রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০২

0
851

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_২
#M_Sonali

ফুলে ফুলে সজ্জিত অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো গোছানো বাসর ঘরে এক হাত ঘুমটা টেনে বসে আছে হায়া। আর অপেক্ষা করছে তার নব্য বিয়ে করা স্বামী সায়েমের জন্য। একটু আগেই ওকে বাসর ঘরে বসিয়ে রেখে যাওয়া হয়েছে। বিয়ে হয়ে এ বাসায় নিয়ে আসার পর প্রায় সবার সাথে ভালভাবে পরিচয় হয়েছে হায়া। তবে একটা জিনিস ভীষণভাবে অবাক করেছে তাকে। সেটা হল “মীর”। কারন এ বাসায় আসার পর আশরাফ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী, মানে সায়েমের মা সহ সবাই ভীষণ ভালো আচরণ ও আপ্যায়ন করেছে তাকে। শুধু একমাত্র মীর’ই ছিল যে চুপচাপ সোফার উপর বসে থেকে বই পড়ছিল। একটিবারের জন্য ফিরেও তাকায় নি বড় ভাইয়ের বউয়ের দিকে। একটা কথা বলারও প্রয়োজন মনে করেনি সে। কেমন অদ্ভুত লাগছিল তাকে। আশেপাশে বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝেও সে একদম নিরব ছিলো। যেনো কিছুই হয়নি। মীরকে দেখে মনে মনে ভীষণ অবাক হলেও মুখে কিছু বলে উঠতে পারেনি হায়া। নতুন বউ বলে কথা, এখনই কিছু বলা একদমই উচিত হবে না তার।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে হায়ার। সায়েমকে রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে দেখে। মাথার ঘুমটা টা আর একটু সামনের দিকে টেনে নেয় সে। তারপর যতটা সম্ভব জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে থাকে। বিয়ের আগে সায়েমের সাথে দুই একবার দেখা হলেও সেভাবে পরিচয় বা খুঁটিয়ে দেখা হয়নি তাকে। তাই মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন এবং চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে হায়ার। সে জানেনা লোকটা কেমন হবে! একটি মেয়ে তার নিজের স্বামী হিসেবে যেমন পুরুষ চায় তেমন হবে কিনা? প্রতিটা মেয়েই নিজের বিয়ে নিয়ে এবং স্বামীকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নকি সায়েম কে দিয়ে পূর্ণ হবে? এসব ভাবনায় বিভোর যখন হায়া, তখনই ওর পাশে বসে হালকা গলা খাকারি দিয়ে বলে ওঠে সায়েম,

–” যত বড় ঘোমটা টেনে বসে আছো তাতে তো মনে হচ্ছে আমাকে নিজের নতুন বউ এর মুখ না দেখেই থাকতে হবে। বলি সারারাত কি এভাবেই বসে থাকবে নাকি?”

হঠাৎ সায়েমের এমন কথা শুনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় হায়া। কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সে। বুঝতে পারছে না সায়েম ওর সাথে দুষ্টামি করছে, নাকি সিরিয়াসলি কথাটা বলছে। হায়া মনে মনে বির বির করে বলে, “কেন উনি কি ঘুমটা টা উঠিয়ে দেখতে পারে না আমায়?” কথাটা মনে মনে বলার সাথে সাথে সায়েম আচমকা এক টান দিয়ে ঘোমটা টা খুলে ফেলে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে মুচকি হেসে বলে ওঠে,

–“মাশাআল্লাহ আমার বউটা দেখি অনেক সুন্দরী।”

আচমকা সায়েমের এমন কান্ডে বেশ চমকে ওঠে হায়া। বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকায় সে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে সায়েম দুষ্টু হেসে ওর মুখের কাছে মুখ এনে চোখ টিপ মেরে বলে,

— “কি বেপার আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমার বুঝি লজ্জা করে না! আমি জানি শেরওয়ানীতে আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, তাই বলে এভাবে আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে? তোমার মতলব টা কি বলো তো?”

