যতনে রাখিবো পর্ব-১৩+১৪

0
75

#যতনে_রাখিবো

১৩
অভয় ক্যাপ, মাস্ক পরে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে যেন কোন চোরাবালিতে ফেঁসে গেছে মনে হচ্ছে। যতই সব ক্লিয়ার করতে চাচ্ছে ততই জিনিস আরও প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে। অভয় গাড়িতে থাকতেই লোপার কল এসেছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে অভয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিরক্তি নিয়ে উচ্চারণ করল,

-এ আবার কী চায়!

কল রিসিভ করলেও অভয় কিছু বললো না। লোপার সাথে কথা বলার কোন রুচি নেই। কিন্তু এই পাগল আরও কী করতে চায় তা জেনেই নেক্সট স্টেপ নিতে হবে।

-তুমি আমার ভালোবাসা ওই দুই পয়সার মেয়েটার জন্য ফিরিয়ে দিয়েছ অভয়! কে ওই মেয়ে? কী ওর পরিচয়? তোমার রুচি এতটা খারাপ হয়ে গেছে আমি ভাবতেই পারছি না।

অভয়ের ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল। নেহাৎ ছোটবেলায় বাবা মা তাকে মেয়েদের সাথে সম্মান রেখে কথা বলতে শিখিয়েছিল। নয়তো লোপার কথার জবাবে অভয়ও এমন কিছু বলতে পারবো যাতে লোপা অন্য কারো ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলার সাহস পেতো না।

-রুচি খারাপ বলেই এখনও তোমার সাথে কথা বলতে হচ্ছে।

-তুমি ওই মেয়েটার সাথে আমাকে কম্পেয়ার করছো! আমাকে? লোপা চৌধুরীকে?

-কী বলতে কল করেছ বলে লাইন কাটো।

-ওই মেয়েটাকে তুমি কেন তোমার ফ্ল্যাটে রেখেছো? ওই মেয়ের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?

-আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে প্রশ্ন করার তুমি কে? এই অধিকার আমি তোমাকে দিয়েছি?

-তোমার সবকিছুর উপর শুধুমাত্র আমার অধিকার। অন্য কোন মেয়ে তোমার জীবনে আসতে পারবে না।

-ইউ নিড হেল্প লোপা। ভালো কোন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে দেখা করো।

-তুমি কি ভেবেছো অন্য কারো সাথে আমি তোমাকে সুখী হতে দিব? তুমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবে? ওই মেয়েকে বিয়ে করে প্রমাণ করবে আমাদের মাঝে কিছু ছিল না।

লোপা আরও অনেককিছু বলে যাচ্ছে। কিন্তু অভয়ের সুঁই এই একটা কথাতেই আটকেছে। লোপা নিজেই তো তার সমস্যার সমাধান দিয়ে দিয়েছে। অভয় বাঁকা হেসে বলল,

-থ্যাঙ্কস লোপা। সমাধান তুমি নিজেই দিয়ে দিয়েছ।

-আমি তোমাকে ছাড়ব না অভয়। তোমাকে সহ তোমার ফ্যামিলিকেও রাস্তায় নিয়ে আসব। ভালোবাসা গ্রহণ করোনি, ঘৃণা সহ্য করার জন্য তৈরি থাকো।

অভয় ড্রাইভ করে সোজা নিজের ওই বাড়িতে এসেছে যেখানে তাথৈরা থাকছে। দরজায় অভয়কে দেখে তানিয়া মুখ হাঁ করে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সবথেকে পছন্দের নায়ক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। অভয় খান সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! এতদিন যে মানুষটাকে শুধু টিভিতেই দেখেছে আজ হঠাৎ সে সামনে চলে এলে ধাক্কা তো পাওয়ারই ছিল। অভয় নিজেও বুঝতে পারছে তার এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। এটা নিশ্চয় তাথৈয়ের বোন। এভাবে বেশিক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না। অভয় সামান্য হেসে বলল,

-ভেতরে আসতে পারি?

