যতনে রাখিবো পর্ব-১১+১২

0
74

#যতনে_রাখিবো

১১
অভয়ের সাথে দেখা করার সবরকম চেষ্টা করে ফেলার পর বাধ্য হয়ে লোপা ভীষণ বাজে একটা চাল চাললো। অভয় তাকে এভাবে ইগনোর করতে পারে না। লোপার মনেও জেদ চেপেছে।

“এবার তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে অভয়। আমি তোমার কাছে অন্য কোন পথ খোলা রাখব না।”

ম্যানেজার আনোয়ারকে আজকের ভেতরে কাজটা করে ফেলার জন্য বলে লোপা মেডিটেশনে বসলো। আনোয়ারের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে চাচ্ছে না ম্যাডাম এমনকিছু করুক। আনোয়ার এখনও মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে দেখে চোখ খুলে লোপা ধমক দিয়ে বলল,

“সমস্যা কী তোমার? যাচ্ছ না কেন?”

“ম্যাম আরেকবার ভেবে দেখুন। কাজটা করা কি ঠিক হবে?”

“ভাবাভাবির সময় চলে গেছে আনোয়ার। এই কাজ করতে অভয় আমাকে বাধ্য করেছে।”

“এসবে কিন্তু আপনার ক্যারিয়ারেও…

লোপা কঠিন চোখে আনোয়ারকে দেখে বলল,

” আমি এই লাইনে কেন এসেছি জানো? অভয়ের জন্য। অভয় ছাড়া আমার লাইফে আর কিছু ইম্পর্ট্যান্ট না। তোমাকে যা করতে বলেছি তুমি করো।”

—–
তাথৈয়ের ইচ্ছা না থাকলেও তাদেরকে কয়েকদিনের জন্য হলেও নিজের বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছে। ওখানে থাকা সত্যিই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। নোমান সবাইকে ফ্ল্যাটটায় নিয়ে এলে তানিয়ার তো মাথাই চক্কর দিয়ে উঠেছে। এত বড় একটা ফ্ল্যাটে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে!

“আমরা এখানে থাকব!”

নোমান জবাব দিল।

“হ্যাঁ আপু।”

তানিয়া ইতস্তত করে বলল,

“অন্য কোথাও আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?”

“কেন আপু? এখানে থাকতে কি আপনাদের কোন সমস্যা হবে? সমস্যা হলেও আমি তো আছিই। যখন মন চাইবে আমাকে কল করবেন। আমি চলে যাব।”

তাথৈ ফ্ল্যাটটা দেখে নিয়েছে। সে নোমানের কাছে এসে বলল,

“সমস্যা একটা আছে। চারজন মানুষের জন্য এত বড় ফ্ল্যাটের প্রয়োজন নেই। আপনি উঁহু, আপনার স্যার আমাদের সাহায্য করছেন বুঝলাম। কিন্তু তিনি তো সাহায্যের নামে শো অফ করছেন।”

নোমান চোখ বড় বড় করে বলল,

“শো অফ!”

“জি। উনার হয়তো এমন আরও অনেক বাড়ি আছে। থাকতেই পারে। এতে আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আমরা উনার বাড়িতে থাকব না।”

নোমান কী বলবে ভেবে না পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

“এটা স্যারের বাসা না।”

“তাহলে তো এখানে আরও আগে থাকব না। কারণ এত বড় ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।”

তাথৈয়ের সামনে বরাবরই নোমান কথা হারিয়ে ফেলে। এরকম কঠিন চরিত্রের কোন মেয়ে আজ পর্যন্ত দেখেনি। স্যারের জীবনে এরকম একটা মেয়ের আশাই করে নোমান। তানিয়াও বোনের সাথে একমত। কেউ সাহায্য করছে এটা তার মহত্ত্ব। তাই বলে তারা সাহায্যের নামে এমনকিছুও নিতে পারবে না যাতে বিবেকের কাছেই ছোট হয়ে দাঁড়াবে। তানিয়া বলল,

“হ্যাঁ ভাই, তাথৈ ঠিকই বলছে। তুমি আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছ এটাই অনেক। আমরা নিজেদের থাকার জন্য কোনো না কোন ব্যবস্থা করে নেব।”

তাথৈরা চলে যাবে বুঝতে পেরে নোমান ওদের আটকানোর কোন পথ না পেয়ে অভয়কে কল করলো। অভয় কল তুলতে সময় নিয়েছে। কল রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে নোমান বলল,

“স্যার একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

অভয় ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

“তুমি কোন কাজ ঝামেলা ছাড়া করতে পারলেই বরং আমি অবাক হবো। বলো কী সমস্যা।”

“উনারা এখানে থাকতে চাচ্ছেন না।”

নোমান সারাদিনে হাজারটা ব্যাপারে তাকে কল করে। তাই এখন কোন ব্যাপারে কথা বলছে অভয় বুঝতে পারল না।

“উনারা কারা গাধা?”

