যদি তুমি জানতে পর্ব-১+২

0
897

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_1

বিছানা থেকে বালিশ গুলো একে একে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলতে লাগলো রুপা। বিছানার চাদর’টাও ফেলে দিলো। টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা জোড়ে-সোড়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো যাতে ভেঙে যায়।
এর বিকট আওয়াজ গিয়ে পৌঁছে আজিজ চৌধুরীর কানে। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘বাড়ি’টা কি পাগলা গারদ বানাতে চাচ্ছো? ভাড়াটিয়ারা শান্তি পাচ্ছে না। সারাক্ষন বাসার ভেতর ভাংচুর। এগুলো কে সহ্য করবে?’
আজিজ চৌধুরীর কথা শুনে ঠান্ডা গলায় সাহেলা বেগম বলল,
-‘ওর মা-বাবা আজ আসছিলো। সেজন্যই অমন করছে। মা-বাবা কে একদম সহ্য করতে পারে না রুপা।’
একরাশ বিরক্ত নিয়ে আজিজ চৌধুরী বলল,
-‘ওর বাবা-মায়ের টাকায় কি কমতি আছে? কোন ভালো মেন্টাল হসপিটালে মেয়েকে ট্রিটমেন্ট করাতে পারে না? এটা ভদ্র লোকের বাসা।’
-‘এভাবে বলছো কেন? আর রুপা তো স্বাভাবিক প্রায়। তোমার সন্তান কি তুমি পাগল গারদে রাখতে চাইতে?’
-‘আমার সন্তান পাগলা গারদে না রাখলেও অন্য কারো ঘাড়ে চাপাতাম না।’
এই বলেই আবার খবরের কাগজে চোখ বুলালো আজিজ চৌধুরী। রুপার ব্যাপারে সাহেলা বেগম কে কিছু বলে লাভ নেই। সে এ ব্যাপারে পজেটিব। সব সময় রুপার সাপোর্টই করে যাবে। আনমনে এসব বিড়বিড় করে বলছে আজিজ চৌধুরী।
সাহেলা বেগম দ্রুত উঠে রুপার রুমে গেলো। রুমের পুরো নাজাহেল অবস্থা । রুপা ফ্লোরে বসে হেচকি দিয়ে কাঁদছে।
সাহেল বেগম গিয়ে রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে আদরের সুরে বলল,
-‘কি হয়েছে আমার রূপা মা মনির? কে রাগিয়েছে?’
রুপা এবার কান্না থামিয়ে সালেহা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘ওই মহিলা এসেছিলো কেন আজ? উনাকে আসতে না করি নি।’
-‘উনি তোমার মা রুপা। মা কে কেউ মহিলা বলে?’
-‘আমার মা তুমি ।’
-‘তোমার দুই টা মা।ওইটা তোমার বড় আম্মু আর তোমার ছোট আম্মু।’
-‘না ,না আমার একটাই আম্মু। সেটা হলো তুমি।’
রুপার কথায় যতক্ষন সায় না দিবে ততক্ষন রুপার পাগলামী থামবে না। সাহেলা বেগম মুচকি হেসে বলল,
-‘আচ্ছা, আচ্ছা! আমিই তোর আম্মু।’
বিশ্বজয়ের হাসি দিলো রুপা। কে বলবে এই মেয়েটা একটু আগে কেঁদেছে? পাগলের মত আচরন করছিলো,রুমের সব কিছু ভাঙছিলো।
সাহেলা বেগম এবার ধমকের সুরে বলল,
-‘রুপা তোমায় কত দিন বলেছি বিছানা এভাবে এলোমেলো করবে না। পুরো রুম টা অগোছালো করলে কেন?’
সাহেলা বেগমের পাশে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রুপা বললো,
-‘ওই মহিলা কে দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়েছিলো।’
-‘আবার ওই মহিলা…..’
