যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৩১+৩২

0
360

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩১.
রাইয়্যান কাছে আসতেই পিছু হটলো সিদ্রা, কিন্তু ভুলে গেল যে বাথরুমের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। তার ফলে যা হবার তাই হলো, চৌকাঠে পা লেগে উলটে গেল পেছন দিকে, আ…… করে চিৎকার করে উঠলো সিদ্রা। ঠিক সময়ে ওর একটা হাত ধরে ফেলল রাইয়্যান, বাঁচিয়ে দিল আছাড় খাওয়ার হাত থেকে। পরমুহূর্তেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে সোজা করলো ওকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় মোটামুটি হা হয়ে গেছিলো সিদ্রা। সেই হা করা মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো রাইয়্যান। সিদ্রার ভীত চোখমুখ দেখে মজা করে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল ও, কিন্তু সেটা যে এতখানি কাজে দিবে ভাবতেও পারেনি।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থার্মোমিটার মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিদ্রা। ভীষণ লজ্জা পেল ও, উনি আমার জ্বর মাপতে আসছিলেন আর আমি এমন উদ্ভট চিন্তা করছিলাম! ছি!! ছি!!!

এক মিনিট পর রাইয়্যান নিজেই ওর মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিলে সম্বিৎ ফিরল ওর।

“যাক, নরমাল” স্বস্তির সুর রাইয়্যানের কন্ঠে। বিড়বিড় করে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলল সিদ্রা।

“আচ্ছা, তুই বাসায় একা থাকতে পারবি, আমি তাহলে খালাকে দেখে আসতাম”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন সিদ্রা, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পারবোনা?”

“ঠিক আছে, আমি বেরোচ্ছি তাহলে”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা, রাইয়্যান দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবার।

“বুবুর বাসা থেকে খাবার আনিয়েছি, নিচে টেবিলে ঢাকা দেয়া আছে, খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি”

“আপনি খেয়েছেন?” বলেই জিভে কামড় দিল সিদ্রা। উনি খেলেন কি খেলেন না, তাতে আমার কি? নিজের ওপর বিরক্ত হল ও।

“হুঁ” মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রাইয়্যান।

***
বুবুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে খালার কাছে রয়েছে রাইয়্যান। খালার জ্বর অবশেষে ছেড়েছে, এখন ঘুমাচ্ছে। টেস্ট রিপোর্ট এসে গেছে, নিউমোনিয়া হয়েছে খালার। কয়েকদিন এখানে ভর্তি থাকতে হবে খালাকে। সেটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে রাইয়্যান। সিদ্রা মুখে কিছু না বললেও একা বাসায় ওর সাথে থাকতে সিদ্রা অস্বস্তি বোধ করবে এটা ভালই বুঝতে পারছে ও। বুবুর বাসার কাজের মেয়েটাকে বাসায় এনে রাখা যায়, কিন্তু ওর আর সিদ্রার আলাদা থাকার বিষয়টা চোখে পড়ে যাবে ওর। কাজের উসিলা দিয়ে ঢাকায় চলে যাব? নাহ! খালা আর সিদ্রা দুজনেই অসুস্থ, এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া খারাপ তো দেখাবেই, আমারও মন মানবেনা। কি করি আমি এখন?

খালার ঘুম ভাঙল এসময়। আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে নার্স কে ডাক দিল রাইয়্যান। নার্স এসে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে যাবার পর খালা ওকে সিদ্রার কথা জিজ্ঞেস করল। সত্যি কথাই বলল ও। শুনে চিন্তিত হয়ে গেল খালা, ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলল।

“কেন খালা?” অবাক হল রাইয়্যান।

খালা জানাল, সিদ্রার দিনের বেলায় জ্বর ছেড়ে যায় আর রাতের বেলা আসে, আগেরবার খেয়াল করেছেন উনি। এবার রাইয়্যানও টেনশনে পড়ে গেল। এসময় ঝড়ের বেগে কেবিনে ঢুকল বুবু, পেছনে ঢুকল বুবুর বাসার কাজের মেয়েটা।

“এই তুই সিদ্রাকে বাসায় আটকে রেখে এসেছিস কেন?” ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল রাইয়্যানের, বুবু কিভাবে বুঝল!

