যবনিকা পর্ব-০২

0
65

#যবনিকা। (পর্ব-২)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

ঘড়ির কাটা রাত দুইয়ের ঘরে। চারদিক নিস্তব্ধ, ঘুমে বিভোর বাড়িতে আমিই কেবল নিশাচরী। গন্তব্য, সকাল সন্ধ্যার আপননীড় রান্নাঘর। দিনের সিংহভাগ কাটে এই ঘরেই। এমনিতে জিরোবার একটু ফুরসত পেলেও রমজান কড়া নাড়তেই বিশ্রাম সিন্ধুকে উঠল যেন। সবাইকে রাত্তিরের খাবার খাইয়ে সব গুছিয়ে শেষ করতে বারোটা পেরিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরটা ঘুমে তলানোর মননে বিছানায় গা এলানোর পর স্ত্রীর দায় এসে পড়ে। আতিকের ঘুমানো ব্যবস্থা করা, মশারী টাঙানো, ঘোর পুরানো সব কোটায় সময় কাটা আরও আগায়। তারপর চোখ লাগতেই এলার্ম বেজে উঠে। ফের চুলোর দোরগোড়ায় দাঁড়াতে হয়।

এই সময়টায় আমার আতিককে বেশ হিংসে হয়। সে মহাসুখে ঘুমাচ্ছে, তার কোন দায় নেই, কেউ জাগায় না। একবারে শেষ সময় হেলেদুলে উঠে দুমুঠো অন্ন মুখে নিয়ে আবার এসে বিছানা নেয়। কী সুখ! এত সুখ আমার কপালে জুটে না কেন? বউ বলে?

গরম ভাত ছাড়া মুখে রচে না এ পরিবারের কারো। দিনে দুবেলা ভাত রান্না করতে হয়। রাতের ভাত বিকেলে ইফতারের সাথে মাটির চুলোয়। দিনের বেলার রান্না সারা হয় ঘরের বাইরে চালের রান্না ঘরে। লাকড়ি দিয়ে আগুনতাপে বসে। টিনসেডের ঘরে একটা রান্নাঘর ও আছে। রাতের ভাতটা গ্যাসের চুলা রান্না করার অনুমতি আছে। এটা সৌভাগ্য বলা যায়।

চুলোয় ভাত বসিয়ে রাতের এঁটোবাসন নিয়ে চলে গেলাম পুকুরে। ঘরের পাশে পুকুর। ঘরের কোণে লাইট জ্বলছে। তবুও পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড় আর চারদিকের গা ছমছম পরিবেশে ভয় লাগে। কেউ একজন আশপাশে থাকলে ভালো হতো। আতিককে বলেছিলাম একদিন, আমার সাথে একটু পুকুরঘাটে যাবে? আমার একা একা ভয় লাগে।

ভাগ্য সুপ্রসন্নতায় আতিক রাজি হয়েছিল বটে। কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়লেও নিয়েছিল পিছু। থালাবাসন বেশি ছিল বলে আমার হাতে আঁটছিল না। আতিক এক হাতে দুটো পাতিল আর আরেক হাতে সাবানের কেইস নিয়ে আমার পিছু পিছু রান্নাঘর থেকে বেরুবার সময় আম্মার সামনে পড়ল। আম্মা ছেলের হাত দেখেই বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন,

” পোলা মানুষ থাকবো বাইরের কামে, মাইয়্যা মানুষ থাকবো পাকের কামে। পোলা মানুষ ঘরের কাম করোন শরমের কতা। বাপ মার সামনে বউর আঁচলে ঘুইরা, ঘরের কাম করোস। ছিঃ ছিঃ! কী দিনকাল আইল? আমি তো এক গেলাস পানি ও লইয়্যা খাইতে দিই নাই। আর দুই দিনকার বেলাজ বউ জামাইরে দিয়া কাম করায়? কী জিল্লতি! ”

