রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-০১

0
788

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#সূচনা_পর্ব

আমার বুবুর লাশটা যখন ফ্যানের সাথে ঝুলছিলো তখন আমার মধ্যে কি চলছিলো তা শুধু উপরওয়ালা ভালো জানতেন।আমি সেদিন কাঁদিনি।একটুও কাঁদিনি।কেন কাঁদবো?বুবু তো স্বার্থপর ছিলো।তাই তো আমার কথা আমাদের কথা না ভেবে আমাদের কষ্ট দিয়ে চলে গিয়েছিলো।ভালবেসে বিয়ে করেছিলো বুবু।অথচ সেই ভালোবাসা ফিকে পড়ে গেলো আমার বুবু সন্তান জন্ম দিতে পারবেনা কখনো এই কথাটা জানার পর।কতো অবহেলা,অত্যাচার সহ্য করেছে দিনের পর দিন।তাও বুবু কাউকে কিচ্ছুটি বলতো না।ওইযে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।কিন্তু যেদিন তার সেই ভালোবাসার মানুষটি তাকে না জানিয়ে আরেকটা বিয়ে করে আনেন।সেদিন ভীষন কষ্ট পেয়েছিলো বুবু।সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমাদের বাড়িতে আসলো।কোনকিছু না বলে কাউকে সোজা রুমে চলে গিয়েছিলো।পাক্কা দুদিন নিজেকে ঘড়বন্দি করে রাখলো।এতো বের হতে বলেছিলাম আমরা বের হলো না।অবশেষে একদিন সেই রুমের দরজা খোলা হলো।কিন্তু আমার বুবুটাকে সেদিন চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। হারিয়ে গেলো আমার বুবু।এতো খুঁজলাম আর পেলাম না।তার কয়েকদিন বাদে বুবুর ডায়রীট আমি পাই। সেখানেই এসব কিছু লিখা ছিলো। আমি সব জানতে পারি।আমার বুবু আত্মহত্যা করেনি।তাকে তো জীবত থাকতেই ওরা মেরে ফেলেছিলো।জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছিলো আমার বুবু।শুধু শরীর হতে রূহটা ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করতো একদিন সেটাও হয়ে গেলো।সেইদিন থেকে আমি পণ করলাম।কাউকে ভালোবাসবো না।কোনদিন নাহ।কাউকে বিয়েও করবো না।পড়াশোনা করবো।মা বাবাকে দেখবো।একা একা জীবনটা পাড় করে দিবো।তাও কারো সাথে নিজেকে জড়াবো না।এই দুনিয়াতে ভালোবাসাটাই তো নেই।সেখানে ভালোবাসবো কিভাবে?চারদিকে শুধু মিথ্যে অভিনয়।কেউ কারো না।ভালোবাসা মিথ্যে। আমি এসব বিশ্বাস করিনা।ভালোবাসা নাকি মানুষকে বাঁচতে শিখায় তাহলে আমার বুবুও তো ভালোবেসেছিলো তাহলে সে কেন মরে গেলো।আমার বুবু কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলো?

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো শুদ্ধতা।ভীষণ কষ্টে তার হৃদপিন্ডটা বোধহয় ফেঁটে যাবে।তাও শুদ্ধতার চোখে বিন্দু পরিমান জলের অস্থিত্ব দেখা পেলো না। সানাম কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।একটা মানুষ কতোটা কষ্ট পেলে এমন পাথর হৃদয়ের হয়ে যেতে পারে।যে অতি কষ্টেও তার চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পরে নাহ।সানাম দুটো শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠলো,
-‘ শুদ্ধতা, আমি জানি তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিলি আপুর মৃত্যুতে।কিন্তু এটাতো তুই মানস।পৃথিবীর সকল ছেলে একরকম নাহ।তুই নিজেই দেখ তোর বাবা মা আর আমার বাবা মা এতো বছর যাবত একসাথে আছেন।তাদের মধ্যে কতো ভালোবাসা।উনাদেরটা দেখেও তো তোর হৃদয়টা একটু নরম কর।’