“কি বলছো বুবু? আটকে রেখেছি মানে?” এমনভাবে তাকাল যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

“আমি ওকে দেখতে গেলাম, মেয়েটা দরজা খুলতে পারলনা, বলল তুই নাকি চাবি নিয়ে গেছিস!”

“ও এই ব্যাপার! আসলে ও তো রেস্ট নিচ্ছিল, দরজা লাগাতে গেলে শুধুশুধু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হবে তাই আমি বাইরে থেকে লাগিয়ে এসেছি” সাবধানে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল রাইয়্যান।

“আচ্ছা, তা তুই ওকে ফোন কিনে দিসনি?” বুবুর কন্ঠে জেরার সুর।

“দিতে চেয়েছিলাম তো, ও নিজেই নিতে চায়নি। মোবাইল হাতে পেলেই নাকি ওর মন মানবেনা, বাসায় ফোন দিতে ইচ্ছে করবে, আর ওর আব্বু আম্মু ওকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবে। কি অদ্ভুত মেয়ে, বুঝো”

“হুম, কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, ও তোর সাথেও কেমন গুটিয়ে থাকে, ভালোবেসে বিয়ে করলে এমন তো হওয়ার কথা না। সত্যি করে বল, তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস নাতো?”

“ছি ছি বুবু, তুমি আমাকে আবার সন্দেহ করছো! আরে, একবার ভেবে দেখো, ওর মত মেয়ের কি এমন কাজ করা সাজে? ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছে। এখন বেচারি অনেক গিল্টি ফিল করছে, কিছুতেই সহজ হতে পারছেনা। আর এর খানিকটা দোষ তো আমারও, সেজন্য আমাকেও শাস্তি দিচ্ছে”

“আহারে, এত ভাল মেয়েটা। ওর ফ্যামিলি যে কেন মানলনা তোকে। যাকগে, তুই কষ্ট পাসনা। ওর দিকটা একটু বুঝার চেষ্টা কর। তোকে ভালবাসে বলেইতো এতকিছু ত্যাগ করেছে। ওকে যেন কোনদিন পস্তাতে না হয়। তুই অন্তত ওকে কোনদিন কষ্ট দিসনা” অবশেষে বুবুর কন্ঠ থেকে সন্দেহের সুর দূর হতে দেখে হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান।

“না না, কোনদিন দিবনা, দেখো তুমি” বুবুকে পটানোর মত একটা হাসি উপহার দিল ও।

“দিবিনা তো, এখন কি করছিস? ওকে একা বাসায় রেখে এখানে বসে আছিস কেন?” ধমকে উঠল বুবু, হাসি বন্ধ হয়ে গেল রাইয়্যানের।

“ওর জ্বর তো ভাল হয়ে গেছে, ও-ই তো জোর করে পাঠাল আমাকে”

“গাধা! ও পাঠাল আর তুই ড্যাঙড্যাঙ করে চলে এলি। আমি মুক্তাকে নিয়ে এসেছি সাথে করে, ও খালার কাছে থাকবে। তুই চল আমার সাথে। অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে এতক্ষণ এখানে বসে আছে! ইরেস্পন্সিবল ইডিয়েট একটা!” মাথায় জোরে একটা ঠোকনা মারল বুবু।

ড্রাইভ বুবুই করছিল, রাইয়্যানের বাংলো আগে পড়ে, ওকে নামিয়ে দিয়ে বুবু চলে গেল নিজের বাংলোর দিকে। অসুস্থ সিদ্রাকে দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বুবুর। কিন্তু রাইয়্যানের সাথে কথা বলার পর বুবুর মনে হয়েছে, ওদের একটু স্পেস দেওয়া দরকার। বাসায় কেউ নেই, ওরা বরং নিজেদের মত একটু সময় কাটাক। আমার ভাইটা একটা আস্ত গাধা! প্রেম করেছে, কিন্তু রোমান্স বুঝেনা। নতুন বউকে নিয়ে হানিমুন তো দূরের কথা, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার নাম পর্যন্ত নিচ্ছেনা। এবার মেয়েটা সুস্থ হলে আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি পার্ক করতে করতে এসবই ভাবছিল বুবু।