আম্মার কথার রেশে সেদিনের পর আর কখনো আতিক আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। যতই ঝড় যাক আমার উপর, দূর থেকেই তাকিয়ে ছিল। ‘আম্মা দেখবে’ এ ভয়ে ঘরের বাইরে আমাকে অচেনাই করে থাকে। সবার সামনে বউয়ের প্রতি আগ্রহ দেখানো ও মানা। বিয়ের প্রথম দিকে আতিক বাড়ি ফেরার সময় আমার জন্য এটা ওটা নিয়ে আসতো। এ নিয়ে ও আম্মা কথা শোনাতে ছাড়েন নি। ছেলেকে বুঝিয়েছেন,
“বউরে এত লাই দিতে নাই। বউরে কড়া শাসনে রাখতে হয়। লাই দিলে মাতাত উইঠা নাচব। প্রথম থেইক্যা টাইট না দিলে পরে সংসার নষ্ট কইরা ফেলবে। বউকে শাসনে রাখবি, জামাইরে কথায় উঠবস করব। বউগো এত আহ্লাদ আবার! বউগো জাগা স্বামীর পায়ের নিচে, মাতাত না। মাতাত তুলিস না।”

আতিক মায়ের কথা মনে তুলেছে কিনা জানি না, তবে তারপর আর আহ্লাদের পাহাড় নিয়ে হাজির হতে পারিনি আমি। আমার আহ্লাদের মতো বাড়ি ফেরার সময় আতিকের হাত ও শূন্য হয়ে গেল। এখন
আগ বাড়িয়ে আর সাহায্য চাইনা। কারণ, সেদিন আম্মা মনের ক্ষোভ কথায় উঠিয়ে শেষ করতে পারেন নি। ছেলেকে আর কিছু না বললেও ছেলের আড়ালে আমাকে বেশ কটুকথা শুনিয়েছে। কড়া গলায় হুশিয়ারি দিয়েছেন,
আমার পোলারে আঁচলে বাঁধবার চেষ্টা করবা না, তোমার আঁচলই ছাড়াইয়্যা দিমু।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এই রাতদুপুরে একাই গেলাম পুকুর ঘাটে। বাসন মাজার সময় পুকুর পাড়ে ঝোঁপে কিসের শব্দ হলো। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। বিয়ের আগে হলে বাড়ি মাথায় তুলতাম চিৎকারে। থালা বাসন ছেড়েই পালাতাম।
কিন্তু এখন আমি বউ। সংসার কাজই আমার একমাত্র কর্ম। এখন পালালেও খানিক পর এসে সেই আমাকেই করতে হবে সব কাজ। বাড়ির মতো কোমলমতি হাত মাথায় ঠেকবেনা, বলবেনা,
অনেক করেছিস, আর করতে হবে না। যা আমি করছি সব।

ভয় পাস না, বাবা আছি।

ওদিকে আর তাকালাম না, দোয়া পড়তে পরতে বাসন মেজে উপরে উঠে এলাম। বোল রেখে, কলস হাতে ফের গেলাম পানি আনতে।
ভাতের মাড় গালতে গিয়ে হাতে পড়ল, ঝলসে গেল হাতটা। অথচ উহ্ঃ শব্দটা ও বেরুল না। সংসারে নেমে এত কিছু লাই দিলে চলে?

তরকারি গরম করে টেবিল সাজানোর সময় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আম্মা উঠে এলেন। ভাতের মাড় হাতে পড়ায় হাত সরাতে গিয়ে কয়েকটা ভাত নিচে পড়ে গেছে। তা দেখে গরম গলায় বললেন,
” একটা কাম ও ঠিক মতই করতে পারো না। সারাদিন কাজ কাম করো না, দুইটা ভাত রানতে আইলা হেইটাও পালাইয়্যা চালাইয়্যা নষ্ট করতাছ। মাগনা পাইছ ত, জিনিসের মর্ম বুঝতাছ না, বাপের বাড়ি থেকে আনলে বুঝতা। মায় ভাত রান্দা ও শিখায়নাই। ”

আম্মা মাটিতে পড়া কটা ভাত দেখলেন কেবল, চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন না আমার হাতের নরম মাংস লাল হয়ে ফোসকা পড়ে যাওয়াটা । বুঝতে চেষ্টা করলেন না, কতখানি যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে। মনের কথা নাইবা বললাম। মনের হিসেবে কজনেই রাখে?

