রেড রোজ পর্ব-০২

0
220

#রেড রোজ (পর্ব ২)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

১.
ইকবাল রোডের এই গলিটা বেশ নিরিবিলি। একপাশে বড় একটা মাঠ। সকালে স্কুলের বাচ্চাদের অবশ্য একটা ভীড় থাকে, ক্লাশে ঢুকে গেলেই সব চুপচাপ। আর বিকেলের পর তো সুনসান। এখানে ঢুকলেই একটা শান্তি লাগে। ঢাকা শহরে এমন নিরিবিলি এলাকা পাওয়া এখন সত্যিই দুষ্কর। গলির শেষ মাথায় যে দশতলা বিল্ডিং, তার একদম টপ ফ্লোরের বাসা থেকে হারমোনিয়ামের হালকা সুর ভেসে আসছে। একটু কান পাতলে একটা মিঠে গলায় গান শোনা যায়, কেউ খুব দরদ দিয়ে গাচ্ছে –

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না”

গানের মাঝামাঝি এই লাইনটায় এসে সাজিদের গলা ধরে আসতে চায় –
“কী করিলে বলো পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে”

হারমোনিয়ামে রিডের উপর আঙুলগুলো থেমে যায়। উদাস হয়ে সামনের কাচের শার্সি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে সাজিদ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর থেকে নতুন কেনা bushnell ব্র‍্যান্ডের বাইনোকুলার নিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। এটা খুব পাওয়ারফুল একটা বাইনোকুলার, অনেক দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যায়। সাজিদের অবশ্য খুব বেশি দূরের জিনিস দেখার দরকার হয় না। রয়ার ফ্ল্যাট একদম কাছেই। সাজিদের প্রিয় একটা কাজ, সময় পেলেই বাইনোকুলার দিয়ে রয়াকে দেখা। একটা মায়া, একটা ভালোবাসায় ডুবে গেছে। বের হবার কোনো পথ খোলা নেই। ওর বন্ধু রায়ান যখন বলেছিল বিকেলে ওর বাসায় যেয়ে ভাবিকে গান শেখাতে ও একটু বিব্রতই হয়েছিল। বলেছিল এখানে এসে শিখতে। কিন্তু ভাবি নাকি এই বয়সে গান শিখবে তাতেই লজ্জা পাচ্ছিল। রায়ানই জোর করেছে যাতে ওর অখন্ড অবসরের কিছুটা সময় ব্যস্ত থাকে।

সাজিদের স্পষ্ট মনে আছে প্রথম যেদিন রয়াকে দেখে ও থমকে তাকিয়েছিল, কী অদ্ভুত একটা বিষাদ মাখা মুখ। ফর্সা মুখটা কেমন রঙহীন, ফ্যাকাশে। প্রথম প্রথম খুব একটা কথা হতো না। ও যখন গান শেখাত কাজের মেয়েটা বসে থাকত। ধীরে ধীরে রয়া সহজ হলো। হারমোনিয়াম শেখাতে যেয়ে রিডের উপর দু’জনের আঙুল খেলা করল। রয়ার বেসুরো জীবন সাজিদের কাছে নতুন সুর খুঁজে পেল। দিন দিন কাছেই আসা হয়েছে শুধু। তাতে সাজিদেরও অনেক দিনের একাকীত্ব ঘুচেছিল, ছন্নছাড়া জীবনে নতুন করে গুছিয়ে থাকার ইচ্ছেটা দিন দিন প্রবল হয়েছে।

সাজিদ বাইনোকুলার চোখে লাগায়। অনুসন্ধিৎসু চোখ রয়াকে খুঁজে বেড়ায়। সকাল দশটা, এ সময়টায় একবার হলেও বারান্দায় দাঁড়ানোর কথা। সকালে রয়ার মুখটা না দেখলে সারাটাদিন কেমন খালি খালি লাগে। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে, খুব ইচ্ছে ছিল সকালে ফুল আর চকলেট নিয়ে যেতে। কিন্তু সেদিন বিকেলে রয়া অদ্ভুত আচরণ করল। লাল গোলাপ দেখে কেমন খ্যাপাটে হয়ে গেল। যা করেনি তাই করল, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। অথচ অন্যদিন ওকে দেখামাত্র হাত ধরে নিয়ে ভেতরে বসাত। নাহ, কিছু একটা হয়েছে রয়ার।

