যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪৬
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
আদ্র অসম রাগ নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
“কি যা তা বলছিস আদু!? এই মেয়ে আর মুগ্ধ কেনো মেইড ফর ইচ আদার হবে? তোর কথা বার্তায় তো লাগছে এই মেয়ে মুগ্ধর স্ত্রী!”
আদ্রিশা মাথা নেড়ে আসরাফ খান আর তার স্ত্রীকে ঘরে ঢুকিয়ে বললো,
“ইনি মুগ্ধর স্ত্রী নন তবে হবু স্ত্রী!”
কথাটা যেনো খুব বড় ধাক্কা খেলো মালিহার হৃদয়ে। সোফার হাতলে ভর দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“কি হচ্ছে এসব? আদ্রিশা, মা! ক্লিয়ারলি বল না যা বলার! আমার যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তোর কথা শুনে। কেনো এমন উল্টো পাল্টা কথা বলছিস?”
আদ্রিশা ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো,
“মা, মুগ্ধ আর আমার বিয়েটা মিসান্ডার্স্টেন্ডিং ছিলো! উনি আমাকে নয় তিথি আপু মানে (তিথির দিকে আঙুলের ইশারায়)ওনাকে ভালোবাসেন।”
আদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,
“যদি তাই হবে তবে এতোগুলো দিনের সম্পর্ক কি ছিলো?”
আদ্রিশা মুগ্ধ আর তিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“বলছি। সবাই শান্ত হন। আমাকে সম্পূর্ণ কথা বলতে দিন। আসলে, বিয়ের আগেই আমি মুগ্ধকে বলেছিলাম আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আর তাকেই বিয়ে করবো। কিন্তু মুগ্ধ আমাকে তিথি আপুর কথা বলার সুযোগ পান নি। তাই একাই সিদ্ধান্ত নেন, আমায় বিয়ে করবেন। যেহেতু আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি না সুতরাং বিয়েটারও কোনো মূল্য নেই আমাদের কাছে। তাই বিয়ের পর দুজনে আলাদা হয়ে যাবো আর যার যার ভালোবাসার কাছে ফিরে যাবো! কিন্তু বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ার পর রবিনের আসল চেহারা সামনে আসে। বিয়ের আসরে যখন শূণ্য হাতে ফিরেছিলাম তখন লোকচক্ষুর কাছে মাথা নুয়াতে হয়েছে। অপমানজনিত কথা তীরের মতো বিধছিলো! আমাকে, আমার পরিবারকে ঐ পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতেই মুগ্ধ আমার হয়ে কিছু কথা বলেছিলেন মাত্র। অথচ তার উপর ভিত্তি করে সবার মনে হলো মুগ্ধ আমায় ভালোবাসেন। (মালিহার দিকে তাকিয়ে) মা, তুমি আমাকে ঘরের বউ করার জন্য উপস্থিত সবার সামনেই আবেদন করেছিলে। কিন্তু একটা বার তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো নি, সে আদৌ রাজি কি না! আমার বাবা মাও তাতে আপত্তি করেন নি। সবার কথা ভেবেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম আমি। যদিও নিজেকে বুঝিয়েছিলাম বিয়ের পর সব ঠিক হবে। এই পরিবারকে নিজের বলেই গ্রহণ করবো। কিন্তু ভাগ্য তো অন্য কিছু শুনিয়ে দিলো। বিয়ের রাতেই মুগ্ধ সব কথা জানান। কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসতেন তিথি আপুকে। পড়াশুনার জন্য বিদেশ যাওয়ার সময় জানতে পারেন তিথি আপুর বাবার পরিচয়। ততদিনে কিছুই করার ছিলো না। সম্পর্ক কি ভেঙে দেয়া যায়? অপেক্ষায় ছিলেন, কোনো একদিন সব ঠিক হবে।”
কথা শেষ হওয়া মাত্রই মনোয়ারা বেগম গর্জে উঠে বলেন,
“কি ঠিক হবে? যে ব্যাক্তি আমাদের ধোকা দিয়েছে তার পরিবারের সাথে কোনো ভাবেই সম্পর্ক গড়া যাবে না! আর তুমি কেমন স্ত্রী? নিজের স্বামীকে অন্য এক মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছো!”
