যদি হঠাৎ ইচ্ছে হয় পর্ব-০১

0
167

#যদি_হঠাৎ_ইচ্ছে_হয়
#পর্ব_১
#Saji_Afroz

এতদিন পর সেই প্রিয় জায়গা, নিজের আপন মানুষদের দেখতে পাবে জেনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে দিশা। একটি ন্যাশনাল ভার্সিটিতে ভর্তি হলো ও। নতুন জীবন ভালোভাবে চললেও সেই স্কুল জীবন কী সহজে ভোলা যায়! দিশার বারবার মনেহয়, আবার যদি সেই দিন গুলোতে ফিরে যাওয়া যেত! মাঝেমধ্যেই ফেইসবুকে মেসেঞ্জার গ্রুপে পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা হয়। তবে বেশিরভাগরই সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন! আজ জানলো, পুর্নমিলনীর অনুষ্ঠান হতে চলেছে বিদ্যালয়ের। যা শুনে মনের মাঝে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করে ওর।
দিশা ভালো নাচতে পারে। তাই পরিচিতরা সবাই ওকে অনুষ্ঠানে নাচতে বলে। প্রথমে বিষয়টা খুব একটা গুরুত্ব ও দিলো না। কিন্তু যখন বিদ্যালয়ের প্রিয় হাবিব স্যারের ফোন ও পায়, রাজি ওকে হতেই হয়৷ ভাবতে পারেনি, এত বছর পরেও তারা মনে রেখেছেন দিশাকে! এবং ওর নাচকে। অবশ্য দিশা থাকতে নাচে প্রথম স্থান কেউ দখল করতে পারেনি।
দিশাকে মেসেঞ্জারে একটি গ্রুপে এড করা হয়৷ যেখানে অনেক সিনিয়র ও জুনিয়রেরা ছিল।
এখানে যারা অনুষ্ঠানে নাচে অংশগ্রহণ করবে তারাই ছিল। তবে হাবিব স্যারের কথায় দিশাকে নাচের পুরো দায়িত্ব নিতে হয়। কে কী গানে নাচবে, নাচ শেখানো সহ দলীয় নাচ করা সব দায়িত্বই দিশার উপরে দেওয়া হয়। দিশাও নিজের মতো করে সময় ঠিক করে নেয়। দুপুরের সময়টাকে বেছে নেয় বিদ্যালয়ে যাওয়ার। ওখানেই সবাই একত্রিত হয়ে নাচ শিখবে ঠিক করে।
এভাবে কয়েকদিন কেটে যায়। সব ভালোই যাচ্ছে। দিশা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে সব। হঠাৎ একদিন হাবিব স্যার এলেন। সাথে নিয়ে এলেন প্রাক্তন ছাত্র ফুয়াদকে। দিশাকে জানালেন, ফুয়াদ পুরো অনুষ্টানের দায়িত্বে রয়েছে। ওর সাথে আলোচনা করে সব সাজাতে। ফুয়াদের সঙ্গে পরিচিত হয় দিশা। জানতে পারে ওর সাত বছরের বড়ো ফুয়াদ। পরিচয় এর প্রথম দিনেই দিশার নাচ কতটুক আগালো জানতে চায় ফুয়াদ। যতটুক হয়েছে তা সবাইকে দেখাতে বলল দিশা। এরপর আসে ওর পালা। একটি বাংলা গানে চমৎকার ভাবে নেচে দেখায় দিশা। ও যতক্ষণ নাচছিল অপলকভাবে ওকে দেখছিল ফুয়াদ। দেখতে ভারী মিষ্টি দিশা। কোমর সমান লম্বা চুল ওর। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ওর ডান চোখের উপরের তিলটা। ফর্সা গালে সেই কালো তিলটা যেন সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে কেউ নজর ফোটা দিয়ে দিয়েছে।
ওর নাচ শেষে নিজের অজান্তেই হাত তালি দিয়ে বসে ফুয়াদ। এতক্ষণ কারো নাচে ও এমনটা করেনি দেখে বাকি সবাই কেমন করে যেন তাকালো ওর দিকে। ফুয়াদ হালকা কেশে বলল, তোমাদের ম্যাডাম উনি! তাই তালি দিলাম।

পাশ থেকে সিনথিয়া নামক এক মেয়ে বলল, আমি ওর সিনিয়র। এমন অনেক সিনিয়রও আছে। তাহলে ও কীভাবে ম্যাডাম হয়?

সিনথিয়াকে ভালোভাবে চেনে ফুয়াদ। ফুয়াদের বন্ধু সাকিবের বোন সিনথিয়া। সেও প্রাক্তন ছাত্রী। কিন্তু প্রায়শই ওদের দেখা হয়। সাকিব আর ফুয়াদের সম্পর্ক অনেক ভালো। সেই সুবাদে সিনথিয়ার সাথেও দেখা হয়ে যায়।
ফুয়াদ সিনথিয়ার কথা শুনে বলল, দুষ্টুমির ছলে বলা। তোমার নাচও বেশ ভালো হয়েছে।
-তবে তালি দেননি কেন?

