যদি আমার হতে পর্ব-৫৯ এবং শেষ পর্ব

0
1351

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৫৯ (অন্তিম পর্ব)
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

মালিহা ইয়াসমিন চরম রেগে চোখ মুখ কালো করে বসে আছেন। আদ্রিশা সেই কখন থেকে তাকে জড়িয়ে আছে, কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া করলেন না। আদ্রিশা তার কাধে মাথা রেখে বললো,

“মা, এতো রাগ তোমার! আমি কখন থেকে আদর করছি তোমায়। তবুও হাসছো না? সরি তো!”

মালিহা গা ঝাড়া দিয়ে আদ্রিশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। অভিমানী কন্ঠে বললেন,

“আমি তোর কে? আমি রেগে থাকি আর হাসি তাতে কি আসে যায় বলতো? আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না। হবু ব‌উমা তুই আর আমি শাশুড়ি, ব্যাস! তাইতো?”

আদ্রিশা মুখ ফুলিয়ে বললো,

“আর হবে না। আমি তো পিছুটান থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাম শুধু। তাই যোগাযোগ রাখতে চেয়েও পারি নি। কিন্তু এখন তো ফিরে এসেছি বলো। এখন‌ও কাছে টেনে নেবে না?”

মালিহা আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ‌ও মিষ্টি হাসলো।

__________________

চার মাস পর আজ মুগ্ধ আদ্রিশার বিয়ে। জেসমিনের প্রেগন্যান্সির জন্য‌ই বিয়ের ডেট পিছিয়ে আজকের দিন ধার্য করা হয়। তিথি বিদেশ ফিরে গেছে গত সপ্তাহে। যদিও বিয়েটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার তবুও সময়ে হলো না। তবে এই চার মাসে আরো দুটো বিয়ে হয়েছে। রুহি স্নিগ্ধ আর নীলা তুহিনের। তুহিন এখনো কোনো জব পায় নি তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানো অব্দি নীলা তার বাপের বাড়িই থাকবে। সম্পর্কটাকে হালাল করার প্রচেষ্টায় তাই কাবিন হয়ে গেছে। আর রুহি স্নিগ্ধের ব্যাপারে জানাজানি হয় মুগ্ধর থেকে। ছেলে, পরিবার ভালো। বিধায় মত দেন রুহির বাবা মা। মনোয়ারা বেগম ছেলের পছন্দের সহিত একমত। এদিকে আদ্র জেসমিনের দ্বিতীয় সন্তান জিহাদের জন্মের একমাস পূর্ণ হয়েছে। আরিয়া বড় বোনের ভুমিকায় বেশ ভালোই নাম কামিয়েছে। সারাক্ষন পুচকুর পাশে পাশে থাকছে। পুচকুর সাথে কতো কথাই বলে সে। আদ্রিশার কাছে নিয়ে আসে হাজার‌ও অভিযোগ। ভাই তার কথা বলে না, খেলে না, খালি কাঁদে, ছোট্ট বলে কোলে নিতে সমস্যা হয় হেনতেন কতো কিছু! আরিয়ার অভিযোগে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে আদ্রিশা। বিগত মাসে মুগ্ধর সাথে সম্পর্ক অনেক মাখো মাখো হয়ে উঠেছে তার। এখন সে হাসতেই ভালোবাসে। আগের মতোই দুষ্টুমিতে মেতে থাকে ভাই ভাবির সাথে। বাবার কাছে হুট করে বায়না ধরে শপিং করার। মায়ের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ‌ও খেলা হয় জম্পেশ !

“এই এতো নড়িস কেনো? সাজাতে তো দিবি!”

নীলার কথায় ভ্রু উচিয়ে তাকালো আদ্রিশা। মুখ ফুলিয়ে বললো,

“আমি ক‌ই নড়লাম? ওরাই ঠিক ঠাক সাজাতে পারছে না!”

