রাগে অনুরাগে পর্ব-০৩

0
3324

#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৩
.

কোচিং থেকে ফেরার পথে ঘটলো বিপত্তি। অথৈ আর মিলি জোর করে নিয়ে গেলো গাঙ্গিনাপাড় রাসেল মামার ফুচকার দোকানে। আমার টনক নড়লো এগারোটা পনেরোতে। এই সময় তো সানাফ ভাই পড়াতে আসার কথা। আর আমি ফুচকা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে আছি। মিলিকে বললাম,

‘সর্বনাশ মিলি! আমাকে এক্ষুনি বাসায় ফিরতে হবে। সানাফ ভাই আসবেন।’

পাশ থেকে অথৈ টিপ্পনী কেটে বললো,
‘সানাফ ভাই বুঝি তোকে চোখে হারায় নিধি? সারাক্ষণ তোদের বাসায় আনাগোনা লেগেই থাকে উনার। আর কয়দিন পরেই তো একেবারে নিয়ে যাবে তোকে। এখন একটু ধৈর্য ধরলে কী হয়?’

অথৈয়ের সানাফ ভাইকে নিয়ে এমন কথা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। আমি সানাফ ভাইকে নিয়ে যতই খারাপ কথা বলি না কেন; উনি তো আমার নিজের মানুষ। কিন্তু অন্য কেউ তাকে নিয়ে কেন এভাবে মজা করবে? মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলাম ওর উপর।

তবে মুখে বললাম,
‘আরে না না। সানাফ ভাই তো আসবেন পড়াতে। কি রে মিলি তোদের ঐ দিন বললাম না? উনি আমায় ফিজিক্স পড়াতে আসবেন।’

মিলি আমার কথার পিঠে বলল,
‘হ্যাঁ, কিন্তু ফিজিক্স না পড়িয়ে বোধহয় কেমিস্ট্রি পড়ালে ভালো হতো। তাহলে তোদের কেমিস্ট্রিও বেশ জমে যেতো।’

কথাটা বলা মাত্রই মিলি ও অথৈ হাসাহাসি শুরু করলো। ওদের হাসি দেখে আমার মেজাজ চরমভাবে বিগড়ে যেতে লাগলো। শেষ ফুচকাটা মুখে দেওয়ার পূর্বেই অর্ণব এসে উপস্থিত হলো আমাদের মাঝখানে। আমরা চারজন। সবসময় এক সাথেই চলাফেরা করি। সেই প্রাইমারি লেভেল থেকেই আমার একসাথে আছি। কিন্তু সেদিন সানাফ ভাই অর্ণবের সাথে মিশতে নিষেধ করার পর থেকেই একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলি ওর সাথে। এই যেমন- আজ ওকে রেখেই আমরা তিন বান্ধবী ফুচকা খেতে চলে এসেছি।

অর্ণব আসার পরে আরো এক প্লেট ফুচকা অর্ডার করা হলো। আমি বললাম,
‘তোরা তাহলে থাক, আমি বাসায় যাচ্ছি।’

অর্ণব আপত্তি জানিয়ে বললো,
‘আমি আসতেই তোকে চলে যেতে হবে নিধি? তাহলে তো আমার আসাটাই উচিৎ হয়নি। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি।’

‘অর্ণব, এভাবে বলছিস কেন? আমার তাড়া আছে তাই যাচ্ছিলাম। ঠিক আছে তুই জলদি খেয়ে নে, আমি দাঁড়াচ্ছি।’

কথাটা শেষ করা মাত্রই আমার ফোন বেজে উঠলো। যা ভেবেছিলাম তাই। সানাফ ভাই ফোন দিয়েছেন। আমি রাস্তায় ওদের থেকে একটু দূরে গিয়ে ফোনটা ধরলাম। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রাগী কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

‘নিধি, তুই কোথায়? কোচিং তো আরো একঘন্টা আগে শেষ হয়েছে। কী করছিস তুই? আমি তোর জন্য প্রায় বিশ মিনিট যাবৎ অপেক্ষা করছি।’

আমি মিইয়ে যাওয়া গলায় বললাম,
‘ফুচকা খেতে এসেছি। হয়ে গেছে, এক্ষুনি ফিরছি আমি। আপনি বসুন।’

‘ওয়েট, ফুচকা খেতে গিয়েছিস মানে? কার পারমিশন নিয়েছিস? সাথে নিশ্চয়ই অর্ণব আছে? তোর বাসায় ফেরা লাগবে না, যেখানে আছিস, সেখানেই দাঁড়া। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

‘আরে…’