এ কথার কোনো জবাব ফুয়াদ না দিয়ে তাকালো দিশার দিকে। ও হাপাচ্ছে দেখে ওকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো ফুয়াদ। দিশা পানি পান করে। ফুয়াদ বলল, একটা গানেই নাচবে?
-দলীয় গানও আছে।
-সেটা রেডি হয়েছে?
-না।
-গুড!
-গুড?
-হু। কারণ আমি ভাবছি দলীয় নাচটা আমাদের চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গানে করতে। তুমি কী বলো?
-করা যায়। আপনি গান ঠিক করে দিন।
– দু’জনে মিলে করি? সমস্যা না হলে তোমার ফেইসবুক আইডি দাও। আসলে গান আমার পছন্দ হলে যে তোমারও হবে এমন কথা নেই।

দিশার ফেইসবুক আইডি নিয়ে চলে যায় ফুয়াদ। সন্ধ্যায় দিশার সঙ্গে চ্যাট হয় ওর। দু’জনে মিলে একটি গানও ঠিক করে ফেলে।

পরেরদিন হল রুমে ফুয়াদকে দেখে অবাক হয় দিশা। কারণ হাবিব স্যার বলেছিলেন, ফুয়াদ খুব একটা সময় দিতে পারবে না। মাঝেমধ্যে এসে খবর নেবে। কিন্তু ফুয়াদ আজ আসে। এবং সারাটা সময় নাচের রুমেই কাটায়। অথচ অন্যান্য রুমে আরও অনেক কিছুরই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সবকটার প্রধান দায়িত্বে আছে ফুয়াদ। কিন্তু ওর এই রুম ছেড়ে যেতেই মন চায় না। এই রুম? নাকি দিশাকে ছেড়ে!

অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে আসে। দিশার জোরাজোরিতে ওর প্রিয় বান্ধবী রাত্রীও দলীয় নাচে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ওরা অনুষ্ঠানের দিন কী পরবে এখনো ঠিক করতে পারেনি। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে দিশা। চাইলেই হুট করে প্রিয় কিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে যায় না। অনেক কিছু বুঝতে হয় আর নিতে হয় মেনে। আজ দিশা মা এর কাছে জানায়, ওর একটি নতুন গাউন লাগবে অনুষ্ঠানে পরার জন্যে। ওকে অবাক করে দিয়ে দিলোরা খাতুন বললেন, আমি জানতাম তোর নতুন জামার প্রয়োজন হবে। তাই টাকা জোগাড় রেখেছি। আজ যাবি শপিং এ?

দিশা নরমসুরে বলল, তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না তো?
-সমস্যা হলে বলতামই। আমার মেয়ে যে সব বোঝে জানা আছে।

দিশা খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে মা কে। এদিকে দিলোরা জামান যে সেই টাকা ধার করে এনেছেন তা গোপণ রাখলেন দিশার কাছে। মেয়েটা নাচে পারদর্শী। নাচ নিয়ে কিছু করার ইচ্ছে ছিল। টাকার জন্য পারেনি। এমন একটা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ওকে দেওয়া হয়েছে। ওখানে নাচবে ও। ভালো পোশাক তো প্রয়োজন। নতুবা মনটা যে ওর খারাপ হবে।

এভাবে আরও কিছুদিন কেটে যায়। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি অনুষ্ঠানের। আরও কিছু নাচ বাকি রয়েছে। এদিকে ক্লাসে যাওয়ার সময় বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যায় দিশা। যার কারণে পা এ জখম হয় ওর। যদিও পা ভাঙেনি। কিন্তু ওকে বাসায় এক সপ্তাহ আরাম করতে বলে ডাক্তার। একথা ফুয়াদ শুনে অস্থির হয়ে পড়ে। দিশাকে দেখতে আসতে চাইলে নিষেধ করে ও। দু’জনেই চিন্তিত হয়ে পড়ে পা নিয়ে। আদৌ অনুষ্ঠানে নাচতে পারবে তো দিশা!

তিনদিন কেটে যায়। ফুয়াদ পড়ে যায় চিন্তায়। দিশা আসতে পারছে না। নাচ বাকি রয়েছে। আর ওদিকে ফ্যাশন শো এর একদিনও অনুশীলন করা হয়নি। কারণ মডেল ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনি। মডেল রাদিন। এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। ফুয়াদের পরের ব্যাচের ও। মডেলিং এর জন্য এখন ভালো নামডাক আছে ওর। তাছাড়া বিত্তশালী পরিবারের ছেলে ও। এই অনুষ্ঠানের জন্য এক লাখ টাকাও ও দিয়েছে। কিন্তু সময়টা দেবে বলেও দিতে পারছে না। বিষয়টা দিশাকে বলতেই ওর মন খারাপ হয়। ঠিক করে এই পা নিয়েই বিদ্যালয়ে যাবে। ও নড়তে না পারলে কী হবে! বসে দেখিয়ে তো দিতে পারবে! এই ভেবে বান্ধবী রাত্রীর সঙ্গে রিকশায় চড়ে বিদ্যালয়ে চলে আসে দিশা। ওকে দূর থেকে দেখে ছুটে আসে ফুয়াদ। দিশার পা এ এখনো ব্যাণ্ডেজ৷ যা দেখে ফুয়াদের মনটা খারাপ হয়। ও বলল, তুমি এই অবস্থায় কেন আসতে গেলে?
-আমার উপর একটা দায়িত্ব আছে তা কীভাবে ভুলি বলুন? সময় বেশি নেই। নাচের বাকিও বেশি নেই। আপনি চিন্তা করবেন না।

