যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-০৮

0
141

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: আট |

রজনীর মধ্যভাগে পুরো পৃথিবী ঘুমে নিমগ্ন। রজনীর আকাশে গোলাকার চন্দ্র আলো ছড়াচ্ছে নিজের মতো করে। তার সাথে তাল মিলিয়ে তারকারাজি মিটিমিটি করে জ্ব’ল’ছে। পুরো পৃথিবী ঘুমের রাজ্যে মজে থাকলেও মিষ্টির চোখে ঘুম নেই। পাশে অন্তিক ঘুমিয়েছে কী না জানা নেই তার। উঁকি দিয়ে অন্তিকের ঘুমের অবস্থান বুঝে মিষ্টি চুপি চুপি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। উদ্দেশ্য লায়লা বেগমের ঘর থেকে চু’রি করা। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে মিষ্টি নিচে নেমে আসে। অতি সন্তর্পণে ধীরেধীরে লায়লা বেগমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ধস্তাধস্তরি আওয়াজ ভেসে আসে, সাথে লায়লা বেগমের চাপা আর্তনাদ। মিষ্টি থেমে যায়, বুঝতে চেষ্টা করছে ভেতরে লায়লা বেগমের সাথে কে আছে। অবশ্য ফিরোজ ব্যতীত এই ঘরে আর কারো থাকার কথাও না। অবশেষে দরজা খোলার আওয়াজ বুঝতে পেরে মিষ্টি দৌড়ে পাকেরঘরে চলে যায়। দরজা খুলে কেউ একজন বের হয়েছে। অন্ধকারের কারণে ব্যক্তিটির অবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারেনি সে। পুরুষ মানুষের অবয়বের পিছু না নিয়ে মিষ্টি দৌড়ে লায়লা বেগমের ঘরের চৌখাটে দাঁড়াতেই ভেতরে অর্ধ বিবস্ত্র হয়ে পড়ে থাকা লায়লা বেগমকে দেখতে পায় সে। মিষ্টি সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নেয়! তখনও লায়লা বেগম শায়িত অবস্থায় আর্তনাদ করছে, “ ও মাগো! ম’রে গেলাম গো! এই যন্ত্রণা আর সইতে পারি না! আর কতো, আর কতো সহ্য করমু। সংসারের লাইগা নিজের জীবনকে শেষ করলাম। কিছুই পাইলাম না গো!”

মিষ্টি ফিরে আসাকেই উচিত মনে করে। যেভাবে ধীরপায়ে এসেছিল ঠিক একইভাবে নিজের ঘরে ফেরত চলে আসে সে। অন্তিক বিভোর ঘুমে মগ্ন। মিষ্টি অন্তিকের পাশে শুয়ে পড়ে। অন্তুিককে দেখে ভাবতে থাকে, ‘ এই বাড়ির প্রত্যেকের মাঝেই রহস্য লুকিয়ে আছে। অন্তিকের সেই কাগজের ব্যপারে লুকানো। শ্বশুর বাবার স্ত্রী বাড়ি ছাড়া আজ কতো বছর! কিন্তু উনি কখনো স্ত্রীর খোঁজ নেয়নি। নাটক সিনেমার মতো স্ত্রী ফিরে আসবেন বলে ভাবছেন। যদি ফিরে না আসে! ফিরোজ অর্থাৎ অন্তিকের চাচা কম কথা বলে কিন্তু তার কথা বার্তায় আলাদা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়। কলি মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত, এই বয়সে একদিন উচিত শিক্ষা পেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবার মাঝে আজ যা হলো! কে ছিল সেই মানবটি যে লায়লা বেগমকে প্রহার করেছে! আপন কেউ না হলে তো আর সেই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। ফিরোজ নাকি অন্য কেউ!’

শত হাজার ভাবতে ভাবতে রজনী পাড় হয়ে যায়। দূরের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দ ভেসে আসে। মিষ্টি ভেবে নেয় আজ সে আর অন্তিক একত্রে নামাজ আদায় করবে। অন্তিককে দুই একবার ডাকতে সে চোখ খুলে তাকায়। মিষ্টির হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখে জিজ্ঞেস করে, “ তুমি ঘুম থেকে সজাগ হলেও কী হাসো? তোমার এই হাসিটা আমি খুব পছন্দ করি। একেবারে বুকে এসে লাগে ঐ হাসিটা।”

মিষ্টি খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। এমন পাগলাটে মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুললে ‘কী হয়েছে’ বা ‘ডাকছো কেন’ বলে। কিন্তু এদিকে মহারাজা তার হাসি বিশ্লেষণ করছে! মিষ্টি অন্তিকের বুকে ধাক্কা দিয়ে উত্তর দেয়, “ বড়োই রোমান্টিক কথাবার্তা বলা হচ্ছে! মতলব কী অন্তু মহারাজ!”