তানিয়ার হুঁশ ফিরল। নিজের আচরণে লজ্জিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

-হ্যাঁ হ্যাঁ। প্লিজ আসুন।

তানিয়ার অভয়কে দেখাই শেষ হচ্ছে না। টিভিতেও হ্যান্ডসাম লাগে। কিন্তু সামনে থেকে তো আরও বেশি হ্যান্ডসাম দেখতে। তানিয়ার অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে অভয় নিজেও ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হচ্ছে। তানিয়ার স্বাভাবিক ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা থাকলে এতক্ষণে প্রশ্ন করত অভয় হঠাৎ কেন এসেছে। কিন্তু বেচারি ফ্যান গার্ল। অভয় বনিতা না করে নিজের কাজের কথা জানাল।

-তাথৈ আছে?

অভয়ের মুখে তাথৈয়ের নাম শুনে তানিয়ার মনে পড়ল তাথৈ নতুন করে আবার কী অঘটন ঘটিয়েছে। পছন্দের নায়কের প্রতি সব মুগ্ধতা সাইডে রেখে কৈফিয়তের সুরে তানিয়া বলা শুরু করল,

-তাথৈ! আপনি তাথৈয়ের কাছে.. না মানে আপনি নিশ্চয় দেখেই এসেছেন। বিশ্বাস করুন আমার বোন কোনকিছু ইচ্ছে করে করছে না। ও আদতেই এমন গাধা। এমন এমন সব কাজ করে বসে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। ভিডিওটা তাথৈ ওর এক বান্ধবীকে দিয়েছিল। সেখান থেকেই কোনভাবে লিক হয়ে গেছে। তাথৈ এসবের কিছুই জানতো না। আমি ওকে অনেক বকেছি।

অভয় বুঝতে পারছে তানিয়া হয়তো ভাবছে সে তাথৈকে শাসাতে বা ধমকাতে এসেছে। তাই আগে থেকেই ভুল স্বীকার করে নিচ্ছে। অভয় তানিয়ার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট নরম কন্ঠে বলল,

-ওসব কোন ব্যাপার না। আমি উনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

-ক-কথা বলবেন! ঠিক আছে। তাথৈ ঘরেই আছে। আমি ওকে ডাকছি।

-আমি উনার সাথে একা কথা বলতে চাই।

একা কথা বলবে! কী কথা বলবে?
তানিয়া তাথৈকে ডাকলে তাথৈ পিঠে হাত দিয়ে বলল,

-আবার কেন ডাকছে? এবার আপুর সামনে গেলে পিঠে ছালা বেঁধে যাব।

তাথৈ বেরিয়ে এলে তানিয়া জাস্ট এটুকু বলার সুযোগ পেলো ওর সাথে অভয় খান দেখা করতে এসেছে। এটা শুনেই তাথৈ বোনের হাত চেপে ধরল। বিড়বিড় করে বলল,

-আমি উনার যা যা ক্ষতি করেছি, আমি দুইশো পার্সেন্ট শিওর উনি আমার নামে কেস করে দিবেন।

তানিয়া চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-শুধু কেস! তোকে তো মা-র্ডা-র করা উচিত।

আপু থাকলেও তাথৈয়ের একটা ভরসা থাকত। কিন্তু একা ঘরে লোকটার সাথে কথা বলতে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাথৈ চোখ তুলে অভয়ের দিকে তাকানোর সাহস করছে না যদি চোখাচোখি হয়ে যায়। পায়ের নখ দিয়ে টাইলসে খুঁটছে। অভয় অবশ্য মনোযোগ দিয়ে তাথৈয়ের প্রতিটা মুভমেন্ট লক্ষ করছে। ঘনঘন ঢোঁক গেলা, হাত কচলানো, চঞ্চল চোখের দৃষ্টি কিছুই চোখ এড়াচ্ছে না। দু’জনের দিক থেকে কেউই আগে কথা শুরু করছে না। তাথৈ মনে মনে ভাবছে,

-কিছু বলছে না কেন? নাকি কথায় না কাজে অ্যাকশন দেখাবে। সাথে ছু-রি টুরি নিয়ে আসেনি তো!

তাথৈ সাহস করে অভয়ের দিকে তাকিয়েই ফেলল। দৃষ্টি লুকিয়ে লাভ নেই। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কিছু একটা তো বলতেই হবে। তাথৈ মুখ খোলার আগেই অভয় সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটা করলো তা হলো,

-আমাকে বিয়ে করবেন?

