রাগে অনুরাগে পর্ব-০১

0
4897

#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০১

আম্মু সামনে থাকা সত্ত্বেও সানাফ ভাই এসে আমার গা ঘেঁষে বসলেন। রাগে আমার শরীর রি রি করতে লাগলো। তবুও চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে রেখে সহ্য করে নিলাম। আমার অবস্থা দেখে সানাফ ভাই মিটমিটিয়ে হাসছে। লোকটা এতো অসভ্য, অভদ্র। আমি চোখের ইশারায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আম্মুর সামনে এমন অসভ্যতামি না করতে।

উনি আমার ইশারা বুঝতে পেরে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘আরে দুইদিন পর তো তুই আমার বউ হবি। এখন এতো ফরমালিটি করে বসতে পারবো না।’

লোকটার অতিরিক্ত ঢংয়ে আমার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। বিয়ে করবে, বিয়ে করবে বলে মাসখানেক ধরে লাফাচ্ছে। আর আমার পরিবারও কী দেখে যে উনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে গেলেন বুঝি না। আমি দাঁত কিড়মিড় করে সেখান থেকে উঠে চলে আসলাম। তারপর সানাফ ভাই আম্মুর সাথে কী কথা বললেন তা আর জানা হয়নি।

মিস্টার ইমতিয়াজ আহমেদ সানাফ। আমার আম্মুর একমাত্র বান্ধবীর বড় ছেলে। ছোটোবেলা থেকেই উনার আসা যাওয়া রয়েছে আমাদের বাড়িতে। কে জানতো এই আসা যাওয়ার একমাত্র কারণ আমিই ছিলাম। সানাফ ভাই আমাদের এলাকার সব মেয়ের ক্রাশ। শুধু আমিই দুই চোখে দেখতে পারি না উনাকে। সুন্দর, সুদর্শন যুবক। ফর্সা গোলগাল চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখগুলো অবশ্য খেয়াল করিনি চশমার জন্য। লম্বা ন্যূনতম ছয় ফিট হবেই। এমন ছেলে মেয়েদের ক্রাশ হবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কেমন জানি উনার স্বভাব ভালো লাগে না। গায়ে পড়া লোক একটা। পাড়ার মেয়েদের গায়ে পড়ে কি না জানি না, তবে আমার গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে।

যেদিন সানাফ ভাইয়ের আম্মু আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন, সেদিনই আমি আম্মুকে না করে দিয়েছি। আম্মুর এক কথা, সানাফ ভালো ছেলে। লাখে একটা মিলে। আর ভালো চাকরিও করে। সবথেকে বড় কথা, তোকে ভীষণ ভালোবাসে। তুই সুখী হবি ওর কাছে গেলে। এসব কথা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি প্রায়। ছোটো থেকেই আব্বু-আম্মুর কথা শুনে চলি। তাই আর জোর দিয়ে না করতেও পারিনি।

আব্বু-আম্মু এতো বছর আমার জন্য যা করেছেন, সব ভালোই করেছেন। আমার আর সানাফ ভাইয়ের বিয়েটা হলেও আমি সুখী হবো, এটাও জানি। তবুও মন থেকে মেনে নিতে পারছি না বিয়েটা। আম্মু আর উনার বান্ধবী বহুকাল আগ থেকেই আমার আর সানাফ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন এটাও আমার জানা ছিলো। তখন সানাফ ভাইকে আমারও বেশ লাগতো। ক্লাস টেন অবধি সানাফ ভাইয়ের জন্য আমিও একরকম পাগল ছিলাম। ধীরে ধীরে সেটা বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে। উনি সিগারেট খেতে ভীষণ পছন্দ করেন। আর আমার সিগারেটের গন্ধটাই সহ্য হয় না।

সানাফ ভাইকে সিগারেট ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। তার প্রত্যুত্তরে সানাফ ভাই বলেছিলেন,
‘প্রয়োজনে বিয়ে করা বউ ছেড়ে দিবো, তবুও সিগারেট ছাড়তে পারবো না।’

সেদিনই উনার উপর আমার প্রথম রাগ হয়। তারপর থেকে তার প্রতিটি কাজ অসহ্যকর লাগে আমার কাছে। এই যে আজ আসলো আমাদের বাড়িতে এটাও অসহ্য লাগছে আমার। আর কিছুদিন পর আমার এইচএসসি এক্সাম। তারপরই উনার সাথে আমার বিয়ে। এখন এতো ঘনঘন এই বাড়িতে আসার কী দরকার সেটাই বুঝতে পারি না।

কিছুক্ষন পর সানাফ ভাই আমার রুমের দরজার সামনে চেঁচিয়ে ডাকলেন,
‘নিধি, এই নিধি, দিনদুপুরে দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতর কী করিস?’

আমি তাড়াতাড়ি ওড়না ঠিক করে নিয়ে চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

সাথে সাথে সানাফ রুমে ঢুকে গেলেন। আবারও ধমক দিয়ে বললেন,
‘কীরে এমন করে ঘোমটা দিয়ে আছিস কেন? তুই এতো পর্দাশীল আগে তো জানতাম না।’

এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি। কড়া গলায় বললাম,
‘না জানলে এখন জেনে নিন। আর আমার রুমে আসার কী দরকার ছিলো আপনার? চোখে লাজ-লজ্জা বলতে কিছু নেই, না?’

সানাফ ভাই আমার রাগটাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বললেন,
‘এখন ঘোমটা দিয়ে আছিস। কিন্তু রাস্তায় তো ঠিকই খোলা চুলে ছেলেদের সামনে ঘুরাঘুরি করিস। আর আমি আমার হবু বউয়ের রুমে এসেছি, এতে লাজ-লজ্জার কী আছে?’