“মিস তাথৈ ও উনার পরিবার।”

অভয় লাইব্রেরিতে এসে একটা বই নামাচ্ছিল। তাথৈয়ের নামটা শুনে মাঝপথে হাত থেমে গেল। বইটা না নিয়েই হাত নামিয়ে নিল।

“কেন?”

“এত বড় ফ্ল্যাটে থাকতে চাচ্ছেন না।”

“ফ্ল্যাট বড় এটাই সমস্যা!”

“না। সমস্যা উনারা ভাবছেন ফ্ল্যাটটা ভাড়া করা।”

“তুমি বলোনি কেন গাধা ওটা ভাড়া করা ফ্ল্যাট না।”

“বললে হয়তো এখানে আসতোই না।”

ফোনের ওপাশে অভয়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কৌতূহল দমিয়ে জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না।

“তোমার সমস্যা কী নোমান? যা বলছো সব অর্ধেক করে বলছো। পুরো কথাটা বলবে?”

নোমান বলতে চাচ্ছিল না। তবুও স্যার জানতে চাইলে মিথ্যা তো বলতে পারবে না।

“কোন কারণে হয়তো মিস তাথৈ আপনাকে পছন্দ করেন না। পছন্দ না করার কারণটা অবশ্য এখনও জানতে পারিনি। তবে আমার মনে হয় গত কয়েকদিনে যাকিছু হয়েছে তার জন্যই আপনার উপর রেগে আছে। উনার পরিবার সাহায্য নিতে রাজি হলেও মিস তাথৈ কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। যদিও বোনের সামনে উনার জেদ চলে না। কিন্তু এখানে আসার পর বেঁকে বসেছে। আসলে স্যার মেয়েটার আত্মসম্মান প্রখর।”

এপাশে অভয় চুপ হয়ে গেল। তার জীবনে যা-কিছু হচ্ছে এজন্য মেয়েটাকে দায়ী করা যায়। তারপরও সে এমনকিছু করছে না। উল্টো সাহায্য করতে চাচ্ছে। অভয় নিশ্চুপ আছে দেখে নোমান জিজ্ঞেস করল,

“স্যার, লাইন কি কেটে গেছে?”

“ওই পরিবারের সবার বড় কে? উনাকে ফোনটা দাও।”

নোমান আশ্চর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“আপনি কথা বলবেন স্যার।”

“হুম।”

অভয় হারুনের সাথে কী কথা বলেছে নোমান শুনতে পায়নি। কিন্তু কথা শেষ করেই হারুন পরিবারকে এখানে থাকার জন্য মানিয়ে নিয়েছে।

—–
লোপা কী করতে চাইছিল তা সন্ধ্যার মধ্যেই অভয়সহ পুরো দেশবাসী জেনে গেছে। দেশের অন্যতম গুণী অভিনেত্রী লোপা চৌধুরীর সাথে অভয় খানের সম্পর্ক নিয়ে লোপার ম্যানেজার আনোয়ার মুখ খুলেছে। আনোয়ার মিডিয়াকে জানিয়েছে অভয়কে নিয়ে ওই মেয়েটার সাথে যা-কিছু সামনে আসছে তা সত্য নয়। কারণ অভয় খান অনেক আগে থেকেই তার ম্যাডামের সাথে সম্পর্কে আছেন। দু’জন শীঘ্রই বিয়েও করবেন বলে জানিয়েছে।
এই নিউজ বের হওয়ার সাথে সাথে মুভি পাড়ায় শোরগোল পড়ে গেল। অনেকে তো অভয়কে বয়কট করার কথাও বলে ফেলেছে। অভয়ের জন্য ইন্ডাস্ট্রির নাম খারাপ হচ্ছে। রাদিদ খান নিউজটা দেখেই অভয়কে কল করলেন। তাকে নিয়ে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ অভয় কিছু জানেই না।

“অভয় তুমি কোথায়?”

