যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৩৩+৩৪

0
519

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩৩.
সিদ্রার পছন্দের ইজিচেয়ারটাতে শুয়ে আছে মুনিরা। বুকের ভেতরটা কান্নায় হুহু করছে, মাঝে মাঝে অবাধ্য কিছু ফোঁটা চোখ দিয়ে বাইরেও বেরিয়ে আসছে, সাথে সাথে মুছে ফেলছে ও। সিদ্রার জন্য ভেবে ভেবে এভাবেই প্রতিদিন চোখের পানি ফেলে মুনিরা। সিদ্রাকে যে ও এতো ভালবাসে, সিদ্রা নিখোঁজ না হলে হয়তো কোনদিন বুঝতেও পারতোনা।

নিজাম সাহেব আদর করে দুই জমজ মেয়ের নাম রেখেছিলেন সিদ্রাতুল মুনতাহা আর সিরাজাম মুনিরা। জমজ হলে কি হবে, ছোটবেলা থেকেই সিদ্রা আর মুনিরা যেন উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। আর বড় হওয়ার সাথে সাথে এই পার্থক্য শুধুই বেড়েছে। মুনিরা সদা প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল, চটপটে, যাকে বলে এক্সট্রোভার্ট আর সিদ্রা ঠিক তার উল্টো। অতিরিক্ত শান্তশিষ্ট আর এতো বেশি ভদ্র বলে সিদ্রার ওপর প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করে মুনিরা। ওর কাছে সিদ্রা একদম মরা মরা, ছিঁচকাঁদুনে টাইপ মেয়ে।

“দারুণ একটা মুভি ডাউনলোড করেছি, দেখবি আমার সাথে?” “নারে, আমি এখন বই পড়বো!”;
“জানিস আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে না……… ” “থাক, আর বলতে হবেনা, গীবত করা ভালো না মুনিরা!”;
“আয় দুজনে কয়টা সেলফি তুলি” “অপ্রয়োজনে এত ছবি তুলতে হয়না, জানিস তো, তাও এমন করিস কেন তুই!”;

সবসময় এমনতরো উত্তর শুনতে কার না রাগ লাগে! তারওপর সারাক্ষণ কুরআন পড়, হাদীস পড়, গান শুনিসনা, মুভি দেখিসনা, ফেসবুক না গুতিয়ে একটু ইসলামিক বই পড় এসব কানের কাছে রেডিওর মত বাজাতে থাকে। আরে বাবা, সকালে তো প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও তো পড়ছি সময়মত, ভোররাতে তাহাজ্জুদ না পড়লে কি হয় এমন! সিদ্রা ওর জীবনের একটা ঝামেলা, এমনটাই ভাবতো মুনিরা।

কিন্তু এ কয়দিনে হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে, সিদ্রা ওর কাছে কতটা কি ছিল। এইতো সেদিন, মাথা ব্যথা করছিল, অভ্যাসবশত বলেই ফেললো, “সিদ্রা, একটু কফি বানিয়ে দে না” তারপরেই মনে পড়লো, সিদ্রা তো নেই! নিজে উঠে কফি বানাতে গিয়ে বুঝতে পারল, ও আসলে কফি বানাতে জানেইনা। কোনদিন দরকারই হয়নি, সিদ্রাই বানিয়ে দিয়েছে সবসময়। তারপর থেকে আর কফি খেতে ইচ্ছেই হয়নি ওর। এটা তো শুধু একটা উদাহরণ, এভাবেই প্রতি মুহূর্তে ও উপলব্ধি করছে সিদ্রার অভাব। ওয়ার্ডরোবে সিদ্রার জামাকাপড় আর আলমারিতে সিদ্রার বোরকা দেখলেই চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে ওর। রাতেরবেলা ঘুম আসেনা, বিছানার শূন্য পাশটা ওর দিকে তাকিয়ে যেন বিদ্রূপ করে। রাত কেটে যায় সেই শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে, জানেনা কোথায় কিভাবে আছে ওর এত ভালো বোনটা।

একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে সিদ্রা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে। মাঝেমাঝেই সিদ্রাকে স্বপ্নে দেখে ও, ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকে সিদ্রা ওর দিকে, চোখদুটো যেন বলতে চায় ও কোন বড় অন্যায় করেছে সিদ্রার সাথে। প্রথমদিন স্বপ্নটা দেখার পর ও ভেবে দেখেছে, আসলেই তো, সিদ্রার সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করেছে, বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে, কিন্তু সিদ্রা কোনদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। এমনকি ও যে গান শুনে, মুভি দেখে, ছেলেদের সাথে কথা বলে, ভার্সিটিতে ছেলে ফ্রেন্ডও জুটিয়ে ফেলেছে, এসব আব্বু আম্মু জানলে ওর খবর করবে। তবু সিদ্রা কোনদিন বিচার দেয়নি ওর নামে, নিজেই সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু সিদ্রার কোন কথার গুরুত্ব দিতোনা ও, প্রতিটা কথা এককান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতো। অথচ এখন, সিদ্রা ওকে যা যা করতে বলতো আর যা যা করতে নিষেধ করতো, সব মেনে চলার চেষ্টা করছে মুনিরা। যেন সিদ্রাকে বলতে চাইছে, “দেখ, তুই যেমনটা চাইতি, আমি তেমনটা হয়ে গেছি, শুধু তুই ফিরে আয়”

যেই সিদ্রা ওকে প্রতিরাতে তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য ডাকত বলে ও বিরক্ত হতো, এখন তার ফিরে আসার জন্যই ও দোয়া করে প্রতিরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে। আল্লাহকে বলে, “শুধু একবার আমার বোনটাকে সহি-সালামতে ফিরিয়ে দাও, আমি ওর সাথে আর কোনদিন কোন দুর্ব্যবহার করবোনা” শুধু আব্বু আম্মুর সামনে স্ট্রং থাকার চেষ্টা করে মুনিরা, যাতে উনারা ওকে শক্ত থাকতে দেখে নিজেরাও কিছুটা সান্ত্বনা পান। এখানেও ওরা দুইবোন আলাদা, সিদ্রার মনের অবস্থা সহজেই ওর মুখে ফুটে উঠে, নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারেনা ও। আর মুনিরা, ওর ভেতরে ভুমিকম্প-সিডর ঘটে গেলেও, ও না চাইলে কেউ বুঝতে পারবেনা।

এইতো কয়েক মাস আগে, একটা ছেলের সাথে মিথ্যামিথ্যি ফেসবুকে প্রেম করতে গিয়ে সত্যি সত্যি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যদিও ছেলেটা দুর্বল হয়েছিল ওর থেকে অনেক বেশি। সেই সিলেট থেকে ঢাকা চলে এসেছিল ওর সাথে দেখা করতে। তখনি টনক নড়ে ওর, ছেলেটা এত বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে, আর বেশিদূর এগোন যাবেনা। একেতো প্রেম করছে জানতে পারলেই আব্বু জ্যান্ত কবর দিবে তার ওপর এমন একটা ছেলে, যার মধ্যে নামটা বাদে মুসলমানের আর কোন চিহ্ন নেই। আব্বু আম্মু যতই ভালবাসুক ওকে, এমন একটা ছেলেকে জামাই হিসেবে কখনোই মেনে নিবেনা। তাই আস্তে আস্তে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ছেলেটা এত ডেস্পারেট হয়ে যায়, বাধ্য হয়ে সব যোগাযোগ অফ করে দেয় ও। ছয়মাস ধরে গড়ে ওঠা একটা সম্পর্ক, ভুলে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! কম কষ্ট কি হয়েছে? প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়েছে ও। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি ওর মনের অবস্থা, এমনকি পাশে শুয়ে থাকা সিদ্রাও না।

আর এখনও, সিদ্রার জন্য যে ওর কত কষ্ট হচ্ছে, কেউ বুঝতে পারেনা। কেউ দেখলে হয়তো ভাববে বোনের জন্য কোন চিন্তাই নেই ওর। কিন্তু ওকে স্ট্রং থাকতে হচ্ছে আব্বু-আম্মুর জন্য। সিদ্রা নিখোঁজ হবার পর থেকে ওদের বাসাটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। হাসির আওয়াজ তো দূরের কথা, জোরে কথাও বলেনা কেউ। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর চোখের জল শুকিয়ে গেছে বহু আগেই। সারাদিন বসার ঘরে বসে সিদ্রার জন্য অপেক্ষা করা এখন তার একমাত্র কাজ। বাসার সকল কাজ এখন মুনিরাকে করতে হয়। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, এসবে কখনওই আগ্রহ ছিলনা ওর। দুই বোন জমজ হলেও সিদ্রা ওর থেকে কয়েক মিনিটের বড়। তাই ছোট হওয়ার সুবিধাটা সারাজীবন কড়ায় গন্ডায় উপভোগ করেছে ও। সিদ্রাই সবসময় ঘরের কাজে আম্মুকে সাহায্য করতো, ওকে কিছু করতেই হয়নি কখনো। আর এখন করছে, যা পারছে। ওর আনাড়ি হাতের বিস্বাদ রান্না বিনাবাক্যব্যয়ে কয়েক লোকমা মুখে তুলে উঠে যায় আব্বু। আর আম্মুকে খাওয়ানো তো অসাধ্য ব্যাপার, চিন্তা করে আর না খেয়েদেয়ে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে একদম।