আদ্রিশা খানিক হেসে বললো,
“ফুপি! উনি আমার স্বামী কাগজে কলমে। মনের দিক থেকে কোনো ভাবেই কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের মাঝে! এই সারে ছ’মাসের সম্পর্কে সমাজের চোখেই স্বামী স্ত্রী ছিলাম আমরা, চার দেয়ালে দুজন অপরিচিত!”
মনোয়ারা বেগম চোখ মুছে বলেন,
“তোমার কোনো সমস্যা নাই থাকতে পারে। কিন্তু আমার আছে! অতীত ভুলতে বসেছিলাম। আবারও সামনে এসে আমাকে দূর্বল করতে পারবে না কেউ। না, কখনো না। ও বাড়ির কারো সাথেই কোনো সম্পর্ক গড়বে না।”
মনোয়ারা বেগম উপরের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। ছেলে স্নিগ্ধর কথায় থেমে গেলেন তিনি।
“তুমি কি বাবার সাথে সুখি নও মা?”
কান্না ভেজা গলায় কথা টা বলে স্নিগ্ধ। মনোয়ারা বেগম হতচকিত হয়ে বলেন,
“স্নিগ্ধ! তোর বাবার সাথে আমি কখনোই অসুখী নই। ঐ মানুষটা সেদিন ছিলো বলেই বেঁচে গেছি আমি। আছে বলেই আজও জীবিত আছি!”
স্নিগ্ধ অভিমানী কন্ঠে বললো,
“যদি তাই হয়, তবে কেনো এই লোকটার উপস্থিতি তুমি সহ্য করতে পারছো না? যা হয়েছে সব তো অতীত। বর্তমান থেকে মুখ ফিরিয়ে কেনো নিচ্ছো?”
মনোয়ারা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন ছেলের কথায়। আদ্রিশা এগিয়ে এসে মনোয়ারা বেগমের সামনে দাঁড়ায়। ওনার হাত ধরতে গেলেই তিনি ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেন । আদ্রিশা নিচের ঠোঁট কামরে বললো,
“একবার ভাবুন। সেদিন আসরাফ আঙ্কেলের ভুলের মাঝেও ঠিক ছিলো। উনি আপনাকে ধোকা দিয়েও বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সেদিন যদি তিনি আপনাকে বিয়ে করতেন, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন কোনো একদিন আপনিও আমার জায়গায় দাঁড়াতেন না! বিয়েটা নাহয় সেদিন হয়ে যেতো। কিন্তু তারপর? ভালো থাকতে পারতেন? সুখি হতেন ওনার সাথে? না, পারতেন না। স্বামী স্ত্রীর সামাজিক বৈধতা থাকলেও কখনো স্বামী স্ত্রী হতে পারতেন না আপনারা। আর আঙ্কেল! যার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে, আপনার ডাক্তার সাহেব! তাকে পেয়ে আপনি ভালো নন? আসরাফ খানের ধোকার পরই কিন্তু ওনাকে পেয়েছেন আপনি। সেক্ষেত্রে ওনাকে মাফ করাই যায়!”