ওর কথায় ভীষন লজ্জা এবং অস্বস্তিতে পড়ে যায় হায়া। কি বলবে বা করবে কিছুই যেন মাথায় আসছে না তার। লজ্জায় তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে হাত দিয়ে নিজের শাড়িটা খামছে ধরে সে। কি বলবে কিছুই মাথায় আসছে না। সায়েম যে ওকে এভাবে লজ্জায় ফেলবে সেটা কল্পনায়ও ছিল না তার। ওকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে সায়েম অট্টস্বরে হেসে উঠে। তারপর দুষ্টুমির স্বরে বলে,

–” আচ্ছা হয়েছে হয়েছে, তোমাকে আর লজ্জা পেতে হবে না। আসলে কি জানো তো, আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক দুষ্টু টাইপের ছেলে। তাই তোমার সাথে এতক্ষণ একটু দুষ্টামি করছিলাম। তুমি আবার এতটা লজ্জা পেওনা, বরং দুষ্টুমি সহ্য করার অভ্যাস করে নাও। নইলে আমার সব দুষ্টামি আজকেই মাটি হয়ে যাবে। সারাটা জীবন আমার এই দুষ্টামি তোমাকেই তো সহ্য করতে হবে, তাই না?”

সায়েমের কথা শুনে এবার মুচকি হেসে ফেলে হায়া। ওকে হাসতে দেখে সায়েম একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর ওর হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। অতঃপর পকেট থেকে একটা হিড়ের আন্টি বের করে ওর হাতে পড়িয়ে দিয়ে সেখানে আলতো করে চুমু দিয়ে শান্ত গলায় বলে ওঠে,

–“আজ থেকে আমাদের নতুন জীবনের শুরু। কিন্তু নতুন জীবন শুরু করার আগে তোমার কাছে আমার কিছু চাওয়ার আছে হায়া!”

ওর কথার উত্তরে হায়া নিরব দৃষ্টি ফেলে ওর উপর। তারপর মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। ওর সায় পেয়ে সায়েম বলতে শুরু করে,

–” আমাদের আজকে থেকে নতুন জীবন শুরু হবে।এ জীবনে সুখে-দুঃখে সারাক্ষণ আমায় তুমি তোমার সাথে পাবে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সকল দায়িত্ব আমার। তোমাকে সারাজীবন আমি নিজের বুকে ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখবো। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। এটা তোমার কাছে আমার প্রমিস। তবে তোমার কাছেও আমার কিছু চাওয়ার আছে। আমি জানি তুমি আমায় নিরাষ করবে না হায়া!”

সায়েমের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল হায়া। প্রতিটা কথা যেন মনের মাঝে এক ভালোলাগা ভালোবাসার সৃষ্টি করছিল তার। প্রত্যেকটা মেয়ে তো এমন একটি পুরুষ’ই তার জীবন সাথী হিসাবে চায়। যে কিনা, এভাবে তাকে সারাজীবন আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাশে থাকবে। তাকে ভালবাসায় বুকে আগলে রাখবে। হায়া কিছুক্ষণ সায়েমের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মৃদু গলায় বলে উঠলো,

–“বলুন আপনি আমার কাছে কি চান! কথা দিচ্ছি নিজের সাধ্যমত আমি সবকিছু করতে রাজি ইনশাআল্লাহ।”

হায়ার মুখে এমন কথা শুনে একটা তৃপ্তির হাসি দিল সায়েম। তারপর ওর আর একটু কাছে এগিয়ে এসে, ওর হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে শুরু করল,

–” আমি চাই তুমি আমার পরিবারের সকলকে নিজের পরিবার মনে করে তাদের ভালোবাসো। আমার বাবা মাকে কখনো নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি নয় বরং নিজের বাবা-মায়ের মত আপন করে নেবে। আর সবথেকে বেশি যেটা চাই তা হলো, আমার ছোট ভাই মীর, তাকে তুমি নিজের দেবর নয় বরং নিজের ভাইয়ের মত ভালবাসবে। ও একটু অন্যরকম। ভীষণ রাগী, একটু অদ্ভুত, খুব কম কথা বলে। কিন্তু বিশ্বাস করো হায়া, ও মনের দিক থেকে অনেক ভালো।ও ভীষণ ভালো একটি মানুষ। আমি আশা করি তুমি কখনোই ওকে পর মনে করে দূরে ঠেলে দেবে না। দেবর ভেবে কখনো ওর উপর কোন হিংসা করবে না। সব সময় নিজের ছোট ভাইয়ের মত আগলে রাখবে ওকে। ওর কোন আচরণে কখনো কষ্ট পেলে শাসন করবে। বা আমাকে বলবে। কিন্তু কখনও ওর ওপর মন খারাপ করে থেকে ওর জন্য বদ দোয়া করবে না।”

