#যতনে_রাখিবো
৯
এই কাঁঠাল পাকা গরমের মাঝেও তাথৈয়ের শীত লাগছে কেন বুঝতে পারছে না। এতক্ষণ ঘামছিল। এখন থরথর করে কাঁপতে ইচ্ছে করছে। গাড়িতে এসি চালু করা মনে হয়। তাথৈ চোখ তুলে লোকটার দিকে তাকাতে পারছে না। কথা বলবে বলে ডেকেছে। এখন কথাই বলছে না। অভয় কথা শুরু করার আগে মেয়েটার হাবভাব পরখ করে নিচ্ছে। যদিও নোমান আগেই সব ইনফরমেশন জোগাড় করে ফেলেছিল।
তাথৈ নতমুখে বসে হাতের নখ খুঁটছে। কথা শুরু করতে আর কতক্ষণ সময় নিবে?
“আপনি আমাকে চিনেন?”
প্রশ্নটা শুনে তাথৈ ঝট করে মাথা তুলে তাকিয়েছিল। কিন্তু অভয়ের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। উত্তর দেওয়ার আগে মনে মনে বলল,
“লোকটা আমার সাথে মজা করছে! এটা জিজ্ঞেস করার মতো কোন প্রশ্ন ছিল? নাকি নিজে কতটা ফেমাস এটা বোঝার চেষ্টা করছে।”
অভয়ও বুঝলো প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। গলা খাঁকারি দিয়ে প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলল,
“ফরগেট ইট।”
“হুম।”
মেয়েটার সাথে কথা বলতে অভয় নিজেও গুলিয়ে যাচ্ছে। যে প্রশ্ন গুলো করতে চাচ্ছিল তা কঠিনভাবে করা যাচ্ছে না। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত তো তাথৈ সেই কবেই হয়েছে। এখন লোকটা তাকে সাবান ছাড়া ধোয়ার আগেই স্যরি বলে ফেলা ঠিক নয় কি?
“দেখুন…
” শুনুন…
নীরবতাও দু’জন একসাথেই ভাঙলো। এতক্ষণ কেউ কথা বলছিল না। এখন যা-ও বলেছে দু’জন একসাথে। তাথৈ লোকটাকে কথা বলার কোন সুযোগই দিতে চাইল না।
“দেখুন, আমি জানি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন। তাই কষ্ট করে আপনাকে আর বলতে হবে না। ওই দিনের ঘটনা নিয়েই আজকের এই মিটিং তো। কসম করে বলছি, আপনার দুর্নাম করার আমার কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। ফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়ে না বুঝে জাস্ট একটা ছেলেমানুষী করে ফেলেছি। আপনার জন্য হয়তো স্যরি অনেক ছোট শব্দ হয়ে যাবে। আপনার যেটুকু ক্ষতি হয়েছে আমার স্যরি দিয়ে পূরণ হবে না। আপনি হয়তো আমার স্যরি একসেপ্টও করবেন না। যদিও আমিও আপনার থেকে কম ভুগিনি। গতকাল সকাল পর্যন্ত মিডিয়া আমার দরজার সামনে থেকে নড়েনি। আমি ভাগ্নে স্কুলে যেতে পারেনি। দুলাভাই অফিসে যায়নি। আপু সারাদিন বকে বকে আমার জান বের করে ফেলছিল। আমি বাড়ি থেকে বেরুতে পারছিলাম না। সেদিক থেকে ভিক্টিম কিন্তু আমিও ছিলাম।”
তাথৈ এক দমে কথাগুলো বলে ফেলে হাঁপাচ্ছে। অভয় খানিকটা বিস্মিত হয়ে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটা ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। তাথৈয়ের গলা শুকিয়ে গেছে। নায়ক ব্যাটা কি তার কথা বিশ্বাস করেছে? বিশ্বাস না করলেও তার কিছু করার নেই। পুরো সত্যি বলে দিয়েছে। এখন বিশ্বাস করা না করা উনার ব্যাপার।
এদিকে নোমান গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটার চিন্তায় অস্থির হচ্ছে। যদিও জানে স্যার মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। যথেষ্ট ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলে। কিন্তু রেগে গেলে যে স্যারের অন্য রুপ বেরিয়ে আসে। তখন সামনের মানুষটা ছেলে না মেয়ে তা দেখার প্রয়োজন মনে করে না।
“আমারই ভুল হয়েছে। স্যারের সাথে উনাকে একা ছাড়া একদমই ঠিক হয়নি।”
নোমানের কথা বলার মাঝেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। তাথৈকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নোমান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তাথৈয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নোমান বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা কেঁদেছে কি-না। নোমানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাথৈ জিজ্ঞেস করল,
“আমার মুখে কিছু লেগে আছে?”
