যতনে রাখিবো পর্ব-৪+৫

0
104

#যতনে_রাখিবো

বাবাই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তাথৈ হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পেছনে ঘুরে খু’ন্তি হাতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করা তার বোনকে দেখে ঢোক গিলল। আপু নিশ্চয় টিভিতে দেখেছে। অভয় খান আপুর প্রিয় নায়ক। আজ তার কপালে খারাবি আছে। অন্তত চার পাঁচটা খু*ন্তির মার তো খেতেই হবে। তাথৈ দুলাভাইকে দেখে স্বস্তি বোধ করল। যাক দুলাভাই থাকলে মারটা কম খাবে। বাবাই যতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতেই খুশি গলায় জিজ্ঞেস করছে,

“খালামনি আমরা তোমাকে টিভিতে দেখেছি। তুমি কি নায়িকা হয়ে গেছ খালামনি?”

তাথৈ বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখে জোর করে একটু হাসলো। বিড়বিড় করে বলল,

“চুপ কর বাবা। এখন একটা কথাও বলিস না। নায়িকা না তোর মা’র চোখে আমি এখন রিনা খানের থেকেও বড় ভিলেন।”

তাথৈ বোনের দিকে তাকাল। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বলতে লাগল,

“আমি তোমাদের বুঝিয়ে বলছি। তোমরাও আমাকে ভুল বুঝো না। ব্যাপারটা হলো গিয়ে…

তাথৈ নিরাপদ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালেও আপুর সেই দূরত্ব পার করতে সময় লাগল না। চটাস করে তার পিঠে একটা তাল পড়ল। ব্যথায় মুখ কুঁচকে পিঠ বেঁকে উঠল।

“আল্লাহ গো মেরে ফেলল!”

বাবাই মায়ের ভয়ংকর রুপ দেখে দৌড়ে গিয়ে বই নিয়ে বসে জোরে জোরে পড়তে লাগল। হারুন স্ত্রীর সামনে থেকে তাথৈকে সরিয়ে এনে বলল,

“আহা করছো কী! মারলে কেন?”

তানিয়া ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

“মারব না, ওকে চুমু খাবো! কাজটা কী করেছে ও? এতগুলো মানুষ, সাংবাদিকের সামনে গিয়ে ওর ওই নাটক করার দরকার কী ছিল? কেন করেছে এটা জানি না। কিন্তু আজকে ওর জন্য বাড়ির বাইরে সাংবাদিকের ভীড়। আত্মীয়স্বজন এখনও আসা শুরু করেনি। শুধু ফোন দিয়েই জিজ্ঞেস করছে। তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো কেন ওই লোকের ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চাচ্ছে ও। এই কাজ করে লাভটা কি হলো ওর?”

তাথৈ ডান হাত ঘাড়ের উপর দিয়ে নিয়ে পিঠ ডলতে ডলতে মনে মনে ভেংচি কাটল। এহহ কত দরদ! বোনের কথা না ভেবে এখনও ওই নায়কের কথা ভেবে যাচ্ছে। তাথৈ ভাবল, এখন যদি সে আপুকে সত্যি কথাটা বলে তাহলে আপু তাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে পেটাবে। বান্ধবী ও বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাজি ধরে এই কাজ করেছে। এর থেকে ছেলেমানুষি আর কিছু হয়? সে হাইস্কুলে পড়া আবেগী নিব্বি হলেও না এই কাজ মানা যেত। অবশ্য ছোটখাটো কোন বাজি তো ধরেনি। আইফোন! রনি হারামজাদা তাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। তাথৈও ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বসেছে।
এই ঘটনায় ওই নায়কের কিছু এসে যাবে না। কিন্তু তার হাতে আইফোন এসে যাবে। আইফোনের জন্য সে আপুর হাতে একটু আধটু মার খেতেও রাজি আছে। কিন্তু সমস্যা হলো সাংবাদিক গুলোকে কী করবে এখন? এরা তো তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। অলরেডি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে।

