যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-০১

0
205

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব:১|

“ শুনেছি ঠোঁটে কিস করলে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়।”

সদ্য বিবাহিতা বঁধুর মুখে এমন কথা শুনে থমকে যায় অন্তিক শাহরিয়ার। চমকায়িত দৃষ্টিতে হালকা কেশে গলা ঝেড়ে পরিবেশ পাল্টাতে চায় সে। নজর এদিকসেদিক ঘুরিয়ে অমনোযোগীয় শ্রোতার ভান করে সে। কিন্তু তার নব বিবাহিতা বঁধু পুনরায় একই কথা বলে তার কান গরম করে দেয়।

“ আপনি কখনো কাউকে ঠোঁটে কিস করেছেন, অন্তু!”

অন্তু! শোনা যায়,মেয়েরা একদিনের পরিচয়ে অপরপক্ষের ছায়াও মাড়ায় না সেখানে অন্তিককে অন্তু বলে সম্বোধন করছে! ব্যাপরটা অস্বস্তিজনক। বুঝা যাচ্ছে, অন্তিকের নব বঁধু খুবই চঞ্চল ও চতুর। অন্তিকের বলতে ইচ্ছে করছে,’ করিনি, করতে চাইও না। আর আপনাকে তো আরো আগে না, মিস দুষ্টু।’ কিন্তু তার মতো অতি ভদ্র শান্ত ছেলে তো আর অতিরিক্ত কথা বলতে পারে না। সে শেরওয়ানীর কয়েকটা বোতাম খুলে ফ্রেস হতে চলে যায়। এদিকে অন্তিক চলে যেতেই কোমড়ে গুঁজে রাখা ফোন বের করে নব বঁধু, অবন্তি রহমান মিষ্টি। মুখে তার দুষ্ট হাসি লেগে আছে। অন্তিকের অবস্থান নির্ধারণ করে ফোন কানে রাখে। দুই একবার রিং হতেই সে চাপা স্বরে বলতে শুরু করে,“ হ্যালো মিঠাইওয়ালা, আমি বাসর ঘর থেকে বলছি। এরপর কি করব রে?”

অপরপাশ থেকে উত্তর আসলো,“ তুই সত্যি সত্যি এই সময়ে কল করেছিস? তোর বর কই? মান সম্মান কিছু রাখলি না, মিষ্টি। ফোন রাখ!”
“ আরে শোন তো!”
নব বঁধুকে পাত্তা না দিয়ে মিঠাইওয়ালা কল ডিসকানেক্টেড করে দিলো। নব বঁধুর তাতে কোনো মাথা ব্যাথা নেই সে পুনরায় আরেকজনকে কল লাগালো,“ হ্যালো গোলাপি, আমি বাসর ঘর থেকে বলছি, তুই কি করছিস?”
প্রত্ত্যুত্তরে অপরপক্ষ যে ভাল কথা বলেনি তা নব বঁধুর পানসে মুখ দেখেই বুঝা গেছে। সে ফোন কানে নিয়েই বিড়বিড় করতে থাকে,“ বন্ধু নামক দুশমন কোথাকার! একবার কলেজে যাই, তোদের চামড়া কে’টে ঝালমুড়ি খাবো।”
“ আপনি কী কারো সাথে কথা বলছেন?”
অন্তিকের কথায় ছিটকে দূরে সরে যায় নব বঁধু। চোখ ঘুরিয়ে ফোন লুকাতে ব্যস্ত হয়। অন্তিক ব্যাপারটা দেখে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা এমন যেন অন্তিক নব বঁধুর লোকায়িক বস্তুখানা লুকাতে দেখেনি। নব বঁধু ইতস্ততভাবে উত্তর দেয়,“ আমার দাদী ফোন করেছিল, কী সব দুষ্ট কথা বলছিল। তাই কে’টে দিয়েছি।”