নোমান কাচুমাচু মুখে বলল,
“জি।”
তাথৈ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“কী লেগে আছে? কোথায়?”
“গালের ডান পাশটায়। মনে হয় জুতার কালি।”
সত্যিই গালে কালি লেগে আছে কি-না দেখার জন্য তাথৈ গাড়ির জানালার কাঁচের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হায় আল্লাহ! সত্যিই তো কালি লেগে আছে। এভাবেই ওই নায়ক ব্যাটার সামনে বসে ছিল! তাথৈ নোমানের সামনে ফিরে এসে প্রায় ধমকানোর মতো বলল,
“কালি লেগে আছে এই কথা আপনার স্যারের সামনে যাবার আগে বলতে পারলেন না।”
“তখন খেয়াল করিনি ম্যাম। ম্যাম যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? স্যারের সাথে আপনার কী কথা হয়েছে?”
তাথৈয়ের সব রাগ নোমানের উপর পড়েছে। তাকে নিশ্চয় জোকার লেগেছে। মানুষের সামনে হাসির পাত্র হয়েছে সে। তাই তাথৈ রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই কথা আমাকে জিজ্ঞেস না করে আপনার স্যারের থেকেই জেনে নিন।”
তাথৈ চলে যাবার পর অভয় ওর কথাই ভাবছিল। জীবনে এতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে যে, এখন মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে কোনটা সত্যি বলছে আর কোনটা মিথ্যা। মেয়েটা মিথ্যা বলেছে বলে মনে হয় না। অভয়কে ভাবনা থেকে বের করে আনার জন্য নোমানের একটা ডাকই যথেষ্ট ছিল।
“স্যার!”
“চেঁচাচ্ছ কেন গাধা।”
“স্যার আপনি কি মেয়েটাকে ধমকেছেন?”
“আজ ছোট বোনের ওখানে চলো। এখনও মিমের রাগ ভাঙানো হয়নি।”
“স্যার আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন। তার মানে…
“নোমান তোমার কি সত্যিই চাকরির মায়া চলে গেছে?”
“এটা কিন্তু ঠিক না স্যার।”
“কোনটা ঠিক না?”
____
অভয়ের সাথে দেখা করা বা কথা বলার সবরকম চেষ্টাই করে ফেলেছে লোপা। তবুও সে অভয়কে ধরতে পারছে না। যত বার ভেবেছে অভয় কল তুলেছে ততবারই ওর ম্যানেজারের কন্ঠ শুনে লোপার গায়ে আগুন ধরে গেছে। অভয় তার সাথে এমনটা করতে পারে না।
“সবকিছু দিয়ে ভালোবাসার পরও কেন তোমাকে নিজের করে পেতে আমাকে এত কষ্ট পোহাতে হচ্ছে অভয়? আমি ছাড়া অন্য কোন নারীকে আমি তোমার জীবনে এলাউ করবো না। তুমি কতদিন আমাকে ইগনোর করবে? সপ্তাহ, মাস, বছর? জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি তোমাকে পাওয়ার চেষ্টা করে যাব।”
____
তাথৈ ভেবেছিল তার জীবন থেকে সব সমস্যা চলে গেছে। এবার আগের মতো খোলা আকাশে উড়তে পারবে। কিন্তু কে জানতো সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। দেরিতে বাড়ি ফেরার কারণে বোনের কাছে বকা খেয়ে বিকালে ঘুমিয়েছিল। কিন্তু ভূমিকম্প মাথায় নিয়ে ঘুম থেকে উঠতে হলো। জেগে বসেই তাথৈ বলতে লাগল,
“ভূমিকম্প! ভূমিকম্প। বাড়ি থেকে বের হও সবাই।”
তানিয়া বোনের পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,
“ভূমিকম্প এবার তোর জীবনে হবে।”
তাথৈ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। যাক প্রাকৃতিক ভূমিকম্প না। কিন্তু তার বোনের আবার কী হয়েছে। কিলটা জোরে লেগেছে।
“ভূমিকম্প না হলে আমাকে এভাবে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেওয়ার মানে কী আপু?”
