যদি আমার হতে পর্ব-৩৬+৩৭

0
705

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৩৬
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

চুলায় বসানো তরকারিটা নামাতে গিয়ে হাত খানিক পুরে যায় আদ্রিশার। ঠোঁট চেপে মুখ কাঁচু মাঁচু করে কড়াই নামিয়ে রাখে র‌্যাকে। নিশ্বাস ছেড়ে হাত ঝাড়তে থাকে আদ্রিশা। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে আসে, ‘আহ’! মালিহা ইয়াসমিন আদ্রিশাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে ছুটে আসেন তার কাছে। ডান হাত চেপে ধরে চোখের পানি লুকোনোর ব্যার্থ চেষ্টা করছিলো আদ্রিশা। কিন্তু তা বেশিক্ষন টিকলো না। জোর করে হাত টেনে দেখেন লাল হয়ে আছে আঙুলসহ ডান হাতের উপরিভাগ। বুঝতে বাকি নেই গরম কড়াইতে হাত লাগানোয় এই অঘটন ঘটেছে। একটা বাটিতে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে হাত ডুবিয়ে দেন আদ্রিশার। তারপর তাড়াহুড়া করে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। আদ্রিশা তখন‌ও হাত পানিতে চুবিয়ে আছে। মালিহা হাতে মলম নিয়ে ফিরে আসেন। আদ্রিশার হাত মুছে দিলেন নিজের শাড়ির আঁচলে। সোফায় এনে বসিয়ে আলতো করে মলম লাগিয়ে দেন পুরা জায়গায়। মাঝে মাঝে ফুঁ দিয়ে জালা কমানোর চেষ্টাও করছেন তিনি। এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো হাত আদ্রিশার নয় বরং উনার পুরেছে‌! আদ্রিশা মালিহার আড়ালে মুচকি হাসলো। এক মায়ের থেকে দূরে গিয়ে আরেক মা পাওয়ায় মনে মনে ধন্যবাদ জানালো আল্লাহ’কে! সত্যিই সে ভাগ্যবতী! কিছুদিনের জন্য হলেও সে ভাগ্যবতী! ‌মলম লাগানো শেষে আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে তাকে হাসতে দেখে মাথায় গাট্টা মারলেন মালিহা। আদ্রিশা হতভম্ব হয়ে আছে শাশুড়ির কাজে। হঠাৎই বকতে লেগে গেলেন তিনি।

“কাজের সময় খেয়াল কোথায় থাকে? আর কে বলেছে তোকে রান্না করতে? একা কেনো করতে হবে সব? আমি ছিলাম না? রোজ যেমন একসাথে দুজনে রান্না করছি তাহলে আজ কেনো বাহাদুরি করতে গেলি শুনি? এখন যে হাতটা পুরালি, জালা কি কম করছে? একটা কথা বললে শুনতে হয়! তা না করে যা নয় তাই করছিস! কি জবাব দেবো আমি তোর বাবা মাকে, মুগ্ধকে? ছি ছি,,,,, আমি থাকা সত্তেও এমন একটা অঘটন ঘটলো!”

আদ্রিশা এবার কেঁদেই দিলো। আদ্রিশার চোখে পানি দেখে মালিহা ভরকে গেলেন। অস্থির কন্ঠে বললেন, “কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো? বেশি জালা করছে? ইশশশ,,, আমিও না! বকছি মেয়েটাকে! সরি মা, আর বকবো না! কান্না থামা। চল তো হাসপাতাল যাই। হাতে ইনফেকশন না হয় আবার!”

আদ্রিশা হো হো করে হাসতে লাগলো। মালিহা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলেন। ধীর আওয়াজে বললেন, “ঠিক আছিস তুই? একবার কাঁদছিস তো একবার হাসছিস!”আদ্রিশা মালিহাকে টেনে সোফায় বসালো। মালিহার হাতটা নিজের হাতে পুরে বললো,

“মায়ের পর‌ও যে কেউ এতো ভালোবাসবে জানতাম না। তুমি সত্যিই আমার শাশুড়ি ন‌ও, আমার মা! কতো ভাবো তুমি আমার জন্য।হাত সামান্য পুরেছে, আর এতেই তুমি যা করছো বলার বাইরে। হাহা,,,, এই টুকুর জন্য হাসপাতাল যেতে হবে না কি?”