অন্তিক বাম পাশে ফিরে বাম হাতে ভর করে শুয়ে উত্তর দেয়,“ নতুন বউ পাশে থাকলে প্রতি পুরুষদের মনে যেই মতলব আটে, সেটা!”

মিষ্টি আবারও খিলখিল করে হেসে বলে,“ ভীষন দুষ্ট তো সেই সকল পুরুষ মানুষ! যাদের মনে সবসময় বঁধুকে নিয়ে মতিচ্ছন্ন ইচ্ছে জাগে।”

অন্তিক মিষ্টির হাত ধরে বুকের উপর ফেলে দেয়। এক হাতে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে অঙ্গের অপ্রকাশিত স্থানে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,“ মতিচ্ছন্ন পুরুষরাই আসল পুরুষ হয়। অন্ততপক্ষে ঐ সব পাপিষ্ঠ পুরুষের মতো তো আর হয় না! যারা আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেয়ার বদলে বঁধুকে প্রহার করে!”

অন্তিকের কথা শেষ হতেই মিষ্টি ভরকে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে অন্তিকের দিকে ফিরে তাকাতেই অন্তিকের মাতাল আঁখি জোড়ায় নজর যায়! সে ভাবে, অন্তু কী চাচীর ব্যপারে জানে? নাকি এমনিতেই বলেছে। এই মুহূর্তে সে কী জিজ্ঞেস করবে? মিষ্টির ভাবনার মাঝেই অনুভব করে অন্তিকের ঠোঁট জোড়া মিষ্টির ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিচ্ছে। মিষ্টি আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। সায় দেয় পাশের মানুষটাকে। অন্তিক মিষ্টির সাড়া পেয়ে নিজের সাথে চেপে নেয় তাকে। গভীর থেকে গভীরভাবে মিষ্টির ঠোঁটের স্বাদ গ্রহণ করে হালকা কামড় দিয়ে বলে, “ ছটফটে মেয়েদের কথা বন্ধ করতে হয় না। পরবর্তীতে চুপ থাকলে এভাবেই তাদের শা’স্তি দিব।”

মিষ্টি লাজে রাঙা হয়ে অন্তিকের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে,“ চলো, একসাথে নামাজ পড়ব।”

অন্তুক আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে। ফ্রেস হওয়ার আগ মুহূর্তে নিজের ঠোঁট জোড়ায় হাত বুলিয়ে বলে, “ টেস্ট টা নামের মতোই মিষ্টি।”

——————-

সকালের নাশতা মিষ্টির তৈরী করে। গরম গরম ভাতের সাথে চার পাঁচ পদের ভর্তা ও খাঁটি ঘি। অন্তিক সরাটা সময় মিষ্টির পাশে থেকেছে। মেয়েটা একাই একশ। একা হাতেই সব কী সুন্দর সামলে নিচ্ছে! মুখে ক্লান্তি নেই,নেই কোনো গ্লানি। এই অভ্যাস অন্তিকের মায়ের ছিল। অন্তিকের মা ছিল খুবই সুন্দরী। রুণাকে যখন মোল্লা বাড়ির বউ করে আনা হয় তখন পাড়া প্রতিবেশীরা দেখে হায় হায় করছিল। এত রূপ দেখে অনেকে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। অবশ্য কথাগুলো অন্তিক বাবার কাছেই শুনেছে। রুনা চলে যাওয়ার পর কায়েস অন্তিকের সাথেই ঘুমাতো। রুনাকে নিয়ে এই সেই গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো। অন্তিক খুবই আগ্রহে মনোযোগ সহকারে সব শুনতো।
খাবার তৈরী হয়ে গেলে মিষ্টি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। অন্তিক তা দেখে মনে মনে ভাবে,আজ অফিস শেষে মেয়েটার জন্য কয়েক সেট সুতি থ্রি পিস কিনে আনবে সে। চুলার পাড়ে শাড়ি পরে থাকা মিষ্টির জন্য কষ্টকর হয়ে যায়।

মিষ্টির হাতের রান্না খেয়ে সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রুনার হাতের রান্না খেয়ে সবাই যেমন মজা পেত এইহাতেও ঠিক একই মজা পায় সবাই। পেটভর্তি খাওয়ার শেষে প্লেট চেটেপুটে খেয়েও আরেক চামচের লোভ জাগে। লায়লা বেগম খাবার ঘরে দেরীতে প্রবেশ করেন। তিনার চোখমুখ ফোলা। নাজিমউদ্দীন লায়লার উপস্থিতি দেখে বলতে শুরু করে, “ নাত বউকে কাজ সপে দিয়েছি বলে শরীরে জং ধরাইয়ো না কলির মা! হাতে হাতে মাইয়াডারে একটু সাহায্য কইরো।”

লায়লা বেগম মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে বলেন, “ আইচ্ছা আব্বা।”
পরবর্তীতে নাজিমউদ্দীন আবারও জিজ্ঞেস করে, “ ফিরোজ কবে নাগাত আসবো কিছু বলছে?”