“তোকে তো ছাদ থেকে ফেলব।”
“হোয়াই সিস্টার হোয়াই!”
তানিয়া ফোনের মাঝে যা দেখালো তা দেখার পরে তাথৈয়ের মাথায় ভূমিকম্প ছাড়াই ছাদ ভেঙে পড়েছে। আজ দুপুরের ঘটনা এটা। নায়ক ব্যাটার সাথে মিটিং শেষ করে গাড়ি থেকে বের হবার সময় কেউ তাদের ছবি তুলে নিয়েছে। তাথৈ হতবুদ্ধি হয়ে নিউজের হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল নীল হলুদ সাংবাদিক গুলো তার আর নায়কের মাঝে গোপন কোন সম্পর্কের কথা তুলে ধরতে চাচ্ছে।
“এটা দেখার পর কী বলবি তুই?”
“আপু বিশ্বাস করো। এসব একদমই সত্যি না। ঘটনা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি।”
“আমাকে নাহয় বোঝাতে পারবি। কিন্তু দুনিয়াকে কীভাবে বোঝাবি তুই?”
“দুনিয়ার মানুষের চিন্তা আমার নেই। তুমি আমার সম্পর্কে কী ভাবো এটা গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।”
তানিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তাথৈ বুঝতে পারছে না কোন ঝামেলার মাঝে ফেঁসে গেছে ও। মানুষ ওর চরিত্র নিয়ে কেমন কেমন সব মন্তব্য করছে। তানিয়া জানে এসব সত্যি না। কিন্তু মানুষ তো তার বোনের চরিত্রের দিকেই আঙুল তুলছে।
“আপু প্লিজ, তুমি প্যানিক না করে আমার কথাটা তো শোনো।”
“সবকিছু তো ঠিক হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছু ঠিক হবে না। তুই কেন অভয় খানের সাথে দেখা করেছিস?”
“আমি দেখা করিনি। উনি আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল।”
“কিন্তু উনাকে নিয়ে তো কেউ কথা বলছে না। সবাই তোর চরিত্রে দাগ লাগাচ্ছে।”
বোনের চিন্তা দেখে তাথৈ চেষ্টা করেও সহজ থাকতে পারছে না। চিন্তা তো তারও কিছু কম হচ্ছে না। সব দোষ ওই নায়কের।
____
নিউজটা দেখার পর থেকে অভয় নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। নোমান আগেই সতর্ক করেছিল। কিন্তু অভয় ভাবেনি এসব কেউ জেনে-বুঝে প্ল্যান করে করছে। নয়তো তাদের আজকের দেখা করার কথাটা কোন মিডিয়া বা কারো জানার কথা না।
“নোমান, জানতে পেরেছ এসবের পেছনে কে আছে?”
নোমান অসহায় মুখে অভয়ের দিকে তাকাল। কল তুলতে তুলতে বেচারার কান দিয়ে এবার রক্ত আসবে।
“একটু সময় লাগবে। কিন্তু মানুষটাকে ঠিকই খুঁজে বের করে আপনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসাবো স্যার।”
“আমি জানি তুমি পারবে।”
অভয়ের হঠাৎ তাথৈয়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল।
-আমিও আপনার থেকে কম ভুগিনি। গতকাল সকাল পর্যন্ত মিডিয়া আমার দরজার সামনে থেকে নড়েনি। আমার ভাগ্নে স্কুলে যেতে পারেনি। দুলাভাই অফিসে যায়নি।
“শিট ড্যাম!”