মনোয়ারা ঠাস করে চড় বসিয়ে দেন আদ্রিশার গালে। আদ্র এগুতে গিয়েও থেমে যায়। মালিহাও কেঁপে উঠেন খানিক। তারপর সব চুপ। আদ্রিশা স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“বাবা! আপনি অন্তত বুঝুন! আসরাফ আঙ্কেলও মুগ্ধর মতো কাওকে জানাতে পারেন নি নিজের ভালোবাসার কথা। বাধ্য হয়েই পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তার শাস্তি ওতো পেয়েছেন। এতোগুলো বছর তেজ্য পুত্র হয়ে রয়েছেন নিজের বাবার কাছে।(শওকত শাহ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন) হ্যাঁ , বাবা। আসরাফ আঙ্কেলের বাবা ওনাকে তেজ্য পুত্র করেছিলেন। আর উনি জানতেনও না যে, ফুপি সেদিন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। দাদুর হার্ট এট্যাক, মৃত্যু, ফুপির বিয়ে এসবের কিছুই জানতেন না তিনি। আমি যখন তাদের ইনভাইট করতে যাই তখনই সব জানিয়েছি। বিশ্বাস করুন, সব জেনে এখানে আসতে চান নি তিনি! বার বার বলেছিলেন আপনারা উনাকে ক্ষমা করবেন না!”
শওকত শাহ কড়া গলায় বললেন,
“ক্ষমা করার মতো কোনো মহান কাজ সে করে নি। এতো কিছুর পরও বিজন্যাস রাইভেল হয়ে আমাদের কোম্পানির ক্ষতি করতে চেয়েছে!”
আদ্রিশা মাথা নেড়ে বললো,
“না বাবা। ভুল করছেন আপনি! বিজন্যাস রাইভেল তো উনি হন নি। উনি নিজের কোম্পানির উন্নতি করতেই এগিয়েছেন শুধু। এতে অন্যান্য কোম্পানির লোকসান হবে স্বাভাবিক। কিন্তু জোর করে বা ইচ্ছাকৃত তো করেন নি কিছু! আপনিই বলুন, সেন ইন্ডাস্ট্রিজ! ওরা আমাদের,,,, মানে আপনাদের বিজন্যাস রাইভেল কেনো? যেচে পরে তাদের সাথে শত্রুতা করেছিলেন? (শওকত শাহ মাথা নাড়লেন) এর পরও কিন্তু ওদের সাথে সব সময় কম্পিটিশন করে চলেছেন আপনারা। নিজেদের লাভের জন্য এগিয়ে গেলে অন্যদের ক্ষতি হতেই পারে। এখানে ওনার কি দোষ? তাছাড়াও সেদিন শুধু ফুপি আর আঙ্কেলের বিয়ের সম্পর্ক ভাঙে নি। ভেঙেছে, দুই বন্ধুর সম্পর্ক, দুই পরিবারের সম্পর্ক, দুই বিজন্যাস পার্টনারের সম্পর্ক!”
কিছুক্ষন থেমে আবারও বললো,
“বাবা, আপনি যতোটা ওনাকে চেনেন ততোটা আমরা কেউ চিনি না! আপনিই বলুন, জেনেশুনে কারো ক্ষতি কি তিনি করতে পারেন? মানছি একটা ভুল হয়েগেছে কিন্তু সেটাকে ধরে বসে থাকলে তো হবে না। ফুপি! আপনি তো খুশিই আছেন বলুন। স্বামী ,সন্তান , পরিবার সব আছে আপনার সাথে। ছিলোও সেসময়। কিন্তু আঙ্কেলের সাথে সেদিন কেউ ছিলো না। একা ছিলেন তিনি। আজ আবারও একা করে দিবেন না ওনাকে। অতীত নিয়ে পড়ে থেকে ভবিষ্যৎ কেনো নষ্ট হবে?” মনোয়ারা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“ফুপি, যে কষ্ট একসময় আপনি পেয়েছেন তা তিথি আপুকে ফিরিয়ে দেয়া কি খুব জরুরী? একবার তাকান ওদের দিকে। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে! আমরা কেনো তাদের আলাদা করতে উঠে পরে লেগেছি? চাইলেই কিন্তু ওরা পালাতে পারতো। সবার অমতে বিয়ে করতে পারতো। আমাকে ধোকা দিতে পারতো। কিন্তু সেসবের কিছুই করে নি। বরং সবার সামনে দাঁড়িয়েছে। একটা ছোট্ট আবদার নিয়ে। সে আবদার ফেলে না দিয়ে গ্রহণ করা যায় না? আপনারা যদি আজ তাদের মেনে না নেন তবে, তাদের জীবনটাও যে আপনাদের মতোই শত্রুতায় কাটবে। আল্লাহ না করুক, যদি ফুপির মতোই তিথি আপু কিছু করে বসে?”