মালিহা প্রতিবাদ করে বললেন, “মোটেও সামান্য নয়! পুরো হাত লাল হয়ে গেছে, ফোসকা পরবে মা! চল না কথা টা রাখ আমার। আর কি বললি তুই? আমি তোর শাশুড়ি ন‌ই মা! এটা তুই আজ মানলি? বাহ,,,, সেই কবে থেকে যে মা মা বলে ডাকিস তখন মনে হয় নি আমি মা, শাশুড়ি ন‌ই। আজ মনে হলো?” আদ্রিশা ইশারায় সরি বলে মালিহাকে জড়িয়ে ধরলো। মালিহাও এক হাতে জড়িয়ে নিলেন তাকে।

দুপুরের খাবারের সময় মালিহা নিজের চেয়ারে না বসে আদ্রিশার পাশের চেয়ারে বসলেন। তারপর নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আদ্রিশাকে। মুগ্ধর বাবা অনেকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও আদ্রিশা দৃঢ় কন্ঠে তা নাকোচ করেছে। মালিহাও আর জোর করেন নি তাকে। তবে একটু পর পর‌ই মলম, আইস সহ যা যা হাতের জালা কমাতে উপযোগী সব‌ই লাগাচ্ছেন তিনি। এতে আদ্রিশার কোনো আপত্তি কানে তুলেন নি।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চমকে গেলো মুগ্ধ। সোফায় মালিহা বসে টিভি দেখছেন আর তার কোলে মাথা রেখে আদ্রিশা টিভি দেখছে। শাশুড়ি ব‌উয়ের ভালোবাসা অনেক দেখলেও এই অবস্থায় কখনো তাদের দেখে নি মুগ্ধ। মুগ্ধ আসার পর‌ও তাদের কোনো হেলদোল নেই। ঘর থেকে আদ্রিশার নাম ধরে ডাকলেও মালিহা উপস্থিত হন মুগ্ধর সামনে। ভ্রু কুঁচকে মুগ্ধ বললো, “আমি কি তোমায় ডাকলাম মা? আমার তো মনে হচ্ছে আদ্রিশাই বলেছি!”

মালিহা ছেলের কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ডেকেছিস তো তুই ব‌উকেই। কিন্তু আমায় আসতে হলো।”

মুগ্ধর ভ্রু যুগল আরো একটু কুঁচকে গেলো। মালিহা গাম্ভীরতার সুর টেনে বললেন, “ও আসবে না বললো। কি হয়েছে তোদের মাঝে? মেয়েটা রাগ করেছে কেনো?”

মুগ্ধ অসহায় কন্ঠে বললো, “আমি আবার কি করলাম। উনি কেনো রেগেছেন তা উনাকেই বলতে বলো। আমার তো সকাল থেকে কথাও হয় নি উনার সাথে।”

মালিহা ধমকের সুরে বললেন, “কি! সকাল থেকে ব‌উয়ের সাথে কথা হয় নি? এই সত্যি করে বল। তোদের মাঝে ঝগড়া টগড়া হয় নি তো আবার!”

মুগ্ধ মাথা নাড়লো। বললো, “না মা, ঝগড়া কেনো হতে যাবে‌ । এমনিই, দরকার ছিলো না তাই ফোন করা হয় নি। সিম্পল!”

“দরকার ছাড়া ব‌উয়ের সাথে কথা বলতে নেই? কে শেখালো কথাটা? তোর বাবা? বোকা ছেলে। বুদ্ধি শুদ্ধি কিচ্ছু নেই! তোর অফিসের ঐ ম্যানেজার কি যেনো নাম?(মুগ্ধ কিছু বলতে নিলেই হাত নেড়ে বললেন) নাম বাদ দে। ঐ ছেলেটার ওতো ব‌উ আছে। সেদিন বাড়িতে এসেছিলো তোর বাবার সাথে কিসব ডিসকাস করতে, এক ঘন্টার মধ্যে শতাধিক বার ব‌উকে ফোন করেছে! ওর তো নতুন বিয়েও নয়। দু বছরের মেয়েও আছে একটা! এরপর‌ও ব‌উ ছাড়া চলে না তার। আর তুই নতুন ব‌উয়ের সাথে কথা বলার জন্য দরকার খুজিস! বাপ বেটা একরকম! কাজ ছাড়া কিছুই বুঝে না। অপধার্ত!”

আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মুগ্ধ আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের কথায় কি রিয়েকশন দিবে বুঝে উঠতে পারছে না মোটে।সারাজিবন দেখে এসেছে মায়েরা ছেলের আর ছেলের ব‌উয়ের অযাচিত ফোনালাপ সহ্য করেন না। এমনি ছেলে ব‌উয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বললেও বেশিরভাগ মায়েরা ভাবে ছেলে ব‌উয়ের আঁচল ধরে চলছে। অথচ তার মা রেগে আছেন ছেলে কেনো ব‌উয়ের সাথে ফোনালাপ করলো না! মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে কাপড় হাতে ফ্রেশ হতে গেলো সে।

রাতে খাবার টেবিলে আদ্রিশাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে মুগ্ধ বললো, “কি ব্যাপার খাচ্ছেন না কেনো আপনি?”

মালিহা ইয়াসমিন গম্ভীর মুখে বললেন, “ওকে আমি খাইয়ে দেবো। তোকে ভাবতে হবে না।”

‌শ‌ওকত শাহ আর আদ্রিশা দুজন‌ই মালিহার কথার তাৎপর্য বুঝলেন না। তবে মুগ্ধ বুঝেছে, ব‌উকে ফোন করেনি বলেই তার মা রেগে আছেন। ভেবেই মুচকি হাসলো মুগ্ধ। শয়তানি করে বললো, “কেনো উনি কি ছোট বাচ্চা নাকি? যে নিজ হাতে খেতে পারবেন না।”

আদ্রিশা মুখ ফুলিয়ে মালিহার দিকে তাকালো। মালিহা চোখ রাঙিয়ে ছেলেকে বললেন, “সব সময় মেয়েটার সাথে এমন করিস কেনো তুই? তোরই তো ব‌উ! এতো হিংসে কিসের?”

শ‌ওকত শাহ‌ও স্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেকে শুনিয়ে দিলেন কয়েক কথা। সাথে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা থাকা কতোটা জরুরী তা নিয়ে এক দফা বক্তৃতাও দিলেন। এক পর্যায়ে আদ্রিশার পুরা হাতে নজর গেলো মুগ্ধর। কপাল কুঁচকে বললো, “হাতে কি হয়েছে?” মালিহা প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললেন,
“দুপুরের রান্না করতে গিয়ে হাত পুরিয়ে ফেলেছিলো। জালাও করছে ভীষন। তাই আমিই খাইয়ে দিচ্ছি। দুপুরেও দিয়েছি আর এখনো দেবো।”

মুগ্ধ রাগি কন্ঠে বললো, “দুপুরে হাত পুরেছে আর আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না! ওয়াও,,, ঘরে তো আমায় বকছিলে কেনো ফোন করে ব‌উয়ের খোঁজ নেই না। তা তোমার অতি আদরের ব‌উমা আমায় একবার ফোন করতে পারলেন না? তুমিও তো জানাতে পারতে না কি?” ছেলের কথায় তব্দা খেয়ে বসে র‌ইলেন মালিহা। কি উত্তর দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। মুগ্ধ আবার‌ও বললো, “হাতে কিছু লাগানো হয়েছে না কি জালা পুরা ভালো লাগছে?”

আদ্রিশা মুখ ভার করে বললো, “হুম মা মলম লাগিয়ে দিয়েছেন।”

মুগ্ধ মুখ ভেঙিয়ে বললো, “মা মলম লাগিয়ে দিয়েছেন? ভালো তো। তা জালা কমেছে?”

আদ্রিশা মাথা নাড়লো। অর্থাৎ না। মুগ্ধ নিজের চেয়ার আদ্রিশার কাছে টেনে আনলো। মায়ের হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে বললো, “তুমি বসো মা। খেয়ে নাও!”