বলতে গিয়েও থেমে গেলেন সাহেলা বেগম।
রুপা এবার চুপটি করে শান্ত ভাব নিয়ে চেয়ারে বসলো। একুশ বছর বয়সের মেয়ে রুপা। কোমল,মায়ামাখা চেহেরা, চোখ গুলো ডাগর ডাগর,গায়ের রং শ্যামলা। গায়ের এই শ্যামলা রংটা যেন রুপার চেহেরা মাধুর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাঁটু অবধি ঘন,কালো চুপ। দেখে মনে হবে শ্যাম প্রতিমা!
ঠোঁটের নিচে কুচ কালো ছোট্ট একটা তিল। সব মিলিয়ে শ্যামলা পরী। রুপা কখনো স্বাভাবিক, কখনো অস্বাভাবিক। কখনো শান্ত,কখনো তুফানের মত উত্তাল।
সাহেলা বেগম ড্রেসিং টেবিল থেকে তেলের বোতল টা হাতে নিয়ে রুপায় চুলে যত্ন সহকারে তেল মাখিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘বাসায় আর কখনো ভাংচুর করিস না মা। তোর বাবায় বিরক্ত হয়। আমায় কথা শোনায়।’
রুপা নিরব ভঙ্গিতে বলল,
-‘আচ্ছা।’
লম্বা ,ঘন চুল আঁচড়িয়ে বেনী গেঁথে দিলো সাহেলা বেগম । মাঝে মাঝে রুপার চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়ে টার চুল গুলো এত সুন্দর কেন?
বিছানার চাদর ,বালিশ ফ্লোর থেকে উঠিয়ে একে একে গুছাতে লাগলো সাহেলা বেগম। ফুলদানি ভাঙা টুকরো গুলো পরিষ্কার করলো।
সাহেলা বেগম কাজে ব্যস্ত। সুযোগ বুঝে আচারের ডিব্বা নিয়ে এক দৌঁড়ে ছাদে চলে গেলো রুপা।
ছাদের এক কোনায় চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তুরান। চোখে ইয়া বড় ,বড় চশমা দেওয়া। চুল গুলো কোঁকড়ানো,চেহেরায় গম্ভীরতার ছাপ।ইঞ্জিনিয়ারিং চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তুরান। লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগ! প্রয়োজনের বেশী একটা কথা বলে না। চাপা স্বভাবের। রুপা পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে গিয়ে তুরানের পিছনে দাঁড়ালো। ডিব্বায় অবশিষ্ট আচার টুকু তুরানের মাথায় ঢেলে দিলো। হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো তুরান। আচারের তেল নাক-মুখ বেয়ে পরছে। শার্টে অলরেডী দাগ গেলে গিয়েছে।
পাশে দাঁড়িয়ে খিলখিয়ে হাসছে রুপা। চরম বিরক্তি নিয়ে মেজাজ খারাপ করে তুরান চেঁচিয়ে বলল,
-‘এই মেয়ে তোর সমস্যা’টা কি বল তো? তুই কি করছিস এটা? নতুন শার্ট’টা দিলি নষ্ট করে? চুল গুলো মাত্র শ্যাম্পু করলাম। গোসলটাও নষ্ট করলি।’
রাগে নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে তুরান। রুপা মোটেও ভয় পাচ্ছে না। বরংচ বিষয়টা উপভোগ করছে ।রাগ সংযত করতে না পেরে তুরান আবার চেঁচিয়ে বলল,
-‘এক্ষুনি যাচ্ছি বাড়িওয়ালা আংকেলের কাছে। মাস শেষে এত গুলো টাকা ভাড়া দিয়ে থাকি এই প্যারা সহ্য করার জন্য ।’
পথ আটকিয়ে দাঁড়ালো রুপা। অনুনয়ের সুরে বলল,
-‘পায়ে ধরি আপনার বাবার কাছে বলবেন না প্লীজ। আমি শ্যাম্পু,সাবান সব দিচ্ছি আবার গোসল দিন।’
চোয়াল শক্ত করে তুরান বলল,
-‘আমার শার্ট যে নষ্ট হলো তা কে দিবে?’