***
হাত উঁচিয়ে বুবুকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান, পুরো বাড়ি অন্ধকার। মাত্র তো রাত নটা বাজে, সত্যি সত্যি আবার জ্বর আসলনা তো? সিদ্রার ঘরে ঢুকে দেখল, শুয়ে পড়েছে ও। আলো জ্বালাতেই চোখ মেলল সিদ্রা, উঠে বসল বিছানায়। বিছানার কাছে এসে কপালে হাত দেয়ার আগেই কথা বলে উঠল সিদ্রা।

“জ্বর আসেনি আর”

“কখন মেপেছিস?” জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।

“আমার কথা বাদ দেন, খালা কেমন আছে সেটা আগে বলেন”

রাইয়্যান ওর কথার উত্তর না দিয়ে ঔষধের পাতাটা হাতে নিল, একটা কম। যাক, ঔষধ খেয়ে নিয়েছে তাহলে, স্বস্তি পেল ও।

“উত্তর দিচ্ছেন না কেন?” অস্থির কন্ঠে বলল সিদ্রা।

“বলছি বলছি” বিছানার পাশের সোফাটাতে বসল রাইয়্যান, “খালার নিউমোনিয়া হয়েছে”

“আল্লাহ্‌! আমি কি করলাম এটা!” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সিদ্রা।

“আরে, আবার কাঁদে। এটা এত ভয়ংকর কিছু না, বয়স্ক মানুষদের ঠাণ্ডা লেগে হয়েই থাকে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে”

“সত্যি বলছেন?” মুখ তুলল সিদ্রা।

“শুধু শুধু মিথ্যা কেন বলব? রাতের খাবার খেয়েছিস?”

“হুঁ”

“বেশ, তাহলে আর কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়। অন্তত একজন সুস্থ হয়ে আমাকে ধন্য কর” সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাইয়্যান।

সিদ্রা কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমানোর জন্য নয়। লোকটা যাওয়ার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে ও, শুধু দুইবার নামাজের জন্য উঠেছে। ও আন্দাজ করতে পারছিল, খালা হাসপাতালে থাকলে এই গোটা বাড়িতে ওই লোকটার সাথে একা রাত পার করতে হবে ওকে। তাই রাতে কিছুতেই ঘুমানো যাবেনা, জেগে থাকতে হবে। সেজন্য মাগরিবের পর কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে খেয়েছে আর বাগান থেকে একটা লাঠিও কুড়িয়ে এনে রেখেছে কম্বলের নিচে। এখন এই ভয়ংকর রাত ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়!

লোকটা লাইট অফ করে দরজা টেনে চলে যাওয়ার পর কতক্ষণ পার হয়েছে জানেনা সিদ্রা, হঠাৎ দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে। লোকটা লাইট না জ্বালিয়েই এগিয়ে আসছে কেন? কম্বলের নিচে লাঠিটা শক্ত করে ধরল সিদ্রা, কোন তেড়িবেড়ি দেখলে সোজা বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত। লোকটা বিছানার কাছে আসতেই ঘুমের ভান করে চোখ বুজল সিদ্রা।

কপালে হাত দিল লোকটা, ভয়ে সিদ্রার গোটা শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই হাতটা সরে গেল। হালকা করে চোখ ফাঁক করে সিদ্রা দেখল লোকটা চলে যাচ্ছে। ও, শুধু জ্বর দেখতে এসেছিলো! আলহামদুলিল্লাহ্‌! এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সাবধানে ছেড়ে দিল সিদ্রা।