আজব! কলটা কেটে দিলো। আর পারমিশন নিবো মানে? আমি আগেও তো কতোবার এসেছি এখানে। কই কারো কাছ থেকে তো পারমিশন নেইনি। আর উনি এখানে আসবেন কেন? বিড়বিড় করে কথাগুলো বললাম।

সানাফ ভাই সাত মিনিটের মাথায় চলে আসলেন। এসেই ফুচকার দোকানের পাশের টং দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাকে একবার পরখ করে নিয়ে চা খাওয়াতে মন দিলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন পর, মিলি চিৎকার দিয়ে বললো,
‘নিধি, দেখ্ সানাফ ভাই এখানে! আল্লাহ, আজ তো আরো বেশি সুন্দর লাগছে। উনার উপর আমি প্রতি মিনিটে মিনিটে ক্রাশ খাই। উফফফ!’

মিলিকে সজোরে একটা চিমটি কেটে বললাম,
‘চুপ কর্। রাস্তায় এভাবে চেচাচ্ছিস কেন? ক্রাশ খাস ভালো কথা, সেটা এভাবে মাইকিং করে বলার কী আছে? সানাফ ভাই শুনে ফেললে কী হবে ভেবে দেখেছিস?’

মিলি চিমটির জায়গায় মালিশ করতে করতে জিভ কেটে বললো,
‘সরি রে, ভুল হয়ে গেছে। তাই বলে তুই এতো জোরে আমায় চিমটি কাটবি? উঃ!’

‘হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। আমি জানি, তোর মতো মুটির আমার মতো সামান্য পিঁপড়ার চিমটি খেয়ে কিচ্ছু হয়নি। এখন নাটক না করে চল বাসায় ফিরতে হবে। অর্ণবের খাওয়া হয়ে গেছে।’

‘সেটা তো সেই কখনই শেষ। তুইই তো এক ধ্যানে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস। চল্।’

মিলির সাথে কথা শেষ করে টং দোকানের দিকে তাকিয়ে আমি শকড খেলাম। সানাফ ভাই নেই। এইতো একটু আগে এখানে ছিলো। এখন কোথায় গেলো?

‘এই মিলি সানাফ ভাই কোথায় গেলো?’
টং দোকানের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলাম মিলিকে।

‘আসলেই তো। কই গেলো ব্যাটা? ইশ! আরেক দফা ক্রাশ খাওয়া মিস হয়ে গেলো।’

মিলির কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ওকে ওখানেই পুঁতে রেখে আসি। আমি মরছি আমার জ্বালায়। আর ও আছে ক্রাশ খাওয়া নিয়ে। তবে বেচারির মুখটা দেখার মতো ছিলো। ওকে আর কিছু না বলে আমি গটগট পায়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। নাহ, সানাফ ভাই এই চত্বরের আশেপাশে নেই। মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আজকের মতো হয়তো রক্ষা পেয়ে গেলাম ভেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

_________

বাসার গেইটের সামনে এসেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সানাফ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন গেইটে। আমি ধীর পায়ে তার সামনে এগিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম হয়তো উনি ধমক দিবেন। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। বরং উনি আমায় অবাক করে দিয়ে বললেন,
‘ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বস্। আমি আসছি।’
আমি আর উনাকে ঘাটলাম না। বাধ্য মেয়ের মতোন ভেতরে চলে আসলাম। প্রায় দশ মিনিট পর উনি রুমে আসলেন। নিশ্চয়ই এতোক্ষন নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন।
উনার হাতে একটা ফিজিক্স বই ছিলো। সেটা টেবিলের উপর খুব জোরে শব্দ করে রাখলেন। তারপর আমায় প্রশ্ন করলেন,

‘এতো অবাধ্য হচ্ছিস কেন?’
আমি চুপ করে রইলাম। বুঝতে পারছি, উনি আমাদের সাথে অর্ণবকে দেখেই এতো রেগে গেছেন। এমন অদ্ভুত প্রশ্নটাও সেই কারণেই করছেন। আমি এর জন্য মোটেও চমকালাম না। উনি ফের বললেন,
‘বই বের কর্। যেসব কোশ্চেন দিয়েছিলাম, সেগুলো সলভ কর্।’

আমি ভয়ে ভয়ে সব কোশ্চেন সলভ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,
‘ম্যাথ বইটা এদিকে দে তো।’