অভয়ের মুখ থেকে উচ্চারণ হওয়া তিনটা শব্দ তাথৈয়ের কানে বুলেট হয়ে ঢুকলো। কয়েক মিনিটের জন্য চারপাশ শব্দ শূন্য হয়ে গেল। তাথৈ হতভম্ব চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি ঠিক শুনেছে! তাথৈ মনে মনে ভাবল,

-না না। ঠিক শোনার প্রশ্নই আসে না। ভুল শুনেছি। আমার কানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কালই ডাক্তার দেখাতে হবে।

অভয় জানে তার প্রস্তাবে ঝট করে কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব না। সে কোন সাধারণ প্রস্তাব রাখেনি। তাথৈ এখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। একটুও নড়াচড়া নেই। ঠিক যেন পাথরের কোন মূর্তি। অভয় সময় দিচ্ছে। কিছুটা সময় পর নিজেকে সামলিয়ে তাথৈ দ্বিধান্বিত ভাবে প্রশ্ন করল,

-আপনি কিছু বলছিলেন?

-জি।

তাথৈ অভয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভাবে হাসল। আমতা আমতা করে বলল,

-আমি মনে হয় ঠিক করে শুনিনি। আবার একটু বলবেন।

অভয় তাথৈয়ের চোখে চোখ রেখে একটু সময় নিয়ে বলল,

-ভুল শোনেননি। আপনি যা শুনেছেন আমি সেটাই বলেছি।

তাথৈয়ের চোয়াল ঝুলে গেল। এই বেডা বলে কী! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? থতমত খেয়ে তাথৈ বলে বসল,

-আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কেন! আপনার কি গার্লফ্রেন্ডের অভাব আছে?

অভয় শান্ত চোখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এর থেকেও বেশি কিছু আশা করছিল সে। কিন্তু তাথৈ তার পক্ষে কমই বলেছে। এই লোক কী চাচ্ছে তাথৈ এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। এখানে কি কোন মুভির শুটিং চলছে? নাকি সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে?

—–
অভয় বিয়ের কথা জানালে একমাত্র মিম ছাড়া সকলেই কতক্ষণ নীরবতা পালন করলো। কিন্তু মিম সাথে সাথেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে একসাথে শত কয়েক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলল।

-তুমি সত্যিই বিয়ে করবে ভাইয়া! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কানে ভুল শুনেছি। কবে বিয়ে করবে? পাত্রী কে? এত জলদি এসব কীভাবে হলো?

মিমের আগ্রহে পানি ফেলে দিয়ে আয়েশা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল অভয় সত্য বলছে কিনা।

-তুই কি মিডিয়ার চাপে পড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? মিথ্যা বলবি না কিন্তু।

অভয় বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারলো না। কিন্তু সত্যও বললো না। মিম দেখতে পাচ্ছে ভাইয়ার মত ঘুরে যাচ্ছে। তাই বোনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-আপু তুমি না! আজব কথা বলো। মিডিয়ার চাপে কেন বিয়ে করবে? ভাইয়া সত্যিই মনে হয় কোন মেয়েকে পছন্দ করে।

-তুই চুপ থাক। তোকে কথা বলতে বলেছি?

দুই বোন ঝগড়া লেগে যাবে অবস্থায় অভয় বলল,

-কারো চাপে বা নিজের মতের বিরুদ্ধে কিছুই করছি না।

মিম বড় বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ মুচড়ে বলল,

-দেখলে তো। তুমি খালি বেশি ভাবো।

আয়েশা নিজেও চায় তার ভাইয়ের সংসার হোক। তার ভাই জীবনে অনেক খুশি থাকুক। এতদিন তারা বললেও অভয় না করে দিয়েছে। কিন্তু আজ নিজে থেকে বলছে দেখেই খটকা লাগছে।

-আচ্ছা তোর কথাই মানলাম। মেয়ে কে? কোন হিরোইন?

