রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০১

0
1298

রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_১
#M_Sonali

বিয়ের ভরা অনুষ্ঠানের মাঝে ঝনঝন করে কাঁচের গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে আশেপাশের সকলে বেশ চমকে উঠে এদিকে ফিরে তাকাল।আমার হাত পা যেন ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। এর আগে হয়তো এতটা ভয় কখনই পাইনি। সামনে থাকা লোকটা যে এভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। যদিও আম্মু এবং হায়া বারবার সাবধান করেছিল আমায়। কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে সেটাই করে বসেছি যেটা করার জন্যে বার বার সাবধান করা হয়েছিলো।

আমি আব্রু। ঢাকা শহরের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি আরাফ খানের ছোট মেয়ে। আজ আমার বড় বোন হায়ার বিয়ে ছিল। ও বয়সে আমার দুই বছরের বড় হলেও আমি ওকে সব সময় নাম ধরেই সম্বোধন করি। আমরা দুই বোনের চাইতে বন্ধু হয়ে থাকি বেশি। হায়া আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আর আজকে ওর’ই বিয়ে হচ্ছে আব্বুর বন্ধু প্লাস বিজনেস পার্টনার আশরাফ চৌধুরীর বড় ছেলে সায়েম চৌধুরীর সাথে।

বিয়েতে স্বাভাবিকভাবে সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বিপত্তিটা বাজিয়েছি আমি। আশরাফ আঙ্কেলের ছোট ছেলে মীর চৌধুরী আর আমি একই কলেজে পড়াশোনা করি। উনাকে প্রথম দেখাতেই আমি ওনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। যদিও একথা শুধুমাত্র হায়া ছাড়া আর কেউই জানে না। আসলে মীর চৌধুরী বেশ অদ্ভুত একটি মানুষ। তাকে দেখতে যেমন অদ্ভুত রকমের সুন্দর তার আচরণ ও বেশ অদ্ভুত।সব সময় গোমরা মুখে থাকাটা যেন তার অভ্যাস। উনি ভিষণ গম্ভির থাকতে ও কম কথা বলতে ভালবাসেন। তবে ওনার মাঝে সবচাইতে বেশি যেটা লক্ষণীয়, সেটা হলো কলেজে সবাই জিন্স প্যান্ট সানগ্লাস পড়ে স্মার্ট ভাবে চলাফেরা করলেও। উনি সবসময় পাঞ্জাবি-পাজামা এবং মাথায় পাগড়ি অথবা টুপি পড়ে থাকেন। সাথে উনার মুখে রয়েছে ঘন চাপ দাড়ি। সারা শরীর ধবধবে ফর্সা সাথে গাঢ়ো কালো চোখ হওয়ায় উনাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। উনাকে যে কেউ দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওনার গোমরা মুখো থাকার কারণে আর ওনার সব সময় রাগী লুকে থাকার কারণে সবাই ওনাকে বেশ ভয় পায়। সবার মত আমিও তাকে ভয় পাই। তাই তো গত একবছরেও নিজের মনের কথা বলে উঠতে পারিনি। আমাদের মাঝে তেমন কথাও হয়নি কখনো।

মীর কলেজে ফার্স্ট বয় হিসেবে পরিচিত। কলেজের অনেক মেয়ে তার চেহারা এবং রেজাল্টের জন্য তার ওপর ফিদা থাকলেও কখনো তার সাথে কথা বলার মত সুযোগ পায়নি। কারণ মীর কখনোই কোন মেয়ের সাথে কথা বলে না। খুব প্রয়োজনে যদিও কথা বলে তার মুখের দিকে কখনোই তাকায় না। আর তার এই জিনিসটাই অনেক বেশি আকর্ষিত করে আমায় তার দিকে। তাই তো আজ সুযোগ পেতেই ভেবেছিলাম তার সাথে একটু কথা বলবো। সম্পর্কে তার বেয়াইন হিসাবে একটু মজাও করবো। কিন্তু সেটার পরিণতি যে এমন হবে ভাবনার বাইরে ছিল আমার।

আমি বেশ দুষ্টু প্রকৃতির। তাই আম্মু ভালো করেই জানত আমি মীরের সাথে হয়তো দুষ্টামি করে কিছু করতে পারি। যেহেতু সে, সম্পর্কে আমার বেয়াই হন। তাই আম্মু এবং হায়া আমাকে আগেই বারবার বলে রেখেছিল যাতে আমি তার সাথে কোনরকম ইয়ার্কি-ফাজলামি না করি। কেননা মীর এসব একদমই পছন্দ করে না। তবে তাদের কথা না শুনে আমি বেশি করে কাঁচা মরিচ দিয়ে করলার জুস বানিয়ে নিয়ে আসি তাকে খাওয়াবো বলে। কারণ আমি যতদূর জানি বিয়ের অনুষ্ঠানে বেয়াই বেয়াইনের এরকম একটু আকটু ইয়ার্কি ফাজলামি হয়েই থাকে। আর তাছাড়া আমাদের মত সোসাইটিতে তো এটা একদমই স্বাভাবিক। তাই আমি নিজে হাতে এমন জুস বানিয়ে নিয়ে আসি তাকে খাওয়াবো বলে। সেই সাথে তার একটু কাছাকাছিও আসা যাবে ভেবে। কিন্তু আমাকে জুস হাতে কাছে এগিয়ে আসতে দেখেই উনি অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। এতে নিজেকে বেশ ছোট মনে হচ্ছিল আমার। তাই রেগে গিয়ে আমি ওনাকে এক প্রকার জোর করে হাত ধরে আমার দিকে ঘুরিয়ে জুসটা খাওয়াতে যাই। আর তারই ফল সরুপ তিনি গ্লাসটা সবার সামনে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলে, আমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয়।