-‘ আমি আম্মুর কাছ থেকে একশ টাকা এনে দিবো আপনি শার্ট কিনে নিয়েন।’
হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না তুরান। একশ টাকায় শার্ট! এই মেয়ের মাথায় সত্যি কি গন্ডোগোল আছে? নয়ত কি কেউ এমন করে ?
রুপা কান ধরে বলল,
-‘এই যেন কান ধরলাম আর হবে না । বাবার কাছে বলেন না প্লীজ। ভয় পাই তো আমি।’
রুপার আচরনে মাঝে মাঝে তুরানের মন হয় রুপা পাঁচ-সাত বছরের বাচ্চা। এমন কেন মেয়েটা ? কেমন যেন রহস্যময়ী।
আর রুপা এমন ভাবে অনুনয় করে মাফ চায় কারো কাছে নালিশও দিতে পারে না। এমন কি কান ধরে উঠ-বসও করে।
তুরান বলল,
-‘সেদিন আমি ছাদে লুঙ্গি রোদ দিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি সেই লুঙ্গি ছিঁড়ে চোখ বেধে কানা মাছি ভোঁ ভোঁ খেললে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। আজ আমার শার্ট’টা নষ্ট করে দিলে । পেয়েছোটা কি?’
রুপা গাল ফুলিয়ে বলল,
-‘সেই পুরোন লুঙ্গির শোক এখনও ভুলতে পারেন নি ভ্যাবলাকান্ত মশাই। আরে মানুষ মরলে তিন দিন পর আর শোক থাকে না। আর আপনি আপনার লুঙ্গির শোক পনেরো দিনেও গেলো না ।’
বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রুপা। তুরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। তুরানের চোখ চোখ পড়তেই রুপা বলে,
-‘এই ভাবে তাকান কেন? ভয় পাই আমি।’
রাগ চাপিয়ে তুরান বলল,
-‘নেক্সট টাইম যদি এমন করো তাহলে সত্যি আমি বিচার দিবো। যতই অনুনয় করো কাজ হবে না। একটা ম্যাচুরেট মেয়ে তুমি। অথচ বাচ্চাদের মত কান্ড করো।’
রুপা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-‘রুপা বাবু আমি।’
রুপার কথার ভঙ্গি দেখে অনিচ্ছাকৃত সত্ত্বেও হেসে দেয় তুরান। অস্ফূট স্বরে বলল,
-‘এলিয়েন।’
চলবে…

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_2
সকালে উঠে নাস্তা রেডী করছে সাহেলা বেগম। কাজে বেশ তাড়াহুড়া। রান্না সেরে হসপিটালে যেতে হবে। পা টিপে টিপে গিয়ে সাহেলা বেগমের পিছনে দাঁড়ালো রুপা। আচমকা জোরে শব্দ করে উঠল। ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে সাহেলা বেগম বলল,
-‘ডাইনিং রুমে যাও নাস্তা রেডী।’
মুখটা কালো হয়ে যায় রুপার। মন খারাপ করে বলল,
-‘আমি এত কষ্ট করে পা টিপে টিপে এসে জোরে শব্দ করলাম তোমায় ভয় দেখানোর জন্য । তুমি ভয়ই পেলে না আজব!’
মুচকি হেসে সাহেলা বেগম বলল,
-‘আমি তোর উপস্থিতি টের পেয়েছি।’
-‘আচ্ছা তোমাদের এত এত এত টাকা রান্নার জন্য কাজের লোক রাখতে পারো না?’
