যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-০২

0
146

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: দুই|

প্রভাতের কিরণ উপচে পড়েছে গগনতলে। পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিক বিবেচনা করে কর্মস্থলে যাচ্ছে সকলে। বিয়ের মৌসুম পাড় হলেও আত্মীয়াদের আনাগোনা কমেনি মোল্লা বাড়িতে। পাড়া পড়শীর প্রশ্নের সম্মুখে লায়লা বেগম। একসময় লাজ শরম ভুলে তেজস্বী নারী হাঁক ছেড়ে ডাকে নব বঁধুকে।

“ অত বেলা করে নতুন বউ ঘুমালে সংসারে মঙ্গল হবে কী করে? কী যুগ আসলো, সকাল আটটা বাজতে চলল নতুন বউয়ের দুয়ার খুলার কেনো নাম নাই, অথচ আমরা ফজরের আগে গোসল করে রান্না ঘরে চলে আসতাম।”

দীর্ঘ রজনীর শেষেও তন্দ্রার ভাব অবসান ঘটেনি অন্তিক ও মিষ্টির। লায়লার উচ্চ আওয়াজে প্রথমে অন্তিকের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে প্রথমেই তার নব বিবাহিতা বঁধুর দিকে দৃষ্টিপাত করে। তন্দ্রাচ্ছন্ন, অগোছালো বঁধুর বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আপাদমস্তকে নজর ঘোরাতে মেদহীনা পেটের দিকে দৃষ্টি আটকে যায় অন্তিকের। কতক্ষণ সময় লোভনীয় দৃষ্টিতে সেটা দেখছিল নিজেরও অজানা। অন্তিক শুকনো ঢোক গিলে নেয়। নব বঁধুর রূপের তেজে কবে যেন অন্তিক ঝলসে যায়। অস্থির অন্তিক বৈধতা থাকা সত্বেও দূরে সরে আসে। সে তার অনিশ্চিত জীবনে ফুটন্ত গোলাপকে অকালে ঝড়ে যেতে দিবে না।
তন্দ্রাঘোরে হাতড়ে দাদীকে ডাকতে চায় সে। কুঁচকান চামড়ার পরিবর্তে হৃদপুষ্ট শরীর অনুভব করে চমকে উঠে সে। অন্তিক চোখ বন্ধ করে নেয়। ঘুমন্ত অবস্থায় মিষ্টি তাকে দেখে বড়োসড়ো ধাক্কা খায়। নিজের বদ অভ্যাসের প্রতি বরাবরের মতোই উদাসীন সে। পরিধানের বস্ত্র পরিপাটি অবস্থায় পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নেয়। পরমুহূর্তে দুষ্ট রাণীর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি ভড় করে। মিষ্টি অন্তিকের একদম কাছাকাছি এসে লেপ্টে শুয়ে সেলফি তুলতে নেয়। দৃষ্যটা এমন দেখায়, অন্তিকের ঠোঁট মিষ্টির কপালে ছুঁই ছুঁই। মিষ্টি সেভাবেই ছবি তুলে নেয়। ছটফটে মেয়েটা নড়েচড়ে ডান, বাম পাশ ফিরে ছবি তুলতে নেয়। অন্তিক অভিনয়ে কাঁচা, সে এমন জটিল, অস্বস্তিকর মুহূর্ত থেকে রেহাই পেতে সরে আসতে নেয়, আচমকা রাতের ন্যায় মিষ্টির মিষ্টি ঠোঁটজোড়া অন্তিকের ঠোঁটের নিচের অংশে ছুঁয়ে দেয়। অন্তিক ছিটকে দূরে সরে আসে। মিষ্টিকে হালকা ধাক্কাও দেয়। তার অন্তর কাঁপছে। উত্তেজনার শরীর শিরশির করছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ত্যাগ করে বলতে শুরু করে,“ পাগল নাকি? এভাবে অচেনা কাউকে চুমু খেতে লজ্জা করে না?”
মিষ্টি বুকে হাত রেখে অবাক নয়নে তাকায়। বড্ড ভয় পেয়েছে সে। এই যাত্রায় বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসতে পারলেই বাঁচে। মনে পরিপূর্ণ আস্থা রেখে শুধায়,“ চোর চুরি করে ধরা পড়লে পুলিশের দোষ?”

