রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০৯

0
501

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_৯
#M_Sonali

বিকেল ৪.১০ মিনিট
ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে একমনে বেল গাছে থাকা পাখি দুটির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। চারিদিকের পরিবেশটা অসম্ভব সুন্দর, নিরব নিস্তব্ধ। সবকিছুই যেন ভীষণ মনমুগ্ধকর। কিন্তু তবুও আমার মনটা ভীষণ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। বারবার মনের মাঝে এক অজানা শূন্যতা অনুভব করছি। ভীষণভাবে মন চাইছে মীরকে কাছে পেতে। ওর সাথে একটু গল্প করতে। মনের সকল কথা তার কাছে খুলে বলতে। তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে প্রকৃতির সুন্দর নিরাবতা অনুভব করতে। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। তাইতো আজ মীরের সাথে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও একা একাই দাঁড়িয়ে থেকে এসব অনুভব করতে হচ্ছে আমাকে। দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর সবাই যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র আমি একাই ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছি। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। আমার জীবনে কি কখনো সেদিন আসবে না, যখন মীর আমার সাথে থাকবে! আমাকে ভালোবাসবে। ওর সাথে আমি মন খুলে গল্প করতে পারব!

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আমার। এ কষ্ট যে কাউকে দেখানোর মত নয়। বুঝিয়ে বলার মতও নয়। এ কান্না নীরব কান্না। যার কোন শব্দ নেই, শুধু বুকটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

হঠাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নিলাম আমি। তারপর মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে পেছন দিকে ঘুরে দাড়াতেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার পিছনে মীর দাঁড়িয়ে আছে। যার মুখে মিষ্টি হাসি। ওকে এভাবে হাসি দিতে যেন প্রথম দেখছি আমি। ওকে যতবারই দেখেছি সব সময় গম্ভীর মুখে দেখেছি। তাই ওর হাসি মুখটা দেখাতেই যেনো মনের মাঝে এক ভাললাগার শীতলতা বয়ে গেলো। আমি এক নজরে সব ভুলে বেহায়ার মত তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সেও একি ভাবে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কিছু একটা ভেবে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে ছাদের রেলিং ধরে পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

–“সবাইতো যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাহলে তুমি এখানে কেন?”

উনার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেল গাছের পাখির বাসার দিকে ইশারা করে বললাম,

–“ওই পাখির বাসাটাকে দেখছিলাম। আসলে বাসায় আমার রুমের জানালার কাছেও একটি আম গাছ আছে। ওই গাছেও ঠিক এরকম দেখতে দুটি পাখির বাসা ছিল। আমি অনেক সময়ই পাখিটাকে মন ভরে দেখতাম। কেনো জানিনা তাদের দেখলে মনের মাঝে এক আলাদা ভাললাগা কাজ করতো আমার। খুবই ভাল লাগত পাখিদের জোড়া দেখে।”

আমার কথা শুনে সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলে উঠল,

–” আসলে পাখি আল্লাহর একটা অপরুপ সৃষ্টির নিদর্শন। যা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আর এই পাখি দুটি ও সবসময় একসাথে থাকে। কখনো আলাদা হয় না। আমি প্রায় কয়েক মাস হলো পাখি দুটি কে এই বেল গাছের উপর দেখি। মাঝে মাঝে আমিও এভাবে ছাদে এসে পাখিদেরকে দেখে মনে মনে ভাবি আল্লাহর নিয়ামত গুলোর কথা। কিন্তু ভাবতে পারিনি আজকে তুমিও এভাবে পাখিদের দেখবে। ”

এতটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলো মীর। তারপর আবার বললো,

–“সে যাই হোক, এখন বলো সারাদিন নামাজ পড়েছো সময় মত?”