মিম আগ্রহ নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাইয়ের পছন্দ নিশ্চয় সাধারণ হবে না।

-মিডিয়া জগতের কেউ না।

আয়েশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অভয় কোন নায়িকাকে বিয়ে করতে চাইলেও সে আপত্তি করত না। কিন্তু মনে মনে একটা আফসোস থেকেই যেত। কারণ তার ভাইয়ের জন্য ওই মেয়ে নিশ্চয় ক্যারিয়ার ছেড়ে দিত না।

-মেয়েটার পরিচয়, ঠিকানা দে। আমরা ওদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাই। তুই যাকেই পছন্দ করেছিস আমরা তাকে মেনে নিব। তোর সুখের উপর আমাদের কাছে কিছু নেই। শুধু তুই ভালো থাকিস।

বোনের কথা শুনে অভয় মনে মনে বলল,

-সরি আপু। বিয়েটা আমি কেন করছি তার আসল কারণ তোমাদের বলতে পারব না। কিন্তু এই সিচুয়েশনে এছাড়া আমার কাছে সেকেন্ড আর কোন অপশন নেই।

চলবে

#যতনে_রাখিবো

১৪
তানিয়া চোখের ইশারায় হারুনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এলো। মেহমানের সামনে থেকে উঠে হারুন স্ত্রীর কাছে এলে তানিয়া খপ করে হারুনের হাত চেপে ধরে চাপা গলায় বলে উঠল,

-এসব কী হচ্ছে? উনারা কি সত্যিই অভয় খানের বোন!

হারুন মুচকি হেসে মজা করে বলল,

-ডিএনএ টেস্ট করা ছাড়া কীভাবে বুঝবো? তবে উনারা যখন বলছেন তাহলে হয়তো সত্যিকারের বোনই হবে।

তানিয়া চোখ গরম করে হারুনকে দেখে বলল,

-এই সময়ও তুমি মজা করছো! ওরা সত্যিই আমার তাথৈয়ের বিয়ের জন্য এসেছে! আমাকে একটা চিমটি কাটো তো। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

তাথৈ ভেতরে ভেতরে ভীষণ নার্ভাস হচ্ছে। দুলাভাই তাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেল? যদিও এব্যাপারে নায়কের সাথে আগেই কথা হয়েছে। কিন্তু উনার বোনদের সামনে বসে থাকতে নার্ভাস লাগছে। তাথৈকে মিমের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আয়েশার কথা বলা যাচ্ছে না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাথৈকে পরখ করছে। নোমান এখানকার পরিস্থিতি ফোনে অভয়কে জানাচ্ছে।

-স্যার, স্যার শুনছেন?

-এরকম ফিসফিস করে কথা বললে কীভাবে বুঝবো গাধা? যা বলার স্পষ্ট করে বলো।

-কীভাবে বলবো? আপনার বোনরা সামনে বসে আছে।

-ওখানকার সিচুয়েশন কী?

-শেয়ালের সামনে মুরগী বসে আছে। শেয়াল যেকোনো সময় মুরগির উপর হামলা চালাতে পারে। স্যার আপু ডাকছে। এখন ফোনে কথা বলছি দেখলে আমাকেই মুরগী বানিয়ে দিবে।

নোমান কল কেটে দিলে অভয় কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

-এই ছেলে কি সত্যিই পাগল!

ভাইয়ের পছন্দই দুই বোনেরও পছন্দ। আয়েশা এই বিয়েতে মন থেকে খুশি হতে না পারলেও তার আচার-আচরণে বা কথাবার্তায় তা প্রকাশ পেতে দিল না। এই পরিবারকে অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। মেয়ের বোন যথেষ্ট ভালো মানুষ। মিশুকও অনেক। কিন্তু তাথৈকে আয়েশার একটা কারণেই অপছন্দ। যদিও আয়েশা এখনও মানতে নারাজ এই মেয়ের সাথে অভয়ের কোন সম্পর্ক আছে। আর যদি সম্পর্ক থেকেও থাকত তাহলে মেয়েটা পারিবারিক ভাবে সেটা সামনে আনার চেষ্টা না করে এত এত মানুষের সামনে তার ভাইয়ের নামে ভুলভাল অভিযোগ তুলে বসলো। মিম তাথৈকে এটা সেটা নানান প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আর প্রশ্ন গুলো সব তার ভাই সম্পর্কিত।

-তুমি ভাইয়াকে পছন্দ করো?

-উনাকে কে না পছন্দ করেন!