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যে, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ভয়ে কিছুক্ষন সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি সকলের নজর এখন আমার দিকে। শুকনো ঢোক গিলে ধীরে ধীরে সামনে ওনার দিকে তাকাতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার। উনি অসম্ভব হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতের মুঠো শক্ত করে। মনে হচ্ছে এখনি আমাকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে। ওনার এমন রূপ এর আগে কখনো দেখিনি আমি। আমি ভয়ে আরো কয়েক পা পিছিয়ে দাড়াই। উনি কোন কথা না বলে হনহন করে আমায় পাশ কাটিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে যান। আমি বেশ অবাক হয়ে ওনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। সামান্য বিষয়ে যে উনি আমার সাথে এমন আচরণ করবে সেটা আমার কল্পনায় ছিল না। হঠাৎ মাথায় কারো কোমল স্পর্শে ধ্যান ভাঙে আমার। সেদিকে তাকাতেই দেখি আন্টি (মীরের মা) দাঁড়িয়ে আছেন। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল গলায় বলেন,

–“মীরের আচরণে তুমি রাগ করো না মামনি। আমার ছোট ছেলেটা এমনই। ও একটু বেশিই গম্ভীর টাইপের। আর এইসব দুষ্টুমি ও একদমই পছন্দ করে না। তোমরা তো একি কলেজে পড়। এতদিনে তো ওর বিষয়ে তোমার এতটুকু জানার কথা ছিল! তাহলে তুমি এই ভুলটা করলে কি করে!”

আন্টির কথায় কী উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিনা আমি। আমি তো সত্যিই জানি, যে উনি খুব গভীর টাইপের আর এমন দুষ্টুমি একদমই পছন্দ করেন না। তারপরেও আমি সেটাই করেছি। এখন কি উত্তর দেওয়া উচিত সেটা আমার মাথায় আসছে না। আমি কিছু বলার আগে আম্মু তেড়ে এসে আমার হাত ধরে রাগী গলায় বলল,

— “আমার সাথে ভিতরে এসো আব্রু।”

তারপর আন্টির দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

— “আপনি কিছু মনে করবেন না ভাবি। আব্রুর দোষের কারণেই ওর সাথে মীর এমন করেছে। আপনি এদিকটা একটু দেখুন আমি আসছি।”

কথাগুলো বলেই আন্টিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে হন হন করে আমার রুমের দিকে যেতে লাগলো আম্মু।

রুমের মাঝে ঢুকে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো গলায় আম্মু বলে উঠলো,

–“এই নাটকটা কি না করলে চলছিলো না আব্রু? তোমার দুষ্টুমি দিন দিন বেড়েই চলেছে। তোমাকে আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম যে আজকের দিনে অন্তত এমন দুষ্টুমি করো না। তুমি ভালো করেই জানো যে মীর ছেলেটা অনেক গম্ভীর টাইপের। আর একটু অদ্ভুতও বটে। ওর সাথে এমন ইয়ার্কি না করলেও পারতে। অন্তত আজকের দিনটার জন্যে। এতগুলো মানুষের সামনে তোমার বাবার সম্মান যাক। সেটাই কি চাও তুমি? সবাই কি মনে করলো বলতো? মীর যদি গ্লাস ভাঙার বদলে তোমায় থাপ্পড় মারতো তাহলে কি হত ব্যপারটা একবার ভাবতে পারছো?”

একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থেমে গেল আম্মু। এর মাঝে আমি একটি কথাও বললাম না। একদম চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম। তবে আম্মুর শেষের কথাটা শুনে বেশ অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে। তাহলে কি মীর যখন আমায় থাপ্পড় মেরেছিল সেটা আম্মু দেখে নি! নইলে এই কথাটা কিভাবে বলল আম্মু? কিন্তু এখন থাপ্পড়ের কথাটা আম্মুকে বলা উচিত মনে করছি না। এমনিতেই গ্লাস ভেঙেছে বলে এত কথা শোনাচ্ছে। যদি জানতে পারে আমাকে গ্লাস ভাঙার সাথে থাপ্পরও মেরেছে। তাহলে না জানি আরো কত কি বলবে। তাই সবকিছু চুপচাপ হজম করে নিলাম। আম্মু আরো বেশ কিছুক্ষন আমাকে শাসিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ওদিকে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। একটু পরেই হয়তো হায়ার বিদায়ের পালা।

