যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-০৭

0
142

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: সাত |

আজ মিষ্টির বিয়ের তৃতীয় রজনী। মিষ্টির বুদ্ধিমত্তা ও কথার ছলে এখন পর্যন্ত পরিবারের তিনজন সদস্যকে আপন করতে পেরেছে সে। রজনীর খাবার তৈরী করার মধ্যেই দুইবার চায়ের ফরমায়েশ পেয়েছে নাজিমউদ্দীনের কাছ থেকে। বলা যায়, নাজিমউদ্দীনের মনের এক তৃতীয়াংশ স্থানে সে জায়গা দখল করে ফেলেছে। মোল্লা বাড়িতে টিকে থাকার সবচেয়ে শক্ত হাত অন্তিকের। মিষ্টি স্বামীকেও আপন করে নিয়েছে। এবার শুধু অন্তিকের ভয় পাওয়া ও মিষ্টিকে অবজ্ঞা করার কারণ সে জানবে। একা হাতে গোটা মোল্লাবাড়ির পরিবারের খাবার রান্না করা কমটি কথা নয়! চাচী শাশুড়ির সাহায্য সে পাবে এমনটাও আশা করা অনুচিত তার জন্য। অন্তিক বসায়, আপনও তার! তাই সে অন্তিককে সাহায্য করতে ডাকে। কিন্তু কে জানতো, মিষ্টিকে সাহায্য করার বদলে সে মিষ্টিকে কা’ম’ড়ে দিবে! অন্তিকের মুখশ্রীতে দুষ্ট হাসি দেখতে পাচ্ছে মিষ্টি। সে মূলত অন্তিকের দিকে তরকারির ঝোলযুক্ত হাত এগিয়ে দিয়েছিল স্বাদ পরখ করার জন্য। অন্তিক বাঁকা হেসে স্বাদ পরখ করার বাহানায় দুই তিনটে কা’ম’ড়ে দেয় মিষ্টির তুলতুলে আঙুলে! মিষ্টি আহ বলে আত্ম চিৎকার করে বলে, “আমাকে সাহায্য করতে বলেছিলাম, অন্তু! ইঁদুরের মতো কুটকুট করে কা’ম’ড়া’তে বলিনি। আপনি রীতিমত আমাকে অত্যাচার করছেন।”

“ কা’ম’ড়া’লা’ম আর কোথায়! আমি তো তোমার স্বাদ,,,

অন্তিকের অসমাপ্ত কথা সমাপ্ত করার পূর্বেই মিষ্টি চোখ গরম করে তাকায়। অন্তিক বোকা হেসে নিজেকে সংশোধন করে বলে,“ আমি তো তরকারির স্বাদের কথা বলছি! রাগছো কেন, নতুন বউ!”

“ রাগলাম কোথায়? আমি মিষ্টি, আমার আচরণও মিষ্টি।তাই আমার রাগ, অভিমান, হাসি সবকিছু মিষ্টি ভাবতে চেষ্টা করো, অন্তু!”

অন্তিক হাসে। তার দুরন্ত বঁধু কথায় পটু সব কাজেও। তুমি বলা সম্বোধনও খারাপ লাগছে না মিষ্টির মুখে। একা হাতে সব সামলে নিচ্ছে সে। মিষ্টি কথা শেষ করে রান্নায় মনোযোগী হয়। এমনসময় লায়লা বেগম চুলারঘরে প্রবেশ করেন। অন্তিককে মিষ্টির পাশে দেখতে পেয়ে বাঁকা সুরে বলতে শুরু করেন, “ কী দিন আসলো! আমগোর সময় তো স্বামীর পাশে বসা কী দিনে রাইতে চেহারাই দেখতে পারতাম না। আর এখন বউয়েরা পারে না জামাইকে আঁচল দিয়ে বাঁইধা রাখতে!”

লায়লা বেগম যে ভালো কোনো কাজে আসেননি মিষ্টি তা বুঝতে পারে। সে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে হাসিমুখে উত্তরে বলে,“ তাহলে কলি হলো কীভাবে? কলি কী আসলেই জেঠুর সন্তান?”