আসরাফ খান মাথা নত করে ছিলেন এতোক্ষন। আদ্রিশার কথা শেষ হতেই হাত জোর করে বললেন,
“শওকত আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু তা তো অতীত! সে ভুলের শাস্তি আমার মেয়ে কেনো পাবে?”
শওকত শাহ মুখ ঘুরিয়ে আদ্রিশার দিকে তাকালেন। গম্ভীর মুখে বললেন,
“তাহলে এই মেয়ে কি দোষ করেছে? আমার ছেলের একটা ভুলের জন্য আদ্রিশা কেনো শাস্তি পাবে?”
আদ্রিশা শওকত শাহের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাতর চাহনি দিয়ে বললো,
“আমি কোথায় শাস্তি পাচ্ছি বাবা? বরং শান্তি পাবো!”
মালিহা ইয়াসমিন আদ্রিশার হাত টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
“শান্তি! কিসের শান্তি? মুগ্ধকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতে পারবি তুই? সহ্য করতে পারবি? নিজ থেকে মুগ্ধর জীবন থেকে সরে যাবি?”
আদ্রিশা টলমল চোখে বললো,
“সহ্য না করার কি আছে! এখনো যখন পারছি সামনেও পারবো। আর বলছো নিজ থেকে সরে যাওয়া, তোমাদের তো বলাই হয় নি। পরশু আমাদের ডিভোর্সের হিয়ারিং! আশা করা যায় সেদিনই ডিভোর্স হয়ে যাবে আমাদের।”
মালিহা দু কদম পিছে চলে গেলেন। মনোয়ারা বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়েন। আদ্রিশা এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলে মালিহা মুগ্ধর দু গালে হাত রেখে বলেন,
“কি বলছে ও এসব? মুগ্ধ? তুই বলনা বাবা! সব কিছু মিথ্যে! বল না!”
মুগ্ধ মাথা নুইয়ে বললো,
“আই এম স্যরি মা! আমি জানি না সব কি করে হয়ে গেলো। আমি কখনোই কাওকে আমার জন্য কষ্ট দিতে চাই নি। আমি সত্যিই তিথিকে ভালোবাসি। ডিভোর্সের ব্যাপারটাও সত্যি। আদ্রিশাই সব,,,,,”
তাকে আর কথা বলতে না দিয়ে হাত তুলেন শওকত শাহ। রাগি স্বরে বললেন, “কি করে পারলে এমন করতে? ঐ মেয়েটাকে কখনো বাড়ির বউ বলে নয় মেয়ে বলেই মেনেছি! আর তুমি আমার মেয়ের সাথে এমন ঘৃণ্য আচরণ কি করে করতে পারলে। তার সব আশা আকাঙ্খা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে বাধলো না তোমার? কি জবাব দেবো ওর পরিবার কে?”
আদ্রিশা চোখ মুছে লম্বা শ্বাস টানলো। মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটিয়ে বললো,
“বাবা! মুগ্ধর এখানে কোনো দোষ নেই। ভালোবাসা তো দোষের না। যখন তখন যে কাওকেই ভালোলাগতে পারে। সব কিছুর এক্সপ্লেনেশন হয় না। আর তাছাড়া এমন তো নয় মুগ্ধ বিয়ের পর অন্য মেয়েকে ভালোবেসেছেন। উনি তো তিথি আপুকে ভালোবেসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতেই বিয়ে করেছেন। আমার পরিবারকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। তাদের মেয়ের সম্মান বাঁচাতে এই মানুষটা নিজের ভালোবাসার থেকে দূরে থেকেছে। আমার উপর সামান্য আঁচ আসতে দেয় নি। তাদের তো মূলত ওনার উপর কৃতজ্ঞ থাকার কথা।”
শওকত শাহ আর আসরাফ খানকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বললো,
“নতুন করে বন্ধুত্ব শুরু করা যায় না? বেয়াই হতে হবে তো!”