একনাগাড়ে এতোটুকু বলে থামলো সায়েম। হায়া এক নজরে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। সত্যিই বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, একটা মানুষ কতটা ভালো হলে তার পরিবারের কথা এভাবে ভাবতে পারে। বাসর ঘরে স্বামী স্ত্রী কত উল্টাপাল্টা গল্প করে। কিন্তু কতটা ভালো হলে একটা মানুষ তার পরিবার সম্পর্কে এভাবে নিজের স্ত্রীর কাছে বলতে পারে। নিজের ভাইকে কতটা ভালবাসলে তাকে এভাবে আগলে রাখার কথা নিজের স্ত্রীর কাছে বলে।

হায়াকে চুপ থাকতে দেখে ওকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো সায়েম,

–“কী হলো হায়া, কিছু বলছো না যে! তুমি আমার এই আব্দার গুলো রাখবে না! বলো?”

ওর প্রশ্নের উত্তরে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল হায়া। তারপর চোখ দিয়ে ইশারা করে আশ্বাস দিয়ে বললো,

–” আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন সায়েম। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি যেমন চান তেমনি হবে। আমি কখনোই ওদেরকে পর মনে করবো না। সবাইকে আপন করে নেবো। আপনি ওদেরকে যতটা ভালবাসেন, আমিও তাদেরকে ঠিক ততটাই ভালোবাসা দিব। এটা আপনার কাছে আমার প্রমিস।”

হায়ার কথায় খুশি হয়ে ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো সায়েম। সত্যিই আজ দুজন যেন ঠিক মনের মত জীবনসঙ্গী পেয়েছে। ঠিক যেমনটা কল্পনা করেছিল তারা বিয়ের আগে। আল্লাহ যেনো ওদের কপালে ঠিক তেমন জীবনসঙ্গীই লিখে রেখেছিল।

——————————–

“জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আনমনে ঐ আকাশের অর্ধ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ভীষণ একা একা লাগছে আমার। প্রতিদিন এই সময়টায় হায়ার কত শত গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পরতাম। কিন্তু আজকে রুমটা একেবারেই খালি খালি লাগছে। হায়া শশুড়বাড়িতে চলে যাওয়ায় যেন একদম একা হয়ে গেছি আমি। সত্যি বড্ড বেশি মিস করছি আমি ওকে। কিন্তু হায়াও কি আমাকে এখন এভাবে মিস করছে? ধুরু আমিওতো একটা পাগল। আজকে তো হায়ার বাসর রাত। ও কিভাবে আমাকে মিস করবে। যাই আর এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল তো আবার কলেজ আছে আমার। “কথাগুলো মনে মনে ভেবেই জানালা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

বেশ কিছুক্ষণ হলো এপাশ ওপাশ করছি কিন্তু কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না চোখে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল মীরের কথা। সামান্য কারণে ভরা বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝে কিভাবে গায়ে হাত তুললো ও আমার? কিভাবে পারলো এতটা নিষ্ঠুর হতে? আচ্ছা আমি যে ওকে ভালবাসি সেটা কি মীর জানে? গত এক বছরে তো কম চেষ্টা করি নি ওর সাথে কথা বলার জন্য। তাহলে তো ওর মুঝে যাওয়ার কথা। তাছাড়া কলেজের অনেকেই জানে যে আমি ওকে পছন্দ করি। এভাবেও তো ওর কানে কথাটা পৌঁছে যাওয়ার কথা! তাহলে কিভাবে আঘাত করলো ও আমায়? ওর কি একটুও কষ্ট হলো না আমাকে আঘাত করতে?

কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল আমার। সত্যিই ভীষণ রাগ হচ্ছে মীরের ওপর। আমি কি এমন দোষ করেছিলাম যে এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে অপমান করতে হলো আমায়? মনে মনে ঠিক করলাম কালকে সকালে কলেজে গিয়ে সামনাসামনি কথা বলব আমি ওর সাথে। এভাবে আর লুকচুরি নয়। যা হবার কালকে হবে। দরকার হলে ওর হাতের আরেকটা থাপ্পড় খাবো তবুও আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,