শুদ্ধতা শক্ত কন্ঠ সরাসরি নাকচ করলো,
-‘ আমি পারবো না।কোনদিন পারবো না।আর আমি পারতেও চাই না।এসব প্রেম ভালোবাসা একটা বিষ।যেটা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।’

-‘ একটু মায়া দয়া রাখ মনে শুদ্ধতা।ভাইয়া তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে।তোর জন্যে কি না করে লোকটা। তুই ভাইয়াকে সামনে আসতে বারণ করেছিস।তাই ভাইয়া সেদিনের পর থেকে আর তোর সামনেও আসে না।’

শুদ্ধতা অগ্নি দৃষ্টিতে সানামের দিকে তাকালো।অতঃপর বলে,
-‘ এটা নিত্যন্তই তার সমস্যা।আমি হাজারবার তাকে বলেছি আমার পিছনে ঘুরতে না।তিনি কেন এখনো পরে আছেন আমার পিছনে?আমি বার বার বলছি বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।তিনি আমার কথার কোন গুরুত্বই দিচ্ছেন নাহ। আমি কোনদিন তাকে ভালোবাসতে পারবো না।বার বারে তাকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করছি আমি।আর কতো?না জানি কি করেছে আমার বাবার মাথাটাও খারাপ হয়ে গিয়েছে।তার বিরোধী দলের নেতার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠেপুঠে লেগেছেন।আমি জাস্ট আর এসব নিতে পারছি না।’

সানাম শান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়,
-‘ভাইয়ার বাবা তোর বাবার বিরোধী দলের নেতা।সেটা ঠিক।তবে রাজনীতির দিকটা তারা রাজনীতির মধ্যেই রাখেন।এটা তুইও জানিস আমিও জানি।তাদের সম্পর্ক অনেক সুন্দর।তারা একে-অপরকে অনেক সম্মান করেন।তারা দুজনেই সৎ মনের মানুষ।ভাইয়ার বাবা,মা তোকে এখনি তাদের পূত্রবধুর ন্যায় ভালোবাসেন।আর তার ভাইয়ার ভাইয়েরা তো তোকে ভাবি ভাবি ডাকতে ডাকতে শেষ হয়ে যায়। সবাই তোকে কতোটা ভালোবাসে শুদ্ধতা।’

শুদ্ধতা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে রাগটা কন্ট্রোল করলো।তারপর অনেকটা শান্ত কন্ঠে বললো,
-‘ আমি তো এসব চাই না সানাম।আমি শান্তি চাই সানাম।এসব আর সহ্য হচ্ছে না আমার।আমি একা থাকতে চাই সারাজীবন।নিজেকে আর কারো সাথে জড়াতে চাই না।তুই আর একটা আমাকে বলিস না সানাম।আমার মাথাটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে প্লিজ।আমি এখন বাড়ি যাবো।’

কথাগুলো শেষ করে শুদ্ধতা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ক্যাম্পাস হতে বেড়িয়ে গেলো।নিত্যদিন আর এসব সহ্য করার ক্ষমতা শুদ্ধতার আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে।অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা হতে ঘাড়টা পর্যন্ত ব্যাথায় টনটন করছে।শুদ্ধতা ডান সাইডের ঘাড়টা একটু ডলে নিলো।ব্যাথায় মুখশ্রীটা নীল হয়ে যাচ্ছে।এমন সময় হঠাৎ একটা ছেলের আগমন ঘটে।শুদ্ধতার ব্যাথাতুর নীল মুখশ্রীটা দেখে বলে উঠলো,
-‘ ভাবি! আপনি ঠিক আছেন? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

শুদ্ধতা নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো সামনের ছেলেটির দিকে।নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল,
-‘ আমি ঠিক আছি ঐক্য ভাইয়া।চিন্তা করবেন না!’