লেখিকা- আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

ক্লিষ্ট মনে সবাইকে খাবার পরিবেশন করলাম। কারো লবণ লাগবে, কারো পানি, কারো ঝোল, কারো ভাত, কারো লেবু, কারো ফল। এসবে আমার খাওয়া হলো না। সবার খাওয়া শেষ হবার পর জিরিয়ে প্লেট নিয়ে বসলাম দু’লোকমা মুখ তুলবার পর আযান হয়ে গেল। পানিটাও গলায় নামল না।

সাহরির পর কাজ নেই। দু’দন্ড শান্তিতে ঘুম আমার প্রাপ্য বটে। কিন্তু সেই সাধ্যি ও নেই। আতিক অফিসে যাবে, সকাল সকাল রেড়ি হতে গিয়ে কিছুই খুঁজে পায়না। কিছুক্ষণ পর পর কাঁধ ঝাকিয়ে বলে,
“কবিতা, আমার আয়রন করা শার্ট পাচ্ছি না, আমার ঘড়ি কই? আমার চিরুনী কই? ”

ঘুমের ঘোর ঠেলে আমাকে আয়রন নিয়ে বসতে হয়। হুলস্থুল করে বাড়ি মাথায় তুলে অফিসের জন্য বিদায় নেয় আতিক। ততক্ষণে ঘুম পালিয়েছে, বাইরে হাঁস মুরগীর ডাক কানে আসে। হাঁস মুরগী ছেড়ে দিয়ে এঁটো বাসন, রাতের কালিমাখা পাতিল নিয়ে ছুটি পুকুর ঘাটে।

বড়ো বাড়ির একটাই পুকুর। সকাল হলে বাড়ির বউ-জি রা হাড়ি পাতিল নিয়ে ভীড় করে।
ছাই দিয়ে পাতিল মাজার সময় এক চাচী শ্বাশুড়ি বললেন,
“কিরে আতিকের বউ, এইবার ইফতার টিফতার খাওয়াইবানা?”

ইঙ্গিতটা বুঝে আমি বললাম,
” শ্বশুরবাড়ির থাকলে বাপের বাড়ি থেকে আনতে হয়না।”

আমার কথায় বেজায় অসন্তোষ হলেন চাচী। চোখ মুখে নিদারুণ বিতৃষ্ণা ফুঁটে উঠল। কথা দিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে তেড়ে এলেন যেন,
“কী কও বউ! বউগো উপর শ্বশুরবাড়ির হক আছে। একখান পোলা মানুষ করছে, টাহা পয়সা খরচ করাইয়্যা বিয়া দিছে, বউ নিয়া আইছে, ভরণপোষণ দিতাছে। পোলার বাপ মার তো কিছু পাওন দরকার আছে। এগুলা সম্মান। সংসারে ভালা চলতে এগুলা দিতে অয়। মাইয়্যার বাপ মাগো অনেক কিছু করোন লাগে। কইতে অয়না। আমার মাইয়্যার জামাইর বাড়ি তরফে তরফে সব দিছি। বিয়ার তিন বছর হইতাছে, এখনো গাট্টি বাইন্ধা বাজার যায়। মাইয়্যার মান আছে, ভালা আছে মাইয়্যা।”

আমার মনে প্রশ্ন জাগল, সংসারের সুখ, বউয়ের মান বাবার বাড়ির দেনার মাঝে কে রেখেছে? বিয়ের শর্ত,,ছেলে বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে, সেখানে বাবার দায় তো নেই। তবুও কেন বাবাকে জিম্মি করা হয়? আর মানুষ শুধু ছেলেকে করছে? মেয়েকে করেনাই?

থেমে আয়েশ করে গল্প করলেন চাচী,
” আমার পোলার শ্বশুর ইফতারের কতা জিগাইছিল। কইয়্যা দিছি, ইফতার লাগব না। তোমার চাচা শ্বশুর কদিন আগে এক গাট্টি বাজার করছে। পুরা মাস চইলা যাইব। এত ইফতার খাইব কে? আর বউয়ের বাপ কিপটা, হাত দিয়া পানি সরে না, কী না কী আনে, ভরসা নাই। এর লাই বউরে কইছি, তোমার বাপরে কইয়ো ইফতার না আইনা টাকা দিয়া দিতে। কাইল রাইতে পোলার কাছে ২০ হাজার টাকা পাঠাইয়্যা দিছে। সমাজে চলতে হইলে সামাজিকতা জানতে হয়। ”

আমি চাচীর দিকে তাকালাম, চাচীর চোখমুখ খুশিতে ভাসছে। চাচীদের আর্থিক অবস্থা ভালো। সংসারে অভাব নেই, শরীরে স্বর্ণ অলংকারে ভরা। এক ছেলে বিদেশ থাকে। মাসে হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাঠায়। এমন হাজার বিশেক টাকা চাচীর হাতের উপর দিয়ে যায়, তবুও ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা টাকার লোভটা ছাড়তে পারেন নি।