তাথৈয়ের জবাব শুনে মিম হেসে বলল,

-আরে সেরকম পছন্দ না। আচ্ছা পছন্দ শব্দটা বদলে ফেলি। তুমি ভাইয়াকে ভালোবাসো?

তাথৈ ভাবছে, এ কোন মুসিবতে পড়ে গেল সে! জীবনে কখনও মিথ্যা বলেনি এমন সাধুও সে না। কিন্তু আজকের মতো এতগুলো মিথ্যে কথা একসাথে কখনও বলেনি। ওই নায়ককে ভালোবাসা তো দূর ঘৃণা করারও সময় নেই।

-তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি! কী মুশকিল। আমার সামনে লজ্জা কী?

তাথৈ জোর করে মুখে হাসি রেখে বলল,

-হুম ভালোবাসি।

-যাক এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। তুমি দেখো, আমার ভাই তোমাকে অনেক ভালো রাখবে।

মনে মনে তাথৈ নিজেকেই বলল,

-তোর ভালো থাকার দিন শেষ হয়ে আসছে রে তাথৈ।

তাথৈ খুশি খুশি বনে গিয়ে সন্ন্যাস নিয়ে নিত তবুও অভয় খানকে বিয়ে করার কথা ভাবতো না। কিন্তু কী করার? ভাগ্য তাকে এমন প্যাঁচে ফেলেছে এছাড়া কোন উপায় নেই। গতকাল অভয় তাকে বিয়ের প্রপোজাল দিলে তাথৈ সাথে সাথে না করে দিয়েছে।

-কী আজব! আপনি ভাবলেন কীভাবে আমি আপনাকে বিয়ে করবো। দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে আমার আপনাকে বিয়ে করতে হবে?

মুখ ফসকে কথাগুলো বলে ফেলেও তাথৈ জিভ কামড় দিল। লোকটার বাড়িতে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। অভয় জানত না কোন মেয়ে তাকে এভাবেও রিজেক্ট করতে পারে। ব্যাপারটা তার কাছে আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাথৈ কথা ঘুরিয়ে আবার বলে উঠল,

-না মানে আপনিই বা আমাকে বিয়ে করবেন কেন? আমাদের কোন মিল নেই। স্ট্যাটাস বলুন আর পছন্দের বলুন। সবকিছুতেই আপনার সাথে আমার যায় না।।

অভয় শান্ত মুখে তাথৈয়ের কথাগুলো শুনলো। একটু সময় নিয়ে বলল,

-আমাদের হয়তো কোনকিছুতে মিল নেই।

অভয়ের কথার মাঝখানেই তাথৈ বলে উঠল,

-ঠিক বলেছেন। সত্যিই কোন মিল নেই।

-কিন্তু বিয়ে করা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হবারও কোন উপায় নেই। যা কিছু ঘটছে তা শুধু আমাদের নিয়ে না। দুই পরিবারও এসবে জড়িয়ে গেছে। মিডিয়া তখনই শান্ত হবে যখন আপনার আমার মাঝে কোন সম্পর্ক খুঁজে বের করতে পারবে। তাই দু’জনের দিক ভেবেই…

-অসম্ভব। মিডিয়ার যা খুশি মন চায় করুক। কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

অভয় কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাথৈকে দেখছে। যেখানে দেশের ৯৯% মেয়ে তাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। লোপার মতো সাইকো হয়ে পেছনে পড়ে যায়। সেখানে তাথৈ এই সুযোগ পেয়েও মুখের উপর না করে দিচ্ছে!

-জীবন ধ্বংস করার আরও অনেক পছন্দ আছে। তার জন্য আমার আপনাকে বিয়ে করতে হবে না।

ব্যাটা কেমন চোখে তাকেই দেখছে বুঝতে পেরে তাথৈ আমতা আমতা করে বলল,

-না মানে, আপনি কোথায় আর আমি কোথায়? আপনি সুপারস্টার, আমি আমজনতা। আপনি এসি গাড়িতে চরেন, আমার রিকশা পছন্দ। আপনার পেছনে দেশের অর্ধেক মেয়েরা পাগল। আমাকে তো আমার ক্রাশই পাত্তা দেয় না। তাছাড়া এত স্টারডম ওয়ালা লোক আমার পছন্দ না। আপনিও অল্প দিনেই আমার উপর বিরক্ত হয়ে যাবেন। পাছে ডিভোর্সি ট্যাগ থেকে ভালো আমি কুমারীই থেকে যাই।