-‘তোর বাবা আমার হাতের রান্না খেতে পছন্দ করে। হাজবেন্ডের পছন্দের গুরুত্ব মেয়েদের কাছে খুব। বিয়ে হলে বুঝবি।’
রুপা একটু ভেবে বলল,
-‘বিয়ে কি?’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সাহেলা বেগম বলল,
-‘বড় হ তারপর বুঝবি।’
-‘সবাই বলে আমি বড়। অথচ আমি কিছু বুঝি না।’
-‘আস্তে আস্তে সব বুঝবি।’
-‘বাবার এত টাকা তোমার জব করার কি দরকার? একা বাসায় একদম মজা না।’
-‘ছোট বেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়া। আমি সফল হয়েছি। টাকা ব্যাপার না ব্যাপার হলো আমার নিজের তো একটা পরিচয় থাকা চাই। আমার হাজবেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এটা তো আমায় পরিচয় হতে পারে না,আমি ডাক্তার এটা আমার পরিচয়।প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত স্বাবলম্বী হওয়া। হাজবেন্ডের উপর নির্ভর করে থাকা ভুল। জীবনের মোড় কখন ঘুরে যায় তার তো ঠিক নেই।’
একটু থেমে সাহেলা বেগম আবার বলল,
-‘ যেকোন একটা উপলক্ষে তোর বাবা আমায় গিফ্ট দিলো, আমি যদি নিজে উপার্জন না করতাম তাহলে তাঁকে কিভাবে গিফ্ট দিতাম? তাঁর কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে তাঁকে গিফ্ট করা টা বেমানান।’
সাহেলা বেগমের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে রুপা। মন খারাপ করে বলল,
-‘আম্মু আমি তোমার মত এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না কেন? তুমি কত সুন্দর করে কথা বলো।’
-‘পারবি।’
-‘আমি যদি তোমার মত ডাক্তার হতে পারতাম। আচ্ছা ডাক্তার হয় কি ভাবে?’
ক্ষীন নিঃশ্বাস ফেলে সাহেলা বেগম বলল,
-‘তুই আমার থেকে অনেক বড় ডাক্তার হতে পারতি কিন্তু ভাগ্য তোর সঙ্গে ছিলো না।’
সাহেলা বেগমের কথা গুলো বিদঘুটে মনে হয় রুপার কাছে। কি সব বলে কিছুই বুঝে না রুপা।
নাস্তা করে সাহেলা বেগম চলে গেলো হসপিটালে । আর আজিজ চৌধুরী চলে গেলো তাঁর অফিসে। একা রুমে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। একা থাকলেই রুপার মন খুব বেশী খারাপ হয়। অশান্ত হয়ে যায় রুপা।
ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা পারফিউমের বোতল’টা দিয়ে নিজের কপালে কয়েকটা আঘাত করল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে রুপা, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। সব কিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। নিজের হাত কামড়াতে লাগলো। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে রুপার। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কেন কাঁদছে রুপা? তা সে নিজেও জানে না।
কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গেলো। একটু পর ঘুম ভেঙে যায় রুপার। এখন সব কিছু স্বাভাবিক। মেঝে থেকে পারফিউমের বোতল’টা তুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো।
নিজের হাতে দিকে তাকিয়ে আছে রুপা। হাতে অসংখ্য কামড়ে দাগ। হাতে মলম লাগিয়ে ছাদে চলে গেলো।
ছাদে গিয়েই রুপার মন খুশিতে ভরে উঠে তুরানকে দেখে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে। তুরানের সাথে কথা বলতে, তুরানকে ক্ষ্যাপাতে বেশ ভালোই লাগে! কিন্তু তুরান প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। রুপার ভাষ্যমতে ভ্যাবলাকান্ত মশাই! কিছু হলেই শুধু বাবার কাছে বিচার দিবে এই বলে ভয় দেখায়।
রুপাকে দেখে বিরক্ত হয়ে যায় তুরান। আজকে আবার কি কান্ড করবে আল্লাহ্ই জানে। তুরান রুপার দিকে না তাকিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরান ভেবে পায় না রুপা এমন কেন? নিজের পার্সনালিটি,ইগো বলতে কিছু নেই নাকি? তুরান কথা বলতে বিরক্ত বোধ করে এটা কি বুঝে রুপা?