কথাটা ভাবতেই বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা অনুভব হল আমার। আজ হায়া অন্য বাসায় চলে যাবে। তাহলে আমি কার সাথে নিজের মনের সব কথা শেয়ার করব! কেন যে বোনেরা এভাবে পর হয়ে অন্য মানুষের ঘরে চলে যায়! কথাটা ভাবতেই দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে বিয়ের আসরে পৌঁছে গেলাম আমি। সেখানে গিয়ে দেখলাম যেটা ভেবেছিলাম সেটাই হচ্ছে। হায়াকে এখন উঠিয়ে দেওয়া হবে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে। একটু পরেই হয়তো চলে যাবে আমাকে ছেড়ে। হায়া আমায় দেখতেই সবাইকে ছেড়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কান্না করতে করতে বলল,

–“আমি চলে যাচ্ছি রে আব্রু। আর তোর সাথে ঝগড়া করা হবেনা। অনেক বেশি মিস করব আমি তোকে। তুই কিন্তু একদম আমায় ভুলে যাবি না। আমি আবার ফিরে আসবো তোর কাছে। অনেক ভালোবাসি তোকে আব্রু। আমার যে তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। ”

হায়ার এমন কথা শুনে আমি ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করতে লাগলাম। সত্যিই আজকে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে ওকে বিদায় দিতে। যার সাথে সবসময় ঝগড়া লেগে থাকতো, তাকে বিদায় দিতে যে এতটা কষ্ট হবে সেটা জানা ছিলনা। বোনদের সম্পর্কগুলো হয়তো এমনই হয়।

—————

গাড়ির মধ্যে বসে রাগে থর থর করে কাঁপছে মীর। ওর চোখ মুখ একদম লাল টকটকে হয়ে গেছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসম্ভব রেগে আছে। পাশ থেকে হঠাৎ মায়ের কোমল কন্ঠ শুনে তার দিকে ফিরে তাকায় সে।

–“কি হয়েছে মীর, তুমি এত রেগে আছো কেন?”

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

— “আমি কেন রেগে আছি সেটা কি তুমি বুঝতে পারো নি আম্মু? তুমি দেখনি ওই মেয়েটা কিভাবে আমার সাথে ইয়ার্কি করতে এসেছিল! ও কি জানে না আমি এসব একদম পছন্দ করি না। ওর সাহস হয় কি করে আমার হাত ধরার?”

–“শান্ত হও মীর। তোমার এত রেগে থাকা ঠিক নয়। নিজের রাগের উপর কন্ট্রোল করতে শেখো।”

–” কিভাবে কন্ট্রোল করব আম্মু? তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কোন মেয়ের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। তাদের মুখের দিকেও ফিরে তাকাই না। আর সেটার কারণও তুমি ভালো করে জানো। কিন্তু এই মেয়েটার সাহস হয় কি করে আমার সাথে জোর করে কথা বলতে চাওয়ার? এমনকি আমার হাত ধরার স্পর্ধা দেখানোর! আমার তো ইচ্ছে করছিল যে হাত দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করেছে, ওর সেই হাতটা ভেঙে ওর অন্য হাতে ধরিয়ে দিই।”

কথাগুলো বলে রাগে থর থর করে কাপতে লাগল মীর। ওর আম্মু বুঝতে পারল তার ছেলে ভীষণ রেগে আছে। তাই মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

–” দেখো মীর, তুমি আর আব্রু এখন সম্পর্কে বেয়াই বেয়াইন হও। আর বেয়াই বেয়াইন দের মাঝে এমন একটু একটু মজা হয়েই থাকে সব সময়। কিন্তু তুমি তাই বলে এমন রিঅ্যাক্ট করবে? এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মেয়েটা সকলের সামনে কতটা অপমান হয়েছে একবারও ভেবেছো? তোমার এমনটা করা একদমই উচিত হয়নি। অন্তত আজকের দিনটা সহ্য করে নিতে পারতে! একবার মেয়েটার কথা চিন্তা করে দেখো। এতগুলো মানুষের সামনে তুমি ওর হাত থেকে শরবতের গ্লাস টা নিয়ে ভেঙে ফেললে। এতে ওর কতটা অপমান হয়েছে ভাবতে পারছ? তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি আমি মীর।”

মায়ের কথাগুলো চুপ করে মনোযোগ দিয়ে শুনে কোন উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে সামনের দিকে চলে গেল মীর। ওর মা চুপ করে বসে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কারণ সে ভালোভাবেই জানে তার ছেলের রাগ সম্পর্কে। তার রাগ কমানোর সাধ্য যে কারোর’ই নেই এটা তার অজানা নয়। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু মনে মনে দোয়া করল যেন ছেলের রাগটা একটু কন্ট্রোল এ আসে। আর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,