যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৫৮
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
সানি ভ্রু কুঁচকিয়ে বললো, “আপনার কথায় মনে হচ্ছে, যেদিনের কথা বলছেন সেদিন আদু এদেশে এসেছে। তো আপনারা এতোদিন খুঁজেন নি ওকে? এক মাস পর স্বামী স্ত্রীর অভিনয় করছেন কেনো?”
তিথি কথার পিঠে বললো, “খুঁজেছি। কিন্তু খুঁজলেই যে পেয়ে যাবো এমন তো নয়! আদ্রিশার বাবা মা বলেছিলেন ও দেশে নেই। সুতরাং সে কোথায় আছে তা জানা হাতের মোয়া ছিলো না। মুগ্ধ বার বার ছুটে গেছে ও বাড়িতে, আঙ্কেল আন্টি তাদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরেন নি। আদ্র তো মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ভাবি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন তাই আমাদের সাথে তাকে দেখা করতে দেয়া হয় নি। আর রইলো বাকি, আদ্রিশার বন্ধুরা। ওকে দেয়া ওয়াদা ভাঙা তাদের পক্ষে অসম্ভব বলেই জানিয়েছে তারা। অবশ্য আদ্রও তাদের বলেছে এমনটা করতে।”
সানি ভাবনায় মগ্ন হয়ে বললো, “তাহলে এখন কিভাবে পেলেন?”
তিথি হাসলো খানিক। মুগ্ধ গলা কেশে বললো, “আদ্রিশার আত্মীয় পরিজন, বন্ধুদের থেকে কোনো হ্যাল্প না পেয়ে নিরাশ হয়ে পরেছিলাম। স্নিগ্ধই তখন সম্বল!”
আদ্রিশা থেমে থেমে বললো, “স্নিগ্ধ তো জানতো না কিছু।”
মুগ্ধ মৃদু হেসে বললো, “রুহি তো জানতো!”
তিথি মুগ্ধর কথায় যোগ দিয়ে বললো, “যদিও স্নিগ্ধ প্রথম প্রথম মুগ্ধকে সাহায্য করতে চায় নি ইন ফ্যাক্ট খোঁটাই দিয়ে গেছে তবে মুগ্ধকে তোমায় পাগলের মতো খুঁজতে দেখে রুহির থেকে কিছু ইনফরমেশন নিয়েছিলো। স্নিগ্ধ যখন বলে তুমি এখানে আছো তখন আর কিছু ভাবারই ছিলো না আমাদের। মুগ্ধ ফোন করে বললো, ‘তিথি রেডি হও। সিঙ্গাপুর যেতে হবে, আদ্রিশাকে আনতে!’ আমিও আমার পুটলি বেধে বেরিয়ে পরেছিলাম।”
আদ্রিশা চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটিয়ে বললো, “হোটেলে হানিমুন প্যাকেজে উঠেছেন কেনো তাহলে?”
মুগ্ধ মৃদু হেসে বললো, “তোমার কাছে আসার এতো তাড়া ছিলো যে হোটেল বুক না করেই বেরিয়ে গেছিলাম। এখানে এসে থমসন খুব কাছে ছিলো। হোটেলে গিয়ে জানতে পারি একটাই রুম আছে। তাও হানিমুন প্যাকেজে। ঐ সময় নতুন হোটেল খোঁজে সময় নষ্ট করা যেতো না তাই মিছিমিছি স্বামী স্ত্রী সাজতে হলো।”
তিথি তাড়াহুড়া করে বললো, “বাট খাট আলাদা ছিলো! আসলে ডাবল ব্যাড ছিলো তো তাই আমরা আলাদা করতে পেরেছিলাম। সো মুগ্ধ ইজ স্টিল ভার্জিন!”
মুগ্ধ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আদ্রিশা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সানি হালকা কেশে পরিবেশ শান্ত করে বললো, “আচ্ছা, আদ্রিশার সাথে দেখা হওয়াটা কি প্ল্যান ছিলো?”
মুগ্ধ ঘাড় দুলিয়ে বললো, “অবশ্যই! রুহির ইনফরমেশন অনুযায়ি আদ্রিশার অরচার্ড রোডের শোরুমে থাকার কথা। তাই সকাল সকাল সেখানেই উপস্থিত হই আমরা। ফলাফল , আমাদের দেখে আদ্রিশার ভড়কে যাওয়া!”
আদ্রিশা ভ্রু কুঁচকে বললো, “তাহলে তখন বললেন কেনো হানিমুনে এসেছেন?”