***
প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় গিয়ে রাইয়্যান দেখে আসছে সিদ্রাকে, আর তার ফাঁকে ল্যাপটপে কাজ করছে। সারাদিনে ধকল তো আর কম যায়নি, বারোটার দিকে হাই তোলা শুরু করল ও। আর কিছুক্ষণের মধ্যে কাউচে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুম ভাঙল একেবারে চারটার সময়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রাইয়্যান। ততক্ষণে মনে পড়ে গেছে সিদ্রার জ্বরের কথা, তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটল ও সিদ্রার ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে কম্বল সরিয়ে আরেকদফা চমকে গেল রাইয়্যান, বিছানা ফাঁকা। বাথরুমে গিয়েছে মনে হয়, নাহ! বাথরুমের দরজা খোলা। বারান্দা, সেখানেও নেই।
ড্রয়িংরুম, বাগান, রান্নাঘর, লাইব্রেরি সব জায়গা খুঁজে ফেলল রাইয়্যান, সিদ্রা কোথাও নেই। মাথার চুল খামচে ধরল দুহাত দিয়ে, মেয়েটা গেল কোথায়!?

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩২.
সদর দরজার দিকে ছুটে গেল রাইয়্যান। যেভাবে লাগিয়ে রেখেছি, সেভাবেই তো আছে! আর ও বাইরে কিভাবে যাবে, ওর কাছে তো চাবিই নেই। খালার কাছে যে চাবিটা থাকে, সেটা পেয়ে যায়নি তো কোনভাবে? কথাটা মনে হতেই খালার ঘরের দিকে ছুটল রাইয়্যান। দরজাটা ঠেলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভেতর থেকে দরজা আটকানো, তার মানে সিদ্রা এখানেই আছে। প্রথমে আস্তে আস্তে আর তারপর জোরে জোরে নক করেও ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল রাইয়্যান।

ভয়াবহ আতংক পেয়ে বসল ওকে। কয়েক মাস আগের সেই দিনটার যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, আতংকে শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইল ওর। চোখের সামনে যেন ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেল সবকিছু, দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখতে পাচ্ছে বিছানায় পড়ে আছে সিদ্রার নিথর ঠান্ডা মৃতদেহ!

না…………হৃদয়বিদারক একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল রাইয়্যানের বুক চিরে। পা দুটো যেন থেকেও নাই হয়ে গেল, বসে পড়ল ও দরজার সামনে। চোখের সামনে থেকে সিদ্রার মৃতদেহের দৃশ্যটা কিছুতেই সরছেনা। হাত দিয়ে দুচোখ চেপে ধরে পাগলের মতো না না করতে লাগল রাইয়্যান। খানিকটা সময় লাগল ওর ধাতস্থ হতে। দরজার ওপারে যাই থাকুক, সত্যের মুখোমুখি তো এক সময় না এক সময় হতেই হবে। বরং তাড়াতাড়ি করলে হয়তো বাঁচানোর একটা সুযোগ পাওয়া যাবে, এই চিন্তাই শক্তি যোগাল ওকে। কাঁধ দিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল ও দরজার গায়ে। এক পর্যায়ে ছিটকিনির স্ক্রু আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ক্ষান্ত দিল, খুলে পড়ে গেল নিচে আর সাথে খুলে গেল দরজাটাও।

দিশেহারা রাইয়্যান বিদ্যুৎবেগে ঘরে প্রবেশ করল। আলো জ্বেলে সামনে তাকাতেই জমে গেল ও। বিছানা ফাঁকা, বাথরুমের সামনে পড়ে আছে সিদ্রা, চোখ দুটো বোজা। তবে কি আমার আশংকাই ঠিক হল? ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা, হৃৎপিন্ডটা যেন লাফ দিয়ে চলে এল গলার কাছে। কোনমতে সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করে টলতে টলতে সিদ্রার কাছে পৌঁছল ও। থরথর কম্পমান হাতটা সিদ্রার হাতে ছোঁয়াতেই যেন আগুনের উত্তাপ টের পেল রাইয়্যান।