ভাবতে ভাবতে সাজিদ বাইনোকুলার আরও জুম করে দেখার চেষ্টা করে। রয়ার বেডরুমের পর্দা এখনও টানানো। তাহলে কি আজ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি? কি মনে হতে বাইনোকুলার দিয়ে ওদের বাসার নিচের রাস্তায় তাকাতেই রয়াকে দেখতে পায়, সাথে সাজিদ। কী সুন্দর হলুদের উপর সবুজের কাজ করা একটা শাড়ি পরেছে রয়া আজ!

ড্রাইভার গাড়ির পেছনে লাগেজ ওঠাচ্ছে। রয়া কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে? কই বলেনি তো ওকে।

একটা বিষাদ ঘিরে ধরে সাজিদকে। বাইনোকুলার জুম করে রয়ার মুখ দেখার চেষ্টা করে, বিষণ্ণ একটা মুখ। রয়া কি একবার এদিকে তাকাবে??

২.
রয়া গাড়িতে উঠার আগে একবার সামনের বিল্ডিংয়ের দিকে মাথা উঁচু করে তাকায় একটা নির্দিষ্ট জানালার দিকে। এখান থেকে ঠিক বোঝা যায় না জনালার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না। কিন্তু রয়া নিশ্চিত সাজিদ বাইনোকুলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সকালে দেখা দেয়নি ইচ্ছে করেই। সকাল থেকেই আজ ব্যস্ততা। রায়ান আজ আর পরশু ছুটি নিয়েছে। এবার স্পেশাল ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করবে। আজ ঢাকার কাছেই একটা রিসোর্টে থাকবে ওরা দু’জন। রয়া খুব অবাক হয়েছিল একথা শুনে। বিয়ের এত বছরে কখনও এমন আয়োজন করে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা হয়নি। অথচ এবার রায়ান সেই সাত তারিখ থেকে শুরু করেছে। একদম নিয়ম মেনে একেক দিন একেকটা। যেদিন হাগ ডে সেদিন অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। অনেক দিন পর একটা পুরনো ভালো লাগা ফিরে আসছিল। আর গতকাল তো ও লজ্জাই পেয়েছে, কিস ডে ছিল। অফিস থেকে ফিরে একটু পর পরই চুমু। রান্নাঘরে রান্না করছে, এমন সময় পেছন থেকে এসে ঘাড়ে চুমু। প্রথমে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল, চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর একটু পর পর চুমু, ভাবতে এখনও কেমন মুখটা লাল হয়ে উঠে রয়ার।

রায়ান গাড়ি স্টার্ট করতেই রয়া শেষ বারের মতো তাকাতেই বুক ধক করে ওঠে, জানালাটা খোলা, সাজিদের বিষণ্ণ মুখ দেখা যাচ্ছে সেখানে। বুকের ভেতর একটা কষ্ট টের পায় রয়া। এমন একটা সম্পর্কে ও জড়িয়ে পড়ল! এখন শুধুই টানাপড়েন।

গাড়িতে উঠেই রায়ান ভ্যালেন্টাইনের জন্য বাছাই করা গানগুলো ছাড়ে। প্রথমেই JVKE এর I was all alone with the love of my life গানটা বেজে ওঠে। পিয়ানোর মধুর সুরে মুহুর্তেই সব মন খারাপ যেন দূর হয়ে যায় রয়ার। মন চঞ্চল হয়ে উঠে, মাথা দোলাতে থাকে রয়া।

রায়ান ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘কি, গানটা সুন্দর না?’