“তোকে জ্বালাতে! তাই না?”–সানি কথাটা বলেই ভ্রু নাচালো মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে। মুগ্ধ কিছু বললো না। তিথি মাথা নুয়ালো। আদ্রিশা তীব্র রাগ নিয়ে বললো, “রাতের ক্যান্ডেল লাইট ডিনার?”
তিথি দাঁত কেলিয়ে বললো, “শোরুম থেকে যাওয়ার সময়, ফোনে কি কথা বলেছিলে মনে আছে?”
আদ্রিশার মনে পরলো শোরুম থেকে বেরিয়ে টেক্সিতে ওঠার সময় ফোনে কথা বলছিলো সে। বলেছিলো, “ইয়াহ! আই উইল বি ইন ধানশিড়ি এট নাইন। সি ইউ গাইজ, বাই!”
মুগ্ধ মৃদু হেসে বললো, “যদিও প্ল্যান ছিলো ওখানে তোমার সাথে দেখা হলে আমরা রোমান্সের এক্টিং করবো আর তুমি ফুলবে। কিন্তু ভাবি নি আমাদের টেবিলের পাশেই তোমাদের টেবিল হবে। তোমায় দেখার পর রোমান্সের ডোজ বাড়াতে হয়েছে খানিক সাথে এক্সট্রাও করতে হলো।”
আদ্রিশা গোল গোল চোখ করে বললো, “তার মানে এখানে আসাটাও আপনাদের প্ল্যান ছিলো?”
তিথি ফিক করে হেসে দিলো। মুগ্ধ না বোধক মাথা নেড়ে বললো, “যদি জানতাম তুমি সানির সাথে থাকছো তবে অবশ্যই তার কাছেও স্বামী স্ত্রীর পরিচয় দিতাম। বিজন্যাস পার্টনারের কথাটা বলতাম না। ঘটনাটা সম্পূর্ণই কাকতালীয় ছিলো।”
সানি দুষ্টু হেসে বললো, “আপনি শিওর ছিলেন, আদ্রিশা জ্বলে পুরে আপনার কাছে এসে অধিকার ফলাতো? আপনাকে ‘ভালোবাসি’ বলতো?”
মুগ্ধ অসম্মতি জানিয়ে বললো, “উহু! জ্বালানো তো একটা ধাপ ছিলো। আসল কার্যসিদ্ধি তো পরে হতো!”
তিথি লম্বা শ্বাস ফেলে বললো, “ভাগ্যিস এখনই সব ফাঁস হয়ে গেলো নয়তো কাল যে কি হতো আল্লাহ জানেন!”
সানি উৎসাহ নিয়ে বললো, “কি হতো?”
তিথি ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললো, “মুগ্ধর প্ল্যান অনুযায়ি কালই আদ্রিশার মুগ্ধর কাছে ফিরার কথা ছিলো।”
সানি কপাল কুঁচকে বললো, “কি এমন ভয়াবহ প্ল্যান?”
তিথি বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মুগ্ধ চোখের ইশারায় তাকে বলতে মানা করছিলো। আদ্রিশা খেয়াল করলো সেসব। ভাঙা গলায় বললো, “তিথি আপু, থামলেন কেনো? বলুন না কি প্ল্যান ছিলো?”
তিথি মুগ্ধর চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করে বললো, “মেরিনা বে স্টেন্ড! ওখানে কাল কিছু উৎসব আছে। আর তোমারও যাওয়ার কথা ছিলো সেখানে। যতোটুকু শুনেছি আরকি রুহির থেকে। তো মুগ্ধর প্ল্যান ছিলো আমরাও সেখানে যাবো। তারপর ড্রিঙ্ক করার নাটক করে আমি পরে থাকবো কোথাও একটা। আর মুগ্ধ লেকে ঝাপ দিবে। যেহেতু সাতার জানে না সে সুতরাং ডুবে যাওয়ার পুরো চান্স ছিলো। আমি হুশে নেই দেখে তুমি নিশ্চয় মুগ্ধকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আশেপাশের মানুষরা মুগ্ধকে তীরে আনতে পারলে অথবা কোনো ভাবে সে তীরে চলে আসতে পারলে কান্নায় ভেঙে পরে মুগ্ধর প্রতি তোমার ভালোবাসা ষোল আনা প্রকাশ করতে।”
আদ্রিশা বড় বড় চোখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধ মাথা চুলকে উল্টোদিক হয়ে আছে। সানি চোখের পাতা ঝাপটিয়ে বললো, “মাই গড! আপনি তো মরার প্ল্যান করছিলেন বস। আচ্ছা যদি আদুর চোখের সামনে কিছু না ঘটতো , তখন? আর এই যে আপনি, (তিথির দিকে তাকিয়ে) ডেইন্জারাস মহিলা! ছেলেটা এভাবে পানিতে হাবুডুবু খেতো আর আপনি মরার মতো পরে থাকতেন?”