নোমান অভয়ের দিকে ফিরে বলল,
“কিছু বলেছেন স্যার?”
“ওই মেয়েটার নাম যেন কী নোমান? হ্যাঁ, তাথৈ। আজকের ভেতরে ওদেরকে ওখান থেকে অন্য কোথাও শিফট করাও। মিডিয়া ওদের ছাড়বে না। আমার কাছে পৌঁছানো সহজ হবে না। কিন্তু মেয়েটাকে ছাড় দিবে না।”
চলবে..
Jerin Akter Nipa
#যতনে_রাখিবো
১০
ওই নায়কের সাথে দেখা হবার পর থেকে তাথৈর জীবনের চৌদ্দটা বেজে আছে। জীবনে একফোঁটা শান্তি অবশিষ্ট নেই। নায়ক ব্যাটা আজাব হয়ে তার জীবনে এসেছে। তানিয়া তখন থেকে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। বাবাইয়ের খিদে পেলেও মা’কে বলার সাহস হচ্ছে না। মা’র সামনে গেলেই এখন চড় খেতে হবে। তাই সে খালামনির কাছে চলে এলো।
“খালামনি।”
তাথৈ নিজেও চিন্তিত। মিডিয়া তো জীবন তেজপাতা করেই রেখেছিল। এখন আত্মীয় গুলোও উঠেপড়ে লেগেছে। তাথৈ বাবাইয়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না দেখে বাবাই তাথৈয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকল,
“ও খালামনি!”
“হু, কী বাবা? বল।”
“খিদে পেয়েছে খালামনি।”
তাথৈয়ের নিজের উপর ভীষণ রাগ হলো। তার জন্য সবার জীবনে অশান্তি নেমে এসেছে। আপু সকাল থেকে রান্নাবান্না না করে বসে আছে। দুলাভাই যে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে এটাও সম্ভব হচ্ছে না। তাথৈ বাবাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“নুডলস খাবি?”
“হুম।”
তাথৈ বোনের সামনে দিয়ে রান্নাঘরে যাবার সাহস করল না। তানিয়া যেখানে বসেছিল তার পেছন দিয়ে পা টিপেটিপে রান্নাঘরে চলে এলো।
—–
ঘরের ভেতর শালা দুলাভাইয়ের মাথা কথা হচ্ছে। বাইরে দুই বোন নিজেদের মধ্যে মিটিং করছে। আয়েশা মিডিয়ার এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি নিয়ে ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু মিম অন্য কথা ভাবছে।
“আপু তোমার মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে সত্যিই ভাইয়ার কোন সম্পর্ক নেই?”
বোনের কথা শুনে আয়েশা তেতে উঠে বলল,
“বাজে কথা বললে থাপ্পড় খাবি।”
“না, তুমিই ভাবো না। ওরকম একটা ঘটনার পরেও ভাইয়া কেন মেয়েটার সাথে দেখা করবে?”
“এই তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা তো।”
বোনের রাগ দেখে মিম আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু এই সন্দেহটা তার মন থেকে যাচ্ছে না।
রাদিদ খান গম্ভীর মুখে বসে আছেন। অভয়ের মতো একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পূর্ণ মানুষের থেকে এটা আশা করেননি তিনি। নোমান দু’জনের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই নিরব পরিবেশে তার দম আটকে আসছে। স্যারকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি কোনকিছু নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু নোমান ভাবছে। রাদিদ খান সম্পর্কে তার স্যারের দুলাভাই হলেও প্রফেশনাল লাইফে এই লোক একটা খাটাশ। রাদিদ খানের সাথে দুইটা মুভি সাইন করা আছে। নোমান খুব ভালো করে জানে বর্তমানের এই কন্ট্রোভার্সি গুলো স্যারের ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলবে।
“তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি অভয়।”
দীর্ঘক্ষণ পর রাদিদ নিরবতা ভেঙেছে। অভয় পিঠ সোজা করে বলল,
“তুমিও জানো যা হচ্ছে তা আপনাআপনিই হয়ে যাচ্ছে।”
“হুম। কিন্তু তোমার আরও একটু কেয়ারফুল থাকা উচিত ছিল। ম্যানেজারের কাজগুলো তুমিই করবে তাহলে তোমার ম্যানেজার রাখার প্রয়োজন কী?”