কিন্তু সিদ্রার হলটা কি! বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, হাসপাতাল, মর্গ, কোনকিছুই বাকি রাখা হয়নি ওকে খুঁজতে। কিন্তু এতদিন ধরেও পুলিশ কিছুই বের করতে পারেনি, অবশ্য ওরা যে আদৌ খুঁজে দেখেছে তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে। সিদ্রা যেদিন নিখোঁজ হল, সেদিন ডায়েরী করাতে গিয়ে আব্বুকে ওরা সিদ্রাকে নিয়ে এত বাজে কথা শুনিয়েছিল যে বাসায় আসার পর আব্বুর মাথায় পানি ঢালতে হয়েছিল, পুরো একটাদিন আব্বু বিছানায় শুয়ে চোখের পানি ফেলেছে। সিদ্রা নাকি কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে, আরো রাজ্যের সব অকথ্য কথাবার্তা। তাও আব্বু কয়েকদিন পর পর থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসে, কিন্তু ওরা কোন আশার বাণী শোনাতে পারেনা। সিদ্রা যেন জাস্ট হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বাড়িতে বসে থাকলে তো আর সংসার চলবেনা, রোবটের মত তাই প্রতিদিন অফিস করছে আব্বু।

মুনিরাও কয়েকদিন অনবরত কান্নাকাটির পর ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে, যদি তাতে একটু মানসিক চাপ কমে। কিন্তু যাওয়ার পরে আরো বেশি খারাপ লাগে, আম্মুর জন্য চিন্তা হয়, দু একটা ক্লাস করেই ফিরে আসে বেশিরভাগ দিন। সবথেকে বিরক্তিকর হল আত্মীয়-স্বজনদের উথলে ওঠা দরদ! সবাই ফোন দেয়, কিন্তু সান্ত্বনা দিতে না, খোঁচা দিতে। সবাই ধরেই নিয়েছে, কারো সাথে প্রেম করে পালিয়েছে সিদ্রা। এমন একটা মেয়ে তলেতলে এতকিছু ঘটাবে, কেউ ভাবতেই পারেনি, আরো কত কি! বিরক্ত হয়ে মুনিরা সবার ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

ফোনের রিংটোন শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মুনিরার। সেই সকাল থেকে শুরু করেছে এই নাম্বারটা। প্রথমবার রিসিভ করে ছেলের গলা শুনেই কেটে দিয়েছে, তাও করেই যাচ্ছে। আরে বাবা, রিসিভ করছিনা দেখে বুঝতে পারছিসনা যে আমি কথা বলতে চাচ্ছিনা। নাছোড়বান্দার মত লেগে আছে। কিন্তু এতবার করে ফোন করছে, যদি কোন ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার হয়। আচ্ছা আরেকবার ধরে দেখি।

“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”

“ওয়ালাইকুমুসসালাম। আপনি কি সিরাজাম মুনিরা বলছেন?”

“আপনি কে বলছেন?”

“আমার পরিচয় দেয়ার আগে আমি ঠিক মানুষের কাছে পরিচয় দিচ্ছি কিনা সেটা আমাকে জানতে হবে”

“সেটা তো আমার ক্ষেত্রেও খাটে, তাইনা?”

“আচ্ছা আমি ধরে নিচ্ছি আপনিই সিরাজাম মুনিরা। কারণ এটা উনারই নাম্বার”

“আপনি কে না বললে কিন্তু আমি কল কেটে দিব”

“না প্লিজ, সেটা করবেননা। আপনার সাথে কথা বলা আমার খুবই প্রয়োজন। আসলে সামনাসামনি বললেই ভাল হতো, কিন্তু সেটা রিস্কি হয়ে যাবে বলে ফোনেই বলতে হচ্ছে”

“রিস্কি! আপনি কি নাম বলবেন না আমি কাটব?”