রুপা এসে তুরানের কাছে দাঁড়ালো।
-‘আমি আসলাম অথচ আপনি আমার দিকে একটুও তাকালেন না কেন?’
চায়ের কাপে চমুক দিতে দিতে তুরান বলল,
-‘তোমার দিকে তাকাতে হবে কেন?’
-‘জানেন না আমি বাসায় একদম একা থাকি। একা ভালো লাগে না একদম। একটু আসি আপনার সাথে কথা বলতে তা আপনি আমায় সহ্যই করতে পারেন না।’
-‘রুপা আমার পড়ায় ডিস্টার্ব হচ্ছে, এখান থেকে যাও।’
-‘আপনি তো চা খাচ্ছেন। পড়তেছেন না তো।’
তুরান কোন উত্তর দেয় না। চায়ের কাপে একটু চমুক দিচ্ছে, আবার বইয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
তুরানের পাশে আরেক টা চেয়ায় টেনে বসলো রুপা। আচমকা তুরানের হাত থেকে চায়ের কাপটা টান দিয়ে নিয়ে বলে,
-‘যে টুকু আছে আমি খাবো।’
তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কোন লেবেলের পাগল এটা? আধ খাওয়া চায়ের কাপটা এভাবে নিয়ে গেলো!
চায়ের কাপটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে চমুক দিয়ে রুপা বলল,
-‘অনেক মজা!’
খুব তৃপ্তি সহকারে চা খাচ্ছে রুপা। প্রতিটি চমুকে রয়েছে তৃপ্তির ছাপ। রুপা আবার বলল,
-‘এভাবে চায়ের কাপটা নিয়েছি কেন জানেন? আমায় রেখে একা একা খাচ্ছেন, সৌজন্যমূলক সাধলেনও না। মিনিমাম ফর্মালিটি টুকু আপনার নেই।’
-‘তোমার খুব ফর্মালিটি তাই না? অন্যের চায়ের কাপ হাত থেকে নিয়ে যাও।’
-‘অন্যে যদি আমায় রেখে একা একা খায় আমি কি করব?’
অবাক হওয়ার সুরে তুরান বলল,
-‘তুমি মানুষ না এলিয়েন আমি বুঝতে পারছি না।’
রুপা আপতত তুরানের কথায় কান দিচ্ছে না। যত্নসহকারে চা টুকু খাচ্ছে। তুরান রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আগে কখনো চা খাও নি?’
মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। অনেকক্ষন ভেবে বলল,
-‘না।’
-‘না মানে?’
-‘না মানে আগে খাই নি।’
উদাস হয়ে যায় রুপা। আগে কি কখনো চা খেয়েছে? নাকি খায় নি? ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়। এত ভাবতে পারছে না মাথায় ভেতর অশান্তি লাগছে। আবার উত্তাল হয়ে যাচ্ছে রুপা। চোখ বুঁজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চায়ের কাপ’টা হাত থেকে ফেলে দুই হাতে মাথা চেপে নাক-মুখ কুঁচকে রাখে।
আতকে যায় তুরান। কি হলো রুপার? রুপার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
-‘রুপা কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?’
যথারীতি ভয় পেয়ে যায় তুরান। কেমন অদ্ভুধ দেখাচ্ছে রুপাকে। ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-‘রুপা কি হয়েছে বলবা তো? মাথা ব্যাথা করে তোমার?’
কোন কথা বলছে না রুপা। তুরান ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ কি এমন হলো?
স্বাভাবিকই তো ছিলো রুপা।
অনেকক্ষন মাথায় হাত চেপে রেখে বসে থাকে রুপা। চায়ের কাপটা পা দিয়ে ভেঙে লাল চোখে তুরানের দিকে তাকাতে তাকাতে ছাদ থেকে চলে যায়।
তুরান হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপটা ভেঙে ফেলল এভাবে? কক্সবাজার থেকে কত শখ করে কাপটা এনেছে!