অন্তিক ভাবে সে ধরা পড়ে গিয়েছে। নরম স্বরে উত্তর দেয়, “ এখানে কে চোর আর কে পুলিশ?”
মিষ্টি অন্ধকালে ঢিল ছুড়েছিল। নিশানা একদম অন্তিকের কলিজায় লেগেছে তা অনুধাবন করেই দুষ্ট হাসে সে। অন্তিকের দিকে ফিরে লাজুক স্বরে বলে,“ আপনিও কী ভিটামিন-এ এর স্বাদ নিতে চাইছিলেন?”

কী সাঙ্ঘাতিক কথাবার্তা। কর্ণধারে পৌঁছাতেই কান গরম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অন্তিক রাগি চোখে নব বঁধুর দিকে তাকায়। যে বর্তমানে দুই ভ্রু উঁচু নীচু করে অন্তিককে লজ্জায় ফেলতে ব্যস্ত।
“ দেখুন দুষ্ট মেয়ে, আমার থেকে দুরত্ব বজায় রাখবেন। দাদাজানের ওয়াদার কারণে আপনাকে বিয়ে করেছি মাত্র।আমার কাছ থেকে কোনোকিছুরই আশা রাখবেন না।”

অন্তিকের চাচীর হাঁক ছেড়ে যাওয়ার পর অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। নব দম্পতির নড়চড় না দেখে তিনি পুনরায় দরজায় করাঘাত করেন। এই পর্যায়ে রুক্ষতার স্বরে ডাকেন,“ বিয়ের পরদিনই বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকা এই বাড়িতে চলবে না। কাজ করে না চলতে পারলে বউ নিয়ে বিদায় হও।”

বিয়ের পরেরদিন স্বামীর মুখে অবাস্তবিক কথা শুনে এমনিতেই মিষ্টি চটে গিয়েছে, তার উপর চাচীর কথা শুনে মাথা আরো গরম হয়ে যায় তার। দরজা খুলে মিষ্টি হেসে জবাব দেয়, “ আপনাদের বাসায় সবাইকেই কী এভাবে মিষ্টি করে ডাকা হয়, চাচীমা! আমিও তবে কাল থেকে ডাকব! কি বলব লজ্জার কথা, আজ আপনাদের ছেলের জন্যই তো দেরী হলো। কাল থেকে তাড়াতাড়ি উঠব।আপনাকে অভিযোগ করার সুযোগ পর্যন্ত দিব না। তা চাচীমা! এভাবেই বের হবো! নাকি গোসল করে?”

মিষ্টির মিষ্টি লম্বা বক্তব্য শুনে বিস্মিত লায়লা বেগম। কল্পনার বাহিরে ছিল তার শ্বশুর এমন একটা মেয়েকে নিয়ে আসবেন। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে লায়লা বেগম উত্তর দেন,“ বেশরম, নির্লজ্জ মেয়ে।”

লায়লা রাগে কিড়মিড় করেছে। ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে অন্তিকের অবস্থান দেখে হুড়মুড় করে চলে যায়। প্রথম দিনেই চাচী শাশুড়ি নব বঁধুর হাতে জব্দ হয়েছেন ব্যাপারটা অনুধাবন করতেই জিহ্বা কাটে মিষ্টি। দুই গালে তওবা তওবা বলে থাপ্পড় দিয়ে দরজা আটকে দেয় সে।

অন্তিকদের যৌথ পরিবার। অন্তিকের বাবারা দুইভাই। বড়ো চাচা ফিরোজ আলমের কাঠের ব্যাবসা আছে। তিনার দুই সন্তান। বড়ো ছেলে কলেজের প্রফেসার আর ছোটমেয়ে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনা শেষ করে অন্তিক একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় আছে। অন্তিকের বাবা ছোট। অন্তিকের সাত বছর বয়সে কোন এক উষ্ণ সকালে তার মা কাউকে কিছু না বলে সংসার ত্যাগ করে চলে যান। কেন চলে গেছেন,কী কারণে চলে গেছেন আজ পর্যন্ত কেউ জানেন না। শুধু রুনা অর্থাৎ অন্তিকের মায়ের কথা উঠলে অন্তিকের দাদা চুপ করিয়ে দেন।