হাফসা যে ওর বয়ফ্রেন্ড রনির জন্মদিন উপলক্ষে তাথৈকে ডেকেছে এবিষয়ে তাথৈয়ের কোন ধারণাই ছিল না। এখানে এসে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এই রনি প্রথমে তাকে প্রপোজ করেছিল। অনেক দিন ঘুরেও তাকে পটাতে না পেরে তার বান্ধবীর পেছনে লেগেছে। ওরা সম্পর্কে আসার আগে তাথৈ জানতে পারলে কোনদিনই গাধীটাকে এত বড় ভুল করতে দিত না। এদের ব্রেকআপ করানোর জন্য এখনও জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে জন্মদিনের কেক টেক কেটে ওরা বাড়ি ফিরছিল। হসপিটালের সামনের রাস্তায় এত ভীড় দেখে স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহল জাগলো। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এখানে অভয় খান এসেছে। অভয় খানের নাম শুনেই হাফসা পাগল হয়ে গেল।

“অভয় খান! ও মাই আল্লাহ! চল না দেখে আসি। এত কাছাকাছি থেকে অভয় খানকে না দেখে চলে যাব! প্লিজ চল দু’জন।”

রনির আপত্তি নেই। কিন্তু তাথৈয়ের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আপু তার পিঠের ছাল তুলে ফেলবে। ইচ্ছে না থাকলেও রাস্তার মাঝে হাফসা হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিলে না গিয়ে উপায় থাকল না। ওরা দূর থেকেই অভয় খানকে দেখছিল। লোকটাকে নিয়ে মেয়েদের এত বাড়াবাড়ি দেখে তাথৈ বিরক্ত হচ্ছে। মুখ বাঁকিয়ে সে বলল,

“একটা নায়কই তো। একে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার মানে কী?”

তাথৈয়ের কথার বিপরীতে রনি খোঁচা দিয়ে বলল,

“তুই এমন ভাব করছিস যেন ওই নায়ক তোর কাছে পানি ভাত।”

তাথৈ কটমট করে রনির দিকে তাকিয়ে বলল,

“পানি ভাতই। যত বড় নায়কই হোক না কেন এরাও আমাদের মতোই মানুষ।”

রনি তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,

“বাদ দে খেতে না পারলে আঙ্গুর ফল টক। ওই নায়ক তোর মতো তিন তাথৈকেও পাত্তা দিবে না।”

“উনার পাত্তা আমি চাইও না।”

“পাবি না জেনেই চাস না। এত সুন্দর সুন্দর হিরোইনদেরকেই পাত্তা দেয় না। তুই কোথাকার তাথৈ।”

এদের ঝগড়ায় হাফসা একটু শান্তিতে অভয়কে দেখতেও পারছে না। সে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,

“আহ! থামবি তোরা? দেখতে দে।”

তাথৈ মুখ মুচড়ে বলল,

“তোর পালিত কুত্তাকে আগে থামতে বল।”

তাথৈয়ের উপর জেদ আগে থেকেই ছিল। শালি তাকে রিজেক্ট করেছে। কথায় কথায় আবার অপমানও করে। একে একটা শিক্ষা না দিতে পারলে জীবনে বড় একটা আফসোস থেকে যাবে। তাথৈকে ফাঁসানোর ভাবনা থেকেই রনি বুদ্ধিটা বের করল। তাথৈও বুঝলো না। বোকার মতো রনির ফাঁদে পা দিল।

তানিয়া ফের ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,

“কি হলো ওকে জিজ্ঞেস করছো না কেন? কেন নায়কের সাথে এই নাটক করেছে সে? ওই লোক তার কী ক্ষতি করেছে? আমার বাড়ির সামনে সাংবাদিক কেন থাকবে আজ?”

