখিবো পর্ব-০৬

0
70

#যতনে_রাখিবো

আয়েশা বেশি করে কিসমিস কাজুবাদাম দিয়ে ভাইয়ের জন্য পায়েস রান্না করে নিয়ে এসেছে। পায়েসের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে অভয়কে ডাকল।

“ওখানে বসে খাবি?”

“না। তোমার কাছেই আসছি।”

অভয় সোফা থেকে উঠে গেল। পায়েসের বাটির দিকে তাকিয়ে নোমানের চোখ চড়কগাছ। স্যার পায়েস খাবে? এত কাজু কিসমিস! স্যার কি ভুলে গেছেন উনাকে ডায়েট ফলো করতে হয়। এমনিতেই নেক্সট মুভির জন্য ওয়েট লস করতে হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা জিমে গিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছেন। এখন যদি এই পায়েস খায় তাহলে কাল আরও দুই কিলো বেশি দৌড়াতে হবে। অভয় বোনের কাছে যাচ্ছে। নোমান ঝড়ের গরিতে স্যারের সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। অভয় কপালে ভাঁজ ফেলে নোমানের দিকে তাকাল। নোমান বড় আপুকে যথেষ্ট ভয় পায়। বড় আপু যাতে শুনতে না পায় সেজন্য প্রায় ফিসফিস করে বলল,

"স্যার আপনি এই কাজু কিসমিস ওয়ালা পায়েস খাবেন! আপনার জন্য মিষ্টি জাতীয় সকল খাবার এখন বিষের সমান। প্লিজ খাবেন না স্যার।"

"এই অকর্মা ছেলেটা কানে কানে তোকে কী বলছে রে? এখন কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। আমি অনেক কষ্ট করে পায়েস রেঁধেছি। না খেয়ে চলে গেলে খবর আছে।"

অভয় বোনের দিয়ে ফিরে হাসল। হেসে হেসেই নিজের ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বলল,

"শুনলে তো আপু কী বললো। না খেয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।"

অভয় টেবিলে গিয়ে বসল। আয়েশা পায়েসের পুরো বাটিটাই ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তার ভাইটা পায়েস খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ভাইয়ের জন্যই মূলত মা'র কাছে পায়েস রাঁধা শিখেছিল। যদিও মায়ের মতো অত ভালো পারে না সে। তবুও তার ভাই তৃপ্তি করে খায়। অভয় ছোট্ট চামচের এক চামচ পায়েস মুখে নিয়েছে। সে অমৃত খাওয়ার মতো স্বাদ পেলেও নোমান বিষ পান করার মতো চেহারার প্রতিক্রিয়া জানালো। স্যার নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনতে চাচ্ছে কেন? অভয় হয়তো পুরো বাটি পায়েস একাই শেষ করে ফেলত। যদি না নোমান এসে বাধা দিত। তৃতীয় বারের মতো পায়েসের চামচ মুখে তুলতে গেলে নোমান গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল। অসহায় মুখে স্যারের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল,

"আর না স্যার। প্লিজ।"

আয়েশা ছেলেটার এমন কান্ড দেখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। এই ছেলের তো সাহস কম না। তার ভাইয়ের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নিচ্ছে! বেচারাকে শান্তিতে খেতেও দিচ্ছে না। সে ঝাঝিয়ে উঠে বলল,

"এই ছেলে তোমার তো সাহস কম না! কত বড় সাহস দেখেছিস! তোর মুখ থেকে খাবার কেড়ে নেয়। এই ছেলেকে তুই আজই চাকরি ছাড়া কর। একে আর এক মুহূর্তও যেন আমার চোখের সামনে না দেখি।"

নোমান বেচারা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছে। বোনেরা যা বলেন স্যার তাই করেন। চাকরিটা এবার মনে হয় সত্যিই গেল। নোমান কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অভয় ওকে দেখে মনে মনে হেসে বলল, এবার ঠিকঠাক মতো টাইট দেওয়া হয়েছে বেটাকে। নিয়ম নিয়ম করে আমার কান ঝালাপালা করে ফেলছিল। এবার আপুর বকা খা বেটা। আয়েশা এখনও নোমানের ক্লাস নিচ্ছে।

"এই ছেলে এই, তুমি আমার ভাইয়ের মালিক নাকি আমার ভাই তোমার মালিক হ্যাঁ? তুমি যা বলবে আমার ভাই তা কেন শুনবে? বরং আমার ভাই যা বলবে তোমাকে সব শুনতে হবে। কোনোপ্রকার অভিযোগ ছাড়াই। একদিন একটু পায়েস খেলে কি ক্ষতি হবে শুনি? নায়ক হয়েছে বলে কিছুই খেতে পারবে না? আমার ভাই কি গরু? ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকবে নাকি আমার ভাইটা!"