রয়া স্মিত হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।

গাড়িটা শহর ছেড়ে আসতেই কেমন একটা শান্তি লাগে। চারপাশে সবুজের ছোঁয়া বাড়ছে। রয়ার কেমন একটা ঝিমুনি পাচ্ছে। ইদানীং রাতে ঘুম কম হয়, কেমন বুক ধড়ফড় করে সারা রাত। ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না,
একটা অজানা আতংক সবসময় কুড়ে কুড়ে খায়৷ মনে হয় কোনো এক লুকিয়ে থাকা আততায়ী ওকে মেরে ফেলার জন্য সুযোগ খুঁজছে। রাত হলেই ভয়টা আরও বেশি করে চেপে ধরে।

রয়া চোখ বন্ধ করে। এখন একটা নতুন গান বাজছে –

I crashed my car right into a tree
.. then left me to bleed
..So last Valentines, you spent it away

রয়া চোখ বন্ধ করেই ভ্রু কুঁচকায়, এটা কেমন গান! হঠাৎ করেই মনে হয় এটা PinkPantheress এর গান। একসময় খুব শুনত, কিন্তু এখন গানটা ভালো লাগছে না, কেমন কেমন লাগছে যেন।

ঠিক এই সময় মোবাইলে মেসেজ আসতেই রয়া চোখ মেলে তাকায় একবার, তারপর সোজা হয়ে বসে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে খুলতেই স্থির হয়ে যায়, সেই অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেসেজ খোলে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে লেখাগুলোর দিকে –

‘enjoy your last valentine with a murderer’

রয়ার নিঃশ্বাস আটকে আসছে, হাত পা কেমন অবশ অবশ লাগছে। কেন জানি PinkPantheress এর last valentine গানটা ওকে গ্রাস করে এখন। রায়ান কি ইচ্ছে করেই আজ এমন নির্জর রাস্তায় নিয়ে এসেছে ওকে মেরে ফেলার জন্য? রায়ানই কি সেই খুনি? ওকে বাঁচাতেই কি কেউ ওকে বার বার মেসেজ করছে?

যে রায়ান বিয়ের এত বছরে ভ্যালেন্টাইন ডেতে ওকে কোনোদিন বাইরে নিয়ে যায়নি, সেই রায়ান অফিস থেকে দু’দিন ছুটি নিল! নাহ, ভীষণ গোলমেলে ঠেকছে সবকিছুতে। রাতের বুক ধড়ফড় আবার ফিরে আসছে।

রয়া হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠে, ‘রায়ান, এখুনি গাড়ি থামাও।’

রায়ান গানের তালে তালে মাথা নাড়ছিল, রয়ার চিৎকারে হঠাৎ স্টিয়ারিংয়ে ধরা হাত নড়ে যায়, গাড়িটা বিপদজনকভাবে রাস্তার একপাশ থেকে আরেকপাশে চলে যায়। রায়ান দ্রুত স্টিয়ারিং ঘোরায়, ভাগ্যিস উলটো পাশ থেকে কোনো গাড়ি আসছিল না। গাড়িটা বাম পাশের লেনে নিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে অবাক গলায় বলে, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? এমন করে কেউ চেচিয়ে গাড়ি থামাতে বলে?’

ততক্ষণে গাড়ির গতি অনেকখানিই কমে এসেছে। রয়া চোখমুখ শক্ত করে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগিদের মতো বলে, ‘গাড়ি থামাও এখুনি, না হলে আমি চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দেব।’

রায়ান জোরে ব্রেক কষে, মাথা প্রায় ঠুকে যায়। রয়াকে এখন কেমন অচেনা মানুষ মনে হচ্ছে। গাড়িটা থামতেই অস্থিরভাবে সিটবেল্ট খুলে, তারপর হ্যাঁচকা টানে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ে।

রায়ান স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে দেখে রয়া কেমন উদভ্রান্তের মতো মূল রাস্তা দিয়ে দৌড়ুচ্ছে, যেকোনো সময় একটা এক্সিডেন্ট হবে। রায়ানের বুক চলকে উঠে, দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ও নেমে পড়ে।

রায়ান দৌড়ে ওর পিছু নেয়। হঠাৎ করেই খেয়াল করে বিপরীত দিক থেকে বিপদজনকভাবে একটা ট্রাক ছুটে আসছে। রয়ার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। যেকোনো মুহুর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রায়ান এবার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ছোটে। তারপর দৌড়ে রয়াকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে ফেলে। রয়া হাত পা ছুড়ে, জোর করে ছুটে যেতে। পরনের শাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

রয়া জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে হিসহিসিয়ে বলে, ‘তুমি খুনি, তুমি খুনি..’