নোমান চোখ ত্যাড়া করে রাদিদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমার চাকরির উপর নজর দিচ্ছিস কেন ব্যাটা?”
“তুমি কেন মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাবে? এসব কাজ তোমার? ওই মেয়েকে যদি কেউ তোমার পেছনে লাগিয়েও থাকে সেটা হ্যান্ডেল করার দায়িত্ব তোমার ম্যানেজারের।”
অভয় নোমানের দিকে তাকিয়ে চতুর একটা হাসি দিয়ে বোঝালো, তোমার চাকরি ডেঞ্জারে নোমান। নোমান তা বুঝতে পেরে করুণ মুখ করলো। অভয় জানালো।
“যা হচ্ছে তাতে ওই মেয়েটারও কোন অবদান আছে বলে মনে হচ্ছে না।”
“কীভাবে শিওর হচ্ছো?”
“তুমিই তো বলো মানুষ চেনার ক্ষমতাটা আমার খুব ভালো আছে।”
“মানলাম। ওই মেয়ে কিছু জানে না। বা ও কিছু করেনি। কিন্তু এসব যে হচ্ছে এগুলো তুমি কীভাবে থামাবে?”
“সময়ের সাথে এমনিই থেমে যাবে। আমাদের কিছু করতে হবে না।”
“অভয় পলিটিক্সে তুমি বরাবরই কাঁচা। ইন্ডাস্ট্রির পলিটিক্স সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। মিডিয়া যেমন কাউকে রাতারাতি উপরে উঠাতে পারে, তেমনই রাতারাতি কাউকে স্টার থেকে মাটিতেও নামাতে পারে।”
“ওসব নিয়ে আমি ভাবি না।”
রাদিদ খান কতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যক্তিগত ভাবে অভয়কে সে খুব কাছ থেকে জানে। নামডাক, খ্যাতি নিয়ে অভয়ের মাথা ব্যথা নেই। পারলে এসব অভয় নিজেই ছেড়ে দিত।
“অভয়, ফ্যামিলি হিসেবে তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি।”
রাদিদের দিকে তাকিয়ে অভয় হেসে বলল,
“তোমার সব পরামর্শই কিন্তু আমার কাজে লাগে।”
“কেউ খুব সহজে পেয়ে যায়। কেউ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পায় না। ব্যর্থ হতে হতে একসময় হাল ছেড়ে দেয়। তোমার জন্য আমার পরামর্শ, যা পেয়েছ তা এত সহজে যেতে দিও না। এখনও অনেকটা পথ বাকি।”
রাদিদ কী বোঝাতে চাচ্ছে তা অভয়ও বুঝেছে। মিম দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এসে বলল,
“তোমাদের মিটিং শেষ না হলেও আর থাকতে পারলাম না। কী এত কথা বলছো বাবা!”