শওকত শাহ অশ্রুশিক্ত নয়নে আদ্রিশার দিকে তাকালেন। এক চিলতে হাসি এখনো ঠোঁটে লেগে তার। মুখ ঘুরিয়ে মনোয়ারা বেগমের দিকে তাকালেন তিনিও কান্না ভেজা চোখে মৃদু হাসলেন। তিথি মাথা নুইয়ে মুগ্ধর এক হাত জড়িয়ে ধরে আছে। মালিহা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আসরাফ খান হঠাৎই শওকত শাহের পা জড়িয়ে কান্না করতে লাগলেন। শওকত শাহ তাকে টেনে তুলে জড়িয়ে নিলেন বুকে। অঝোরে কাঁদছেন দু বন্ধু। আসরাফ খান কেঁদে কেঁদে বললেন,
“আমি ইচ্ছাকৃত করি নি শওকত। আমি যদি জানতাম আমার ঐ এক কাজে তোর পরিবারের উপর এতো বিপদ আসবে বিশ্বাস কর এমন কিছু করতাম না। আমি নিজেকে বুঝাতে পারছিলাম না। মনোয়ারার জীবন বিপন্ন করতে চাই নি বলেই ঐ দিনই তানিয়া কে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার উপর রাগ করে খানিক ঝগড়া ঝাটি হবে। তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবি নি, এতে চাচার মনে কতোটা আঘাত লাগবে। মনোয়ারা কি করতে পারে কিছুই মাথায় আসে নি আমার। ক্ষমা করে দে আমায়!”
শওকত শাহ পিঠে হাত বুলিয়ে চোখের জল ছাড়ছেন। মালিহাও হালকা হাসলেন তাদের দেখে। আদ্রিশা সন্দেহি কন্ঠে বললো,
“এবার সব কিছু ঠিক ঠাক তো? মুগ্ধ আর তিথিকে মেনে নিয়েছেন আপনারা?”
মালিহা কঠোর গলায় বললেন,
“তুই কি করবি ভেবেছিস?”
আদ্রিশা মালিহাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমি তো কখনো এই সম্পর্ককে মেনে নেই নি মা। যেহেতু এক ছিলাম না তাই আলাদা হয়ে যাওয়ার দুঃখও নেই। আমি ভালোই থাকবো। নিজেকে নিয়েই সুখি হবো দেখো। আর আমার পরিবার তো আমার সাথে থাকবেই!”
মালিহা ইয়াসমিন কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
“আমরা তোর কেউ না?”
আদ্রিশা চোখের জল ফেলে হাসি মুখে বললো,
“তোমরাও তো আমার পরিবার। এ বাড়ি থেকে দূরে থাকলেও তোমাদের থেকে দূরে থাকবো না। রোজ ফোন করবো, দেখা করবো!”
চলবে,,,,,
যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪৭
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
মালিহাও এক হাতে জড়িয়ে নেন আদ্রিশাকে। শব্দ করেই কেঁদে উঠেন তিনি। আদ্রিশা তাকে সামলে চোখ মুছে দেয়। মৃদু হেসে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“এবার কান্নাকাটি থামিয়ে হাসো দেখি! অতীতকে ধরে রাখতে নেই। ভুলে যাওয়াই শ্রেয়! আর এখন তো সব ঠিক হয়েই গেছে। এবার না হয় তিথি আপু আর মুগ্ধর বিয়ের ডেট ঠিক করা যাক! পরশু তো ডিভোর্স ফাইনাল!”
শওকত শাহ টলমলে চোখে তাকালেন। আসরাফ খান আদ্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হাসলেন। শওকত শাহ বললেন,
“তোমরাই যখন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমাদের কিছুই বলার নেই। জীবনটা তোমাদের। আমি সব সময় চেয়েছি আমার মেয়ে হয়েই থাকো তুমি।কখনো কষ্ট পাও সেটা চাই নি। আজ যখন বলছো মুগ্ধর থেকে দূরে গিয়েই তুমি সুখি হবে তখন কি করে আটকাই বলো! তবে, এই বাবা মাকে ভুলে যেও না কখনো!”