রুহি আদ্রিশার খোপায় ক্লিপ লাগিয়ে বললো,

“না না, তুই কেনো নড়বি! ভুমিকম্প দিচ্ছে কি না, তাই আমরা হেলেদুলে পরছি।”

আদ্রিশা ভেঙচি কেটে বললো,

“ভাল লাগে না আর! থাম তো!”

রুমানা আহমেদ দৌড়ে এসে আদ্রিশার কানে ফোন লাগিয়ে ইশারায় কথা বলতে বললেন। আদ্রিশা হতভম্ব হয়ে বললো,

“হ্যালো!”

ওপাশ থেকে উৎফুল্ল আওয়াজে ভেসে এলো,

“কেমন আছো আদ্রিশা?”

গলার আওয়াজ চেনা চেনা ঠেকলো তার। জিজ্ঞাসু গলায় বললো,

“তানহা আপু?”

ওপাশ থেকে মিষ্টি আওয়াজে বলে উঠলো,

“হ্যাঁ। সেদিন ভেবেছিলাম মানিয়ে নিতে পারবে কি না আজ ভাবছি কতো আপন করে নিলে সবাইকে!”

আদ্রিশা হাসলো। তানহার সাথে টুকটাক কথা বলে ফোন নামিয়ে রাখলো খাটে। স্নিগ্ধ চেহারায় লাজুক হাসি খুব মানাচ্ছে কনে কে। ইতিমধ্যে সাজানোও কম্প্লিট। আদ্রিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। সেবার বিয়েতে খুশি ছিলো না সে, খালি ভাবছিলো কিভাবে বিয়ে থেকে বাঁচা যায়। আর এখন এই বিয়ের জন্য‌ই উতলা হয়ে উঠেছে।

মুগ্ধ শের‌ওয়ানি পড়ে মাথায় পাগড়ী সেট করেছে। সেও নিজেকে নিরক্ষন করছে খুব। স্নিগ্ধ দুষ্টুমি করে বললো,

“কি ব্যাপার ভাই? আজ এতো উৎফুল্ল!”

মুগ্ধ ভ্রু উচিয়ে বললো,

“তুই ছিলিস না? সেবার তো রাজকুমার সেজেছিলিস ইম্প্রেস করার চক্করে!”

স্নিগ্ধ কপাল কুঁচকে বললো,

“তখন কি অমার বিয়ে ছিলো না কি? বিয়েতে দেখো নি, নার্ভাসন্যাসের জ্বালায় লাল নীল বেগুনি হচ্ছিলাম আমি। আর তোমায় দেখে মনে হচ্ছে, কোনো ব্যাপার‌ই না। একদম চিল মোডে আছো!”

মুগ্ধ বুকের পাশে ব্রোচ ফিট করে বললো,

“থাকার‌ই কথা। নার্ভাস তো আদ্রিশা হবে, আমি তো দারুণ চিল করবো। বুঝলি কিছু?”

স্নিগ্ধ মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে কিছুই বুঝে নি। মুগ্ধ হালকা হেসে স্লো ভয়েজে বললো,

“বাচ্চার বাবা হয়ার বয়স হয়ে গেলো এখনো সব খোলসা করে বলতে হয়! গাধা কোদাকার! রুহি যে কেমনে তোরে বিয়ে করলো, আল্লাহ জানেন!”

______________

আদ্রিশার চোখের পাতা হালকা ভিজেছে। তার বাবা মায়ের চোখে আজ জল নেই। যা আছে তা হলো, খুশি। এক রাশ ভালোবাসা, আর দোয়া। ভাবি জেসমিন ছেলে জিহাদকে কোলে ঘুম পারিয়েই আদ্রিশাকে বিদায় জানালো। একা সেই কাঁদছে। আদ্র তাকে সামলাতে গেলে কটমট চোখে তাকালো জেসমিন। আদ্র ভেবে পায় না যেখানে কনের চোখে জল নেই সেখানে কনের ভাবি কেঁদে ভাসাচ্ছে কেনো। আদ্রর গোমড়া মুখ দেখে আরিয়া খিলখিল করে হাসছে। আদ্রিশাকে জড়িয়ে বিদায় দিতে গেলে আদ্রিশা ঠোঁট উল্টে বললো,

“আরু?ফুপ্পি চলে যাচ্ছি! কষ্ট হচ্ছে না তোর?”