ওনার মুখে নামাজের কথা শুনে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। কারণ ফজরে উঠে ওনার কথা মত নামাজ পড়ার পর, সারাদিন আর নামাজ পড়া হয়নি। তাই কি বলব বুঝতে পারছি না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বুঝে গেলেন। তাই হাসি মুখটাকে গম্ভীর করে ফেলে রাগী গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,

–” যদি নামাজ পড়তে না পারো, তাহলে আমার রুমে থাকার দরকার নেই। এ বাসায় রুমের অভাব নেই। যেকোনো একটা রুমে থাকো। কারণ বেনামাজিকে আমি নিজের ঘরে প্রবেশ করতে দেব না।”

কথাগুলো বলে উনি সেখান থেকে সরে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। তখনই আমি পেছন থেকে গিয়ে ওনাকে ডাক দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলাম,

–” প্লিজ মীর আমাকে ক্ষমা করে দিন। আসলে বাবার বাসায় থাকতে কখনোই নামাজ পড়া হয়নি। সবসময় নামাজে ভিষন অলসতা ছিল আমার। তাই আজকেও ফজরে পড়ার পর সারা দিন আর পড়িনি। কিন্তু আপনি যে এভাবে রাগ করবেন সেটা বুঝতে পারিনি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময় মত আদায় করবো। তবুও আপনি এমন কথা বলবেন না। আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারব না মীর। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

আমার কথা শুনে সেখানেই থেমে গেলেন উনি। তারপর হাতের মুঠ শক্ত করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন,

–” দেখো আব্রু, নামাজটা আমার কথা মতো নয়। বরং আল্লাহর ভয়ে আদায় করতে হবে। তুমি যদি শুধু আমাকে ভালোবাসো বলে বা আমি বলছি বলে নামাজ পড়ো! তাহলে সে নামাজের কোন মূল্য নেই। নামাজটা অবশ্যই আল্লাহর ভয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হতে হবে। যেটা আমি তোমার কাছ থেকে আশা করি। তোমার স্বামী হিসেবে তোমাকে এসব বলা আমার দায়িত্ব। তাই তোমাকে বলছি। তুমি সারাজীবন যে ভুলগুলো করেছ, সেটা এখন শুধরানোর সময় এসেছে। তুমি শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ’ই নয়, তার সাথে জীবনে যত নামাজ কাজা করেছো সেটাও ধীরে ধীরে আদায় করবে। আর এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে নিচে নেমে এসো। তোমার সাথে এত কথা বলার সময় নেই আমার। আমাকে আবারো যেতে হবে।”

–“এইমাত্রই তো এলেন, এখনই আবার কোথায় যাবেন মীর? সারাদিন আমি আপনাকে প্রচুর মিস করেছি। আমাদের তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে। তাহলে আপনি এভাবে কেন আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মীর?”

আমার কথার উত্তরে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

–” সেটার কারণ তুমি অলরেডি জানো আব্রু। তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন জীবন বেছে নিয়েছো। এখানে আমার করার কিছুই নেই। তাই যেভাবে থাকছো সেভাবেই থাকতে শেখো। এতেই তোমার মঙ্গল।”

কথাগুলো বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হড়হড় করে ছাদে থেকে নেমে গেলেন তিনি। আমি আর কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তারপর ছাদে থেকে নিচে নেমে এলাম।

———————–

বিছানায় পাশাপাশি বসে একি মগে কফি খাচ্ছে হায়া এবং সায়েম। দুজনের মাঝে টুকিটাকি কথা হচ্ছে খুনশুটি হচ্ছে। সাথে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। একটু পর পর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমিও করছে। একেই তো বলে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা। দুজনকে দেখে যেন মনে হয় না যে এদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দেখে যেন মনে হয় এরা লাভ ম্যারেজ করেছে। দুজনের মাঝে এত ভালোবাসার ঘনঘটা, যে কেউ দেখলে হয়তো তার হিংসে হবে। বেশ অনেকক্ষণ হলো এভাবে দুজন বসে বসে খুনশুটি ভালবাসায় মেতে আছে। হঠাৎ কথা বলার এক পর্যায়ে হায়া কিছুটা শান্ত হয়ে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

–” আচ্ছা সায়েম, তোমাকে কয়েক দিন হল ভাবছি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু বলব বলব করেও বলা হয়ে উঠছে না। ভাবছি কিভাবে কথাটা বলব। তুমি’ই বা কথাটা কোন ভাবে নিবে?”