তাথৈ কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো। রনি হারামজাদা তাকে ভালো ভাবেই ফাঁসিয়েছে। বাঁচার জন্য তাথৈ কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে দুলাভাইয়ের দিকে তাকাল। তার শেষ ভরসা এখন দুলাভাই-ই। হারুন বউকে ভয় পেয়ে জোর হীন গলায় জিজ্ঞেস করল,

“কেন করেছ? তোমার আপু যা জিজ্ঞেস করছে জবাব দাও।”

তাথৈ আমতা আমতা করছে। কী বলবে সে? বলার মতো কিছু কি আছে? আসল কারণ বললে আরও কপালে শনি টেনে আনা হবে। তার থেকে চুপ করে আপুর হাতে আরও কয়েকটা মার খেয়ে নিক।
এর মাঝেও একবার তানিয়ার চাচী শাশুড়ী কল দিয়েছে। তানিয়া কল তুলে অগ্নি দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে ফোনে বিনীত গলায় হেসে হেসে কথা বলছে। তার চাচী শাশুড়ী মানুষ সুবিধার না।

“কী কাণ্ড! আমি তো টিভি টুবি তেমন দেখি না। একটু আগে আমার ছেলের বউ ডেকে দেখাল। তোমার বোনকে নাকি টিভিতে দেখাচ্ছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তোমার বোনের সাথে ওই নায়কের যোগাযোগ আছে!”

“কাকিমা টিভিতে যাকে দেখেছেন সে আমাদের তাথৈ না। তাথৈয়ের মতোই দেখতে অন্য একটা মেয়ে। আমরাও প্রথমে ওই মেয়েকে তাথৈ ভেবেই ভুল করেছিলাম। কিন্তু ওটা সত্যিই তাথৈ না।”

তানিয়া কথা বলতে বলতে হারুন তাথৈকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাক আপুর চাচী শাশুড়ী কল করে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

“কী বলছো! ওটা তোমার বোন না! কী আশ্চর্য..

“সত্যি কাকীমা ওটা তাথৈ না।”

“দেখতে তো তোমার বোনের মতোই মনে হয়েছে।”

“মনে হলেও, পৃথিবীতে একই চেহারার সাত জন মানুষ আছে। ওই মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশেই এক চেহারার দু’জন মানুষ আছে।”

“কী কাণ্ড! আমরা তো মনে করেছিলাম তোমার বোনের সাথে হয়তো ওই নায়কের সম্পর্ক আছে।”

“কী যে বলেন কাকীমা! তাথৈ এতবড় একজন নায়ককে কীভাবে চিনবে? আমরা সাধারণ মানুষ। উনার সাথে কি আমাদের চেনাজানা থাকার কথা বলুন? তাথৈ তো সকাল থেকে বাড়িতেই ছিল। আমার চোখের সামনে। ও তো আজ বাড়ি থেকেই বের হয়নি। বের হলে না বুঝতাম ওটা তাথৈ।

হারুন মুগ্ধ হয়ে বউয়ের কথা শুনছে। এরকম সুন্দর করেও গুছিয়ে মিথ্যা বলা যায়! মিথ্যা না তবে পুরোপুরি সত্যও না। মিথ্যার কাছাকাছি হলেও আংশিক সত্য আছে। চাচী শাশুড়ি কল কেটে দিলে তানিয়া ফোঁস করে দম ফেলল। এই মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকই পড়ে, কিন্তু অন্যের ব্যাপার নিয়ে নাচানাচিও কম করে না। ওটা তাথৈই ছিল জানলে এলাকার একটা মানুষকে বলতে বাকি রাখবে না, ওই নায়কের সাথে তাথৈয়ের সম্পর্ক আছে। শুধু সম্পর্ক আছে বলেই শান্ত হবে? তাছাড়া আরও কী কী বলবে আল্লাহই জানেন। তানিয়া সোফায় বসে পড়ে সামনে তাকিয়ে বোনকে দেখতে পেল না।

“ওই গাধার বাচ্চাটা কোথায় গেছে? ও কি আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবে না!”