“বাসায় আছি।”

“বাসা থেকে বের হয়ো না। আমি আসছি।”

“কিছু কি হয়েছে?”

অভয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রাদিদ কল কেটে দিয়েছে। অভয় বুঝতে পারছে না হঠাৎ রাদিদের কী হলো।
রাদিদ অভয়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই ওর বাসার সামনে মিডিয়া ভিড় জমিয়েছে। রাদিদের গাড়ি গেটের ভেতর ঢুকতেই সকলে এসে ঘিরে ধরেছে। মিডিয়া থেকে হাজারটা প্রশ্ন আসছে।

“স্যার আপনি অভয় খানের ফ্যামিলি মেম্বার। লোপা ম্যামের সাথে অভয় খানের সম্পর্ক নিয়ে আপনি কী বলবেন? সত্যিই কি উনারা বিয়ে করতে যাচ্ছেন?”

অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করছে,

“অভয় খানের সাথে লোপা ম্যামের প্রেমের সম্পর্ক ঠিক কতদিন ধরে চলছে? উনাদের সম্পর্কের কথা কি দুই পরিবারেরই জানা ছিল?”

রাদিদ কারো প্রশ্নেরই কোন উত্তর দিলো না। অনেক কষ্টে সবাইকে ছাড়িয়ে ভেতরে চলে এলো। অভয়ও বিষয়টা জানতে পেরেছে। লোপা আকারে ইঙ্গিতে নানা ভাবেই তাকে বোঝাতে চেয়েছে। অভয় বুঝেও এড়িয়ে গেছে। মাস কয়েক আগে লোপা প্রপোজ করলে অভয় লোপার প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই মূলত অভয় লোপাকে এভয়েড করে চলছে। তার জন্য যে লোপা এরকম কিছু করবে বসবে অভয় কল্পনাও করেনি।

—–
নায়কের বিশাল ফ্ল্যাটে তাথৈ বিন্দাস আছে। মনে মনে ভাবছে হিরো হিরোইনদের জীবন! কোনকিছুর কমতি নেই। বিশাল আলিসান বাড়ি। মাসে মাসে প্যারিস, থাইল্যান্ড ট্যুর। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ারের বন্যা। এক জীবনে আর কী চাই? বাবাই টিভিতে কার্টুন দেখছে। তাথৈ ওর পাশে গিয়ে বসে পড়ে বলল,

“বাচ্চাদের মতো কী সারাদিন কার্টুন দেখিস!”

বলেই রিমোট কেড়ে নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে ফেলল। বাবাইও রিমোট নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছে।

“খালামনি আমি কার্টুন দেখব। কার্টুন দাও।”

তাথৈ বাবাইয়ের হাতে রিমোট না দিয়ে হাত উঁচু করে ধরে রেখেছে।

“বিরক্ত করিস না তো। মুভি দেখি মুভি।”

হঠাৎ একটা নিউজের হেডলাইনে তাথৈয়ের চোখ আটকে গেল। তাথৈ শান্ত হয়ে গেলে বাবাই রিমোট নিয়ে চ্যানেল পাল্টে দিয়েছে। তাথৈ ঝাঁপিয়ে পড়ে রিমোট নিয়ে আগের চ্যানেলটায় দিল। পুরো ঘটনা জেনে তাথৈয়ের চোখ চড়কগাছ। এই লোকের কীর্তির তো কোন শেষ নেই দেখা যাচ্ছে। যাক ভালোই হয়েছে। লোকটার গার্লফ্রেন্ড বেরিয়ে এসেছে। এবার তার উপর থেকে মিডিয়ার ধ্যান সরে যাবে।
তানিয়াও টিভির সামনে বসে অভয়ের নামে ছড়ানো এসব গুজব শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছে।

“সাংবাদিক গুলো কী আলতো ফালতু সব কথা বলছে। এসবের কিছুই তো সত্য না।”

তাথৈ বোনের কথা শুনে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,

“সাংবাদিকরা মিথ্যা বলবে কেন?”