আদ্রিশা মাথা নাড়লো। শওকত শাহ চোখ মুছে পাশ ফিরে তাকিয়ে থম মেরে গেলেন। শ্বশুড়ের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে আদ্রিশা ওনার দৃষ্টি অনুসরণ করলো। মুহুর্তেই থমকে গেলো সে। এতোকিছুর মাঝে নিজের বাবাকে ভুলে গিয়েছিলো সে। মুগ্ধ আর তিথির ব্যাপারে সবাইকে সত্যিটা জানাতে গিয়ে বাবার দিকে মোটে খেয়াল করে নি। বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অভিমানী চেহারায় মেয়ের দিকে তাকালেন। আদ্রিশা ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে এগিয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“বাবা! আমি পরে তোমায় সব বুঝিয়ে বলবো। এখন প্লিজ কিছু বলো না। যা হচ্ছে হতে দাও। আমি জেনে শুনেই করছি। কোনো ভুল নেই এতে। বিশ্বাস করো। আমায় একটু ভরসা করো!”
হামিদুর আহমেদ চোখ সরিয়ে নিলেন মেয়ের থেকে। গম্ভীর মুখে বললেন,
“যা করেছো বেশ করেছো। আমায় কিছু বুঝাতে হবে না। আমি তো মেহমান। এসেছি, খাওয়া দাওয়া করবো, পরিবার নিয়ে চলে যাবো। আর কি? এবাড়িতে এ পরিবারে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানার কোনো ইচ্ছে বা প্রয়োজন আমার নেই! আর না আছে কোনো অধিকার। বাদ দাও! নিজে যখন সব এরেজম্যান্ট করেছো তখন সামলাও গিয়ে। আমায় নিয়ে, আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না।”
শওকত শাহ ধরা গলায় বললেন,
“ভাই সাহেব! আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আপনি ভরসা করেই আপনার মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা সেই আমানত ধরে রাখতে পারিনি। আমি আপনার দোষী! আপনার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি।”
হামিদুর আহমেদ শওকত শাহের জোড়া হাত দুটো আকড়ে বললেন,
“কি করছেন কি? আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন? আপনি, আপনার পরিবার কেউ কিছুই জানতো না এ বিষয়ে। আমি তো ছিলাম সেই কখন থেকে। সব কিছুই দেখেছি শুনেছি। আমাকে কিছুই বলতে হবে না আপনার। আর আপনি কোনো দোষ করেন নি। দোষী কেউ নয় বেয়াই সাহেব!(কথাটা বলেই থেমে গেলেন তিনি। খানিক থেমে আবারও বললেন) মানে, ভাই! পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে কেউ কিছুই করতে পারেন নি। ছাড়ুন ওসব। আমার কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। আপনার মেয়েকে বলে দেবেন আমি আমন্ত্রিত অতিথি মাত্র। তাই অতিথির মতোই থাকবো। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে হবে।”
আদ্রিশা চোখের ইশারায় শওকত শাহকে কোনো কথা বলতে নিষেধ করলো। কারন সে জানে তার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন সব লুকানোয়। কিন্তু আদ্রিশাই বা কি করতো? এ ছাড়া যে কোনো উপায় ছিলো না। হঠাৎই আদ্রিশার বাহু ধরে টেনে কেউ পর্দার আড়ালে নিয়ে গেলো। আদ্রিশা অবাক হয়ে বললো,
“চাচি? কি হয়েছে? এভাবে টেনে আনলে কেনো?”
সানা বেগম বেশ রাগ নিয়ে বললেন,
“কি করছিস তুই এসব? নিজের স্বামীকে ছেড়ে দিচ্ছিস!”