রাদিদ বউয়ের কথার উত্তরে বলল,
“একমাত্র শালাবাবুকে জ্ঞানের বাণী শোনাচ্ছিলাম।”
“তোমার জ্ঞানের বাণী আমার জানা আছে। ওসব জ্ঞান দিয়ে আমার ভাইয়ের কোন লাভ হবে না।”
এতক্ষণে সবার মধ্যে থেকেই সিরিয়াসনেস ভাবটা কেটে গেছে। রাদিদ সামান্য হেসে কৌতুক করে বলল,
“আমার কথা শুনে সত্যিই তোমার লাভ হবে না অভয়। তোমার বোনের কথা শুনলে অবশ্য লাভ হতে পারে।”
মিমের জীবনের একটাই লক্ষ। তার ভাইকে কীভাবে বিয়ে করানো যাবে। কম মেয়ে তো দেখলো না। কিন্তু ভাইয়ের কাউকেই পছন্দ হয় না। এখনও মিম ঘুরেফিরে তার বিয়ের কথায় যাবার আগে অভয় উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“আমার এবার যেতে হবে।”
মিম বাধা দিয়ে বলে উঠল,
“যাবে মানে? কোত্থাও যাওয়া হচ্ছে না তোমার।”
আয়েশা নূরকে স্কুল থেকে আনতে যাবে। সে এটা বলতেই এসেছিল। অভয়ও একটা উসিলা পেয়ে গেল।
“আমি আপুকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
ভাই বোন দুজনই চলে যাবে শুনে মিমের মুখ ছোট হয়ে গেল। আয়েশা বোনের মন খারাপ হতে দেখে বলল,
“অভয় থাকুক। নূরকে নিয়ে আমি এদিকে চলে আসব।”
আপু তাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বুঝতে পেরে অভয় মিছেমিছি কাজের বাহানা দিতে লাগল।
“আমার ভীষণ জরুরি একটা কাজ আছে। নোমান বলো, কত জরুরি কাজ।”
স্যার কোন জরুরি কাজের কথা বলছে এটা না জেনেই নোমান সাথে সাথে বলে উঠল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ভীষণ জরুরি কাজ আপু।”
রাদিদ এদের কাণ্ড দেখে হাসছে। মিম নিজের ভাইকে তো আর কিছু বলতে পারে না। তাই নোমানকেই ধমক দিয়ে বলল,
“হয়েছে তোমাকে আর মিথ্যা বলতে হবে না। সবথেকে বড় মিথ্যুক তো তুমি। দিনে কয়টা সত্য কথা বলো শুনি?”
সবাই চলে গেলে মিম রাদিদকে জিজ্ঞেস করল,
“কী কথা বলছিলে তোমরা? ভাইয়া কী বললো? ওই মেয়েটার সাথে ভাইয়ার কোন সম্পর্ক আছে?”
রাদিদ বাঁকা চোখে বউকে দেখে বলল,
“তুমি খুব চেষ্টা করছো ওদের মাঝে সম্পর্ক খোঁজার!”
“যা-ই বলো, মেয়েটা কিন্তু কোন হিরোইনের থেকে কম না।”
“বাই এনি চান্স, তুমি কি মেয়েটাকে ভাবি বানানোর কথা ভাবছো?”
মিম দাঁত বের করে হেসে বলল,
“ভাবলে কি কোন ক্ষতি আছে?”
রাদিদ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“তোমার এই ভাবনার কথা জানতে পারলে তোমার ভাই হার্ট অ্যাটাক করবে।”
“কেন? ভাইয়ার কি বিয়ে করতে হবে না? সারাজীবন চিরকুমার থেকে যাবে। তুমি কিছু বলো না কেন?”
“আমি কী বলবো?”
“বোঝাবে।”
“এত বছরেও তুমি বোঝাতে পেরেছো?”
“আমার কথা ব্যাঙের মাথা। ছোট হওয়ার এটাই সমস্যা। কেউ কখনও সিরিয়াসলি নেয়ই না।”
রাদিদ পেছন থেকে মিমের কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“আমার কাছে একটা আইডি আছে। তুমি বড়োও হয়ে যাবে। সবাই তোমার কথাও শুনবে।”
“কী আইডিয়া?”
“আমরা একটা কুটুস-পুটুস নিয়ে আসি। তখন আর তুমি ছোট থাকবে না। নয়/দশ মাসেই প্রমোশন পেয়ে যাবে।”
——
আত্মীয়রা তানিয়ার জীবন তিতা ত্যক্ত বানিয়ে ফেলেছে। যারা জীবনেও খোঁজ খবর নেয়নি তারাও কল করে ঘটনার সত্যতা জানতে চাচ্ছে। তানিয়া সব রাগ স্বামীর উপর দেখাচ্ছে।
“পালিয়ে যাওয়ার মতোও কোন জায়গা নেই যে, কয়দিনের জন্য গা ঢাকা দেব। এখানে থাকলে পাগল হতে বেশি সময় লাগবে না।”
তানিয়ার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দরজায় টোকা পড়েছে। তানিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“দেখো আবার তোমার কোন আত্মীয় চলে এসেছে।”
“তুমি বসো। আমি দেখছি।”
হারুন দরজা খুলতে চলে গেল। তাথৈ অপরাধী চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
“সব দোষ তোমার ওই নায়কের আপু। ওই ব্যাটা আমার জীবনে এসে সবকিছু গণ্ডগোল করে দিয়েছে।”
হারুনের পেছনে নোমানকে দেখে তাথৈয়ের সব রাগ তাজা হয়ে গেল। যত অঘটনের মূল সব এই লোক ও তার স্যার। তাথৈ ক্ষিপ্ত গতিতে নোমানের সামনে চলে এসে বলল,
“আপনি আবার কেন এসেছেন জানতে পারি? আপনার স্যার আমার থেকে আর কী চায়? জীবনের সুখ শান্তি তো সব আপনাদের দিয়ে দিয়েছি। এখন আর কী চান?”
