যোগদান পত্র পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
135

#যোগদান_পত্র
— লামইয়া চৌধুরী।
শেষ পর্বঃ

সেই চিঠিটি পড়ে আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল। চেনা নেই, জানা নেই হুট করে এতসব ভেবে ফেললেন। তাঁকে পাগল ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি, অরুণিমা। তাছাড়া, কাজটা তিনি মোটেও ঠিক করেননি। চিঠি, চাকুরি এবং ঐ আধপাগলের অধ্যায় গুটিয়ে নিজের জীবন সংগ্রামের তাগিদে নেমে পড়লাম নতুন পথে। যে পথে হাঁটা যায় স্বাধীনভাবে। যে পথে চলতে পায়ে মাখতে হয়না পরাধীনতার শেকল। ঠিক করলাম বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে টাকা এনে স্বল্প পুঁজিতে কোনো ব্যবসা শুরু করব। কি ভাবছ, অরুণিমা? সহজ পথ বাছাই করে নিয়েছি? তাহলে ভুল ভাবছ। বরং সবচেয়ে কঠিন পথটিই আমি বাছাই করেছিলাম। আত্মীয়স্বজনের কানাঘোষা সহ্য করতে পারলেও কর্পোরেট দুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়ানো ব্যাচমেটগুলোর পৈশাচিক মুচকি হাসিগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলত। সহজ ছিল না, অরুণিমা। একটুও সহজ ছিল না। একটা ঘটনা বলি তোমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ব্যাচমেট একদিন আমার দোকানে এলো। সাথে তার অফিসের ক্রয় কমিটির অন্য সদস্যরাও আছেন। আমাকে দেখেও সে কোনো কুশলবিনিময় করল না। না কোনো বন্ধুত্বের ডাক। আমি কিছু মনে করলাম না। আমিও তার সাথে একজন বিক্রেতার মতই ব্যবহার করলাম। কি দরকার তাকে তার সহকর্মীদের সামনে লজ্জিত করবার? তাঁরা অফিসের গাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্টস কিনলেন। কিন্তু চলে যাবার সময় সে আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। খানিকটা বিরক্তি আর অনেকটা তাচ্ছিল্যের হাসি। যেন বলে গেল, “শেষ পর্যন্ত তোমার যদি এটাই করার ছিল তবে সিজির পেছনে এত ছুটলে কেন, কিবরিয়া?”
তোমাকে শুধু ঘটনাটিই বলতে পেরেছি, অরুণিমা। আমার অনুভূতিটা বলতে পারিনি। আমার জায়গায় থাকলে হয়তো বুঝতে সেদিন আমার কেমন লেগেছিল। তবু সর্বোচ্চ খেটে গেলাম। চাকুরি ভাগ্য আমার মন্দ হলেও ব্যবসা আর আমি ছিলাম সোনায় সোহাগা। বছর তিন, সাড়ে তিনের মাঝে তরতর করে হয়ে উঠলাম সফল ব্যবসায়ী। ভাড়া দোকান ছেড়ে নিজে দোকান কিনলাম। তাও আবার দুটো। একটা ঢাকায়, আরেকটা গাজীপুরে। গাজীপুরে বড় বড় গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি থাকায় ঢাকার চেয়ে গাজীপুরের দোকান বেশি রমরমা। আমিও গাজীপুরের দোকানে বেশি বেশি সময় দিতাম। ঢাকার দোকান কর্মচারীরা সামলাতো। শুধু শনিবার সকালে আমি ঢাকার দোকানে বসতাম। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আবার গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। এক তপ্ত দুপুরে আমি মাত্র দোকান ছেড়ে বেরিয়েছি। হঠাৎ, পরিচিত একটা মুখকে সাদা গাড়ি থেকে নেমে আমার দোকানের দিকে যেতে দেখে থমকালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই স্পষ্ট করে চিনলাম তাঁকে। তিনি সাদা চুলের নাকে চশমাওয়ালা স্যার, ঐ ম্যাডামের বাবা। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি কাজ সেড়ে গাড়িতে করে চলে যেতেই আমি দোকানে ফিরে গেলাম। জানতে চাইলাম কেন এসেছিলেন?
এক কর্মচারী বলল, “গাড়ির কুলিং সিস্টেম নিলেন।”