মালিহা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আহা,,, আমি বসে পরলে মেয়েটা খাবে কি করে শুনি? হাতে জালা করছে শুনলিই তো!”

মুগ্ধ মায়ের কথায় কান না দিয়ে ভাত মেখে আদ্রিশার মুখের সামনে ধরলো। আদ্রিশার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে বললো, “আমি খাইয়ে দিচ্ছি। কি হলো হা করুন!”

আদ্রিশা অস্বস্তি নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির দিকে তাকালো। মালিহা আর শ‌ওকত শাহ দুজনেই মিটিমিটি হাসছেন। আদ্রিশা মুগ্ধকে চোখ দিয়ে তাদের দিকে ইশারা করলো। মুগ্ধ স্বাভাবিক কন্ঠে বললো, “শ্রদ্ধেও বাবা মা! আপনারা খাওয়ায় মনোযোগ দিন। আপনাদের ব‌উমা তার স্বামীর হাতে খেতে লজ্জা পাচ্ছেন!”

মালিহা ঠোঁট চেপে হাসি আটকালেন। শ‌ওকত শাহ‌ও খাওয়ায় মনোযোগী হলেন। আদ্রিশা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে এবার। বাবা মাকে না কি কেউ এভাবে বলে! আদ্রিশা মুখ না খুলায় মুগ্ধ আদ্রিশার কানের কাছে মুখ এনে স্লো ভয়েসে বললো, “হা করবেন না কি বাবা মাকে ঘরে পাঠিয়ে দেবো? আপনি চাইলে অবশ্য আপনাকে নিয়ে আমাদের ঘরেও যেতে পারি!” আদ্রিশা ফট করে হা করে দিলো। মুগ্ধ বাকা হেসে আদ্রিশাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। প্রথমবার আদ্রিশার মনে হলো মুগ্ধ তার স্বামী। মুগ্ধর ভালোবাসা হয়তো তার ভাগ্যে নেই কিন্তু মুগ্ধর তার জন্য যত্নশীলতা, উদ্দীগ্নতা মুগ্ধর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয় বার বার!

চলবে,,,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৩৭
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

মাঝরাতে হঠাৎই ঘুমের রেশ কেটে যায় আদ্রিশার। পাশ ফিরে মুগ্ধকে না দেখে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ব্যালকনিতে কারো কথপোকথনের আওয়াজে হতচকিত হয় বেশ। এতো রাতে কি মুগ্ধ কারো সাথে কথা বলছে? কার সাথে? আর ব্যালকনিতে যাওয়ার কি দরকার? ঘরেই তো কথা বলতে পারতো! এসব ভেবে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গিয়েও থেমে যায় আদ্রিশা। মুগ্ধর গলার আওয়াজে মনে হচ্ছে কারো সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছে তার। কিছু কথা ভেসে এলেও স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না সব। চাপা কন্ঠে কথা বলছে মুগ্ধ। তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অনেকটাই রেগে আছে। এর মধ্যেই ফোন কেটে পেছন ঘুরে তাকায় মুগ্ধ। আদ্রিশাকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনি এখানে?”

মুগ্ধর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় আদ্রিশা‌। ঢোক গিলে বললো, “না ঐ, ঘুম ভেঙে গেছিলো। আপনাকে কথা বলতে শুনলাম তাই উঠে এলাম আরকি। কার সাথে কথা বলছিলেন এতো রাতে?”

মুগ্ধ কৌশলে আদ্রিশার কথা এড়িয়ে যায়। ঘরে এসে বেডসাইড টেবিল থেকে পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। মুগ্ধর এহেন কাজে অবাক হয় আদ্রিশা। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ শুতে চলে যাওয়ায় খটকা লাগছে আদ্রিশার। মুগ্ধ চোখ বন্ধ রেখে বললো, ” দাঁড়িয়েই রাত্রি যাপন করবেন না কি?”