লায়লা বেগমের হাসিমাখা মুখটা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে। তিনার চুলারঘরে আসার উদ্দেশ্য অবশ্যই ভালো নয়! মূলত মিষ্টির কাজে বেঘাত ঘটতেই এসেছিলেন। অন্তিককে পাকের ঘরে দেখে তীর পাল্টে অন্তিকের দিকেই ছুড়েন। লায়লা বেগমের জ্বলন্ত চোখজোড়া অন্তিকের দিকে তিনি কটমটে স্বরে বলেন, “ তুমি আমার সাথে আসো।”
পরপর মিষ্টির দিকে এক আঙুল উঁচিয়ে বলে,“ বেশি বাড়িও না মেয়ে? আমার সাথে লাগতে আসলে ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দিব।”

“ হ্যাঁ হ্যাঁ সময় হলে দেখা যাবে কে কাকে কোথায় পাঠায়।আসছে মিষ্টির সাথে টক্কর দিতে। ”

লায়লা বেগম চলে যেতেই অন্তিক মিষ্টির দিকে অসহায়ের মতো তাকায়। হাঁটি হাঁটি পা ফেলে লায়লা বেগমকে অনুসরণ করে বাহিরে চলে যায়। সে বসে ভাবতে থাকে,“ কেন অন্তু চাচীকে দেখলে নুইয়ে যায়! অন্তিকের অতীতের পাতায় কী এমন আছে যা শুধুমাত্র লায়লা বেগমই জানে?কীভাবে সে জানবে? কার মাধ্যমে জানতে পারবে?”

আঁড় পেতে কথা শোনা ভালো নয় কথাটি মিষ্টির বাবা আহমদ সবসময় বলতেন এবং তিনি একমাত্র মেয়েকে উনার আদর্শে বড়ো করেছেন। মিষ্টি এই প্রথম বাবার কথা অমান্য করতে যাচ্ছে। কিছু খারাপ কাজ যদি তার অন্তুর জীবনটা আলোকিত করে দেয় তবে মিষ্টি তাই করবে। পাকের ঘরে সবকিছু ঠিকঠাক করে সে দ্রুত বের হয়ে আসে। উদ্দেশ্য, লায়লা বেগম ও অন্তিকের কথা তাদের অগোচরে শোনা।
লায়লা বেগম অন্তিককে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন।আলমারি থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে অন্তিকের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলে বলতে শুরু করেন, “ এটা আমার কাছে রেখে দিয়ে কী হইব, যাও তোমার বউরে নিয়ে দেখাও। কারণ তুমি তো এহন মহা পণ্ডিত হয়ে গেছো। বড়ো হয়ে গেছো, বিয়ে করছো। বড়োদের কথা শোনার সময় আছে? বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরো। আরে পাগলেও নিজের ভালো বুঝে। তোমারে এতো করে সাবধান করছি ঐ মেয়ের কাছাকাছি না যাইতে। নিজের কথা কী ভুইলা গেছো? নিজের দিকে তাকাও, অমন মিষ্টির মতো মাইয়ারে ধোঁকা দিতে কইলজা কাঁপবো না? তোমার কাগজ তুমি নিয়ে যাও। আমিও দায়িত্ব নামক বুঝা থেইকা কাঁধ হালকা করি!”

অন্তিক মাথা নিচু করে কাগজগুলো তুলে নেয়। লায়লা বেগম আড়চোখে দেখে বাঁকা হাসেন। উনি মনে মনে বলে, “ যাক তীর ঠিক জায়গায়ই লাগছে।”

কিন্তু লায়লা বেগম জানতেন না, কারো খারাপ করতে গিয়ে তিনি অন্তিকের কতো বড়ো উপকার করে বসেছেন। অন্তিক কাগজগুলো লায়লা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলে,“ কাগজগুলো আপনার কাছেই রেখে দিন চাচী। যেই মেয়ে আমার জীবনে এসেছে সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। জানেন চাচী! সে আমার না বলা অনেক কথাই বুঝে নেয়। মা চলে যাওয়ার পর একা হয়ে গিয়েছিলাম মেয়েটা জীবনে আাসার পর থেকে মনে হয় আপন কোউ পাশে আছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, মেয়েটা আমাকে যত্ন করবে, আগলে রাখবে। মিষ্টি ভালোবাসা নামক বিশ্বাসে আমাকে আবদ্ধ করে রাখবে চাচী। এই কাগজ সে দেখলেও মনে হয় না বিশেষ কিছু হবে। আর যদি বিপরীত কিছু হয়, তো আমি তাতে তার মতো ছেড়ে দিব।”