তাথৈ ভাবছে লোকটাকে সেদিন এত লেকচার দিয়েও লাভ কী হলো? সেই তো রাজি হতেই হলো। যদিও জানে এই বিয়েটা সত্যি না। মানুষের সামনে বিয়ের নাটক করবে। তারপর সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে সে তার পথে। নায়ক ব্যাটা গোল্লায় যাক। তাথৈ এটা শুধুমাত্র নিজের পরিবারের জন্য করছে। কতদিন এভাবে বাড়ি ছেড়ে অন্যের আশ্রয়ে থাকবে? বিয়েই যদি সমাধান হয় তাহলে এটাই সই।


অভয় খান বিয়ে করছেন এর থেকে হট নিউজ আর কী হতে পারে? অসংখ্য রমণীর মন ভেঙে কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন অভয় খান? কে সেই ভাগ্যবতী? মিডিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেছে। এতে আগের সব কন্টোভার্সি ঢাকা পড়ে গেছে।
তাথৈ গালে হাত দিয়ে টিভিতে এসব নিউজ দেখছে। আর ভাবছে,

-ব্যাটা বদের হাড্ডির প্ল্যান কাজ করেছে। কিন্তু তুই কী করছিস তাথৈ? সত্যিই ওই বেটারে বিয়ে করবি তুই!

তানিয়া হারুনের সাথে ফিসফিস করে কোন বিষয়ে আলোচনা করছে। সাথে খেয়ালও রাখছে এসব কথা তাথৈ যেন শুনতে না পায়।

-ওদের বয়সের পার্থক্যটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

-দূর! কী যে বলো। নায়কদের বয়স বাড়ে না। অভয় খান দেখবে আরও পাঁচ /ছয় বছর পরেও এরকমই থাকবে। বুড়ো হবে না, উল্টো আরও ইয়াং হবে।

-তাথৈ তো অভয় খানকে পছন্দ করত না। অভয় খানের কোন মুভি দিলেই টিভি অফ করে দিত। তাহলে হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে গেল কেন?

-তোমার বোনের পছন্দের কোন ঠিক আছে? আগে পছন্দ ছিল না। এখন হয়তো পছন্দ।

-তুমি যত যা-ই বলো, সবকিছু আমার কাছে কেমন সন্দেহজনক লাগছে।

হারুন হেসে বলল,

-সন্দেহজনক লাগছে কারণ আমার বউ ইদানিং খুব বেশি সন্দেহবাতিক হয়ে গেছে।

-তাথৈ তো আমাকে কিছু বলবে না। তুমি জিজ্ঞেস করো না।

-কী জিজ্ঞেস করবো?

-বিয়েটা কেন করছে?

হারুন হতাশ হয়ে বলল,

-ঘুরেঘুরে তুমি সেই আগের কথাতেই চলে এলে। ঠিক আছে। আমি তাথৈয়ের সাথে কথা বলবো।

—-
বিয়েটা শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য হলেও ধীরে ধীরে যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে টেনশনে তাথৈয়ের নাওয়াখাওয়া কমে যাচ্ছে। সুপারস্টারের নকল বউ হওয়াও নিশ্চয় ফুচকা চটপটির মতো মজাদার হবে না। তাথৈয়ের এটা ভেবেই পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, বিয়ের পর চাইলেও সে সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা চটপটি খেতে পারবে না।

-নেহিই! আমি সাধারণই ঠিক আছি। সুপারস্টারের বউ হয়ে নিজের স্বাধীনতার দাফন করতে পারবো না।

এমন সময় তানিয়া তাথৈয়ের ঘরে একজন মহিলাকে নিয়ে ঢুকলো। মহিলার দিকে তাকিয়ে তাথৈয়ের চোখ জ্বলে গেল। বাবারে বাবা! এত কড়া লিপস্টিক। ঠোঁটে কি র’ক্ত মেখে এসেছে। কাঁধ সমান ঝাড়ুর মতো চুল গুলোও লাল রঙের। পরনের পোষাক নাউজুবিল্লাহ মার্কা। এটা মানুষ না তেঁতুল গাছের পেত্নী। তাথৈয়ের চেহারার এক্সপ্রেশন দেখে তানিয়া চোখ পাকিয়ে তাকাল। তাথৈ মুখের ভাবভঙ্গি সহজ হয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে মহিলা বিদেশি কায়দায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেয়ে বলল,