–” এভাবে কেন বলছো হায়া! আমার কাছে এমন কি কথা জিজ্ঞেস করবে যাতে তোমার এতটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। আমি তোমার স্বামী, আমার কাছে কোন সংকোচ নয়। তুমি নিঃসংকোচে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো যা জানার আছে।”

সায়ানের কথা শুনে মনে কিছুটা সাহস পেল হায়া। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,

–” ইয়ে মানে সায়েম, বলছিলাম যে এখানে আসার পর থেকেই আমি তোমাদের সবাইকে দেখছি। সাথে মীর ভাইয়াকেও দেখছি। কেন জানিনা আমি কোনভাবেই মীর ভাইয়া কে তোমাদের কারো সাথে মিলাতে পারিনা। আব্বু আম্মু তুমি, তোমরা কি সুন্দর সব সময় সব কথা নিঃসংকোচে বল। সব সময় হাসি খুশি থাকো। অথচ মীর ভাইয়া সব সময় গম্ভীর মুখে থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। কারো একসাথে বসে খায়ও না। আর তাকে এখানে আসার পর হাসতে দেখিনি বললেই চলে। ওনাকে কিছুতেই আমি তোমাদের সাথে মেলাতে পারি না। তাই জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম যে, উনি কি সত্যিই তোমার ভাই?”

হায়ার প্রশ্নে মুহূর্তেই সায়েমের মুখটা হাসি মুখ থেকে গম্ভির হয়ে গেলো। সে আধা শোয়া থেকে সোজা হয়ে বসে বেশ গম্ভির গলায় বলল,

–” ভাই হয়না মানে? এটা তুমি কেমন প্রশ্ন করছো হায়া? মীর আমার ভাই। আমার আদরের ছোট ভাই। ওকে নিয়ে এমন কথা ভাবার প্রশ্নই আসে না। হ্যাঁ ও আমাদের থেকে একটু আলাদা। একটু গম্ভীর, কথা কম বলে। তাই বলে ও আমার ভাই না, এটা তুমি ভাবলে কি ভাবে হায়া? এরকম কথা তোমার কাছ থেকে আমি আশা করিনি হায়া। তুমি কি ওকে দেবর বলে মেনে নিতে পারছ না? নাকি অন্য কিছু?”

–” না না সায়েম। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তেমন কিছু বলতে চাইনি। আসলে তোমাদের থেকে মীর ভাইয়ার আচরণ সম্পূর্ণই আলাদা। ওনার মত মানুষ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি বললেই চলে। সবদিক থেকেই উনি অনেকটাই আলাদা। তাই তোমাকে প্রশ্নটা করলাম। তুমি ভুল বুঝনা আমায় প্লিজ। আর তাছাড়া মীর ভাই এখন শুধু তোমার ভাই’ই নয়। বরং আমার ছোট বোনের বরও সে। তাই আমার ছোট বোনকে নিয়ে একটু চিন্তা হয়। আজকে সারাদিন আব্রুর মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। ওকে আমি মন খুলে হাসতে দেখিনি। মুখে আমাদের সাথে হালকা হেসে কথা বললেও মন থেকে কোন একটা কষ্ট ছিল ওর। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। হয়তো মীর ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে। বিয়ের পর দিন ছোট বোনের এভাবে মন খারাপ দেখলে আমার কেমন লাগবে বলো?”

চুপচাপ বসে থেকে মনোযোগ দিয়ে হায়ার কথাগুলো শুন ছিল সায়েম।সব কথা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছোট করে একটা নিঃশ্বাস নিলো সে। তারপর হায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠল,

–“তুমি একদম চিন্তা করো না হায়া। মীর ছেলে হিসেবে অসম্ভব ভাল একটি ছেলে। তোমার বোন কখনোই ওর কাছে অসুখী হবেনা। বরং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী যদি কেউ হয় সেটা আব্রু’ই হবে। আমি আমার ভাইকে যতটুকু চিনি, তাতে জানি ও কখনোই আব্রুর সাথে কোন রকম খারাপ আচরণ করবে না। বরং আব্রুকে সব রকম বিপদ আপদ থেকে বাঁচাতে ওর ভালোর জন্য সব সময় ওর পাশে থাকবে। কোনভাবেই ওকে একা ছেড়ে দেবে না। ওকে বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজে বুক পেতে দেবে। তবুও ওর গায়ে একটি ফুলের আচোরও পড়তে দেবেনা। তাই তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। আর হ্যাঁ, ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও। তুমি এসব নিয়ে কখনো আব্রুর সাথে কথা বলোনা। তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। একসময় দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো।”

সায়েমের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে আর কিছু বলল না হায়া। মাথা নেড়ে ওর কথায় সায় দিয়ে ওর বুকে মুখ লুকালো।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,