“ঠিক আছে।” বলে আমি বেরিয়ে এলাম। ম্যাডামের বাবাকে দেখে আমার সেই চিঠির কথাগুলো মনে পড়ল। মনে পড়ল সেই মাথায় গন্ডগোল থাকা অহঙ্কারী ম্যাডামকেও। সাথে এটিও মনে হলো চিঠি পড়ে আমি কি ভেবেছিলাম সেটি ম্যাডামকে জানানো উচিত ছিল। তিনি অপেক্ষা করে বসে থাকলে সেই দায়ভার তো আমারই। আর বসে না থাকলে বাঁচা গেল। ঠিক করলাম আমি তাঁকে গিয়ে জানিয়ে দিব আমি এমন কিছুই ভাবছি না এবং আমি তাঁর প্রতি আগ্রহী নই। যেই ভাবা, সেই কাজ। সুযোগ করে একদিন গেলাম ম্যাডামের অফিসে। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আমাকে দেখেও তিনি বললেন, “বলেছিলাম অফিস আওয়ারে দেখা করতে আসবেন না। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটে।”
আমি বললাম, “এখনও চাকুরি পাইনি।”
“চেষ্টা করে যান।”
“ব্যবসা করি।”
“তাহলে অভিনন্দন।”
আমি নিজ থেকে আরো বললাম, “গাড়ির পার্টস এর ব্যবসা।”
“হুম গুড ক্যাচ, শুভ কামনা রইল।”
আমি পকেট থেকে আমার দোকানের কার্ড বের করে ম্যাডামের টেবিলে রাখলাম। বললাম, “গাড়ির কিছু কিনতে হলে আমাকে স্মরণ করবেন।”
“আমার পরিচিতদেরকে আপনার দোকানের কথা অবশ্যই বলব।”
“আসছি, ম্যাডাম।”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই তিনি বললেন, “আর কিছু?”
আমি বললাম, “জি, না।”
.
একসময় টাকার হাহাকারে বাড়ি যেতে চাইতাম না। কিন্তু সবকিছু বদলে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ানো আমিই তখন মাস শেষ হবার অপেক্ষা করতাম। সবসময় শুধু কবে মাস শেষ হবে, আর কবে বাড়ি যাব সেই ধান্দায় থাকতাম। নিয়মানুযায়ী, সে মাসের শেষের দিকেও বাড়ি গেলাম। বাড়িতে তখন আনন্দ থৈ থৈ। পাকা ঘর, বাবার উজ্জ্বল মুখ, মায়ের গায়ে নতুন নতুন রঙবেরঙের শাড়ি। বোনেদেরও বিয়ে দিয়েছি। ছোট বোনটার ছেলে হয়েছে। ভাগ্নেকে কোলে নেওয়া হয়নি। সেবার প্রথম কোলে নিয়ে বোনকে বললাম, “তোর মেয়ে হলো না কেন? ছোট বোনগুলোকে কখনো সাজিয়ে রাখতে পারিনি। ভেবেছিলাম ভাগ্নীকে সাজাব। এই দেখ ছোট ছোট হাতের জন্য স্বর্ণের রুলি বালা নিয়ে এসেছিলাম।”
আম্মা ফাঁকে দিয়ে বললেন, “এখন একটা বউ নিয়ে আয়। নাকি আমি সাথে করে বউ দিয়ে দিব?”
প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করা যে আমার স্বভাব তা হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছ, অরুণিমা। তাই আম্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি আরেকজনকে পাল্টা প্রশ্ন লিখলাম,
ডালিয়া শফিক ম্যাডাম,
আম্মা আমার বিয়ের কথা বলছিলেন। ইদানিং প্রায়ই বলেন। চিঠিতে বলেন, টেলিফোনে বলেন, বাড়ি গেলেও বলেন। কথা সেটা না, কথা হলো আমি আশ্চর্যান্বিত কারণ আম্মা যতবার’ই আমাকে বিয়ের কথা বলেন ততবারই আমার মাথায় প্রথম যে বিষয়টি আসে সেটি হলো আপনাকে আগে “না” বলতে হবে। তারপর পাত্রী খোঁজা শুরু করব। অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি আপনাকে না বলবার, কিন্তু কেন যেন পারছি না। সেদিন আপনার অফিসে আপনাকে সরাসরি না বলতেই গিয়েছিলাম। এক “না” বাদে বাকি সব’ই বলে এলাম। শুধু “না” বলা হলো না। বাড়ি যাবার সময়ও বগুড়ার বাসে আচমকা মনে হলো আমার পাশের সিটে আপনি এসে বসবেন। আমি যুক্তিহীন অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার ফলাফল হিসেবে পেন্সিলের মত সরু এক ছেলে এসে আমার পাশে বসল। আমি শুধু শুধু হতাশ হলাম। বাড়ি গেলাম এবং অস্থির হয়ে খুব দ্রুত ঢাকায় ফিরে এলাম। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি তো? আমার আবার সময় খানিক বেশি’ই লাগে। আপনার তো জানার কথা। এখন আমি আপনার জীবনসঙ্গী হওয়ার চাকুরিটা নিতে চাই। আশা করি, পদটা এখনও খালি আছে।
আপনার একান্ত বাধ্যগত,
— গোলাম কিবরিয়া।

অরুণিমা মামণি, এভাবেই তোমার মা আমার জীবনে আঁধার ক্ষণে জোনাকি হয়ে এসেছিল।

সমাপ্ত।