তানিয়া চিনতে পারছে না কে এই লোক। তাথৈই বা লোকটার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? নোমান এদের সবার খোঁজখবর নিতে এসেছিল। কিন্তু এখানে এসে তাথৈয়ের রাগ দেখে নিজেই ভয় পেয়ে গেল।
“আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। আমি আপনার থেকে কোনকিছু চাইতে আসিনি। জাস্ট এটুকু দেখতে এসেছিলাম আপনাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না তো।”
“আমাদের জীবনে দুনিয়ার সব সমস্যা তৈরি করে দিয়ে এখন দেখতে এসেছেন আমরা কেমন আছি! আজব লোক তো আপনারা।”
তানিয়া তাথৈয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে ওকে ভদ্র ভাবে কথা বলতে বললো। হারুন তাথৈকে সাইড করে নিজেই নোমানের সাথে কথা বলছে। নোমান হারুনকে ঘটনা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে।
“এসবে দোষ আসলে কাউকেই দেওয়া যায় না। আপনিই ভাবুন আমার স্যার এত বড় মিডিয়া পার্সন হয়েও কেন যেচে পড়ে ঝামেলা কাঁধে নিতে চাইবে।”
হারুন নোমানকে আস্বস্ত করে বলল,
“ওর কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না। আগে কখনও এরকম পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি তো তাই কী করবে বুঝতে পারছে না।”
নোমান আন্তরিক হেসে বলল,
“উনার কথায় আমি কিছু মনে করিনি। আমাকে স্যার পাঠিয়েছেন। আপনাদেরকে নিশ্চয় অনেক সমস্যা হচ্ছে।”
অভয়ের কথা উঠতেই তাথৈ তাচ্ছিল্য করে বলে উঠল,
“আহা আপনার স্যার কত মহান! উনার কাছে তো আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।”
তানিয়া অনেকক্ষণ ধরে বোনের বেয়াদবি সহ্য করছে। এবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই আর একটা কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
বোনের শাসনের সামনে তাথৈ বরাবরই বিলাই হয়ে যায়। আজও মনের রাগ মনে পুষেই চুপ করে যেতে হলো। নোমান তানিয়া ও হারুনের সাথে কথা বলছে,
“আমি জানি মিডিয়া আপনাদের কেমন যন্ত্রণা দিচ্ছে। আর এটা ভেবেই আমি আপনাদের থাকার জন্য নতুন একটা জায়গার ব্যবস্থা করেছি। আপনারা যদি দয়া করে কিছু দিনের জন্য নিজের বাড়ি থেকে দূরে থাকতে রাজি হোন তাহলে আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।”
ছেলেটার আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখে তানিয়া অভিভূত হয়ে গেল। এরকম সময়ে সবথেকে বেশি তাদের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। তারা কীভাবে কী করছে এটা দিয়ে ছেলেটার কোনকিছু আসতো যেতো না। তারপরও নিজে থেকে সাহায্য করতে এসেছে। সাহায্য করে যে খুব উপকার করছে এমটাও ফলাচ্ছে না।
“তুমি করেই বলছি ভাই। আমাদের জন্য তুমি কেন এতকিছু করবে?”
নোমান মৃদু হেসে গর্ব করে জবাব দিল,
“আমি তো শুধু স্যারের অর্ডার পালন করছি। নিজে থেকে কোন কিছুই করছি না।”
চলবে
Jerin Akter Nipa