আরিয়া মাথা নেড়ে বললো,

“না। তুমি কি দূরে কোথাও যাচ্ছো না কি, ফুপাইয়ের কাছেই তো থাকবে! মন চাইলে চট করে দেখা করতে পারবো আমি।”

আদ্রিশা গাল টেনে দিলো তার।

মুগ্ধর শোবার ঘরে ফুলে সাজানো খাটের উপর হাত পা গুটিয়ে বসে আছে আদ্রিশা। এর আগেও এ ঘরে থেকেছে সে, এমনকি এমন‌ই এক দিনে এ যায়গায় বসে ছিলো। তখন অস্বস্তি হচ্ছিলো আর এখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। বুক কাঁপছে তার। হৃৎস্পন্দন ঘন থেকে তীব্র হচ্ছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। অস্থির চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। এখন‌ও মুগ্ধ আসে নি। খাটে বসে বসে কোমর ব্যাথা হয়ে গেছে আদ্রিশার। উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা ঝাড়লো সে। ধীর পায়ে হেটে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো আদ্রিশা। খানিক পর‌ই কোমরে কারো স্পর্শ পেলো আদ্রিশা। ঘাড় ঘুরাতে চেয়েও পারলো না। কাধের উপর গরম নিঃশ্বাস পরছে। সময়ের সাথে সাথে ভারি হচ্ছে সে নিঃশ্বাস। হাতের স্পর্শ কোমর থেকে পেট অব্দি আসতেই খাঁমচে ধরলো আদ্রিশা। আমতা আমতা করে বললো,

“কিছু বলার ছিলো!”

মুগ্ধ মাতাল হ‌ওয়া কন্ঠে বললো,

“বলো!”

আদ্রিশা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

“আমি কি আপনাদের মাঝখানে চলে এসেছিলাম?”

মুগ্ধ ছেড়ে দেয় আদ্রিশাকে। এক হাতে ঘুরিয়ে তাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বললো,

“এর আগে কতোবার জিজ্ঞেস করেছো এ কথা?”

আদ্রিশা চোখ ঘুরিয়ে বললো,

“ক’বার উত্তর দিয়েছেন আপনি?”

মুগ্ধ লম্বা শ্বাস টেনে বললো,

“আদ্রি‌শা? দুজন ব্যাক্তির মধ্যে কখনোই তৃতীয় জনের প্রবেশ ঘটে না, যদি না সেই দুজন ব্যাক্তির মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরে! আমার আর তিথির সম্পর্কে ফাটল না ধরলে সেখানে তোমার প্রবেশ কেনো অস্তিত্ব‌ও থাকতো না। তাই বলছি, বার বার এক কথা বলো না। মোড‌ও নষ্ট করো না আমার!”

আদ্রিশা শাড়ির আঁচলে আঙুল পেঁচিয়ে বললো,

“আরেকটা কথা।”

মুগ্ধ কপালে আঙুল ডলে বললো,

“সব প্রশ্ন কি আজকের জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন?”

আদ্রিশা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,

“আপনি তো আমার বাবা মাকে বলেছিলেন আমার সিদ্ধান্ত‌ই শেষ সিদ্ধান্ত। তাহলে, যদি আমি আপনার কাছে না ফিরতে চাইতাম তবে কি আপনি আমায় ফিরিয়ে আনতেন না!”

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো,

“আশ্চর্য! এমন কিছু যখন হয় নি তখন এসব নিয়ে কেনো কথা হচ্ছে?”