“নাম বললে তো আপনি চিনবেননা, বরং পরিচয়টা বলি। আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আপনার বাবা আপনার নিখোঁজ বোনকে খুঁজে দেয়ার জন্য আমাকে এপয়েন্ট করেছেন”

“কি? প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর! কই, আমি তো এমন কিছু শুনিনি”

“আসলে উনি এটা আপনাদের থেকে গোপন রাখতে চাচ্ছেন। প্লিজ আপনি আবার উনাকে বলে দিবেননা যে আমি আপনাকে কল করেছি। উনি আমাকে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে স্ট্রিক্টলি নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমি কানাগলিতে আটকে গেছি, কোন ক্লু পাচ্ছিনা। তাই নিরুপায় হয়ে আপনার সাথে কন্টাক্ট করছি”

“কিন্তু বাবা সিদ্রাকে খুঁজছে সেটা আমাদের কেন জানাবেনা? আপনার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা”

“উনি বলেছেন, পুলিশের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে উনার ওয়াইফ মানে আপনার মাদার নাকি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন নতুন করে আর আশা জাগাতে চাচ্ছেননা, ইন কেস যদি আমি সফল না হই আর কি, তাহলে তো আরো বড় শক পাবেন”

“হুম, সেটা ঠিক, কিন্তু আমি জানলে কি হবে?”

“সেটা তো আমি বলতে পারবো না। সেটা বরং আপনি আপনার বোনকে খুঁজে দেবার পর আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েন। অবশ্য যদি সেটা আপনি চান আর কি”

“কিসব আবোলতাবোল বলছেন, আমি চাইবো না কেন? আর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কেন করতে যাব, আমি আজকেই জিজ্ঞেস করব”

“এজন্যই তো বললাম, যদি আপনি চান। আপনি যদি আপনার বাবাকে বলেন যে আমি উনার শর্ত ভেঙে আপনার সাথে যোগাযোগ করেছি, তাহলে কি আমার কাজটা থাকবে? তখন আমি আপনার বোনকে কিভাবে খুঁজে দিব?”

“ও আচ্ছা, বুঝেছি। কিন্তু আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আপনি জানেন সিদ্রা কোথায় আছে” আল্লাহ, লোকটা যেন সত্যিই জানে সিদ্রা কোথায় আছে, মনে মনে দোয়া করল মুনিরা।

“এক্সাক্টলি কোথায় আছে না জানলেও কার সাথে আছে জানি। এখন আপনি আমাকে শুধু তার নাম আর পরিচয়টা বলবেন”

“কার সাথে আছে সিদ্রা?”

“জ্বী উনার হাজবেন্ড এর সাথে, আপনার বোন পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছেন”

“জুতা চিনেন?” রাগের চোটে দাঁড়িয়ে গেল মুনিরা।

“স্যরি!?”

“বলছি জুতা চিনেন? আপনি যদি এই মুহূর্তে আমার সামনে থাকতেন না, জুতার বাড়ি মেরে আপনার দফারফা করে ফেলতাম আমি!”

ওইপাশের লোকটা যেন থতমত খেয়ে গেল, কথাগুলো হজম করতে সময় নিল খানিকটা, তারপর বলল,
“আমি বুঝতে পারছি আপনার কাছে ব্যাপারটা শকিং। কিন্তু আমার কাছে পাকা খবর আছে, উনাকে মাদ্রাসায় যাবার পথে একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে”

“এর থেকে যদি আপনি বলতেন, পৃথিবী উলটে গেছে কিংবা শেখ হাসিনা আর খালেদাজিয়ার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে, আমি বরং সেটা বিশ্বাস করে নিতাম। কিন্তু সিদ্রা একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে এটা জাস্ট অসম্ভব! আপনি যে কোন লেভেলের গোয়েন্দা আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমিই আব্বুকে বলছি যেন উনি আপনাকে ঝাটা মেরে বিদায় করে দেন”

“আমার কাছে প্রমাণ আছে”

“আপনার প্রমাণ আপনি গলায় ঝুলিয়ে কটকটি খান। সিদ্রা স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে একথা বললেও আমি বিশ্বাস করবনা। আমার বোন কেমন সেটা আমি খুব ভাল করে জানি। যে মেয়ে রাস্তার একপাশে ছেলেদের দেখলে রাস্তার আরেকপাশে চলে যায়, অপ্রয়োজনে কোন ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনা, আপনি আমাকে তার প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার গল্প শোনাচ্ছেন!”

“সামনাসামনি কথা বলা আর চ্যাট করা তো আর এক হয়না। হয়ত ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে, আপনি তো আর উনার ফেসবুক ঘেটে দেখেননি!”

“না ভাই, আমার ওর ফেসবুক দেখার দরকার নাই, কারণ আমি স্বয়ং সিদ্রাকেই দেখেছি। ওর ফেসবুক একাউন্ট না, আমি খুলে দিয়েছি। ফ্রেন্ডদের সাথে প্রয়োজনে মেসেঞ্জারে মেসেজ আদান প্রদান ছাড়া আর কোন কাজে লাগাতে দেখিনি আজ পর্যন্ত। সারাদিন কুরআন, হাদীস, ইসলামিক বই, গল্পের বই পড়ে সময় কুলোতে পারেনা আর ও করবে ফেসবুকে প্রেম!”