“ তুমিও নতুন থাকতে ঘর থেইকা বাইর হইবার চাও নাই, বউমা। তোমার শাউড়ী তো তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। তাইলে তোমার এতো গা জ্বলে কেন? পাড়া পড়শী মহিলাগোরে বিকালে আইতে কও। বলে দাও, এখন আমগোর পারিবারিক সময়।”

মাথার ঘোমটা আরো আধ হাত টেনে শ্বশুরের কথায় মাথা দুলায় লায়লা বেগম। পানের বাটা সমেত ভোঁতা মুখে অগ্রসর হোন বৈঠক ঘরের দিকে।

“ কী গো পলির মা। নতুন বউয়ের বদলে পানের বাটা আনলা যে?আমাদের খালি মুখেই বিদায় করবার চিন্তা করতাছো নাকি?”

এক পড়শীর কথায় লায়লা বেগম উত্তর দেন, “ আসলে আব্বা বাড়িতে। নতুন বউ নিয়া মশকরা পছন্দ করছেন না।আপনারা না হয় বিকালে নতুন বউয়ের মুখ দেখতে আসেন।বিকালে কিন্তু খালি মুখের বদলে মিষ্টি মুখে ফেরত পাঠামু।”

পাড়া পড়শীরা একেকজন নীরস মুখে প্রস্থান নেন। লায়লা বেগম রাগে টগবগিয়ে জ্বলে উঠেন। এই প্রথম, পরের পুত্রের জন্য মাথা নত হলো তার। সময়ে,সুযোগে সেও এর বদলা নিয়ে ছাড়বেন।

—————————

বিয়ের দীর্ঘ সময়ের সফরে মিষ্টির খারাপ লাগছিল।তার উপর সে রাতেও অনাহারে ছিল। নাওয়ান ধওয়ানে মনের সাথে শরীরও ফুরফুরে লাগছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার বৃথা প্রয়াস করছে সে। এমন সময় একেবারে তৈরী হয়ে অন্তিকের আগমন ঘটে।আয়নার সামনে সেও মাথার চুল ঠিক করছে। আড়চোখে নব বঁধুর অকার্যকর পরিস্থিতি দেখোও অন্ধ সেজে থাকে। মিষ্টি অন্তিকের হাবভাব দেখে দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় চাপে। সে অন্তিকের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে, “ দাদী বলেছে,বিয়ের পরেরদিন স্বামী যদি স্ত্রীকে শাড়ি পরিয়ে দিতে সাহায্য করে তাহলে সংসারে মঙ্গল হবে।”

“ আমার মঙ্গলের প্রয়োজন নেই, আপনার শাড়ি আপনি পরুন।”

মিষ্টি জানতো অন্তিক মানবে না। তাই সে মুঠোফোন বের করে অন্তিকের দিকে একটি ছবি তাক করে হুমকি দেয়,“
আপনি সাহায্য করবেন, অন্তু? নাকি এই ছবি আপনার দাদাকে দেখাবো।”

একে অপরের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই এমন একটি দুর্লভ ছবি বের করেছে মিষ্টি। একদম নষ্ট এই মেয়েটা। ফোন সামনের দিকে ধরে দুষ্ট হাসছে সে। অন্তিক রেগে তাকায়। এগিয়ে এসে খুব যত্নে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে এক পর্যায়ে হাত কোমড়ের কাছটায় নিয়ে আসে। লতার ন্যায় উন্মুক্ত পেটে আলতোভাবে হাত ছুঁয়ে দেয় অন্তিক। মিষ্টি তখন চোখ বন্ধ করে নেয়। অন্তিক এই সুযোগে মিষ্টির ফোন ছো মেরে নিয়ে বলে,“ আপনাকে কন্ট্রোল করলে হলে, আপনাকেই কপি করতে হচ্ছে মিস দুষ্ট। মনে রাখবেন, আপনি বুনোওল হলে আমি বাঘা তেঁতুল। এমনি এমনিই আপনাকে ছেড়ে দিব না। একদম ছিড়ে ফেলব আপনার ঐ দুষ্ট মনকে।”

অন্তিক চলে যেতেই মিষ্টি চিরুনী দরজার দিকে ছুড়ে মেরে বলে, “ এক মাঘে শীত যায় না, অন্তু! আমিও আপনার মনকে মরুভূমির বালুর ন্যায় চৌচির করে ফেলবো। তখন এই মিষ্টিকেই পানি দানে প্রয়োজন পড়বে।”

চলবে………….