আদ্রিশা শান্ত কন্ঠে বললো,
“চাচি, আমি লোকের কথার ভয় পাই না। কে আমায় কি বললো না বললো তাতে কিছুই আসে যায় না আমার। তোমার যদি এতো সমস্যা হয় তখন তুমিও আমার নামে দু চার কথা বলে দিও। বলে দিও, মেয়ে ভালো নয় তাই ছেলে ছেড়ে দিয়েছে। হবে তো?”
সানা বেগম কপট রাগ নিয়ে বললেন,
“খালি লোকের কথার চিন্তাই করে তোর চাচি? তোদের কথা ভাবে না? আমি সমাজের কথা ভেবে নয় তোর কথা ভেবেই বলেছি কথাটা। ছ’মাসের সংসার ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে না?”
আদ্রিশা দুষ্টুমি করে বললো,
“ছ’মাসের আগে সংসার ছাড়লে ভালো হতো বলছো!”
সানা বেগম নাক ফুলিয়ে কাঁদছেন। আদ্রিশা সানা বেগমের হাত ধরে বললো,
“চাচি প্লীজ! যা বলার সব তো বলেই দিয়েছি। বার বার এক কথা বলো না। আমার উত্তর বা মত কোনোটাই বদলাবে না। আমি উনাকে ভালোবাসি না তাই ওনার সাথে থাকতেও পারবো না।”
সানা বেগম ভ্রু উচিয়ে বললেন,
“আমাদেরও কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে হয় নি। বিয়ের পর একসাথে থাকতেই থাকতেই এই অনুভুতি টা হয়েছে। ভালোবাসা হয়ে যায় আদু। তোর হয় নি?”
আদ্রিশা মাথা নাড়লো। বললো,
“না হয় নি! ভালোবাসা তো জোর করে হয় না তাই হয় নি!”
সানা বেগমের তাৎক্ষনিক উক্তি,
“বিচ্ছেদ জোর করে হয়!?”
আদ্রিশা কপাল কুঁচকে বললো,
“জোর করে তো কিছু হচ্ছে না চাচি। তোমার হয়তো আমার কথা ভেবে খারাপ লাগছে। লাগতেই পারে। কিন্তু এটাকে জোর করা বলো না। আর কি ব্যাপার বলোতো? এতো কাব্যিক কথা বার্তা! তার উপর আমায় নিয়ে এতো চিন্তা!”
সানা বেগম বাকা হেসে বললেন,
“হাসি মুখের আড়ালে নিজের হাহাকার লুকাতে চেয়েও আমার কাছে ধরা খাচ্ছিস, তোর মায়ের সামনে কি করে পারবি?”
আদ্রিশা স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“ওসব আমি সামলে নেবো । ভেবো না। সবাইকে যখন বুঝাতে পেরেছি মাকেও ঠিক বুঝিয়ে নেবো!”
________________
ঘড়ির কাটা রাত আট টা ছুঁই ছুঁই। খোলা আকাশের নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ। মস্তবড় চাঁদের আলো ছাড়াও ছাদের লাইটের হালকা আলো আছে। বিকেলের দিকেই বিয়ের ডেইট ফাইনাল হয়েছে। দু সপ্তাহ পরই মুগ্ধ তিথির বিয়ে। সন্ধ্যের কিছু পরেই অতিথিরা নিজেদের গন্তব্যে ফিরেছেন। মনোয়ারা বেগম আর আদ্রিশার পরিবার এখনো আছে। কিছুক্ষন পর তারাও চলে যাবে। যদিও আদ্রিশার ওসব কথা শুনার পর সবাই চলে যেতে চেয়েছিলো তবুও আদ্রিশা আটকে দেয় তাদের। মেয়ের ডিভোর্স হচ্ছে, মেয়ের জামাইয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক হচ্ছে এ যেনো তাদের জন্য অপমান! এসব মেনে বেহায়ার মতো এবাড়িতে থাকা তাদের জন্য তীব্র অপমানজনক!
“সেলিব্রেট করছিস?”