“কারণ ওদের খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই।”

“তোমার পছন্দের নায়ক বলে যে সাধু পুরুষ হবে এমনটাও ভেবো না।”

“দুনিয়ার কোন পুরুষই সাধু পুরুষ না। কিন্তু অভয় খানের চরিত্রে সমস্যা আছে এটা আমি মরে গেলেও মানবো না।”

লোকটার প্রতি তার বোনের বিশ্বাসের নমুনা দেখে তাথৈ হাই তুললো।

“নায়কদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র হয়না আমার সহজসরল বোকা বোন।”

তাথৈয়ের কথা শুনে তানিয়া রেগে যাচ্ছে। তাথৈ অবশ্য বোনের রাগ এনজয় করছে।

“কত বড়ো অকৃতজ্ঞ রে তুই! লোকটা আমাদের এত সাহায্য করেছে তবুও তুই উনার নামে খারাপ কথা বলছিস!”

“সাহায্য করে কোন উপকার করছেন না। সমস্যায়ও উনিই ফেলেছেন।”

“উনি সমস্যায় ফেলেছেন! নাকি তোর কারণে ও বেচারা নিজে সমস্যায় পড়েছে। তোকে জড়িয়ে যে ঘটনা হয়েছিল সেটাতে যেমন এক পার্সেন্ট সত্যতা নেই এবারও তেমনই হয়েছে। লোপা চৌধুরী কোন দুধে ধোয়া তুলসীপাতা না।”

আপুর কথায় লজিক আছে। তাথৈ ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সত্যিই তো। তাকে জড়িয়ে মিডিয়া যে নিউজ বের করেছিল সেটা তো মিথ্যাই ছিল। কিন্তু দেশবাসী এই মিথ্যাকেই সত্য মনে করেছে। হতে পারে লোপা মিথ্যা বলছে। তাথৈ মাথা ঝাঁকিয়ে মাথা থেকে অভয়ের চিন্তাভাবনা বের করে দিল। এই লোকের অতীতেও এমন বহু রেকর্ড আছে। লোপা কেন মিথ্যা বলবে? মিথ্যা বলে ওর লাভ কী?

—-
“ভেবেছে মিডিয়ার সামনে মিথ্যা বলে, দু’চার ফোঁটা চোখের জল ফেলে আমার ভাইয়ের গলায় ঝুলে যাবে! এত সোজা! আমি বেঁচে থাকতে ওই লোপা টোপা আমার ভাইয়ের বউ হতে পারবে না।”

সিরিয়াস আলোচনার ভেতরেও মিম তার ভাইয়ের বিয়ের কথাই ভেবে যাচ্ছে। আয়েশা বোনের উপর বিরক্ত হয়ে বলল,

“কথা কোথায় থেকে কোথায় টেনে নিচ্ছিস তুই!”

“টেনে নিচ্ছি না আপু। লোপার উদ্দেশ্য তো এটাই। তুমি শুনে রাখো আপু, ওই পিশাচিনীর উদ্দেশ্য আমি কোনদিন সফল হতে দিব না।”

মিম কথার মাঝে থেমে গিয়ে কী যেন ভাবলো। পরক্ষণে একবার করে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই দিল।

“এক কাজ করলে কেমন হয়? লোপা কিছু করার আগেই আমরা ভাইয়াকে বিয়ে করিয়ে ফেলি। ভাইয়া বিয়ে করে ফেললে লোপা কিছুই করতে পারবে না।”

চলবে

#যতনে_রাখিবো

১২
মিমের আইডিয়া শুনে সকলেই একযোগে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মিম বুঝতে পারল না সে ভুল কী বললো। ভালো আইডিয়াই তো দিয়েছে। একে কিছু বলাও বেকার। আয়েশা রাদিদের উদ্দেশ্যে দুঃখিত সুরে বলল,

-ভাই তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও। একটা পাগলের সাথে জীবন কাটাতে হচ্ছে তোমার।

রাদিদও দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,

-আমার কষ্ট বোঝার জন্য ধন্যবাদ আপু।

মিম মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। তার নিজের জামাইও মজা নিচ্ছে। আলোচনা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে। নোমান বেচারার টেনশনে যাই যাই অবস্থা। স্যারের কি এবার একটু সিরিয়াস হওয়া উচিত না! লোপা ম্যাম তো হাত-পা ধুয়ে উনার পেছনে লেগেছে।
___

লোপা ফোন হাতে নিয়ে অভয়ের কলের অপেক্ষায় বসে আছে। অনেক ইগনোর করেছ। এবার তো পাখিকে খাঁচার ভেতর আসতেই হবে। আনোয়ার কিছু বলতে এসেছিল। কিন্তু লোপা চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গান গাইছে শুনে ডাকার সাহস পেলো না। চোখ বন্ধ অবস্থায়ও আনোয়ারের উপস্থিতি লোপা বুঝতে পেরেছে।

-কিছু বলবে আনোয়ার?