আর সেই মুহূর্তে, ঠিক সেই মুহূর্তে রাইয়্যানের ভেতরে কি যেন ঘটে গেল। নিদারুণ এক প্রলয়ে ওলটপালট হয়ে গেল ওর সমস্ত সত্তা। সিদ্রার জ্বরের প্রকোপে জ্ঞান হারানো তপ্ত দেহটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল রাইয়্যান। দেহমনে ছড়িয়ে পড়া অচেনা অনুভূতি জানান দিল ওকে, ওর জীবনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক দুর্বলতা, যার নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা। অনুভব করল, কিছুদিন আগে পর্যন্ত যাকে সবথেকে বেশি ঘৃণা করত, আজ পৃথিবীর সকল কিছুর বিনিময়েও তাকে হারাতে চায়না ও।

সিদ্রার শরীরের তাপ যখন সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠল, তখন সম্বিত ফিরল রাইয়্যানের। তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল সিদ্রাকে। মগে করে পানি এনে অবিরাম ছিটাতে থাকল মুখে, যতক্ষণ না সিদ্রার চোখের পাঁপড়ি নড়ে উঠল।

চোখ মেলল সিদ্রা, আধাখোলা চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি। মুখ দিয়ে কেমন একটা আওয়াজ করল, ঠিক বুঝতে পারল না রাইয়্যান। নিজের ওপর চরম রাগ উঠল ওর, খালা সাবধান করে দেবার পরেও এভাবে মরার মত ঘুমানোর জন্য। মাথা যেন কাজ করছেনা ওর, কি করবে না করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। তখনি ওর চোখ পড়লো সিদ্রা খালাকে যেসব দিয়ে জলপট্টি দিয়েছিল, সেসবের ওপর। সাথে সাথে উঠে গিয়ে পানিটা বদলে আনল ও।

বুঝতে পারল, এত জ্বর যখন, শুধু কপালে জলপট্টি দিয়ে কাজ হবেনা। প্রথমে ভাল করে মুখ, গলা আর ঘাড় মুছিয়ে দিল। তারপর হাত উঠাতেই দেখল সিদ্রার জামার হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, নিশ্চয় তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য অজু করতে গিয়েছিল। আশ্চর্য মেয়ে, এই শরীরেও তাহাজ্জুদ পড়তে হবে ওকে! অজু করে বাথরুম থেকে বের হতে গিয়েই জ্ঞান হারিয়েছে, বুঝল রাইয়্যান। হাত, পা মুছে দেয়ার পর কপালে জলপট্টি রেখে সিদ্রার ঘরে গিয়ে থার্মোমিটার আর ঔষধ নিয়ে এল।

মেপে দেখল জ্বর ১০২ এরও উপরে! ইশ!কখন থেকে জানি জ্বরে পুড়ছে মেয়েটা। জলপট্টিটা পালটে দিয়ে রান্নাঘরে দৌড়াল রাইয়্যান। স্যুপ রান্না করে নিয়ে এল সিদ্রার জন্য। এদিকে সিদ্রার কোন হুঁশ নেই, বিড়বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছে। এর ভেতরেই কয়েক চামচ স্যুপ খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল রাইয়্যান ওকে। তারপর বেডসাইড টেবিলটা কাছে টেনে বসে সিদ্রার কপালে জলপট্টি দেয়া শুরু করল। প্রায় আধঘণ্টা পর আবার মেপে দেখল জ্বর একটুও কমেনি। চিন্তায় পড়ে গেল ও, বুবুকে ফোন দিবে কিনা ভাবল একবার। তখনই খাটের পাশে রাখা বালতিটা চোখে পড়ল, সাথে সাথে মাথায় পানি ঢালার কথা মনে হল রাইয়্যানের।

যেই ভাবা সেই কাজ, প্রথমে সিদ্রাকে ধরে বিছানার কিনারে আনল। এরপর বালতিতে করে পানি এনে মগ দিয়ে মাথায় ঢালা শুরু করল। ততক্ষণে সিদ্রা প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে, কিছু যাচ্ছেনা। কয়েকবার আম্মু আর মুনিরাকে ডাকতে শুনল রাইয়্যান। চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা পানিও গড়িয়ে পড়ল। আলতো হাতে পানিটুকু মুছে তপ্ত কপালটাতে ভেজা হাত রাখল রাইয়্যান। প্রায় সাথে সাথে কাতরে উঠল সিদ্রা, “আম্মু, শীত করছে”, আর তারপরেই হু হু করে কাঁপতে লাগল সিদ্রা। সাথে সাথে রাইয়্যান উঠে কম্বলটা ভাল করে ওর গায়ে জড়িয়ে দিল।