“আচ্ছা, আপনিও কি উনার মতই? ফেসবুক চালাননা আপনি? ছেলেদের সাথে কথা বলেননা?”

“আমি কি করি না করি তা দিয়ে আপনি কি করবেন?”

“আহা! আগে উত্তর দেন, তারপর বলছি”

“হ্যাঁ, আমি ফেসবুক চালাই, ছেলেদের সাথে কথাও বলি, তাতে কি হয়েছে?”

“এই যে, আপনি যদি এসব করতে পারেন, তবে আপনার বোন কেন নয়? এমনও তো হতে পারে আপনার কাছে থেকে উনি গোপন করেছেন বিষয়টা”

“না, আমি করতে পারলেও আমার বোন পারেনা। সেটা আপনি না জানলেও আমি খুব ভাল করে জানি। আর আমার কোন কথা হয়ত সিদ্রার থেকে গোপন থাকতে পারে, কিন্তু সিদ্রার কোন কথা আমার থেকে গোপন নেই। কিন্তু আপনার সাথে আমি এসব প্যাচাল পাড়ছি কেন? আপনি এসব করে যে কি খুঁজে বের করবেন, আমি বুঝে গেছি। আমি এখনি আব্বুকে কল করছি। আর কোন মেয়ে নিখোঁজ হওয়া মানেই যে সে কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে, দয়া করে আপনাদের এই পার্সপেক্টিভটা চেঞ্জ করুন। মেয়েটার যে কোন বিপদও হতে পারে সেটাও প্লিজ একটু ভেবে দেখবেন”

“আর একটা প্রশ্ন ছিল”

“ঘোড়ার আন্ডা ছিল, গোয়েন্দা না ছাই, পাগল ছাগল কোথাকার!”

কল কেটে রাগের চোটে মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুড়ে মারল মুনিরা। যত্তসব আজাইড়া কথাবার্তা! সবার মুখে এক কথা, অসহ্য! যেখানে সিদ্রার মত মেয়ে এমন কাজ করতে পারে এটা কেউ বিশ্বাস করবেনা বলে আমি মাঝেমাঝে ওর নাম দিয়ে ছেলেদের সাথে চ্যাট করি, ফারহানের সাথেও তো ওর নাম দিয়েই প্রেম করেছি, সেখানে ওর প্রেম করার কাহিনী আমাকেই শুনাতে আসছে, হুহ!

এসময় কলিংবেল বাজল, পড়িমরি করে ছুটল মুনিরা, আম্মুকে গেট খুলতে দেয়া যাবেনা। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। গেট খুলে ফেলেছেন জাহানারা বেগম আর বাইরে সিদ্রার বদলে ময়লাওয়ালাকে দেখে সবসময়ের মত শকড হয়ে গেছেন। মুনিরা দরজার কাছে যাওয়ার আগেই পড়ে গেলেন তিনি, দরজার চৌকাঠে ঠক করে বাড়ি খেল মাথাটা।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩৪.
মুনিরা ওপাশ থেকে কল কেটে দিলেও রাইয়্যান পুরো তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কয়েক মুহূর্ত যেন নড়তে চড়তে ভুলে গেল ও। কি মেয়েরে বাবা, এতো পুরা সিদ্রার অপজিট। হুম, চ্যাটের কথার ধরণের সাথে এই মেয়ের কথার হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে, যার এক কণাও সিদ্রার সাথে পাওয়া যায়নি।

সিদ্রার জ্বর ভাল হওয়া আর খালাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে রাইয়্যান। তারপরেই আর দেরী করেনি, ফ্লাইট ধরে সোজা ঢাকায় চলে এসেছে। এবার সব রহস্যের জবাব নিয়ে তবেই ফিরবে ও। আর সবকিছুর চাবি রয়েছে ওই মুনিরার কাছে।

সেক্রেটারিকে দিয়ে মুনিরার ব্যাপারে সকল খবর নিয়েছে ও, কিভাবে চলাফেরা করে, কাদের সাথে মিশে সবকিছু, সাথে যোগাড় করেছে ওর ফোন নাম্বার। তাতেই ডায়াল করছে ও সকাল থেকে আর এইমাত্র কথা শেষ করল।

“মে আই কাম ইন স্যার?” সেক্রেটারির গলার আওয়াজ ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনল রাইয়্যানকে।

“ইয়েস, কাম ইন” মুনিরার জুতার বাড়ির কথা শুনে শকড হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাইয়্যান, এখন বসল আবার।

সেক্রেটারি কাছে এসে বলল, “স্যার, একটা ইনফরমেশন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার কাছে তেমন জরুরী মনে হয়নি, কিন্তু আপনার কাছে হতেও পারে”

“কি?”