-জি ম্যাম।

-আমার মুড এখন ভীষণ ভালো। এমন কোন কথা থাকলে বলো না যাতে মুড খারাপ হয়ে যায়।

-ঠিক আছে ম্যাম। তাহলে পরে বলি।

আনোয়ার চলে গেলে লোপা একা একাই হাসছে।

-আমাকে ইগনোর করার সবরকম পথ তোমার জন্য বন্ধ করে দিয়েছি অভয়। তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে।

—-
-কইরে তুই? দুনিয়া থেকে কোথায় গায়েব হয়ে গেছিস!

তাথৈ চিপস চিবোতে চিবোতে বলল,

-শালি হারামি তোর জন্যেই তো গায়েব হতে হয়েছে।

হাফসা আকাশ থেকে পড়ে বলল,

-আমার জন্য! আমি কী করেছি?

-তুই আর তোর গরু বয়ফ্রেন্ডই তো সব করেছিস। সেদিন ওই ছেলেমানুষী বাজি না ধরলে আজ নিজের বাড়িতে থাকতাম।

-হুম কিন্তু এখন কোথায় আছিস?

-জানি না।

-জানিস না! মঙ্গল গ্রহে আছিস নাকি যে জানি না বলছিস।

-মিডিয়ার জ্বালাযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে হয়েছে।

-কোন আত্মীয়র বাড়িতে আছিস?

-আত্মীয় টাত্বীয় কেউ না। আমার কি মনে হয় জানিস? বাড়িটা ওই নায়ক ব্যাটারই।

হাসফা বিস্ময়ে কতক্ষণ কথা বলতে পারল না। ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ আসছে না দেখে তাথৈ চেক করে দেখল কল কেটে গেছে কি-না। কল কাটেনি। গাধীটা মনে হয় বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে।

-কিরে কথা হারিয়ে ফেলেছিস!

-তাথৈ! কী জীবন তোর! পুরা সিনেমার কাহিনি ফেল। ইশ সেদিন যদি তোকে না বলে নিজেই কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলতাম, তাহলে আজ তোর জায়গায় আমি থাকতাম।

-জীবনে তোকেই দেখলাম যার কুয়োয় পড়ার এত শখ।

-বাড়িটা কেমন রে? অনেক বড়? অবশ্য বড় তো হবেই। নায়ক নায়িকাদের বাড়ি কেমন হয় আমি কোনদিনও দেখিনি। পিক তুলে পাঠা না। না দাঁড়া, তুই বরং ভিডিও করে পাঠা।

-খেয়ে তো কাজ নেই। ঘুমা তুই।

-প্লিজ তাথৈ প্লিজ। এমন করিস কেন দোস্ত? আমার তো আর তোর মতো হিরোয়িনী ভাগ্য নেই।

হাফসার কথা শুনে তাথৈ নিজের ঠোঁটেই কামড় মেরে বসে আছে। ব্যথায় মুখে ডলতে ডলতে বলল,

-কী শব্দ ব্যবহার করলি এটা? হিরোয়িনী আবার কী বইন? এভাবে বাংলা ভাষার ইজ্জত লুটছিস কেন?

-ভুল ধরিস না। ফিলিংস বুঝলেই হলো।

তাথৈ হাসতে হাসতে বলল,

-আচ্ছা ঠিক আছে। ভিডিও পাঠাচ্ছি। হোয়াটসঅ্যাপ চেক করিস।

—-
এতকিছুর পরও অভয় লোপার কাছে ধরা দিচ্ছে না দেখে লোপার জেদ ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। এই নিউজটা বের হবার পর পুরো মুভি পাড়া হিলে উঠেছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এই মিথ্যাচার তারই কোন মাথা ব্যথা নেই। লোপা তার কাছে এতটাই সস্তা! আনোয়ারকে ডেকে লোপা বলল,

-প্রেস কনফারেন্স ডাকো আনোয়ার। আমি নিজে ইন্টারভিউ দিব।

-ম্যাম এসব করার আগে একটা বার ভেবে…

-শাট আপ! তোমাকে জ্ঞান দিতে বলেছি? যা করতে বলেছি তা করো। আমার থেকে বেশি বুঝলে ঘাড় ধরে কাজ থেকে বের করে দিব।