আদ্রিশা কিছু না বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মুগ্ধ চোখ খোলে উঠে বসে আদ্রিশার দিকে দেখলো। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, “তিথির ফোন ছিলো আর,,,,,,,,,”

“আমাকে ছেড়ে দিতে বলেছেন তাই তো?” মুগ্ধর কথার মাঝখানেই বললো আদ্রিশা। মুগ্ধ মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আদ্রিশা আবার‌ও বললো, “আমি জানি মুগ্ধ, তিথি আপু আমার উপর ভরসা করতে পারছেন না। আর সেটাই তো স্বাভাবিক! বয়ফ্রেন্ড অন্য একটা মেয়ের সাথে থাকছে যে মেয়েটা সমাজের চোখে তার ব‌উ, তাকে কি করে ভরসা করা যায়! কষ্ট‌ও হচ্ছে হয়তো ! ডিভোর্স যখন হবেই তাহলে এখন কেনো নয়?”

মুগ্ধ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো, “আদ্রিশা, আপনারা বুঝছেন না। এখন ডিভোর্স সম্ভব নয়। আর তাছাড়া তিথিও দেশে ফিরে নি। আমি চাইছি একবার ও দেশে ফিরুক তার পর নাহয় সব হবে!”

আদ্রিশা মুখ ঘুরিয়ে ব্যালকনির দিকে তাকালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো, “আসল কথাটা বলুন না!” মুগ্ধ ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বললো, “কোন কথা?”

“আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। সেদিন শ্রীমঙ্গল থেকে ফেরার সময় বলেছিলাম। আমি সব জানি মুগ্ধ‌। রবিনের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ঘটনা, তিথির আপনার সাথে ঝগড়া আর, কোম্পানির ডিল হাতছাড়া করা! সব কিছুই জানি।” মুগ্ধ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আদ্রিশার দিকে। আদ্রিশার এদিকে কোনো মনোনিবেশ নেই। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো, “ফেরার দিন আপনি যখন শাওয়ার নিচ্ছিলেন তখন রিসোর্টের রুমে ফোন এসেছিলো‌ । আপনার ফোন বন্ধ থাকায় অফিস থেকে রিসেপশনে যোগাযোগ করেছিলেন আপনার ম্যানেজার। আমিই উঠিয়েছিলাম কলটা। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তিনি আপনি ভেবে কত কথাই বলেদিলেন। বললেন, বিজন্যাস পার্টনারের সাথে ডিল ক্যান্সেল করে শ্রীমঙ্গল ঘুরতে যাওয়া মোটে উচিত হয় নি। আপনার একটা ভুলের জন্য কোম্পানিকে মাশুল দিতে হবে। আমি শুধু হু হা করছিলাম‌ । তারপর লান্চের সময় তিথির ফোন আসায় কথা বলতে যান আপনি। কি ভেবে আমিও পিছু নিয়েছিলাম আপনার‌ । যদিও তিথির কনো কথাই শুনিনি তবে আপনার কথায় মনে হচ্ছিলো সে চাইছে ঐ দিন‌ই আমায় ছেড়ে দেন আপনি। আপনি দৃঢ় ভাবে এর প্রতিবাদে বলেছিলেন, ‘না তা হয় না। একা একটা মেয়েকে এভাবে অচেনা শহরে ফেলে যেতে আমি পারবো না। আর এখন তো ডিভোর্স দেবোই না। রবিন জামিন পেয়েছে। কি থেকে কি করবে তার ঠিক নেই। রবিন থেকে বাঁচাতেই ঘুরতে যাওয়ার বাহানা। নয়তো এত বড় ডিল হাতছাড়া করার প্রশ্ন‌ই উঠে না।’ এরপর‌ও বলবেন আপনি আমার জন্য কিচ্ছু করছেন না? আপনি তিথি ফেরার অপেক্ষা করছেন?ক্ষমা করবেন ইচ্ছাকৃত শুনিনি কিছুই!”