নোমান বেচারা অসহায় মুখে স্যারের দিকে তাকাল। স্যারের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্যার তাকে বেকায়দায় ফেলে মজা নিচ্ছে। নোমান বড় আপুর বকা খেয়েও রাগ করতে পারল না। স্যার মাঝে মাঝে তাকে শায়েস্তা করার জন্য এমন সব ছেলেমানুষী করে! স্যারকে যে খুব কাছ থেকে দেখেছে সে-ই বলতে পারবে স্যার কেমন মানুষ।
সকালের ওই স্ক্যান্ডালের পর থেকেই অভয়ের ফোন বন্ধ। ম্যানেজার ব্যাটারও পাখা গজিয়েছে। মিম বোনের ফোনে কল করেছে। কল তুলেছে নূর।

"হ্যালো খালামনি।"

"নূর সোনা! তোমার আম্মু কোথায় মা?"

"আম্মু! আম্মু তো মামার কাছে।"

"তোমার মামা এখন তোমাদের বাসায়?"

"হুম। খালামনি, মামা আমার জন্য অনেকগুলো চকলেট এনেছে।"

"চকলেট খেলে তোমার দাঁতে পোকা হবে সোনা। বেশি চকলেট খেয়ো না। এখন একটু ফোনটা তোমার মামাকে দাও তো পাখি।"

"ঠিক আছে।"

নূর দৌড়ে এসে মামার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। অভয় ফোন কানে নিতেই মিম বলতে লাগল,

"কী ব্যাপার ভাই! না, তুমি আজকে বলবে আমি কি তোমার বোন না? যদি বোন হই তাহলে আমি তোমার কেমন বোন? আপন নাকি সৎ? তুমি আমার কল তুলো না কেন? আমি এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। শুধু এটা বলতে কল করেছি তোমার উপর আমি ভীষণ রাগ করেছি। আজকের পর আর তোমাকে কল দিব না।"

বোনের অভিমানী কথা শুনে অভয় হাসতে হাসতে বলল,

"আরে পাগল শোন তো।"

"না। কোন শোনা শুনি নাই। রাখছি আমি।"

এটা বলে মিম সত্যি সত্যিই কল কেটে দিয়েছে। অভয় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

---
তাথৈ গোসল করে বেরিয়েছে। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে চুল খোলে দিয়েছে। খোলা চুল থেকে টপটপ করে পানি ফ্লোরে পড়ছে। আপু দেখলে খবর ছিল। কিন্তু আপু এখন আসতে পারবে না। সে দরজা লাগিয়ে রেখেছে।
ফোন বাজছে। তাথৈ কলেজের ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করল। আননোন নাম্বার দেখে ধরল না। আগামী এক সপ্তাহ কারো কল তুলবে না ঠিক করে নিয়েছে। অচেনা কারোর তো না-ই, চেনা মানুষ তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাথৈ কাউকে পাত্তা দিবে না। এক সপ্তাহে পরিস্থিতি ঠান্ডা হবে। তখন দেখা যাবে। কিন্তু সবার আগে হাফসাকে গলায় পারা দিয়ে ধরতে হবে। তাথৈ বিছানায় বসে পা নাচাতে নাচাতে ভাবছে,

"মুখের কথা থেকে পল্টি খেলে তোর খবর আছে হাফ চা-র বাচ্চা। কত বড় একটা ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিস! যদি খালি আইফোন না দিবি, তোর বাপের পত্রিকার অফিসে আমি ম্যাচের কাঠি ছুড়ে যাব।"

তাথৈ নিজের সাথে কথা বলতে বলতে আরও দু'বার ফোন বাজলো। তিন বারের মাথায়ও কল তুললো না। উল্টো ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছে।

"আমি এখন নেটওয়ার্কের বাইরে আছি। আপাতত এক সপ্তাহ বাইরেই থাকব। ওই নায়ক সাহেবের যে পরিমাণ নারী ভক্ত! আমাকে রাস্তাঘাটে পেলে চুল ছিঁড়ে রেখে দিবে।"

ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু আপুর ভয়ে এখন বাইরে যাওয়া যাবে না। আপু সামনে পেলেই চড় মারবে। তাথৈ ক্ষিধে পেটেই বসে রইল। সময় কাটছে না। সে এটাও ভাবছে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটালো। ব্যাটা নায়ক কি তাকে ছেড়ে দিবে? অন্তত এটা জানতে চাইবে কেন সে এমন করেছে। তাথৈ ঠোঁট কামড়ে ভাবছে,

"আমি উনার টক্সিক ফ্যান পাবলিক এমনটা ভেবে নিলেই শান্তি। টক্সিক ফ্যানরা কতকিছুই তো করে! আমি তো একটু ভুলভালই বলেছি।"

ফোন সাইলেন্ট ছিল। ইতোমধ্যে হাফসা সতেরোটা মিসড কল দিয়েছে। এখনও কল হচ্ছে। তাথৈ কল তুলেই বলল,

"দরকার পড়ে দুইটা কিডনিই বেচবি। তবুও কালকের মধ্যে আমার আইফোন চাই।"

"দোস্ত দম নিতে দে। তোর আইফোন দোকানেই আছে। কোথাও চলে যাচ্ছে না। কিন্তু এখন তুই বল, বাড়ির পরিবেশ কেমন? সব চ্যানেলেই তুই চলছিস।"

"পরিবেশ সুপার হট। চুলোয় বসানো তাওয়ার মতো গরম। আপু পারলে কিল মেরে আমার পিঠ বাঁকিয়ে ফেলে।"

"আমরা কি একটু বেশিই করে ফেলেছি আজ?"

"বেশি কম এখন আর ভেবে লাভ নেই। যা করার তা করে ফেলেছি। এখন পস্তাতে পারব না।"

"হুম। আচ্ছা বাদ দে। বাংলাদেশে কয়দিন পরপরই নতুন নতুন ইশু ক্রিয়েট হয়। নতুন আরেকটা ইশু পেলে পাবলিক তোকে ভুলে যাবে। বেশি সময় লাগবে না দেখিস।"

"টাকা জোগাড় করেছিস? কথার নড়বড় যেন না হয় দোস্ত। আমাকে তো চিনিস! এমনিতেই এখন ভাইরাল গার্ল। তোকে কে°টে/কুটে বিরিয়ানির দোকানে বিক্রি করে আরেকটু ভাইরাল হয়ে যাব।"

"আরে দোস্ত থ্রেট দিস না। কয়টা দিন সময় তো দিবি? আমার বাপ কি বাড়িতে টাকার গাছ লাগিয়ে রেখেছে? আমি ছিড়ব আর নিয়ে আসব।"

"এসব কথার বেইল নাই দোস্ত। তোমার জন্য আমি এতবড় একটা রিস্ক নিয়েছি। কালকেই তুই তোর ওয়াদা পূর্ণ করবি। নইলে তোর খবর আছে। সাথে তোর বয়ফ্রেন্ডেরও। হারামজাদা ইচ্ছে করে আমাকে ফাঁসানোর জন্যেই এই প্ল্যানটা করেছে।"

"আমার বয়ফ্রেন্ডকে এভাবে বলিস না। ও কেন তোকে ফাঁসাতে চাইবে?"

"কেন ফাঁসাতে চাইবে তা যদি তুই বুঝতি তাহলে আর এই তেল্লাচোরার সাথে রিলেশনে যেতি না। ওসব কথা বাদ। আমি দুই তিন সপ্তাহ বাড়ি থেকে বেরুব না। ভার্সিটিও যাব না। তোর কাছে কেউ আমার কথা জানতে চাইলে বলবি, তাথৈ ইন্তেকাল ফরমায়েছে।"

"তওবা নাউজুবিল্লাহ দোস্ত। এমন কথা বলিস না।"

"উহহ, আর পিরিত দেখাইয়ো না। তুমি নিজেই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিছো।"

হাফসা কল কাটার পরেও তাথৈয়ের ফোনে চেনা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসতেই থাকল। বেচারি তাথৈ ফোনের দিকে তাকিয়ে নাকিকান্না করতে করতে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

"বাংলাদেশের মানুষের সব বিষয়েই এত কৌতূহল কেন? কী হয়েছে এটা জানার জন্য দানাপানি ত্যাগ করে আমার পেছনে লেগেছে। ভাল্লাগে না। মন চায় কোরিয়া চলে যাই।"

একের পর এক কল আসতেই আছে। এখন তো ফোনটাও হ্যাং মারছে। তাথৈ বিরক্ত হয়ে ফোন সুইচ অফ করে রাখল।

চলবে