-হ্যাল্লো বিউটিফুল! আমি জানতাম, অভয় সবসময় বেস্টটাই পছন্দ করে। তোমাকে দেখে আর কোন সন্দেহ রইল না।

হাই হ্যালোর পর্ব শেষ হলে তাথৈ জানতে পারল বিয়ে পর্যন্ত এই মহিলা এখানেই থাকবে। তাথৈ চাপা স্বরে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

-এসব কী আপু?

-আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোর হিরোকে জিজ্ঞেস কর। তোর হিরোই উনাকে এখানে পাঠিয়েছে।

-কেন?

দুই বোনের কথার মাঝখানেই মহিলা তাথৈয়ের সামনে চলে এলো। তাথৈ হাত ধরে টেনে তানিয়ার থেকে দূর দাঁড় করালো। ঘুরে ঘুরে তাথৈয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,

-তোমার ডায়েট চার্ট আমাকে দেখিয়ো তো।

-আমি ডায়েট ফলো করি না।

মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়ল৷ অবাক হয়ে বলল,

-বলো কী? ডায়েট ফলো করা ছাড়া এরকম ফিট আছো কীভাবে!

তানিয়া বিড়বিড় করে বলল,

-পুষ্টিহীনতায় ভোগাকে ফিট থাকা বলে! কী দিনকাল আসলো। মেরে ধরেও একে তিনবেলা খাওয়াতে পারি না। সেজন্যই তো শরীর স্বাস্থ্যের এই অবস্থা।

-তোমার আর ডায়েটের প্রয়োজন নেই। এর থেকে বেশি স্লিম হলে শরীরে মাংস পাওয়া যাবে না। কিন্তু স্কিনের এ কী হাল করে রেখেছ! একদম কেয়ার নাও না মনে হয়। প্রবলেম নেই। এখন তো আমি চলে এসেছি। দেখবে তোমার স্কিন দুই দিনে কেমন গ্লো করা শুরু করে।

তাথৈ মনে মনে অভয়ের উপর রাগে ফেটে পড়ছে। মহিলা ঘর থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে অভয়কে কল লাগাল।

-আপনার উদেশ্য কী বলুন তো? নতুন করে এ কোন মুসিবত আমার গলায় বেঁধে দিলেন!

তাথৈয়ের উত্তেজিত কন্ঠ শুনেই অভয় বুঝে গেছে। মুচকি হেসে সে বলল,

-জো পৌঁছে গেছে?

-কে জো? কোন জো?

-জুহি যায়নি তোমার ওখানে?

তাথৈ খেয়াল করলে বুঝতে পারল অভয় কার কথা বলছে।

-লাল চুল ওয়ালা মহিলাটা?

-হুম। ওর নাম জুহি। তবে তুমি কিন্তু জুহি বলে ডেকো না।

-কেন? যার যে নাম সেটা ধরেই তো ডাকবো।

-জুহি বললে জো রেগে যায়। এখন তুমি বুঝো কী বলে ডাকবে।

তাথৈ লক্ষ্যই করেনি অভয় আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে।

-জো জুহি যেটাই হোক। আপনি উনাকে কেন পাঠিয়েছেন?

-আমি পাঠায়নি। নোমানের কাজ এটা।

-যারই কাজ হোক। আমার কোন বিউটিশিয়ান বা ডায়েটিশিয়ান এর প্রয়োজন নেই। আমাকে আমার মতো করে গ্রহণ করতে আপনার স্টারডমে বাঁধলে বিয়ে ক্যান্সেল করে দিন। যদিও এটা কোন সত্যিকারের বিয়ে না। কিন্তু আমি আমার হাত-পা, নখ, চুল, স্কিনের উপর কোন অত্যাচার সহ্য করব না।

কথাগুলো বলেই তাথৈ কল কেটে দিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগল।

চলবে
Jerin Akter Nipa