চাচীর ছেলে বউ ও ঘাটে পাতিল মাজছে। আমি ওর দিকে তাকালাম। দেখি সে ঢেউ খেলানো জলে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। চোখমুখ ভয়াল মলিন। চাচী যেতেই আমি প্রশ্ন করলাম,
” আমি না হয় বাপের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনতে পারছিনা বলে অসুখী। তোমার বাপের বাড়ি থেকে বারোমাসে তেরোবার খরচাপাতি আসে, তবুও মুখ কালো কেন?”

লেখিকা- আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

চাচীর বউয়ের নাম সুমি। প্রতিদিন ঘাটে দেখা হয়। ঘরে যাওয়া আসা হয়না তেমন। চাচী বউকে কড়া চোখে রাখেন। তার ধারণা, সবার সাথে মিশলে শলা পরামর্শ দিয়ে বউকে খারাপ করে ফেলবে। সে অন্য ব্যাপার যে, তিনি নিজে গিয়ে যত্ন করে মানুষের বাসায় কাটি জ্বালিয়ে আসে।
যাক গে, সুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” সবাই শুধু খরচাপাতি দেখে, কেউ পেছনের গল্প দেখে না। এই যে কাল বাবা টাকা পাঠাল, সবাই খুশিতে আটখানা। কিন্তু কেউ কি জানে, এই টাকা কোথা থেকে আসছে? আমার বাবার কাছে ভালোই টাকা পয়সা আছে। কিন্তু সে অনুযায়ী খরচ ও আছে। মায়ের কিডনিতে পাথর হয়েছে, কদিন আগেই অপারেশন কতগুলো টাকা খরচা গেল। মাসে মাসে মোটা অংকের মায়ের ওষুধের ডাক্তারের পেছনে যায়। দ্রব্যমূল্যের যা দাম তাতে একটা সংসার চালাতে কতগুলো টাকা দরকার হয়। মাসে মাসে বাসা ভাড়া, ভাইবোনদের পড়ালেখার খরচ, সব মিলিয়ে বাবা হিমসিম খাচ্ছেন। কদিন আগে শীত গেল, দুই কার্টুন শীতের পিঠা দিয়েছেন। ননদের ছেলে হলো, স্বর্ণের চেইন দিয়েছেন। তারপর এখন রোজায় টাকা গেল। কদিন বাদে আবার ইদে সবাইকে কাপড় চোপড় কিনে দিতে হবে। না দিলে আমার শ্বাশুড়ি মাকে ফোন দিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে বলে দেন। লাজ লজ্জায় না এনে পারা যায় না। নিজেরা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছেন তো, দায়টা বেশি। আবার না মেয়ের অশান্তি হয়।
সমাজের এত নিয়ম কেন? বাবা মা কি মেয়ে জন্ম দিয়ে পাপ করে ফেলেছেন? বাবার চেহারাটা চোখে ভাসলেই কান্না আসে আমার।”

লেখিকা- আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

আমি স্তব্ধ হয়ে শুনলাম। এতদিন ভাবতাম, বোধহয় আমার বেলাতেই এমন হয়। মনে মনে নিজেকেও দোষ দিতাম, ভাবতাম নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি বলে সাজা পাচ্ছি। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করলে বোধহয় কপালটা এমন হতো না। কিন্তু সুমির কথা এখন মনে হচ্ছে, আমার ধারণা ভুল। সুমির বিয়েটা ওর বাবা মায়ের পছন্দে হয়েছে। বাবা মা দেখে শুনে বিয়ে দিয়েছে। দোষ যদি আমার লাভ ম্যারেজে হতো তবে সুমির মনে সুখ নামতো।
আসোলে বিয়ের ধরণে দোষ না, দোষ সমাজের নিয়মে।
এ সমাজের ঘরে ঘরে এ নিয়ম গেঁথে গেছে, শ্বাশুড়ি সমাজ যুগ যুগ ধরে কড়াচোখে প্রথার খেয়াল রাখছেন।
শহুরে মানুষ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে, তোমরা কেন লাই দাও? দোষটা তোমাদের। পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও।
শুনে আমার হাসি পায়, বলতে ইচ্ছে করে, তোমাদের মতো গ্রামের মেয়েরা ডানা মেলে উড়তে পারেনা। উড়তে গেলেই ডানা ভেঙে বিয়ে দিয়ে দেয়। পড়ার পাঠ চুকিয়ে সংসারের চাবির গোছা তুলে দেয়। আর সেই সংসারে এইসব নিয়মে লাই না দিলে পরিণতি বিচ্ছেদ অবধি গড়ায়। তোমাদের শিক্ষিত সমাজ অবধি ডিভোর্সি মেয়ে গ্রহণ করেনা, সেখানে তো আমাদের অজপাড়াগাঁর অজ্ঞ সমাজ, পারলে জীবন্ত পুঁতে পরিত্যক্তকে। সংসার বাঁচানোর ভয়টা তাই একটু বেশিই আমাদের। লাই নয়, আমরা বাধ্য, বাঁধা, ডানা ভাঙা পাখি শক্ত শিকলে বাঁধা।