আনোয়ার চলে গেল। যেতে যেতে ভাবল,

-কেউ যদি ইচ্ছে করে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায় তাহলে আমার কী? ক্যারিয়ার নষ্ট করতে নিজেই উঠেপড়ে লেগেছে।

লোপার ইন্টারভিউয়ের কথা প্রকাশে এলে নোমান অভয়ের কাছে ছুটে এলো।

-স্যার এই লোপা চৌধুরী তো মনে হচ্ছে পাগলা কুত্তার কামড় খেয়েছে। ইন্টারভিউতে নিশ্চয় আপনাকে নিয়েই কথা বলবে। এবার আমাদের কিছু করতে হবে স্যার।

অভয়ও এটাই ভাবছে। এবার সত্যিই কিছু করতে হবে। এই প্রফেশনের প্রতি তার ভালোবাসা না থাকলেও অন্তত মিথ্যা অপবাদ নিয়ে এই জীবন থেকে সরে যেতে পারবে না। অভয় ঠিক করল সে নিজেই লোপার সাথে কথা বলবে।

লোপা ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। অভয়ের কল পেয়ে এতটা এক্সাইটেড হয়ে গেল যে হঠাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রিং হয়ে কল কেটে যাওয়ার আগেই সবাই রুম থেকে বের করে দিয়ে কল রিসিভ করল।

-থ্যাংক গড! দেরিতে হলেও তুমি কল করেছ।

-এসব কী লোপা?

লোপা আঙুলে চুল পেঁচাতে পেঁচাতে সামান্য লজ্জা পেয়ে বলল,

-আমার ভালোবাসার প্রমাণ। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি…

-স্টপ ননসেন্স লোপা। আর ইউ আউট অফ ইয়োর মাইন্ড! এসব ব্যাপারে তুমি মিডিয়াকে টানছো?

-এছাড়া তুমি তো আমার কাছে আর কোন অপশন খোলা রাখোনি।

-মেয়ে মানুষের মধ্যে যে লাজ-লজ্জা, হায়া থাকে তার বিন্দু পরিমাণ তোমার মাঝে নেই, না! তুমি বুঝতে পারছো না এসব করে তুমি নিজের ক্যারেক্টারেই দাগ লাগাচ্ছ।

-তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি অভয়। এমনকি খুশি খুশি বদনামীর সাগরে ডুবও দিতে পারি।

-লাস্ট বারের মতো তোমাকে ওয়ার্ন করছি লোপা। এসব বন্ধ করো। নইলে তোমার জন্যই ভালো হবে না।

-সব বন্ধ করে দিব অভয়। শুধু তুমি আমাকে একটু ভালোবাসো।

অভয় অবাক হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। লোপা এতটা নিচে নামতে পারবে তার কল্পনা করতেও ঘৃণা লাগছে।

-তোমার মতো মেয়ে মানুষ আমার ভালোবাসা তো দূর, ঘৃণা পাওয়ারও যোগ্য না।

-ঠিক আছে। তুমি আমাকে ভালোবাসবে না। তাহলে আমিও এসব থামাবো না।

-গো টু হেল! তোমার যা খুশি মন চায় করো। আমিও দেখব তুমি আমার চুলটাও বাঁকা করতে পারো কি-না।

লোপার সাথে কথা বলে অভয়ের নিজেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কোন মেয়ে মানুষ এতটা নির্লজ্জ হতে পারে! ভালোবাসা কি জোর করে পাওয়ার জিনিস? আর তার মাঝেই এমন কি বিশেষত্ব আছে যে নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ দিয়ে তাকে পেতে হবে।

—-
তাথৈ বিশ্বাস করে বান্ধবীকে ভিডিও পাঠিয়েছিল। কিন্তু বান্ধবী যে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে তা তাথৈ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। আগেই কি জীবনে ঝামেলার অভাব ছিল? এখন আবার নিজের হাতে নতুন ঝামেলা তৈরি করেছে। তাথৈয়ের নিজে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নয়তো হাফসাকে মেরে জেলে যেতে মন চাচ্ছে। হাফসা নিজেও জানতো না এমন কিছু হবে। সে তাথৈকে নিজের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ দেওয়ার জন্য পৃথিবীর অর্ধেক জিনিস নিয়ে কসম কেটে ফেলেছে।