কথাগুলো বলেই বিছানায় শুয়ে পরে আদ্রিশা। মুগ্ধ একপাশে নিশ্চুপ বসে আছে । চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না তার। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তে আজ তিনটি জীবন অগোছালো হয়ে গেছে।

_______________

মনমরা হয়ে ক্লাসে বসে আছে আদ্রিশা। ডিপার্টমেন্টের স্ট্রিক্ট টিচার সজিব স্যার ক্লাস করাচ্ছেন। অথচ আদ্রিশার কোনো ধ্যান নেই। জানালার দিকে চোখ পড়ায় খেয়াল হলো তুহিন আর নীলা একে অপরের চুল টানাটানি করছে আর রুহি মিটি মিটি হেসে ফোন ঘাটছে। হয়তো স্নিগ্ধর সাথে প্রেমালাপে মগ্ন সে। ক্লাস থেকে তাদের এসব কান্ডে হালকা হাসে আদ্রিশা। একসময় ক্লাসের সমাপ্তি হয়, আদ্রিশা তখন‌ বন্ধুদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রুহি ঝটপট ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। আদ্রিশা রুহির দিকে কপাল কুঁচকে বললো, “তুই আমাদের থেকে লুকাচ্ছিস? লাইক সিরিয়াসলি! গ্রেইট!” রুহি মুখ ভার করে নিজের ফোন আদ্রিশার হাতে দেয়। আদ্রিশা শয়তানি হেসে ফোন অন করতে নিলেই কেউ তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। গোল গোল চোখে সামনে তাকিয়ে মুগ্ধকে দেখলো সে। মুগ্ধ রুহির ফোন তার হাতে দিয়ে বললো, “বেড ম্যানার্স আদ্রিশা! অন্যের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে এভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।”

আদ্রিশা ঠোঁট উল্টে বললো, “সি ইজ মাই বেস্টি! প্রেম করছে অথচ আমাদের লুকিয়ে!”

তুহিন মুগ্ধর পাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিশার উদ্দেশ্যে বললো, “হুম, এখন বেস্টি পরে জা! কি সুন্দর সম্পর্ক তাই না আদু। বেস্টির সব সিক্রেটে অধিকার থাকলেও জায়ের সিক্রেটে কিন্তু অধিকার নেই!”

নীলা কথা কাটিয়ে বললো, “ভাইয়া, আপনি জানেন আদ্রিশার জা রুহি কি করে হলো?”

উত্তরে মুগ্ধ মাথা নাড়লো শুধু। হেসে বললো, “কঙ্গ্রেস রুহি! লুকিয়ে প্রেম করার মজাই আলাদা। সো কেউ জোর করলে, বা ব্ল্যাকমেইল করলেই যে তাকে তোমার আর স্নিগ্ধর সিক্রেট শুনাতে হবে, এমন নয়। যখন কেউ বলবে, আমাদের থেকে লুকাচ্ছিস? কনফিডেন্টলি বলবে, ‘হ্যাঁ লুকাচ্ছি। আমাদের পারসোনাল কথা তোদের কেনো বলবো?’ বুঝলে!”

আদ্রিশা ভেঙচি কেটে নীলাকে টেনে মাঠের দিকে চলে গেলো। মুগ্ধ , রুহি, তুহিন‌ও তাদের পিছু নিলো। কিছুদূর গিয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পরে আদ্রিশা। একটা ছেলে এগিয়ে এলো আদ্রিশার দিকে।

“কি ব্যাপার? রেগে আছো মনে হচ্ছে!”

আদ্রিশা বিরক্তি মাখা চেহারায় বললো, “না রেগে নেই।”

ছেলেটা নাছোরবান্দা। একের পর এক প্রশ্ন করে পাগল করছে আদ্রিশাকে। নীলা দু একবার ছেলেটার উদ্দেশ্যে কিছু বললেও পাত্তা পেলো না সে। মুখ ভার করে আদ্রিশার দিকে দেখলো। মুগ্ধ দূর থেকে সব‌ই লক্ষ্য করছিলো। তুহিন মুগ্ধর দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো, “উফ! এই এক ছেলে, সারাক্ষন আদুর পাশে ঘুরঘুর করবে। দেখাচ্ছি মজা!”

মুগ্ধ সন্দেহী গলায় বললো, “কেনো? আদ্রিশার পাশে কেনো ঘুরঘুর করে?” রুহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আদুর প্রতি বেশিই ফিলিংস কি না!”