“ওই মেয়ের একটা জমজ বোন আছে, প্রায় আড়াই মাস ধরে নিখোঁজ, নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা”

“হুম জানি আমি, এক সেকেন্ড! কি বললা তুমি!?” উত্তেজনায় আবার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল রাইয়্যান, “জমজ বোন!? তুমি শিওর?”

“জ্বী স্যার, ওর ফ্যামিলি সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন তাই। ওর বাবা……”

“আচ্ছা, ফাযিল কাকে বলে?”

“স্যরি স্যার!?” হতভম্ব দেখাল সেক্রেটারিকে।

“আরে, ওই যে মাদ্রাসার পড়ার লেভেল আছে না, ফাযিল টাযিল কি কি যেন। সেখানে ফাযিল কোনটা?”

“ও আচ্ছা, ওইটা অনার্স স্যার। দাখিল এসএসসি, আলিম এইচএসসি, ফাযিল অনার্স আর কামিল মাস্টার্স” গড়গড় করে বলে গেল সেক্রেটারি।

“শিট শিট শিট! অন্তত এটাও যদি জানা থাকতো আমার!” দুম করে টেবিলে একটা কিল বসাল রাইয়্যান। “মুনিরা অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে তাইনা?”

“জ্বী স্যার, ঢাকা ইউনিভারসিটিতে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট”

“শিট! আগে কেন আমি ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ নিইনি, তাহলে তো অনেক আগেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যেত”

“এনি প্রবলেম স্যার?”

“নো থ্যাংকস, তুমি এখন যেতে পারো”

“ওকে স্যার”

লেট মি বি ক্লিয়ারড ওয়ান বাই ওয়ান। বোরকা নেকাব পরলেও মুনিরা তুলনামূলক আধুনিক, ছেলে ফ্রেন্ড আছে, নিয়মিত ফেসবুক ব্যাবহার করে, এক্সট্রোভার্ট। তাহলে তো ফারহানের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে এই মেয়েই যায়, সিদ্রা কোনভাবেই না। আর বোনকে বোনের থেকে বেশি আর কেউই চিনবেনা। মুনিরা যখন বলেছে সিদ্রা ফেসবুক ব্যবহারই করেনা, সেখানে ছয়মাস ধরে ফেসবুকে প্রেম করে গেল আর ওর চোখেই পড়লনা, এটা ইম্পসিবল! আর জেনে থাকলে বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা এমন অবস্থায় সেটা লুকানোর প্রশ্নই উঠেনা। তার মানে চ্যাটে সিদ্রার নাম দিয়ে নিজের ব্যাপারে যা কিছু বলেছে, সেগুলো সব আসলে মুনিরার ক্যারেক্টার, আর বোনের নামে যেটুকু বলেছে, সেগুলো আসলে সিদ্রার সম্পর্কে ছিল, আর আমি গাধা সেটা ধরতেও পারিনি! তার প্রমাণ তো পেয়েছিও আমি। “আমার ফেভারিট বিরিয়ানি আর আমার বোনের ফ্রাইড রাইস” এমনটাই লেখা ছিল চ্যাটে। কিন্তু ফ্রাইড রাইস দেখে সিদ্রার চোখ আনন্দে নেচে ওঠা আর জ্বরের মুখেও অতটা খেয়ে নেয়াই প্রমাণ করে ফ্রাইড রাইস ওর কতটা পছন্দের!

টেবিলে সজোরে একটা ঘুষি মারল রাইয়্যান। এত কেয়ারলেস আমি কিভাবে হলাম! মেয়েটার ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে শুধু চ্যাটিং এর ইনফোর উপর ভিত্তি করে আমি ওকে কিডন্যাপ করে ফেললাম! হাউ কুড আই? অবশ্য তখন জানলেও বা কি হতো, তখন তো আর এসব মাথায় আসতোনা। কিন্তু পরে সিদ্রাকে দেখার এবং চেনার পর তো কনফিউশন ক্লিয়ার হয়ে যেতো, অন্তত এত দেরী তো হতোনা। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, দেরীতে হলেও প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে। আসল দোষী যে সিদ্রা নয় মুনিরা, এতে আর সন্দেহ নেই। এবার তোমাকে সিদ্রাকে মুক্তি দিতে হবে রাইয়্যান!

মুক্তি দিতে হবে!? বুকের বাঁ পাশটা যেন মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল ওর। মুক্তি দেয়া মানে তো সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলা! ওকে হারিয়ে ফেললে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকব?

ফারহানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়াই তো ছিল এখন আমার জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ। তাহলে কি এখন সিদ্রাকে ছেড়ে দিয়ে মুনিরাকে তুলে নিয়ে যাব? নাহ! যে মেয়ে তার নিজের মায়ের পেটের বোনকে এভাবে ফাঁসাতে পারে, তাকে দেখতেও আমার রুচি হচ্ছেনা।

আর তাছাড়া এতে সিদ্রা অনেক কষ্ট পাবে, ও সবকিছু জেনেও চুপ করে ছিল নিশ্চয় ওর বোনকে সেফ রাখার জন্য। আমি ওকে এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছি, এটুক নাহয় আর না দিলাম। রইল বাকি আমার প্রতিশোধ, এই আড়াই মাসেই ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। সিদ্রাকে যত কষ্ট দিয়েছি, সব এখন আমার কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। ফারহান, ভাইরে, ক্ষমা করে দে ভাই, আমি পারলামনা তোর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু, সিদ্রাকে ছেড়ে দিলে আমার কি থাকবে, আমার তো কেউ থাকবেনা।

আচ্ছা, আমি যে সত্যটা জেনে ফেলেছি, সেটা তো আর সিদ্রা জানেনা। ওকে যদি না বলি তাহলে? আমি যদি ওকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিই? তাহলেই তো ও আর আমাকে ছেড়ে কোনদিন যেতে পারবেনা।

“কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখি নিয়েই বা তুমি কি করবে রাইয়্যান? সারাজীবনের জন্য ওর মুখের হাসি কেড়ে নিতে চাও তুমি?” ওর ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল।

“কেড়ে নিব কেন? আমার কি টাকার অভাব আছে নাকি? পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওর পায়ের নিচে এনে দিব আমি, হাসি এমনিই ফুটবে” জবাব দিল রাইয়্যান।

“স্বাধীনতার থেকে বড় সুখ আর কিছু হয়না রাইয়্যান, সেটা বাদ দিয়ে যাই এনে দাও ওর মুখের হাসি তুমি ফেরাতে পারবেনা” সেই কন্ঠটা আবার বলে উঠল।

“কিন্তু ওকে ছাড়া আমি যে বেঁচে থাকতে পারব না” চেয়ার ছেড়ে নিচে অসহায়ের মত বসে পড়ল রাইয়্যান। ওর মনে হচ্ছে ও অথৈ সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে, একটামাত্র কাঠের টুকরা বেঁচে থাকার অবলম্বন, সেটাও ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।

***
বাগানের দোলনাটায় দোল খাচ্ছে সিদ্রা, কিন্তু মন ওর দোল খাওয়ায় নেই। সেদিনের কথা মন থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা ও। জ্বরের সময় প্রলাপ বকলেও পুরোপুরি বেহুঁশ তো আর ছিলনা। লোকটার চোখেমুখে ওর জন্য উদ্বেগ, জ্বর কমানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, সবই আবছা আবছা মনে পড়ছে, কিন্তু এসব তো বিশ্বাস করার মত নয়। এই লোক আমার জন্য এতকিছু করেছে, আমি স্বপ্ন দেখিনি তো? এমনটাই ভেবেছিল ও প্রথমে। কিন্তু স্বপ্ন যে দেখেনি তার সবথেকে বড় প্রমাণ হল ঘুম ভেঙে নিজের ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করা।

মনের মধ্যে চলছে চরম দোটানা। লোকটা ওকে অত জ্বরের সময় সেবা করে বাঁচিয়ে তুলেছে বলে কৃতজ্ঞ হবে নাকি অচেতন অবস্থায় লোকটা ওকে কতটা বেপর্দা অবস্থায় দেখেছে সেটা নিয়ে রাগ হবে যেন ঠিক করতে পারছেনা।

অবশ্য রাতের বেলা গিয়ে খালার ঘরে শোয়ার জন্য লোকটাকে এত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, ওকে দরজা ভেঙে বের করতে হয়েছে, সেজন্য লোকটার ভয়ংকর একটা রিএকশন এর জন্য অপেক্ষা করছিল সিদ্রা, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করেনি লোকটা। জাস্ট একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ও কেন রাতের বেলা উঠে খালার ঘরে গিয়ে দরজা আটকেছিল। কোন উত্তর দেয়নি ও। কিভাবে বলতো, আপনার ভয়ে গিয়েছি! লোকটা অবশ্য আর জোরাজুরি করেনি, হয়ত অসুস্থ বলে ছেড়ে দিয়েছে, পরে কখনো আবার ধরবে।