ম্যাথের নাম শুনেই আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। ম্যাথে আমি প্রচন্ড রকমের দূর্বল। আর সানাফ ভাই ম্যাথ বই চাইছেন, তার মানে নিশ্চয় উনার ভেতর অন্য কিছু চলছে। আজ নির্ঘাত আমি মার খাবো।
আমি দিচ্ছি না দেখে উনি নিজেই উঠে বুক শেলফ থেকে ম্যাথ বইটা নিলেন। তারপর দুনিয়ার সবথেকে কঠিন ম্যাথটা দিলেন আমাকে সলভ করার। আসলে ম্যাথ কঠিন না; আমার কাছেই কঠিন লাগছে।

আমাকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন,
‘এই ম্যাথটা ফিজিক্সের সাথে রিলেটেড। তাড়াতাড়ি সলভ করে দে আমায়।’

আমি বুঝতে পারছি, উনি ইচ্ছে করেই এসব করছেন। আসলে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছেন আর কি। পাঁচ, দশ, পনেরো এমন করে মিনিটগুলো অতিক্রম হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুতেই ম্যাথের সূত্রটা মাথায় আসছে না। আর সানাফ ভাইও হেল্প করছে না। উনি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে আছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর উনি মাথা তুলে তাকালেন। চশমার ফাঁকেও উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ ভয় পেলাম। উনি রেগে আছেন, সেটা খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। উনি উঠে আমার শেলফ থেকে সেদিন রেখে যাওয়া বেতটা হাতে নিলেন। বেত দেখেই ঢোক গিলতে লাগলাম আমি। মিনিট দুয়েক পর আমার হাতটা টেনে ধরে তিনবার বেত্রাঘাত করলেন। আমি হতভম্ব এমন ঘটনায়। লজ্জায়, রাগে কাঁদতেও পারলাম না। শুধু ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। উনি তা দেখেও পাষাণের মতো আমায় মারলেন। তারপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

উনি যাওয়ার পরেই আমি দরজা লক করে বাঁধ ভাঙা নদীর মতো হুঁ হুঁ করে কাঁদলাম। বুঝতে পারলাম, উনি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছেন। আর কোনোদিন উনার মুখোমুখি না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। রাগে আম্মুকেও কিছু বলিনি। জানি, আম্মু উনার সাপোর্টেই কথা বলবেন। আর এখন তো উনি অযুহাত দেখাতে পারবেন আমি পড়া না পারার জন্য মেরেছেন।

_______
কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি। বিকেলে হাতের ব্যথার জন্য হাত নাড়াতে অবধি পারছিলাম না। হাত কালো হয়ে ফুলে আছে। এদিকে মাথাও প্রচন্ড ব্যথা করছে। রুমের দরজা খুলে বের হতে গিয়ে অসাবধানবশত পড়ে যেতে নিলেই আম্মু তাড়াতাড়ি এসে আমায় ধরলেন। আমাকে ছুঁয়েই উনি কেঁপে উঠলেন। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। ব্যথার জন্যই জ্বর এসেছে। কিন্তু তবুও আম্মুকে দুপুরের কথাটা বললাম না।

রাতে আমার জ্বর জ্যামিতিক হারে বাড়তে লাগলো। বাসায় আমি আর আম্মু বাদে কেউ নেই। আম্মুর ভয় বাড়তে লাগলো। উনি আব্বুকে ফোন করলেন। আব্বু সানাফ ভাইকে ফোন করে সবটা জানালেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই সানাফ ভাই এসে উপস্থিত হয়। উনি হাঁপাচ্ছেন খুব। দেখে মনে হচ্ছে উড়ে এসেছেন। আমি উনাকে দেখা মাত্রই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সানাফ ভাই বেডের পাশে বসলেন। আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ডক্টরকে ফোন করেছেন?’

আম্মুর জবাব আমার কর্ণপাত হলো না। উনি সানাফ ভাইয়ের জন্য পানি আনতে চলে গেলেন। সানাফ ভাই হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি অন্যপাশে ফিরে আছি বিধায় সেটা দৃষ্টিগোচর হয়নি আমার।
আমার বালিশের কাছে উনি ঝুঁকে বললেন,

‘আমার কথা একটু শুনলেই পারিস। আমার রাগ তো জানিস? তাও কেন ক্ষ্যাপাস আমায়? আজ একটু বাধ্য হয়ে চললে এমনটা হতো না। তুই কখনো আমার ভালো বুঝবি না, তাই না? এটাই প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিস তো!’

উনার কথাগুলো কেমন ভেজা ভেজা শোনাচ্ছিলো। হয়তো কাঁদছেন। আমিও গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের কোণের জলটা মুছে নিলাম। আমি কিছুতেই গলবো না উনার এমন কথায়। নিধি তার সানাফ ভাইয়ের উপর খুব অভিমান করেছে আজ।
.
.
(চলবে…)