উনার কথাগুলো শুনে আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। আপাতত রুমে আসার কথা বাদ দিয়ে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমি কবে খোলা চুলে রাস্তায় ছেলেদের সামনে ঘুরাঘুরি করেছি?’

ওই তো সেদিন তোদের বাড়ির সামনের রাস্তায় খোলা চুলে দাঁড়িয়ে অর্ণবের সাথে কথা বলিসনি তুই?’

‘তা আপনাকে বুঝি এই খবরটা আপনার গার্লফ্রেন্ড মিলি দিয়েছে?’

‘এই নিধি মুখ সামলে কথা বলবি। মিলি আমার কবেকার গার্লফ্রেন্ড হ্যাঁ?’

‘গার্লফ্রেন্ড নয় বুঝি? তাহলে উঠতে বসতে আপনার গুণগান গায় কেন সে?’

এবার সানাফ ভাই একটু ভাব নিয়ে বললেন,
‘মিলি তো একা আমার গুণগান গায় না। পাড়ার অর্ধাংশ মেয়ে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। শুধু তুই-ই চিনলি না আমাকে।’

আমি ভেংচি কেটে বললাম,
‘রাখেন তো আপনার প্রশংসা। আমার থেকে প্রশংসা পাওয়ার মতো কোনো কাজ আপনি করছেন? নির্লজ্জ পুরুষলোক একটা। বিয়ের আগেই হবু বউয়ের ঘরে এসে হানা দেয়।’

‘এই নিধি মুখ….’

সানাফ ভাই কথাটা শেষ করার আগেই আম্মু রুমে চলে আসলেন। তা দেখে সানাফ ভাইয়ের মুখ একেবারে চুপসে গেলো। দেখার মতো একটা মুখ হয়েছে। আমি অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।

আম্মু উনাকে ডেকে নিয়ে গেলেন নাস্তা খাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে অবশ্য আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বার কয়েক তাকিয়ে ছিলো। উনি যতবারই তাকিয়েছেন আমি হেসে তখন একাকার হয়ে যাচ্ছিলাম।

_______
রাতের খাবার শেষ করে সবেমাত্র রুমে পা রেখেছি এমন সময় মুঠোফোন বেজে উঠলো।
ফোনের স্ক্রিনে বড় বড় করে লিখা সানাফ ভাই।
‘ইশ, লোকটা আমায় দু’মিনিটের জন্যও শান্তি দিবে না, না-কি?’
বিড়বিড় করে বললাম।

তারপর ফোন হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলাম ধরবো কি ধরবো না? একসময় ফোনটা কেটে গেলো। আমি মোবাইল বেডে রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। জোৎস্না রাত। চারদিকে জোনাক পোকাদের ছোটাছুটি। এসব দেখতে দেখতে কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। ফোনটা এর মধ্যে কয়েকবার বেজেছে। ইচ্ছে করেই এমন অদ্ভুত ভালোলাগার ঘোর কাটিয়ে ফোন ধরতে ইচ্ছে হয়নি।

কিছুক্ষন পর আম্মুর ডাকে আমার হুশ ফিরলো।
‘সানাফ কল দিচ্ছে ধরছিস না কেন?’
আম্মুর ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে আমি কেঁপে উঠলাম।

‘ধরছি।’
কথাটা বলে রুমে এসে ফোন ধরলাম। আম্মু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে উনার রুমে চলে গেলেন। আম্মুর তাকানো দেখে মনে হলো আমি কোনো জেল ফেরত আসামী। বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলছি সানাফ ভাইয়ের ফোন না ধরে। আজব!

ফোন ধরেই আম্মুর রাগটা উনার উপর ঝেড়ে বললাম,
‘এক মুহুর্তও কী আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবেন না? এতো রাতে ফোন করার কারণ কী?’

সানাফ ভাই নরম গলায় বললেন,
‘চেঁচাচ্ছিস কেন? একটা জরুরি কথা বলার জন্য ফোন করেছি। শুনলাম, তুই না কি ফিজিক্সে গোল্লা পেয়েছিস?’

‘কে বললো আপনাকে? আমি ৭০+ মার্কস পেয়েছি। এ প্লাস মিস গেছে। এটাকে আপনি গোল্লা বলতে পারেন না।’

‘কেন তুই ৭০+ পাবি কেন? আমার বউ তুই। তোকে এ প্লাস পেতেই হবে। পাড়ার কতো মেয়ে আমার কাছে পড়ে এ প্লাস পেলো। আর তুই আমার বউ হয়ে কি না ৭০ প্লাস পেলি!’

‘বারবার আপনার বউ, আপনার বউ করছেন কেন? আমাদের তো এখনো বিয়ে হয়ে যায়নি।’

‘চুপ কর্। কাল থেকে আমি তোকে ফিজিক্স পড়াতে আসবো।’
ধমকের সুরে কথাটা বললেন।

আমি থতমত খেয়ে বললাম,
‘আপনার পড়ানো লাগবে না। আমি ব্যাচে পড়ছি রাশেদ স্যারের কাছে।’

‘কেন আমি থাকতে তুই ওই বেটার কাছে পড়বি কেন? আচ্ছা পড়ছিস পড়্। কিন্তু আমিও তোকে পড়াবো। এটাই ফাইনাল।’

কথাটা বলা মাত্রই ফোনটা টুংটাং করে কেটে গেলো।
আমার জীবনটাকে তছনছ করার জন্য উনাকে এখন আমাকে পড়াতে হবে। এমন যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না। ফোনটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল থেকে নতুন অত্যাচারের শিকার হতে হবে আবার।

(চলবে…)