কিন্তু কি করতো ও? সেদিন রাতে এত প্ল্যান পরিকল্পনার পরেও প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল ওর, কিন্তু এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো যায়না দেখে ঘুমাতে ভরসা পাচ্ছিলোনা। তাই খালার ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। ভেবেছিল, ফজরের পর আবার চলে আসবে উপরে, লোকটা জানতেও পারবেনা। কিন্তু জ্বর এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে যে সবকিছু ভজঘট হয়ে যাবে, ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

শুধু কি এটুকুই? দুপুরে বুবুর বাসা থেকে আনা ভাত তরকারি খেতে পারছিলনা দেখে লোকটা স্যুপ বানিয়ে খাইয়েছে ওকে। আবার রাতের বেলা খালাকে দেখে আসার পথে বাইরে থেকে ফ্রাইড রাইস নিয়ে এসেছিল, যদিও মুখে স্বাদ ছিলনা, তবু প্রিয় খাবার বলে অনেকটা খেতে পেরেছে। কিন্তু লোকটা কিভাবে জানলো ফ্রাইড রাইস আমার প্রিয়? মুনিরা কি প্রিয় খাবারের কথাও নিজেরটা না বলে আমারটা বলে রেখেছে নাকি!

কিন্তু উনার মত মানুষ, যিনি কিনা আমাকে এত ঘৃণা করেন, তিনি আমার জন্য এতকিছু কেন করলেন? উনার ভেতরে একটা নরম মন আছে, যাতে আছে তার কাছের মানুষগুলোর জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা, বুঝতে পারে সিদ্রা। শুধু কি কাছের মানুষ, চা বাগানের প্রত্যেকটা শ্রমিককে উনি কি পরিমাণ ভালবাসেন নিজের চোখে দেখেছে ও। এইতো সেদিন, এক শ্রমিকের ছেলে পাহাড় থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলল, উনি এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন যেন উনার নিজের ছেলে। তারপর বুবুর কাছে শুনেছে, ছেলেটাকে নাকি উনি রক্তও দিয়েছেন। একই মানুষ, একদিকে একজনের জীবন বরবাদ করছে, অন্যদিকে আবার প্রাণপণে আরেকজনের জীবন বাঁচাচ্ছে। এমন দ্বৈতসত্ত্বা এর আগে কখনও দেখেনি সিদ্রা। অবশ্য এ ক্ষুদ্র জীবনে কয়টা মানুষকেই বা দেখেছি আমি! অসুস্থ অবস্থায় আমাকেও নিশ্চয় একটা মানুষ হিসেবেই দেখেছে, নিজের ভাইয়ের হত্যাকারী হিসেবে নয়, সেজন্যই করেছে অতকিছু, এর বেশি কিছু নয়।

খালা এসে জোরে একটা দোল দিতেই চিন্তার জাল ছিন্ন হল সিদ্রার। হাসিমুখে খালার দিকে তাকাল ও। খালা ইশারায় জিজ্ঞেস করল, বুবুর ওখানে যাবে কিনা। সম্মতি জানাল সিদ্রা, উঠে দাঁড়াল রেডি হওয়ার জন্য।

বুবুর বাংলোয় গিয়ে বিস্মিত হল সিদ্রা। কোন রোগী নেই, বুবু বাগানে বসে বসে বই পড়ছে।

“কি ব্যাপার বুবু? আজ তোমার ছুটি নাকি?” বুবুর পাশে বসতে বসতে বলল সিদ্রা।

“হ্যাঁ রে, আজ ওদের বাৎসরিক উৎসবের দিন, আজ কেউ ইমার্জেন্সি ছাড়া আসবেনা”

“তাহলে তো আজকে বুবুর গল্প শোনার পার্ফেক্ট সময়, কি বলো?”

“কিসের গল্প?”

“ভুলে গেলে তো? তুমি না বলেছিলা সময় করে বলবা”

“ও আচ্ছা, ওই কথা, অত বিশেষ কিছুনা। শুধু শুধু তোর মনটা খারাপ হয়ে যাবে”

“হলে হবে, তুমি বলো”

“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যে ভাইটুর আপন বোন না, এটা তো জানিস?” বই বন্ধ করে বলল বুবু।

“কি? আপন বোন না মানে?” টাশকি খেল সিদ্রা।

“এটাও বলেনি, অবশ্য বলবে কেন, ওরা তো আমাকে আপন ছাড়া পর ভাবেইনি কোনদিন” খুশির অশ্রু চিকচিক করে উঠলো বুবুর চোখের কোণে, “মানে তুই গল্প থেকেই বুঝে যাবি, শোন তাহলে” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গল্প শুরু করল বুবু।

চলবে।