কম্বলের নিচ থেকে বেরোনো লাঠিটার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল রাইয়্যান। খালা কি বিছানায় লাঠি নিয়ে ঘুমায় নাকি! আর এই মেয়ে কেন মাঝরাতে নিজের ঘর ছেড়ে খালার ঘরে আসতে গেল, সেটাও তো বুঝতে পারছিনা। যাকগে, আগে তো জ্বরটা কমুক, তখন না হয় জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যাবে। আপাতত পানি ঢালা বন্ধ করে মাথাটা ভাল করে মুছিয়ে দিয়ে সোজা করে দিল ওকে রাইয়্যান।

তাপ একটু কমেছে, আবার কপালে জলপট্টি দেয়া শুরু করল রাইয়্যান আর সেইসাথে নিজের বোকামোর কথা ভেবে হাসি পেলো ওর। আমি কি ভেবে চিন্তা করলাম যে, ও সুইসাইড করবে! অসুস্থ মানুষ, জ্ঞান হারাতেই পারে, এই সহজ সম্ভাবনাটা মাথায় এলোনা আমার? সত্যি, মানুষ ভয় আর আতংকে যে কতদূর পর্যন্ত ভেবে ফেলতে পারে, আজকে উপলব্ধি করলাম।

তখনও প্রলাপ বকছে সিদ্রা, সবসময় যেসব চিন্তা ঘোরে ওর মাথায় সেগুলোই এখন প্রলাপ হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাগুলো একটু একটু করে বুঝতে শুরু করল রাইয়্যান, আর একদম টনক নড়িয়ে দিল ওর।

***
নিজের ঘরে পায়চারী করছে রাইয়্যান, গভীর চিন্তায় মগ্ন ও।

“মুনিরা, তুই কি করলি এটা?”
“মুনিরা রে, তুই বোন হয়ে এমন করতে পারলি!”
“মুনিরা, তুই এমন কেন করলি?”
“আল্লাহ্‌, মুনিরা বুঝতে পারেনি আল্লাহ্‌, ওকে ক্ষমা করে দাও তুমি আল্লাহ্‌”

অনেক কিছুর মধ্যে এই কয়েকটা কথা বারবার নানা রকম ভাবে বলছিল সিদ্রা। ওর বোন হয়তো খারাপ কিছ করেছে যেটার কথা মনে পড়ছে ওর, অথবা এগুলো শুধুই জ্বরের প্রলাপ, এমনটাই ভাবছিল রাইয়্যান। কিন্তু বারবার একই কথা শুনতে শুনতে ওর মনে পড়ে সিদ্রার আগেরবারের জ্বরের কথা। তখনও তো ও অনেক প্রলাপ বকেছে, কিন্তু এসব তো বলতে শুনিনি।

মনকে মানাতে না পেরে হাসাপাতালে ছুটে যায় ও। খালাকে জিজ্ঞেস করে, ওই সময় এমন কিছু বলতে খালা শুনেছে কিনা। খালাও যখন বলে যে এমন কিছু শুনেনি, সন্দেহ ঘনীভূত হয় ওর।
হঠাৎ করে মুনিরাকে নিয়ে প্রলাপ বকার কারণ কি? সেটা কি আমি ওকে মুনিরাকে নিয়ে ভয় দেখাচ্ছি বলে? সেই মানসিক চাপ থেকেই কি? নাহ! তাহলে ও এসব কেন বলবে? নিশ্চয় কোন রহস্য আছে এর পেছনে। সেটা কি হতে পারে? নতুন কিছু কি ঘটেছে এর মধ্যে, যেটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে?