দূর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই কাগজগুলো মূলত কীসের। মিষ্টি আড়াল থেকে সবটাই দেখে নেয়। অন্তিকের সাথে খারাপ ব্যবহারের কারণে সে খুব রেগে যায়। মনে মনে শপথ করে, এর শাস্তি একদিন এই মহিলাকে দিবেই দিবে। শেষোক্ত কথা শোনার পর মিষ্টির অন্তর কেঁপে ওঠে। অন্তিকের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া কল্পনাও করতে পারেনা সে। লায়লা বেগম রাগে ফুসফুস করছেন। উনার এতো বছরের হাতের পুতুল হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তা মানতেই পারছেন না। তিনি কিছু একটা ভেবে নরম স্বরে বলতে শুরু করে, “ বুঝতে চেষ্টা করো অন্তিক! অভাব শুরু হলে ভালোবাসা দরজা দিয়ে পালায় এমনিতেও সত্যিটা জানার পর দেখবা মেয়েটা তোমাকে রেখে চইলে যাবে। তখন তুমি আরো কষ্ট পাবে।”

অন্তিক কথাটা শুনে মুচকি হাসে। প্রত্ত্যুত্তরে জবাব দেয়, “ একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভ জেগেছে মনে। সে এসে যদি ভালোবাসা দিয়ে চলেও যায়। আফসোস করব না।ভেবে নিব, তার সাথে আমার ততটুকুই সময় উপরওয়ালার বরাদ্দ করে রেখেছিলেন!”

অশ্রুসিক্ত নয়ন নিয়ে মিষ্টি ফিরে আসে। সেখানে আরো কিছু সময় থাকলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাকেরঘরে আসতেই কলিকে দেখতে পায় সে। কলি মাত্রই মসলার চমচ তরকারিতে ঢেলে দিতে উদ্বেগ নিচ্ছিল তখনই মিষ্টির আগমন ঘরে। সে একটু জোরেই বলে ওঠে, “ তোমাদের মা মেয়ের যন্ত্রণায় তো আর থাকা যাচ্ছে না। এই কলি বাঁশের ফলি, তা কি করছো এখানে?”

মিষ্টির আওয়াজ পেয়ে কলি ভয়ে হাত থেকে মসলার চামচ ছিটকে নিচে ফেলে তোতলানো স্বরে বলে,“ নবন কম ছিল, তাই দিচ্ছিলাম আর কি।”

মিষ্টি কাছে এসে দেখে নবনের পরিবর্তে লাল মরিচের গুঁড়ো জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সে কোমড়ে হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ নবন যে লাল মরিচের মতো লাল টকটকে হয় তা জানা ছিল না, কলির বাচ্চা ফলি। আমার রান্না করা খাবার যদি মন্দ হয় তো আজ তোর রক্ষা নাই, ক্যাকটাস গাছের কলি, আমার সাথে লাগতে আসবি না। একদম নিজের নাম ভুলিয়ে দিব।”

কলি শুকনো ঢুক গিলে। সে মাত্রই এসেছিল খাবারে মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিতে। বুদ্ধিটা তার মা দিয়েছিল কিন্তু এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। সে ভয়ে এদিকসেদিক তাকিয়ে পালাতে চেষ্টা করলে মিষ্টি খপ করে হাত ধরে ফেলে। পিছনদিন থেকে হাত মুচড়ে বলতে শুরু করে, “ খেলার মাঠ থেকে পালিয়ে নির্বোধের মতো আচরণ করা তোদের কাজ কিন্তু এই মিষ্টি যেই খেলার মাঠে প্রবেশ করে ট্রফি সাথে করেই ফিরে। আমার সাথে যতো ছলছুতা করতে থাকবি আমি তার থেকে দ্বিগুণ তোদের ফেরত দিব। কথাটা মাথায় রাখিস, কলি বাঁশের ফলি!”

কলির হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে মিষ্টি খাবারের পাত্র পরীক্ষা করতে চলে যায়। এদিকে মিষ্টির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কলি জীবন বাঁচিয়ে দৌড় লাগায়। তার মাকে এখনই সব জানাতে হবে। পরবর্তী স্টেপ কী হতে পারে, জানতে হবে মায়ের কাছ থেকে।

চলবে…………..