স্নিগ্ধর কথায় ঘোর কাটে মুগ্ধর। পাশ ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। স্নিগ্ধ আবারও বললো,
“তারা নেই কেনো আকাশে? আজ তো আনন্দ উৎসব করার দিন , থুরি রাত! তাই না ভাইয়া?”
মুগ্ধ ধীর আওয়াজে বললো,
“কিছু বলবি না কি?”
স্নিগ্ধ মাথা নাড়লো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোর সাথে সেলিব্রেট করতে এলাম । কিন্তু এরম চুপচাপ চোখ বন্ধ করে খুশি জাহির করা যায় না কি? হৈ হুল্লোর করবি তা না!”
মুগ্ধ বিরক্তির সুর টেনে বললো,
“তোকে কে বললো আমি খুশি জাহির করছি?”
স্নিগ্ধ অবাক হওয়ার ভঙ ধরে বললো,
“করছিস না?এখনি তো সময় আনন্দ করার। পরে সময় পাবি? আসলে কি বলতো, এভাবে দাঁড়িয়ে কি না, তাই ভাবলাম। এখন তো আর দুঃখ বিলাস করার সময় নয় নিশ্চয় সেলিব্রেট করছিলি! করছিলি না? তাহলে?”
মুগ্ধ লম্বা শ্বাস টেনে চলে যেতে নিলে স্নিগ্ধ পেছন থেকে বলে উঠলো, “থেঙ্ক ইউ ভাই!”
মুগ্ধ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। স্নিগ্ধ রেলিংএ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। এক পা মুড়িয়ে রেলিংএ রেখে দুহাত ভাজ করে বললো, “প্রায় সাত মাস আগে এমনই এক দিকে ঠিক এখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। মনে আছে? সেদিন আমি তোকে আবদার করেছিলাম, ভাবিকে বিয়ে না করতে বলেছিলাম। বলেছিলাম, ভাই ঐ মেয়েটা কাঁদছে। ও তোকে বিয়ে করতে চায় না, শেষ করে দিস না তার জীবন। উত্তরে তুই বলেছিলিস, আমি যা করছি ওনার কথা ভেবেই করছি। এতেই আমাদের কল্যাণ, আদ্রিশার কষ্ট লাঘব করবো আমি! ঠিকই বলেছিলি সেদিন। সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝছি। তুই সত্যিই ভাবির সব কষ্ট লাঘব করে দিলি। ওয়াও! ভাবি কিন্তু অনেক খুশি। মামা, মামী, আদ্র ভাইয়া, আঙ্কেল সবার চোখে মুখে বিষন্মতা! অথচ সে খুশি। তুই, তিথি তোরা যতোটা খুশি তার থেকেও বেশি খুশি ভাবি! খুশি যেনো ধরছেই না তার। এক মুহুর্তের জন্যও মুখ মলিন হচ্ছে না তার। কতোটা খুশি সে , তার প্রমাণ দিতেই বাড়ি যাচ্ছে! সত্যিই ভাই, ইউ আর গ্রেইট!”
কথাটা বলেই তাচ্ছিল্য হাসলো স্নিগ্ধ। মুগ্ধ হকচকিয়ে বললো, “বাড়ি যাচ্ছে মানে?”
স্নিগ্ধ আড়মোড়া ভেঙে বললো, “বাড়ি যাচ্ছে মানে বাড়ি যাচ্ছে। এখন তো ওর একটাই বাড়ি তাই না! সেখানেই যাচ্ছে। এখানে থাকার না কি কোনো অধিকার তার নেই। যদিও আমি জানি, এখানে থাকার ইচ্ছে নেই তার!”
স্নিগ্ধ কথাটা শেষ করতেই মুগ্ধ তাড়াহুড়া করে সিড়ি ভেঙে নিচে গেলো। স্নিগ্ধ চোখ ঝাপটিয়ে রেলিংএ ভর করে আকাশের দিকে তাকালো। একা একাই বক বক করতে লাগলো সে।
চলবে,,,,,,,,