আদ্রিশা ঠোঁট উল্টে মুখ ফুলালো। মুগ্ধ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,

“না। কেউ ফিরতে না চাইলে তো তাকে জোর করা যায় না। তাই তোমার সিদ্ধান্তের সম্মান জানিয়ে ফিরে আসতাম আমরা। আর তারপর তিথিকে বিয়ে করতাম!”

আদ্রিশা গোল গোল চোখে তাকাতেই মুগ্ধ কড়া গলায় বললো,

“ডাফার! ‌অবশ্য‌ই ফিরে আসতাম না। তোমায় তুলে নিয়ে আসতাম। দরকার পরলে জোর করেই বিয়ে করতাম। গট ইট? মাহবুব শাহ নিজের অধিকার, ভালোবাসা ছাড়ে না। আর তুমি তো আমার জীবন,কি করে ছেড়ে দি বলোতো?”

আদ্রিশা লাজুক হাসলো। মুগ্ধ তড়িঘড়ি পাজাকোলা করে তুলে নিলো আদ্রিশাকে। আদ্রিশা হকচকিয়ে তাকাতেই মুগ্ধ গম্ভীর গলায় বললো,

“তোমার যত প্রশ্ন বাকি সেসব পরে শুনবো। এখন আমার ব‌উ চাই! বুঝেছো? সো নো মোর কুয়েশ্চন!”

আদ্রিশা মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। পবিত্র ভালোবাসায় দুটি প্রাণের এক হয়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়েছে। রাতের অন্ধকার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে একে অপরের প্রতি মগ্নতাও বেড়ে চলেছে তাদের। আজ তাদের ভালোবাসাও পূর্ণতা পেলো।

_______________

লন্ডনের নিজ বাসভবনের ছাদে গরম কফির মগ হাতে নিয়ে তারা গণনায় ব্যাস্ত তিথি। দু দিন আগে মুগ্ধ আদ্রিশার বিয়ের খবর শোনার পর থেকেই নিজেকে যথাসম্ভব ব্যাস্ত রাখছে সে। ভেতর টা জ্বলছে ভীষন। যদিও অনেক আগে থেকেই এই পরিণতি জানতো সে তবে কেনো জানি মেনে নিতে পারছে না। চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা করেই এদিক ওদিক দেখছে সে। পাশে রাখা এলব্যাম থেকে মুগ্ধর ছবি বের করে তিথি। মুগ্ধর একটাই ছবি ছিলো তাতে। বাকিগুলো সব পুরিয়ে দিয়েছিলো নিজ হাতে। আজ সেই দু বছর পুরনো ছবিতে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসলো তিথি। কান্না জড়িত গলায় বললো,

“অনেক অনেক শুভ কামনা মুগ্ধ। নিজের ভালোবাসকে জয় করেছো। বিয়ে করেছো। আমি খুব খুশি। উহু, আমার থেকেও বেশি তোমরা দুজন খুশি। তাই তো? আমার কষ্ট হচ্ছে না দেখো! হাসছি আমি। খুব হাসছি। আরো হাসবো। সামলে নিয়েছি নিজেকে, দেখছো তুমি? তোমার সব ছবি পুরিয়ে দিয়েছি জানো, এটাও কি পুরিয়ে দেবো? না না, এটা থাক না। প্লিজ! তুমি তো আর আমার ন‌ও। এই ছবিটা, তোমার স্মৃতি হিসেবে থাকতে পারে না আমার কাছে? আদ্রিশার কাছে তো তুমি আছোই। সম্পূর্ণ তুমিটাই তো ওর নাগালে। আমি এই ছবি নিয়েই ভালো থাকবো। রাখি?”

কথাগুলো বলেই বুকে জাপটে ধরলো সে ছবি। চোখের জল ঝরিয়ে মনে মনে আওড়ালো,

“যদি আমার হতে,
থাকতে আমার হয়ে
শুধু আমায় ভালোবেসে!!
যদি আমার হতে,
রাখতাম আমার করেই তোমায়
জড়িয়ে জাপটে ধরে!!
যদি আমার হতে,
শুধু আমার‌ই হতে!”

সমাপ্ত❤