মুগ্ধ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রুহির দিকে। রুহি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো, “আদুকে ভালোবাসে বলেই জানি আমরা। এখন‌ও স্বীকার করে নি তবে আদুর জন্য ওর কনসর্ন দেখলেই বুঝা যায়। আদুর ধারনা সহজ সরল ছেলে সবাইকে বন্ধু ভাবে এই যা। তাই কিছু বলে না সে। কিন্তু আদুর বিয়ে হয়ে যাবে শুনে সে কি কান্না তার! ‌জানে আদু বিবাহিত এরপর‌ও পিছু পিছু ঘুরার কি আছে বুঝি না!” রুহি কথা শেষ করে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ আদ্রিশাদের দিকে দ্রুত হেটে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে ছেলেটা আদ্রিশার হাত ধরতে উদ্যোত হলো। তৎক্ষনাৎ মুগ্ধ আদ্রিশাকে হেঁচকা টান দিলো। মুগ্ধর টানে আদ্রিশা ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে গিয়ে মুগ্ধর শার্ট খাঁমচে ধরে। মুগ্ধ‌ও আদ্রিশার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচায়। আকস্মিক কান্ডে থম মেরে যায় ছেলেটা। নীলা তুহিন মিটিমিটি হাসছে। রুহি চট করে ছবি তুলে নিলো সে মুহুর্তের। নিজেদের অবস্থান খেয়াল হ‌ওয়ায় আদ্রিশাকে সোজা করে দাঁড় করালো মুগ্ধ। ছেলেটার দিকে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বললো, “হাই! আমি মুগ্ধ। আদ্রিশার হাজবেন্ড!” কথটা শুনে ছেলেটার মুখ ছোট হয়ে গেলো। আদ্রিশার দিকে একপলক দেখে মুগ্ধর সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,”হ্যালো। আমি শাহিন। আদ্রিশার ক্লাসমেট।”

মুগ্ধ মাথা নেড়ে আদ্রিশার দিকে দেখে বললো, “ক্লাস শেষ তো। চলো। ফেরা যাক।”

মুগ্ধর আদ্রিশাকে তুমি সম্মোধনে তব্দা খেয়ে যায় সবাই। আমতা আমতা করে আদ্রিশা বললো, “আপনি আমায়,,,,,”

মুগ্ধ আদ্রিশার কাধের অপর পাশে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনলো। হাসি মুখে বললো, “দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। তোমায় বাসায় ড্রপ করে অফিসে যেতে হবে আবার। সকালে নিশ্চয় মলমটা লাগাও নি?হাতে জালা করছে এখনো? ইশশশ,,,,, তুহিন জানো, তোমাদের ফ্রেন্ড কিন্তু এখনো বাচ্চা। কাল রান্না করতে গিয়ে হাত পুরিয়ে একাকার! খাওয়া দাওয়াতেই ঘোর অনীহা ম্যাডামের। জোর করে খাওয়াতে হয় তাকে।”

তুহিন ভ্রু উচিয়ে বললো, “খাওয়াতে হয় মানে?”

মুগ্ধ আদ্রিশার ডান হাত আলতো করে ধরে বললো, “মানে, খাইয়ে দিতে হয়। তার‌উপর হাত পুরে গেছে, সুতরাং একমাত্র ভরসা আমি! আমি না খাইয়ে দিলে না কি তার পেট‌ই ভরে না! তাই না আদু?”

আদ্রিশা বিষম খেলো মুগ্ধর কথায়। হঠাৎ কি হলো মুগ্ধর? আদ্রিশাকে তুমি বলছে! আবোল তাবোল কথা বলছে! আদ্রিশা কিছু বলবে তার আগেই মুগ্ধ আদ্রিশার কপালের একপাশে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো, “আদু! তোমার বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে চলো। তোমার লান্চের সময়‌ও হয়ে গেছে।”

আদ্রিশা নিঃশব্দে হেটে চললো মুগ্ধ সাথে। তুহিন ঠোঁট চেপে হাসছে। নীলা তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “হায়য়য়,,,,, কি ভালোবাসা!”

রুহি উচ্চস্বরে বললো, “হবে না? স্বামী স্ত্রী বলে কথা!” মুখ গোমরা করে শাহিন উল্টো পথে হেটে চললো।

চলবে,,,,,,,,