বিয়ের রাত্রিতে দাদী নানীদের দুষ্টু, মিষ্টি কী কী কথা বলতে পারে তা অন্তিকের অজানা নয়! এমনিতেও সে একটার পর একটা ধাক্কায় বাসর রাত পাড় করছে। এখন যদি সে মুখ খুলে তাহলে নব বঁধুকে রেখে বাহিরে গিয়েই রাত্রি যাপন করতে হবে। অন্তিক ইতঃস্তত বোধ করছে সাথে অনুশোচনায় তার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। বিয়ে নামক বন্ধনে সে আবদ্ধ হতে চায়নি। দাদাজানের ওয়াদার কারণেই নিজের থেকে দশ বছরের ছোট বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে হয়েছে তাকে। কয়েকঘন্টায় অনুধাবন করতে পেরেছে সে যে, তার নব বঁধু ভীষণ দুষ্ট, চঞ্চল। সে গলা ঝেড়ে বিছানায় এসে বসলো। নব বঁধু এতে নড়েচড়ে বসে তাকে বসার জন্য জায়গা করে দিল। গালে দুইহাত দিয়ে অন্তিকের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সে অন্তুিকের মুখ নিসৃত এক একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত। অন্তিক আগের থেকে বেশি ইতস্ততবোধ করছে। পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করে এদিক সেদিক দৃষ্টি ফেলছে। নব বঁধু তা দেখে দুষ্ট হেসে অন্তিকের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিতে বলতে শুরু করে,“ বোবায় ধরেছে নাকি? নাকি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছেন?”
“ না তো!”

অন্তিক চাঞ্চল্য চোখজোড়ায় তাকিয়ে রয়েছে। মায়াভরা চোখে সরলতার ছোঁয়া। হৃদয়ের সুপ্ত স্থানে জায়গা করে নিয়েছে সেই চাহনি। তার অবুঝ বঁধু কী সংসারের কঠিন নাড়িকাঠি চালাতে পারবে? কথাগুলো ভেবে অন্তিক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। নব বঁধুকে ভাবনায় ফেলে বালিশ হাতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সম্মুখে পা ফেলে নব বঁধুর উদ্দেশ্যে বলে,“ রাত অনেক হয়েছে। আমি সোফায় ঘুমিয়ে পড়ছি। আপনি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ুন।”

অন্তিক এক মিনিটও সময় অপচয় করেনি। সোফায় শুয়ে মাথায় এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। এদিকে নব বঁধু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রয়। প্রতিটা নারী এই বিশেষ সময়টা নিয়ে মনে অনেক স্বপ্ন বুনে। মিষ্টিও তেমন স্বপ্ন দেখেছিল! সে ভেবেছিল প্রথম রজনীতে স্বামীর সাথে মন খুলে কথা বলবে। উলটা পালটা প্রশ্ন করে একটু লজ্জায় ফেলবে। তারপর যখন মিষ্টি কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে যাবে, তখন অন্তুকে বলবে মাথায় হাত বুলিতে দিতে আর সে ঘুমিয়ে পড়বে। যেমনটা মিষ্টির দাদী সবসময় করে।
মিষ্টি একটু উঁকি দিয়ে অন্তিককে দেখে নেয়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অন্তিক ঘুমাচ্ছে। সে ভারী শাড়ি নিয়েই বিছানা থেকে নেমে আসে। সোফার কাছে এসে অন্তিকের উদ্দেশ্যে বলে,” আপনি কী চুমুর কথা শুনে ঘুমিয়ে পড়েছেন, অন্তিক? আচ্ছা যান চুমুর সংজ্ঞা দিতে হবে না। আপনি বরঞ্চ আমার গয়নাগুলো খুলতে সাহায্য করুন। দাদী বলে দিয়েছে, এই কাজ নাকি আপনার। দাদী আরো বলেছে, বাসর রাতে বউয়ের সাহায্য করলে নাকি মোহাব্বত তৈরী হয়।”