না আর সহ্য করতে পারছে না তুরান। অসভ্য মেয়ে একটা! পেয়েছে টা কি?
তুরান যতই রুপা কে ইগনোর করবে রুপা ততই তুরানের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে। আর মেয়েটা এমন অদ্ভুধ প্রকৃতির! ভাবতেই পারছে না তুরান।
সেদিন নতুন শার্ট’টা নষ্ট করছে,আজকে আবার শখের কাপ’টা ভেঙে ফেলল।
আজিজ চৌধুরীর কাছে এবার বিচার দিবেই তুরান। হনহনিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো আজিজ চৌধুরীর ফ্লাটে। দরজা খোলা কিন্তু বাসায় কাউকে দেখছে না। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ আসলো তুরানে কানে। পাশের রুম থেকে আসছে আওয়াজটা। কন্ঠটা পরিচিত তুরানের। রুপা কাঁদছে। তুরান আস্তে আস্তে রুপার রুমের দিকে গেলো। ফ্লোরে শুয়ে কাঁদছে রুপা। চোখ কপালে উঠে যায় তুরানের । হাতে একটা ব্লেড রুপায়। ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কাটছে! এলোপাথরি ভাবে হাতে ব্লেড দিয়ে আঘাত করছে। রক্তে ফ্লোর লাল হয়ে যাচ্ছে । এমন করছে কেন মেয়েটা? রক্ত দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে তুরানের।
তুরান দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে রুপার হাত থেকে ব্লেডটা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
লম্বা চুল গুলো ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে আছে । নিস্তেজ হয়ে গেছে রুপা। তুরান বুঝতে পারলো রুপা সেন্সলেস হয়ে গেছে। পাজাকোলে নিয়ে রুপাকে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে শুইয়ে দিলো।
রুপার ঠোঁটের নিচে তিল টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুরান। বাহ্! মেয়ে টা বেশ মায়াবতী। আগে কখনো খেয়াল করে নি তুরান।
রুপার কি কোন মেন্টালিটি প্রবলেম আছে? আর ওর মা-বাবা এমন কেন? ওকে একা বাসায় রেখে কেন যায়।
রুপার হাতের রক্ত তুলা দিয়ে মুছে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিলো । ঘেমে একাকার হয়ে গেছে রুপা। ফ্যানটা অন করে দিলো তুরান।
অদ্ভুধ মায়া হচ্ছে রুপার প্রতি। অসহায় মনে হচ্ছে রুপাকে।
সাহেলা বেগম বাসায় ফিরলো। এসে দেখে রুপা ঘুমাচ্ছে। হাতে ব্যান্ডেজ । সাহেলা বেগম কে বাসায় আসতে দেখে তুরান সাহেলা বেগমের কাছে আসলো। সব টা বলল সাহেলা বেগমের কাছে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
-‘আন্টি আপনার মেয়ের কি কোন মেন্টালিটি প্রবলেম আছে? প্লীজ কিছু মনে করবেন না।’
-‘না বাবা । রুপা একটু জেদি। রাগ বেশী। ছোট বেলা থেকেই অকারনে কান্না করে, তাছাড়া স্বাভাবিক।’
তুরান আর কথা বাড়ালো না।
-‘ওকে একা বাসায় রেখে যাওয়া বোধ হয় ঠিক না।
‘এই বলে চলে যায় তুরান।
পিছন থেকে তুরান কে ডাক দেয় সাহেলা বেগম। বলল,
-‘তুমি একটা চায়ের মগ ক্ষতিপূরন হিসেবে নিয়ে যাও বাবা। ও যদি তোমার কিছু নষ্ট করে আমায় বলো,ক্ষতিপূরন দিয়ে দিবো।’
ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে তুরান বলল,
-‘না,না আন্টি দরকার নেই মগের।’
তুরান এই বাসায় এসেছে দেড় মাস হলো। সবাই খুব ভালো জানে তুরান কে। ছেলে হিসেবে বেশ ভদ্রই তুরান।
চলবে…