দিশাকে রিকশা থেকে নামতে সাহায্য করে ফুয়াদ। ও না করার পরেও রিকশা ভাড়া দেয় ফুয়াদ। এরপর ওকে নিয়ে নাচের রুমে চলে আসে। পাশের রুমে গানের শব্দ শুনে দিশা বলল, পাশে কিসের শব্দ?
-ফ্যাশন শো এর প্রাকটিস হচ্ছে। করবে নাকি?
-আরে না! এই ভাঙা পা নিয়ে আবার ফ্যাশন শো!

দিশা ওর কাজ করতে থাকে। ওর সঙ্গে পুরোটা সময় ধরে থাকে ফুয়াদ। হঠাৎ ফুয়াদকে অন্যদিকে যেতে হয়। দিশার কাজও আজকের মতো শেষ হয়। পা এ প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে ও। তাই বাসায় ফিরতে চায়। রাত্রী ওকে নিয়ে বেরুতে যাবে ঠিক তখনি পাশের রুমে এসে থেমে যায়। দিশা বলল, কী হলো?
-চল না একটু ফ্যাশন শো দেখি?
-রাত্রী! আমার পা ব্যথা করছে।
-তুই দাঁড়া। আমিই দেখে আসি।

এই বলে রাত্রী সেই রুমে প্রবেশ করে। খানিকবাদে দিশা রুমের জানালার ধারে আসে রাত্রী কোথায় দেখতে থাকে। ঠিক তখনি ওর চোখাচোখি হয় মডেল রাদিনের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলে ও। এদিকে ও দাঁড়াতেও পারছে না। তাই কোনোমতে বারান্দায় থাকা একটি বেঞ্চে ও বসে পড়ে। হঠাৎ কারো কণ্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় ও।
-আপনি ফ্যাশন শো তে থাকছেন?

রাদিনকে দেখে একটু অবাক হয় ও। ভাবলো, হয়তো ওকে ঘুরঘুর করতে দেখে এই কথা বলছে রাদিন। দিশা বলল, নাহ।
-কেন?
-আমি পারি না ওসব।
-ইচ্ছে হলে আসতে পারেন। এটা কোনো প্রতিযোগিতা নয়। সবাই মিলে মজা করা। এই!
-জানি। কিন্তু এই ফ্যাশন শো আমাকে দিয়ে হবে না। আমি তো মাঝপথেই হেসে দেব । তাছাড়া দেখুন! আমার পা এ ব্যথা।
-কী হলো?

উত্তর দেওয়ার সময় কেউ একজন এসে তাড়া দেয় রাদিনকে। ও দু:খিত জানিয়ে চলে যায় ছেলেটির সঙ্গে। এদিকে রাত্রী ছুটে এসে বলল, রাদিন তোর সঙ্গে কথা বলেছে?
-হু। কেন?
-ও মাই আল্লাহ! আমি তো পাগলই হয়ে যেতাম আমার সাথে বললে। সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম। পাত্তাই দিলো না আমাকে। সবই তোর কপাল।
-ধুর! কথা বলার সাথে কপালের কী সম্পর্ক?
-এত সুন্দর হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। তোর কোনো অনুভূতি হচ্ছে না?
-হচ্ছে। আমার পা টা শেষ হয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। যাবি বাসায় এখন?

ফুয়াদ এদিকে যাচ্ছিলো। দিশার কথা শুনে থেমে যায় ও। পাশে এসে বলল, তোমার বাসায় ভালো জায়গা আছে? যে কয়েকজনের নাচ বাকি আছে ওদের পাঠিয়ে দিই কাল? আর এসো না। পা এর ব্যথা না সারলে অনুষ্ঠানের দিন নাচবে কীভাবে?
-সেই ভালো। প্লিজ পাঠিয়ে দেবেন।
-ফাইন। এখন চলো। বাড়ি পৌঁছে দিই।
-তার প্রয়োজন নেই।
-তবে চুপচাপ বসো। আমি সি.এন.জি ঠিক করে আনি।

এই বলে ফুয়াদ চলে যায় রাস্তার দিকে।
দূর থেকে এসব দেখে সিনথিয়ার রাগ হয়। দিশার প্রতি ফুয়াদের এই দূর্বলতা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ফুয়াদ কী বোঝে না, সেই কবে থেকে ওকে পছন্দ করে সিনথিয়া!

#চলবে