অন্তিক চোখ খুলে অবাক নয়নে দৃষ্টি জ্ঞাপন করে। তার ভাবতেই অবাক লাগছে,এতটুকু বাচ্চা মেয়ে এতো পাকা পাকা কথা বলছে? একটুও কী লজ্জা করছে না? অন্তিক নব বঁধূর দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় মিষ্টি তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অন্তিক বুঝে গেছে সে কোনভাবেই আজ নব বঁধূর থেকে পালাতে পারবে না। অগত্যা শোয়া থেকে উঠে বসে। মিষ্টি সময় নষ্ট না করে অন্তিকের সামনে বসে, একদমই কাছাকাছি, পাশাপাশি। অন্তিক মিষ্টির দুষ্টুমি বুঝতে পেরে কিছুটা পিছনে সরে বসে। নব বঁধূর অর্ধ আবৃত পিঠে হাত রাখে। একটি একটি করে তিনটি গলার হার খুলে ফেলে। কানের কাছটায় হাত দিতেই মিষ্টির মায়াবী মুখশ্রীতে নজর পড়ে। টানা হরিণী চোখে তার দিকেই অবলোকন করে আছে। অন্তিক সেই মায়ায় কিছু সময়ের জন্য আটকে যায়। ধীরচিত্তে এগিয়ে আসে নব বঁধুর ঠোঁটের কাছটায়। একে অপরের নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাস মিলিত হচ্ছে। হঠাৎ অন্তিকের কী হলো! সে ছিটকে মিষ্টির থেকে দূরে সরে আসে। নব বঁধু চোখ তুলে তাকিয়ে রয়! অন্তিকের সেই চোখে চোখ রাখা সম্ভব হয় না। উঠে চলে যেতে নিলে নব বঁধু ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। অন্তিকের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে সত্যি সত্যিই ভিটামিন-এ এর পুষ্টি সরবরাহ করে ফেলল। অন্তিক গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। নব বঁধু তা দেখে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে,“ দেখতে আমাকে ছোট মনে হলেও অতটাও অবুঝ নই। সংসার করিনি বলে অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু মা-চাচীদের সংসার করতে দেখেছি। আপনি যদি পাশে থাকেন তবে সংসার কী! এর চেয়েও কঠিন কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করব না।”

অন্তিক লজ্জিত, বিমূঢ়! কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। চুপচাপ বালিশ হাতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মিষ্টির মুখশ্রীতে লাজ ভরে আসে। স্বামীকে নিয়ে তার মনে অনেক স্বপ্ন বুনা আছে। সেগুলোও সে পূরণ করবে। মিষ্টি বাড়ি থেকে আনা ব্যাগ খুলে সুতির থ্রি পিস নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।

মধ্যরাত! অদূরের হিজলগাছ থেকে পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। মিষ্টি ঘুমের ঘোরে শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। একবার অন্তিকের শরীরে হাত পা উঠিয়ে দিচ্ছে তো একবার বিছানার অপর প্রান্তে চলে যাচ্ছে। মিষ্টির নড়াচড়ায় অন্তিকের ঘুৃম ছুটে যায়। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে মিষ্টির দিকে ফিরে। মেয়েটা কীসের যন্ত্রণায় ছটফট করছে তাই ভাবছে। কিছুক্ষণ পর মিষ্টির অসহযোগ ব্যাথার কথা কানে আসে। মিষ্টি ঘুমের ঘোরে বলছে,“ ম’রে গেলাম রে! হাত পায়ের ব্যাথায় মরে গেলাম! ঐ বুড়ি, কতো ঘুমাও! আম্মাকে ডেকে আনো। হাত পা কামড়াচ্ছে তো!”

অন্তিক এবার বুঝতে পারে নব বঁধুর ছটফটের কারণ। সে দুয়ার খুলে রন্ধনশালায় প্রবেশ করে। একটি পাত্রে গরম পানি নিয়ে কিছুক্ষণ পর চলেও আসে। মিষ্টির মায়াবী মুখশ্রীতে অবলোকন করে গরমপানিতে কাপড় ভিজিয়ে ব্যথাতুর জায়গায় ছুঁয়ে দেয়।
“ ও মা গো!” বলে গগনবিদারী চিৎকারে অন্তিক সহ পুরো শহরই কেঁপে উঠে। অন্তিক রুমাল বাটি ফেলে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে,“ এই মেয়ে মানুষ নাকি সাউন্ডবক্সের বাক্স। যখনই মুখ খুলে, ভালো কথা তো আসেই না ঘুমালেও চিৎকার ছাড়ে না। আজব মেয়ে বিয়ে করলাম!

চলবে……..