তাথৈ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আজকে দুপুরে আর ঘর থেকে বেরুবে না। বাইরের গরম থেকে এসেছে শরীর ঘেমে আছে। গোসল করা প্রয়োজন। তাথৈ কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

চলবে
Jerin Akter Nipa

#যতনে_রাখিবো

নোমান দোকানের প্রায় সব চকলেট তুলে এনেছে। নূর এত এত চকলেট দেখে যেমন খুশি তার মা ততটাই রাগান্বিত। তার ভাইটা যে এতবড় একজন নায়ক! দেশের সব মেয়ের ক্রাশ। বুড়ো থেকে বাচ্চারাও তাকে পছন্দ করে সেই ভাইকেই এমন ভাবে ধমকে যাচ্ছে কেউ এই দৃশ্য দেখলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে চাইবে না। দেশের সুপারস্টারও বোনের সামনে বেড়াল হয়ে যায়।

“তুই কি গাধা? তোর মাথায় ঘিলু নেই? কী মনে করে তুই আমার বাড়িতে চকলেটের দোকান তুলে এনেছিস? ওই চকলেটের পোকার একটা দাঁতও ভালো আছে? দাঁতের ব্যথায় যখন চিৎকার শুরু করে তখন তো তোকেই আবার সব কাজ ফেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে ছুটতে হয়। তুই ছাড়া তো কাউকে কাছে আসতেও দেয় না।”

অভয়কে দেখে মনে হচ্ছে না বোনের বলা একটা কথাও তার কানে ঢুকেছে। আপু আগে এমন ছিল না। সে নায়ক হবার পর থেকেই কি এমন হয়েছে? নাকি মা মারা যাবার পর থেকে? আপুর বকাঝকা শোনা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আপু না বকলেই বরং এখন ভালো লাগে না। আয়েশা বকবক করেই যাচ্ছে।

“দেশে তো আরও কত নায়ক আছে। কই তাদের কাউকে নিয়ে তো দুইদিন পরপর নিউজ হয় না। তোকে নিয়েই কেন হবে? মেয়ে ভক্তদের এত পাত্তা কেন দিতে হবে? পাত্তা পেয়েই মাথায় উঠেছে। ওই মেয়েকে সামনে পেলে আমি দুই গালে ঠাস করে দুইটা চড় দিতাম। ফাজিল মেয়ের সাহস কত বড়! আমার ভাই নাকি তার জীবন নষ্ট করেছে!”

অভয় এখন আর আপুর কোন কথা শুনছে না। সে নূরের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। নূর একটা কিটক্যাট চকলেট ছিড়ে একটু নিজে খেয়ে বাকিটা মামার মুখের সামনে ধরেছিল। অভয় হাঁ করে খেতেই যাবে তখনই বাজ পাখির মতো নোমান এসে থাবা বসাল। অপরাধী গলায় বলল,

“আপনার জন্য চকলেট একদম এলাউ না স্যার। নিউ মুভির জন্য আপনাকে ওয়েট লস করতে হবে।”

অভয় মুখ বন্ধ করে নিয়ে কটমট চোখে নোমানের দিকে তাকাল। ভাগ্নির সাথে সামান্য চকলেটই যদি খেতে না পারে তাহলে এই জীবন রেখে লাভ কী? নোমান অভয়ের দৃষ্টির সামনে মিনমিনিয়ে বলল,

“সরি স্যার।”

এই ছেলেকে টাইট দিতে হবে। নিয়মের মধ্যে ফেলে তাকে দিনদিন রোবট বানিয়ে ফেলছে। অভয়ের মাথায় একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি আসলো। সে নোমানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। আয়েশা এখনও বকবক করেই যাচ্ছে। তাদের আত্মীয় তেমন কেউ নেই। যারা আছে তাদের সাথে সম্পর্ক নেই। তারপরও সেই মানুষ গুলো আজ তাকে কল করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চাচ্ছে। অভয় নূরকে কোল থেকে নামিয়ে বোনের পাশে গিয়ে বসল। আয়েশা ফোনে কথা বলতে বলতে অভয়ের দিকে দেখল।

“আরে বলেছি তো ওই মেয়েকে আমরা কেউই চিনি না। অভয়ের ভক্ত কি কম? ওই মেয়েও ওর একজন ভক্তই হবে। অনেক সময় ভক্তরা কত পাগলামি করে।”

কল কেটে দিয়ে গজগজ করতে করতে আয়েশা বলল,

“দেখলি, সারাবছর কোন খোঁজ নেই। যেই তোকে নিয়ে একটা খবর শুনলো অমনি কল দিয়ে বসে আছে। এদের লজ্জাও নেই! সম্পর্ক তোরা রাখিসনি এখন কল দিস কোন মুখে?”