লায়লা বেগম উত্তরে বলেন,“ গতকাইল রাইতে যাওয়ার পর আর ফোন দেয় নাই।”

ফিরোজ চাচা গতকাল রাতে বাড়িতে ছিল না। কথাটা শুনে মিষ্টিরমনে আরো সন্দেহের বীজ বুনে। সে লায়লা বেগমের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,’ তবে রাতে চাচীর ঘরে কে এসেছিল?’

প্রশ্নটা রয়ে যায়! বাড়ির পুরুষেরা চলে যেতেই মেয়েরা খেতে বসে পড়ে। লায়লা বেগম ও মিষ্টি একসাথে খেতে বসেছে। দুজনই চুপচাপ খাচ্ছে। কলি ঘুম থেকে উঠে নিচে আসে মিষ্টিকে খেতে দেখে ন্যাকা স্বরে বলতে শুরু করে, “ মরে গেলাম গো! ও নতুন ভাবী,একটু গরম পানি করে দাও না গো! হোস্টেলে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়ে কোমড়ে যা ব্যাথা পেয়েছিলাম! মাঝে মধ্যে ব্যাথাটা উঁকি দেয়। দিবে নাকি আমার আদরের ভাবী?”

কলি ভাবী ডাকছে। ব্যাপারটা মিষ্টির হজম হচ্ছে না। নিশ্চয়ই নতুন কোনো মতলব আটছে এরা!
“ ভুতের মুখে রামরাম।” কথাটি মিষ্টি নীচু স্বরে বললেও লায়লা বেগম শুনে ফেলেন। মিষ্টির দিকে শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “ কি বললে?”

মিষ্টি আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “ ঐ কিছুনা চাচী আম্মা! ননদিনীর কোমড়ে ব্যাথা, ভাবীর কাছে সাহায্য চাইছে! তাই করে দিব বলছিলাম। ”

লায়লা বেগম ও মিষ্টি একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। ইঁদুর যে তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছে তা ভেবেই দুজনে আনন্দিত হয়। চোখের ইশারায় তখন মা মেয়ে কথা বলছিল মিষ্টি তা দেখে বলতে শুরু করে, “ তা ননদিনী, তুমি কী একটা কথা জানো?”

কলিকে উদ্ভট নামে না ডাকায় সে খুশি হয়। গদগদকণ্ঠে উত্তর দেয়, “ কী কথা, ভাবী?”

মিষ্টি ভাতের লোকমা চিবোতে চিবোতে প্রত্ত্যুত্তরে বলে,“ আমার দাদী বলে, খাওয়ার সময় আজরাইলও জান ক’ব’জ করে না। সেখানে তুমি আমায় খাওয়া থেকে উঠে পানি গরম করে আনতে বলছো? তোমাকে চাচী এই শিক্ষা দিয়েছে!”

মা মেয়ে দুজনেই চুপসে যায়। কলি মুখ ফসকে বলেই ফেলে,“ এই অসভ্য মেয়ে, তুমি মানুষ নাকি?”

মিষ্টির খাওয়া শেষ। প্লেট বাটি গুছিয়ে উত্তর দেয়, “ তোর মতো শ’য়’তা’নে’র নানী না, কলি বাঁশের ফলি।”

লায়লা বেগম এবার চিৎকার করে বলে, “ এই মেয়ে থামো বলছি? এসব কেমন নামে ডাকা শুরু করছো আমার মাইয়ারে।”

মিষ্টি চলেই যাচ্ছিল। পিছনে ফিরে লায়লা বেগমের উদ্দেশ্যে দুষ্ট স্বরে বলে, “ আমি আপনারও একটা জম্পেশ নাম রেখেছি চাচী আম্মা। নাম কী! একটা ছন্দও বানিয়ে ফেলেছি, শুনবেন? ”

লায়লা বেগম শক্ত স্বরে জবাব দেন, “ কী?”

মিষ্টি আনন্দ চিত্তে ছন্দের তালে বলতে শুরু করে,
“ও লায়লা কাঠপোড়া কয়লা,
ও লায়লা বাথরুমের ময়লা
ও লায়লা, কলি বাঁশের ফলির মাতা,
ও লায়লা, শয়তানের খালা!

চলবে………………