-বিশ্বাস কর দোস্ত, আল্লাহর কসম আমি ভিডিও ভাইরাল করিনি।

রাগে দুঃখে তাথৈয়ের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এমন বান্ধবী আল্লাহ কোন শত্রুকেও না দিক।

-তুই ভাইরাল না করলে ভিডিও নিজে থেকে ভাইরাল হয়েছে! ভিডিওর তো হাতপা আছে।

একটু ভাবতেই হাফসার মনে পড়ল রাতে তাথৈ ভিডিও দেওয়ার পর শুধু একজন মানুষকেই বলেছিল সে। রনিও ভিডিও দেখার আবদার করেছিল। হাফসার মাথার ছেঁড়া তার এতদিনে জোড়া লাগল। চেঁচিয়ে উঠে তাথৈয়ের কান ফাটিয়ে দিয়ে বলল,

-রনি বা****! হারামজাদা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। তোর ভিডিও রনিই ভাইরাল করেছে।

তাথৈ কপাল চাপড়ে বলল,

-ভিডিও রনিকে না দিয়ে তুই নিজেই ভাইরাল করে দিতি বোন। আমার ক্ষতি ওই কুত্তার হাতে হতে না দিয়ে এই উপকারটা তুই-ই করতি।

হাফসা নিজেও প্রেমে ধোঁকা পেয়ে ডিপ্রেশনের পথে আছে। তাথৈ আরও কিছু বললে বেচারীর মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বান্ধবীকে বেশিকিছু না বলে কল কেটে দিয়ে তাথৈ বিছানায় গড়াগড়ি করে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে লাগল।

-আল্লাহ আমাকে তুমি এ কোন মুসিবতে ফেলে দিলে। আরও দুইটা ঘটনা কম ছিল যে এবার ভিডিওই ভাইরাল করে দিলে! ওই নায়ককে আমি কী জবাব দেব? নায়ককে জবাব দেওয়ার জন্য তো বেঁচেই থাকবো না। আপু আমাকে তার আগেই মেরে ফেলবে।

গতকাল রাতে হাফসার কথায় তাথৈ অভয়ের বাড়ির ভিডিও করে ওকে পাঠিয়েছিল। হাসফা সেটা রনির সাথে শেয়ার করেছে। রনির তো আগে থেকেই তাথৈয়ের উপর জেদ ছিল। তাথৈকে ফাঁসানোর জন্য এবারও ভিডিও ভাইরাল করে দিয়েছে। সেটা নিয়েই পুরো নেট দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেছে। একে তো লোপা চৌধুরীর সাথে সম্পর্কের কথা নিয়ে আগেই সবাই ক্ষেপে আছে। এখন আবার নায়ক সাহেব একটা মেয়েকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছে খবর সামনে এসেছে। ব্যাটার চরিত্র নিয়ে পুরো টানাহেঁচড়া লেগে গেছে। অভয় খানকে তাথৈয়ের তেমন পছন্দ না হলেও লোকটার ক্ষতি চায় না। নাকিকান্না করতে করতে তাথৈ বলল,

-আল্লাহ আমাকে তুলে নাও। যেখানে যাব নতুন করে ঝামেলা পাকাবো। আমার নাম তাথৈ কে রেখেছিল? আমার নাম তো ঝামেলা হওয়া উচিত ছিল।

—-
অভয় যতই ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ হোক এই নতুন ঘটনায় তারও মাথায় হাত। দুইটা মেয়ে মিলে তার জীবনকে নাটকের থেকেও নাটকীয় বানিয়ে রেখেছে। চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া লাগছে ইয়ার! লোপার সাথে সম্পর্ক অথচ বাড়িতে অন্য মেয়েকে রেখেছে। কেঁদে বললেও তো মানুষ তার কথা বিশ্বাস করবে না। বোনদের মুখোমুখি হওয়ার চিন্তা মাথাতেই আনতে পারছে না। অভয় ক্যাপ, মাস্ক পরে গাড়ির চাবি নিয়ে কোথাও বেরিয়ে গেল। সবকিছু ঠিক করার সময় এসে গেছে। অভয় ড্রাইভ করে সোজা নিজের ওই বাড়িতে এসেছে যেখানে তাথৈরা থাকছে। তাথৈয়ের মুখোমুখি হয়েই সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটা করলো তা হলো,

-আমাকে বিয়ে করবেন?

চলবে
Jerin Akter Nipa