তিথি রাগ দেখিয়ে বললো, “এক্সকিউজ মি! এমন কিছুই হতো না। সব কিছু এমন ভাবেই প্ল্যাস করতাম যেনো আদ্রিশার চোখের সামনেই হয়। আর আমি কি পাগল? যে ওকে হাবুডুবু খেতে দেখে পরে থাকবো! হুহ!”
কথাটা বলে আদ্রিশার দিকে চোখ গেলো তিথির। আদ্রিশা কেঁদে চলেছে। তবে চোখে মুখে ভয়ানক রাগ প্রকাশ পাচ্ছে তার। তিথি ঝটপট বললো, “আদ্রিশা, আমি কিন্তু রাজি ছিলাম না এতে। মুগ্ধ প্লেইনে বসে এসব ভাবছিলো! বুঝতে পারছো, কতোটা সিরিয়াস ছিলো সে? কোন একটা হিন্দি সিনেমা থেকে কপি করেছে ও। বাদর কোথাকারের! জোর করে রাজি করিয়েছে আমায়। না না রাজি করায় নি, বরং ধমকেছে!”
সানি ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে হালকা হেসে বললো, “মিস! চলুন আমরা বাইরে যাই। ওদের কথা বলতে দিন। মান অভিমান আগে যা জমা ছিলো এখন নিশ্চয় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে!”
তিথি জিব কামড়ে বেরিয়ে গেলো। সানি দরজা ভেজিয়ে চলে গেলো তিথির পেছনে। মুগ্ধ এখনো ওপাশ ফিরেই আছে। হঠাৎই কাধে ভারি কিছুর ধাক্কা লাগায় পেছন ফেরে সে। সাথে সাথে বালিশ ছুড়ে মারে আদ্রিশা। প্রথম বালিশ কাধে লাগলেও এবারের টা নাক বরাবর লেগেছে। মুগ্ধ নাকে হাত বুলিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। আদ্রিশা বিছানায় রাখা কম্বল দুহাতে উঠিয়ে টেনে আনলো মুগ্ধর দিকে। তারপর কোনোভাবে ছুড়ে দিলো মুগ্ধর উপর। কম্বলটা ভারি থাকায় মুগ্ধর শরীরেও লাগে নি সেটা। আদ্রিশা ঠোঁট উল্টালো তাতে। ছুট্টে গিয়ে সোফায় রাখা বালিশ নিয়ে মারতে লাগলো মুগ্ধকে। আর বলতে লাগলো,
“কি ভেবেছেন টা কি আমাকে? আমি বোকা? পাগল আমি? মোটেও না। এতো কষ্ট দিয়েও শান্তি পান নি আপনি! এখন আবার লেকে ঝাপ দিয়ে আমায় চিরতরে দোষী করতে চেয়েছিলেন? আপনাকে তো আর ছাড়ছি না। মরার খুব ইচ্ছে না, দাঁড়ান মারছি আপনাকে! আমার হাতেই মরুন! শয়তান, বাদর, হনুমান, অসভ্য!”
মুগ্ধ কোনোরকম আদ্রিশাকে টেনে ধরলো। তার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে আটকে দিলো মুগ্ধ। আদ্রিশা বালিশ টানছে। মুগ্ধ আর তার মাঝখানে বেচারা বালিশের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। আদ্রিশা রাগার চেষ্টা করে বললো, “ছাড়ুন বলছি! ছাড়ুন আমায়!”
মুগ্ধ আদ্রিশার চোখের দিকে নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “না। ছাড়লে যদি আবার পালাও। রিস্ক নেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই ম্যাডাম! কি বলছিলে, তোমার হাতে মরতে! নাও মারো। শেষ করে দাও আমায়। অবশ্য, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে মরণ আমার এখানেই নির্ধারিত। তোমার এই চোখে তাকানোতেই মরে যাবো আমি। তলোয়ার চাই না আর। কি গো, মরতে দেবে তো তোমাতে! আমার হবে কি?”
আদ্রিশার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসলো। শত চেষ্টায়ও চোখ ফেরাতে পারছে না সে। মুগ্ধর চোখে হারিয়ে যাচ্ছে সে। হুশ হারিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ালো দুজনের কাছে।
চলবে,,,,,,,,