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বিদ্যুতচমকের মত বন্ধুর বিয়ের দিন ফেলে যাওয়া চাবি নিতে এসে সিদ্রার মন্থর গতি আর বুকফাটা কান্নার কথা মনে পড়ে গেল রাইয়্যানের। তবে কি সেদিন ঘরে ঢুকেছিল সিদ্রা? ওই ফাইলটা তো টেবিলের উপরেই রাখা ছিল, সেটা কি দেখেছিল ও? নিজের কুকীর্তির প্রমাণ দেখতে পেয়েই কি ওভাবে কাঁদছিল? নাকি………? চমকে উঠল রাইয়্যান, পরিষ্কার হয়ে গেছে সব ধোঁয়াশা, বুঝে গেছে আসল রহস্যটা কি!

সমস্ত ভাবনা এবার চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল রাইয়্যানের মাথায়। আমি যতবার ওকে একিউজ করেছি সবসময় কঠোর প্রতিবাদ করেছে, বলেছে ও কিছু করেনি, ও কিছু জানেনা। আর ওই চ্যাট হিস্ট্রি পড়ে আমার যে ধারণা হয়েছিল ওর সম্পর্কে, তার সাথে এতগুলো দিন ধরে কোন মিলই খুঁজে পাইনি আমি। এমনটা তো হতেই পারে, অন্য কেউ করেছে কাজটা অথচ ওর নাম দিয়েছে? হ্যাঁ, এই সম্ভাবনার কথা বহু আগেই মাথায় এসেছে আমার, কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি ছবিগুলোর জন্য।

সিদ্রার ছবিগুলো না পেলে ওর ব্যবহারে হয়তো বহু আগেই কনভিন্স হয়ে যেতাম যে ও নির্দোষ। কিন্তু এখন যদি সেই অন্য কেউ এর যায়গার মুনিরাকে বসানো যায়, তাহলেই তো দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায়। ইয়েস! দু আঙুলে তুড়ি বাজাল রাইয়্যান। মুনিরার পক্ষেই তো সম্ভব, নিজের দোষ অনায়াসে বোনের ঘাড়ে চাপানো। ওই বদমাশ মেয়ে সিদ্রার নামের সাথে ওর ছবিগুলোও ব্যবহার করেছে। হ্যাঁ, শুধু তাহলেই মিলছে সকল ধাঁধাঁ, পাওয়া যাচ্ছে সকল রহস্যের সমাধান!

সিদ্রা নির্দোষ! রাইয়্যানের মনে হল এক অনাবিল আনন্দের স্রোত এসে ভরিয়ে দিল ওর মনটা। দিনে দিনে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে সিদ্রাকে দোষী ভাবতে আর কষ্ট দিতে ওর নিজেরই প্রচণ্ড খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। শুধু মৃত ভাইয়ের কাছে করা প্রতিজ্ঞার জন্য মনের আরেকটা দিককে জোর করে এতদিন ইগ্নোর করেছে ও, যেটা আজ এই কিছুক্ষণ আগে ধরা পড়ে গেছে ওর নিজের কাছে। এবার সব বাঁধ যেন ভেঙে গেল, ছুটে গেল ও সিদ্রার কাছে।

ঘুমন্ত সিদ্রার নিস্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে ধপ করে কার্পেটের উপর বসে পড়ল রাইয়্যান। আমি এতবড় ভুল করলাম! তোমার মত একটা মেয়েকে এতদিন ধরে বিনাদোষে এত কষ্ট দিলাম। ছিঃ এই নাকি আমি সফল ব্যবসায়ী! ব্যবসার নির্ভুল ডিসিশন নিতে নিতে এতবড় একটা ভুল ডিসিশন নিয়ে ফেললাম! একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে ফেললাম আমি! কিন্তু এসবই তো সিদ্রার প্রলাপের উপর ভিত্তি করে করা প্রেডিকশন। যদিও সমগ্র সত্তা চিৎকার করে বলছে, আজকের এই প্রেডিকশন একশত ভাগ নির্ভুল। তবু, তবুও এবার আর কোন ভুল করব না আমি। আর ধারণা নয়, এবার নিশ্চিত হতে হবে আমাকে। কিন্তু সেটা কিভাবে করব সেটা নিয়েই ভাবতে হবে এখন, দৃঢ় মুখে উঠে দাঁড়াল রাইয়্যান।

চলবে।