_________

এক এক করে পাঁচটা রোজা পেরিয়ে গেল। আমার শ্বশুরদের বড়ো বাড়ি। বাড়ির বউদের একেকজনের বাপের বাড়ি থেকে ইফতার আসছে। তাদের শ্বাশুড়িরা বুক ফুলিয়ে তা বিলি করছেন। একটা বোলে কয়েকটা খেজুর, দু’ মুঠো ছোলা বুট, এক বাটি মুড়ি, এক বাটি চিড়া, দুটো লেবু, কয়েক চামচ শরবতের পাউডার..
বোলটা আম্মার হাতে দেয়ার সময় টিপ্পনী কাটছেন আমার বাবার বাড়ির ইফতার নিয়ে।
তার ঝাঁজ আম্মা আমার উপর উঠাচ্ছেন। আমাকে আমার বাবা মাকে যা তা শুনাচ্ছেন। ফকিন্নি, ছোটোলোক, বিখেরী, খান* কি বে * শ্যা শব্দগুলো আম্মার জিহ্বার আগায় থাকে। তা ছাড়াও বিশ্রী ভাষায় গালি গালাজ ও করছেন।

আমার বাবার বাড়ির ইফতারের খোঁটার মাত্রা রোজার সাথে সাথে বেড়েছে। কদিনের মাঝে কথার বাণে আমার টিকে থাকা দায় হলো। সারাদিন ঘরে অশান্তি, চোখের সামনে বাবা মায়ের নামে মন্দ কথা শুনতে কারইবা ভালো লাগে।
আমার হেলদোল না দেখে একদিন আম্মা আমার ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” কী এক ফকিন্নির ঘরে ছেলে বিয়ে করালাম। আনমান সনমান জানে না। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে টেকা যাচ্ছেনা। তোমার বাপকে বলো, কালই ইফতার আনতে। ”

বাবাকে ফোন বন্ধ এলো। চার্জ নেই বোধহয়। মাকে ফোন দিলে তুলল ছোটোবোন। বিকেল তখন।
ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করবার পর বললাম,
“মা কোথায়?”

” রান্নাঘরে।”
“ইফতারে কী হচ্চে আজ?”

” ছোলাবুট নেই ঘরে। এ মাসে কিস্তি দিয়ে বাবার হাতে টাকা পুরিয়ে গেছে। কিনতে গিয়েও চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ কিনে আর বাজারে কুল করতে পারেনি। ঘরে চিড়া আছে, চিড়া দিয়েই রোজা ভাঙব।”

মা ফোনটা ধরল। ক্লান্তি অবিশ্রান্ত স্বরটা শুনেই আমার গলা ধরে এলো। হাজার চেয়েও ‘ই’ শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারলাম না। যারা কপালে ছোলাটা ও জুড়ছেনা, তাদের কিভাবে বলব ইফতার আনবার কথা?

এতেও বেজায় ক্ষেপলেন আম্মা। কম হলেও ঘন্টা খানেক আমাকে কথায় ঝাঁজরা করলেন। ছেলে ফিরতেই তাকে বিচার দিলেন, ইনিয়েবিনিয়ে দশ কথা বানিয়ে। আতিক মাকে শান্ত করল। ইফতারের ঘরে আসতেই আমাকে বলল,
” এই রোজা রমজানে এত অশান্তি ভালো লাগছেনা। কাল সকালে সিএনজি ধরিয়ে দিব, তুমি বাপের বাড়ি যাবে।”

চলবে…….

___________