অভয় বোনকে রাগতে দেখে হাসল।
একটা সময় তাদের দিন অনেক খারাপ কেটেছে। তখন কেউই তাদের পাশে ছিল না। বাবার ছায়া মাথার উপর থেকে উঠে যাওয়ার পরেই বুঝেছে জীবন আসলে কত কঠিন। টাকা কামানো যে তার থেকেও বেশি কঠিন এটাও বুঝেছে কাজ খুঁজতে নেমেই। মা তখন এমন কোন আত্মীয়র কাছে হাত পাততে বাকি রাখেনি। কিন্তু কেউই তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। বরং সে যখন ছোটখাটো একটা অ্যাড করার সুযোগ পেয়েছে তখন সবাই বলেছে, মিডিয়ায় ভাত নেই। ওসব টিভি সিনেমায় গিয়ে নায়ক হবার স্বপ্ন বাদ দিয়ে তোমার ছেলেকে কোন চাকরি বাকরি খুঁজতে বলো। কত দেখলাম! মানুষ বছরের পর বছর প্রডিউসারদের দরজায় ঘুরেও কোন কাজ পায় না। তোমার ছেলেকে কে কাজ দিবে? ওই জগতে তার চেনাজানা আছে কেউ?
মানুষের কথা অভয় শুনেনি। ভয় অবশ্য একটু লাগছিল। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? ওই একটা অ্যাডই তার কপাল খুলে দিল। এক অ্যাড করেই রাতারাতি ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। আসলে আল্লাহ কখন কার জন্য কী লিখে রাখে তা কেউ জানে না। সেখান থেকে পরপর আরও কয়েকটা অ্যাড করার অফার পেল। আর তারপর সোজা মুভিতে চান্স। হিরো, হিরোইন হিসেবে নতুন মুখ খোঁজা হচ্ছিল। তার অভিনয়টা তখন কাঁচা হলেও তেমন খারাপ করতো না। আসলে তার ভাগ্যটা ভালো।
প্রথম মুভিতেই মুভি পাড়ায় নামডাক পড়ে গেল। সকালের কাছেই চেনা মুখ হয়ে উঠতে লাগল। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ে অভয়ের এত বেশি সাফল্য পাওয়ার পেছনেও একটা কারণ আছে। সে স্ক্রিপ্ট চোজ করতে খুব বেশি সময় নেয়। খুব বেশি কাজ করার চেয়ে বছরে একটা ভালো কাজ আসুক। মানুষ এটাই অনেক দিন মনে রাখবে। মাঝে মাঝে অভয় কোন স্ক্রিপ্ট ফিরিয়ে দিলে প্রডিউসাররা প্রায়ই একটা কথা বলে,

“তুমি যা ছুঁয়ে দিবে তা-ই সোনা হয়ে যায়। তোমার মাঝে কিছু একটা তো বিশেষত্ব আছে। নইলে এত কম সময়ে কেউ তোমার জায়গায় আসতে পারতো না। আরে আমি নিজেই তো দেখেছি। একটা দুইটা হিট মুভি দিয়েও কত জনের ক্যারিয়ার নিভে গেছে। তোমাকে বাংলাদেশের মানুষ এত পছন্দ করে! আর তুমি কি-না এত অল্প কাজ করো। কাজের পরিসীমা বাড়াও ম্যান। লোকে তোমাকে দেখতে হল-এ আসে। কেউ গল্প খুঁজে না।”


“দুপুরের রান্না হয়ে গেছে আপু?”

“হুম। তোর কি কিছু খেতে মন চাচ্ছে?”