কথাগুলো বলতে বলতে রয়া জ্ঞান হারায়। রায়ান কুঁজো হয়ে দুই হাতে ধরে ফেলে ওকে। তারপর কোলে তুলে নেয়। গাড়ির কাছে এসে পেছনের সিটে শুইয়ে দেয়। সিট পকেট থেকে পানির বোতল বের করে চোখেমুখে ছিটায়, গাড়ির এসি বাড়িয়ে দেয়।

একটু পরেই চোখ মেলে তাকায় রয়া। প্রথমে বুঝতে পারে না, দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আমি কোথায়?’

৩.
ফাল্গুনের সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। একটা আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। রয়া বাসার ছাদের এক কোণে একটা রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আকাশে একটা দুটো করে তারা ফুটছে।

রয়া ভাবছিল একটা বিষয়ে ও নিশ্চিত, ওকে যে লোকটা মেসেজ দেয় সে রায়ান না। কারণ সেদিন যখন গাড়িতে মেসেজ আসল সেদিন রায়ান ওর পাশে বসেই ড্রাইভ করছিল। তারমানে রায়ান ওকে মেসেজ দেয়নি। এতদিন একটা সন্দেহ ছিল রায়ান বুঝি সাজিদের সাথে ওর সম্পর্ক টের পেয়ে গেছে। তাই অমন মেসেজ দিচ্ছিল। কিন্তু সেদিনের পর ও যখন ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল তখন ও বুঝতে পারে এটা রায়ানের কাজ নয়। তাহলে কে ওকে এমন ভয় দেখাচ্ছে?

হঠাৎ করেই সাজিদের কথা মনে হয়। আচ্ছা, সাজিদ না তো? সাজিদ ওকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। বার বার চাপ দিচ্ছিল। তাহলে কি সাজিদই ওকে ভয় দেখাতে মেসেজগুলো দিচ্ছে? রায়ানকে খুনি বলে মেসেজ দিচ্ছে যাতে ও ভয়ে রায়ানকে ছেড়ে দেয়? ব্যাপারটা ভাবতেই ওর কাছে কেন জানি সত্য বলে মনে হয়। সেদিন ও যখন বের হচ্ছিল সাজিদ দেখেছিল ওকে রায়ানের সাথে বের হতে। নিশ্চয়ই ঈর্ষাকাতর হয়েই কাজটা করেছে। কিন্তু সাজিদ ওকে এত ভালোবাসে, ও এমন করবে ওর সাথে?

আর সাজিদ যদি না হয়, তাহলে কে? সেদিন মেসেজ আসার কথা রায়ানকে আর বলেনি। রায়ান বার বার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল মেসেজ এসেছে কি না। ও বলেনি। বললে যদি আবার পুলিশের কাছে চলে যায় রায়ান? সেটা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। পুলিশ ওর কল লিস্ট চেক করলেই বুঝে যাবে ও সাজিদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। তখন কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে। রায়ান যেটা জানত না, সেটাও জেনে যাবে। নাহ, এটা ও কিছুতেই হতে দেবে না।

রয়ার কেমন অস্থির লাগছে, জীবনটা কেমন জটিল হয়ে গেল। কেমন একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি। সাজিদকে আর বিশ্বাস হচ্ছে না। রায়ানকেও না, হয়ত ও সব জানে, তাই সত্যিই ওকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।

কেমন একটা হাঁসফাঁস লাগে রয়ার। ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে এখুনি, সব দুশ্চিন্তার শেষ করে দিতে।

(চলবে)