ঐক্য এদিকে সেদিক তাকালো।তারপর দৃষ্টি নত রেখে বলল,
-‘ ভাবি আপনি ঠিক নেই।প্লিজ আপনি আমার সাথে আসুন।আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই।’

শুদ্ধতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সে জানে ঐক্যকে এখন হাজারবার বললেও ঐক্য এখান থেকে একপাও নড়বে না।আর এর পেছনে কার হাত আছে তা শুদ্ধতা খুব ভালো করেই জানে।তাই বিনা বাক্যে ঐক্য’র কথায় রাজি হয়ে গেলো।ঐক্য শুদ্ধতাকে আগে যেতে বলে ও শুদ্ধতার পিছন পিছন হাটতে লাগলো।শুদ্ধতা গাড়ির কাছে আসতেই গাড়ির পিছনের দরজা খুলে একটা বারো বছরের ছেলে দৌড়ে এসে শুদ্ধতার কোমড় দুহাতে জড়িয়ে ধরলো।ছেলেটাকে দেখে না চাইতেও শুদ্ধতার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।কেন যেন এই ছেলেটাকে দেখে শুদ্ধতার মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায়।ছেলেটা হাসি হাসি মুখে শুদ্ধতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘ ভাবি আই মিস্ড ইউ সো মাচ।বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়াকে আমি সেই কবে থেকে বলছি তোমার সাথে একটু দেখা করাতে কিন্তু তারা কিছুতেই আমার কথা শুনে না।তাই আজ আমি জোড় করে এসে পরেছি।’

শুদ্ধতা নিচু হয়ে ছেলেটার মুখোমুখি হলো।তারপর ছেলেটার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-‘ তুমি একা একা আমাদের বাড়িতে চলে আসবে।ড্রাইভার আংকেলকে নিয়ে চলে আসবে।তবে ড্রাইভার আংকেলকে ছাড়া আসবে না। বুঝতে পেরেছো ঈশান?’

ঈশান হাসলো।ও বেশ খুশি হয়েছে শুদ্ধতার কথায়।শুদ্ধতাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
-‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

ঐক্য হাসি মুখে ঈশান আর শুদ্ধতাকে দেখছিলো।ছোট ভাইটা শুদ্ধতার জন্যে একেবারে পাগল।ঐক্য’র ধ্যান ভাংগে ফোনের আওয়াজে।ফোন ওপেন করে এসএমএস দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
-‘ ঈশান পরে কথা হবে।দেখেছিস না কি রোদ উঠেছে।ভাবি অসুস্থ হয়ে যাবে।গাড়িতে উঠে বস যেতে যেতে কথা হবে।’

ঈশান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে শুদ্ধতাকে ছেড়ে দিলো।তারপর শুদ্ধতার হাত ধরে টেনে গাড়িতে নিয়ে বসালো।সামনের সিটে ড্রাইভারকে শুদ্ধতা সালাম জানিয়ে বললো,
-‘ কেমন আছেন আংকেল?’

ড্রাইভার হাসলেন শুদ্ধতার কথায় তারপর বলেন,
-‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মামনি।তুমি কেমন আছো?’

-‘ আলহামদুলিল্লাহ! আংকেল আমিও ভালো আছি!’

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। ঈশান শুদ্ধতার হাত ধরে এখনো বসে আছে।এই ছেলেটা এতো কিউট।একেবারে শুদ্ধতার ভক্ত।শুদ্ধতা হেসে ঈশানের সাথে কথা বলতে লাগলো।এমন সময়ে ঐক্যর ফোন আসায় ঐক্য কথা বলতে লাগলো।কিন্তু কথাগুলোর ধরন শুনে শুদ্ধতার বিরক্ত এসে চেহারায় ভর করলো।কথাগুলো এমন,
-‘ হ্যা ভাইয়া।হ্যা ভাবি আমাদের সাথেই।হুম ঈশানের সাথে পিছনে বসে।ঈশান কেমন তা তো তুই ভালো করেই জানিস।হ্যা ঠিকভাবে পৌছে তোকে জানাবো।আচ্ছা চিন্তা করিস নাহ।’

শুদ্ধতা ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে রইলো।অতঃপর গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে দিলো।তার আর এসব ভালো লাগে না।একদম না।বাবার সাথে বাড়িতে গিয়ে আবারও বোঝানোর চেষ্টা করবে শুদ্ধতা।শুদ্ধতাকে চুপ করে থাকতে দেখে ঈশানও শুদ্ধতার হাত ধরে চুপচাপ বসে রইলো।সে বুঝতে পেরেছে তার ভাবির মন খারাপ এখন।সে চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে তার ভাবির মন ভালো করবে।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।