“তোমার হাতের পায়েস অনেকদিন খাই না।”

“তুই বোস। আমি এক্ষুনি আসছি। না খেয়ে যাবি না কিন্তু।”

আজকের দিনটা তাকে মনে করিয়ে দেয়, তার এত এত সাফল্য এসবের কোন মানেই নেই। এসবকিছু আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে গেছে। এখন আর এসবের কোন মূল্য নেই। আজ সকাল থেকে অভয়ের মন খারাপ ছিল। ওই ঘটনার পর মন খারাপের কথা ভুলে গিয়েছিল। এখন আবার মন খারাপ ভাবটা ফিরে এসেছে। আপু পায়েস রাঁধলেও খেতে পারবে না সে। অভয় ভাবে, এই জীবন কি সে চেয়েছিল? নাকি এই জীবনে ভালো আছে সে? এখন তার কোনোকিছুর অভাব নেই। তারপরও জীবনে সুখটাই তো নেই।

“স্যার, ওই মেয়েটার সমস্ত ইনফরমেশন চলে এসেছে। মেয়েটার নাম তাসনিয়া জামান তাথৈ। ইংলিশে অনার্স করছে। এবার থার্ড ইয়ার। জন্মস্থান বরিশাল হলেও এখন বোনের সাথে ঢাকায় থাকে। মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মা’র কাছে না রেখে বড় বোন তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। বাবাও গতবছর মারা গেছেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এই মেয়ের বংশের কেউ নেই। তাই মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ থাকারও প্রশ্ন উঠে না। মেয়েটা কেন, কোন কারণে এই কাজটা করেছে তা শুধু এই মেয়েই বলতে পারবে। উনি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে মতোই। ক্লাস, বন্ধুদের সাথে ঘোরাফেরা, আড্ডাবাজি এসব করেই দিন কাটায়। বয়ফ্রেন্ডও নেই।”

এখানে এসেই হাত উঁচিয়ে নোমানকে থামতে বলা হলো। এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে কি নেই তা জেনে তার কাজ নেই।

“তুমি বলছো এই মেয়েকে কেউ টাকা খাইয়ে আমার পেছনে লাগায়নি?”

“না স্যার। এমনটা হবার সম্ভাবনা খুবই কম।”

“এই মেয়ে এখন থাকে কোথায়? বোনের বাড়ির এড্রেস পেয়েছ?”

“জি স্যার।”

“ঠিক আছে। তাহলে ওই মেয়ের মুখ থেকেই শুনব কেন আজকের এই কাজটা করেছে সে। কোন উদ্দেশ্যে? সত্যিই কি ও আমার একজন ফ্যান? নাকি ঘটনা অন্য কিছুও আছে।”

নোমান অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করল,

“স্যার আপনি ওই মেয়েটার সাথে দেখা করবেন!”

“এছাড়া উপায় নেই।”

“মেয়েটার বাড়িতে যাবেন!”

“আমি না গেলে বাড়িটা নিশ্চয় আমার কাছে আসবে না।”

“কিন্তু স্যার মিডিয়া যদি জানতে পারে আপনি ওই মেয়ের বাড়িতে গেছেন তাহলে আপনাদের বিয়ে পড়িয়ে দিতে ওদেরকে কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। আপনার নামে এক দুইটা ছেলেমেয়েও জন্ম দিয়ে দিবে। না না স্যার। আপনার যেতে হবে না। বাড়ি আপনার কাছে না আসলেও মেয়েটা আসতে পারবে।”

“তাহলে সেটাই করো। মেয়েটার উদ্দেশ্য জানা জরুরি। এমন কাজ কিন্তু এই মেয়েই প্রথম করেছে। এই কথাটা মাথায় রেখো। অনেকেই আমাকে মিডিয়ার সামনে প্রেম নিবেদন করেছে। বিয়ে প্রপোজালও দিয়েছে। কিন্তু কেউ এটা বলতে পারেনি আমি কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি। কাউকে ধোঁকা দিয়েছি। এমন অভিযোগ এর আগে কেউ আমার উপর লাগায় নি।”

চলবে
Jerin Akter Nipa